চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৪র্থ কীর্তি – বাঘনখ

Biography, Childhood, Friends, Humor, Ideas, Series, Story, বাংলা

আমরা নিজেরাই এবার বেশ ধন্দে। চার্নকদা গত তিনবারই পাঁকাল মাছের মত বেরিয়ে গেছেন আমাদের এক কথায় যাকে বলে মুগ্ধ করে দিয়ে। নাহ্ জব্দ ওনাকে করতেই হবে। আর কিভাবে ওনার মত একজন ধুরন্ধর কে বাগে পাওয়া সম্ভব এই নিয়েই জোর আলোচনা সাত নম্বর ঘরে।

অগা বলল – “বেশ বলিয়ে কইয়ে কাউকে নিয়ে আসতে হবে। খ্যাপা দা কেমন হবে?” “চলবেনা”– সিটু গম্ভীরভাবে ডিনাই করলো। “যে লোক হিটলারের গোঁফকেও ফুঁকতে ছাড়েননি তিনি এই খুচরো নেতাকে কি হাল করবেন বোঝাই যাচ্ছে। ইনি হচ্ছেন বুনো ওল “।

বুনো ওল বলতেই আমাদের মাথায় এল বাঘা তেঁতুল। বাঘার ‘বা’ আর তেতুল থেকে ‘তেল’ নিয়ে ‘বাতেল’। “পারলে একমাত্র ওই পারবে” – মিতু সম্মতি জানালো। “তাতো পারবেই; মূর্তিমান বিভীষিকা একটা। ও আর ওর কবিতার জ্বালায় মাঝে মাঝে মনে হয় হস্টেল কেন, পৃথিবীটাই ছেড়ে চলে যাই” – দিপুর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পস্ট।

বাপরে বাপ! সেবার ‘বাতেলের পাঁচালী’ বগলদাবা করে সারা কলেজ আর হস্টেল আমায় এইস্যা তাড়া করে বেড়িয়েছিলো; উফফ! আজো চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্ন দেখি” – আমিও চুপ থাকতে পারিনা।

তবে চারজনেই মোটামুটি একমত হলাম যে চার্নকদার মত বুনো ওল কে বাতেলের বাঘা তেঁতুলের দাওয়াই দিয়েই মাত করতে হবে। অতঃপর বাতেল এলো। সঙ্গে তার পাঁচালী- গোব্দা ডায়েরী গুলো। প্ল্যান হল তিনি ঘরে ঢোকার আগেই বাতেল তার পাঁচালী খুলে একের পর এক আধুনিক কাব্যবাণ, কাব্য’গান’,কাব্যকামান মায় কাব্যরকেটও চার্নকদার উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে থাকবে। আর আমরা যতটা পারি সেই ফাঁকে চার্নকদাকে কোনঠাসা করে ফেলব।

আমরা স্পেশাল নেমন্তন্ন করে আজ তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছি। বলেছি তার জন্য একটা সারপ্রাইজ থাকবে । চার্নকদাও যথাসময়ে সাত নম্বরের দরজায় আবির্ভূত হলেন।

আর ওমনি –

অভাবিত গুলিয়ান চিত্ত
ততধিক ধিক তব কর্ম
চার চেলা সমাপিত চরনে
লাজ নেই একটুও শরমও।

সুর করে গৌরচন্দ্রিকা আওড়ালো বাতেল।

সরু সরু পা দুটো কি একটু থমকে গেলো? গৌরচন্দ্রিকা শুনে বাঁকা চন্দ্রের মত ভুরু দুটো কি একটু কোঁচকালো? নাহ! আমাদের মনের ভুল বোধহয়। মুখে পেটেন্ট হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে তিনি প্রবেশ করলেন।

বাতেল এবার অন্যদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলো। আওড়ালো শায়রী-

জান্তব পেশী নাকি পাশবিক
গরিলার গরলেও লাগে ভয়,
অতিবড় গোঁফকেও ফুঁকে দেন
চালাকির আছে শেষ মনে হয়।

আমরা কি ভুল দেখলাম! চার্নকদার মুখে ওটা কিসের ছায়া? একটু কি ভয় পেলেন? যে শ্বাস টা ফেললেন সেটা কি ঘাবড়ে গিয়ে নয়? তবে মানতেই হবে নার্ভের জোর অসম্ভব। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বাতেল কবি তার শেষ পাঞ্চ ঝাড়ল

চারকোলে চিত্রিত চার্বাক
বিতর্ক ছাই হোক, পুড়ে যাক,
স্মৃতি গুলো হোকনা অমলিন
ধরা থাক …ছোট করে …ধরা থাক।
ইজেলের অভিশাপ নীল হোক
বিস্ময় বিষ হোক দুই চোখ ,
সভ্যতার পরাজয় ঘটুক না
বারণ নেই এনে দাও বাঘনখ

আমরা নিশ্চিত হলাম চার্নকদার কারিকুরি শেষ। এবারে স্বীকার করবেন সবটাই তাঁর উর্বর মস্তিষ্কজাত এবং রণে ভঙ্গ দিলেন বোধহয়।

বাঘনখ না কি একটা শুনলাম”। এই জাল থেকে বেরোবার ছিদ্র খুঁজছেন কি,? নাকি পরাজয়টা আজি হল? তাঁর গলা এতো মোলায়েম তো আগে শুনিনি।

ঠিকই শুনলেন। বাঘনখ। আধুনিক কবিতা। কাউকেই ছাড়ে না।” বাতেল চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক।

সেবারেও ছাড়েনি। জিকোর মত অতবড় ব্যক্তিও ওইভাবে হাতজোড় করে অনুরোধ করবে এটাও স্বপ্নে ভাবিনি” -চার্নকদা গলায় জোর ফিরে পান। “জিকো! ফুটবলার জিকো! কি বলছেন!” – বাতেল প্রথম হোঁচট টা খেলো। “এই অর্বাচীনটাকে তো চিনলামনা ঠিক। তোরা কিছুই শেখাসনি দেখছি। কথার মাঝে নিজের অজ্ঞতা জাহির করছে!” চার্নকদার গলায় জোর আর দিপুর মুখে হাসি একই সঙ্গে ফিরে এলো। বাতেলের মুখে মনে হল একটা মাছি ঢুকে গেলো।

যেটা বলছিলাম। ঘটনাটা বেশ পুরানো। পশ্চিমে তখন শিবুর খুব রমরমা। শিবুর দাপটে দিল্লিতে মোগলাই আসন টলোমলো।” “শিবু মানে?“- মিতু আর চুপ থাকতে পারেনা। “ছত্রপতি শিবাজী। আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিলো।” – চার্নকদা এখন টপ ফর্মে। বাতেলও দেখলাম ঘাবড়ে গেছে। “তো আফজল খাঁ বলে একটা লোককে দিল্লী থেকে পুনে পাঠানো হল শিবাজীকে দমন করার উদ্দেশ্যে। পুরো ঘটনাটাই গুপ্তচর মারফত আগেভাগেই জানতে পেরে সাবধান করলাম শিবুকে। বলতে নেই, ওইরকম মাপের একজন রাজা ‘দাদা বাঁচাও’ বলে পায়ে পড়ে গেলো। আমারও দয়ার শরীর। দিয়ে দিলুম।” একটু দম নিলেন তিনি। “কি দিয়ে দিলেন? পরামর্শ?” বাতেল মুগ্ধতা লুকাতে পারলোনা। “হুম। পরামর্শ তো দিলাম। সেই সঙ্গে পোষা বাঘের একটা থাবা থেকে পাঁচখানা নখ মানে ওই তোমার ভাষায় ‘বাঘনখ’ খুলে দিলাম। পরের ঘটনাটা তোমরা ইতিহাসে পড়েছ- শিবাজী আফজল খাঁ কে সেই বাঘনখ দিয়ে গুপ্ত হত্যা করে।” তিনি থামলেন। আমরা একদম চুপ।

বাতেলের দুচোখে যুগপৎ বিস্ময়, মুগ্ধতা। কিন্তু কয়লার ময়লা তখনও একটু বাকি ছিলো বোধহয়। বাতেল আবার প্রশ্ন করল – “কিন্তু ওই যে জিকো না কি বললেন, ওই ভদ্রলোকের ব্যাপারটা খোলসা হলোনা?

জিকো,মানে জিম করবেট তো পরবর্তী কালে রুদ্রপ্রয়াগের ওই বুড়ো বাঘটাই মেরে বিখ্যাত হবে। তাই হাতে পায়ে ধরে বলেছিলো ‘দাদা বাঘটা মারার পর লোকে যদি দেখে থাবার পাঁচটা নখ নেই, কেউ কি আমায় বাহবা দেবে?’ আমিও তাই শিবুর কাছ থেকে তিনখানা নখ চেয়ে এনে রিপ্লেস করেছিলাম।

বাতেল চার্নকদার পায়ের ধুলো নিল। শুধু বরাবরের মত সিটু বলল – “তিনটে কেন? বাকি দুটো কি হল?
আফজল খাঁর শরীর থেকে দুটো উদ্ধার করা যায়নি।জিকোর সন্মান রাখতে আমার ডানহাতের দুটো বাঘটাকে দিতে হয়েছিলো।” এই বলে তাঁর ডান হাতের সিগারেট খেয়ে কালো এবং ক্ষয়ে যাওয়া তর্জনী আর মধ্যমার নখ দুটো দেখিয়ে তিনি প্রস্থান করলেন।

 

৫ম কীর্তি – বারমুডা ->

 

লেখক পরিচিতি ~ ডঃ স্বদেশ মান্না-র জন্ম 4 April 1986, কলকাতায়। এন আর এস মেডিকাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করে বর্তমানে হলদিয়া পোর্ট হসপিটাল এবং ডায়মন্ড হারবার জেলা হসপিটাল-এ কর্মরত। জীবসেবা-র পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও প্রশংসনীয়! অশেষ ধন্যবাদ স্বদেশ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ লেখা পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গুল্পগুচ্ছ।

 

প্রচ্ছদচিত্র ~ ডঃ স্বদেশ মান্না

One thought on “চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৪র্থ কীর্তি – বাঘনখ

Comments are closed.