চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৫ম কীর্তি – বারমুডা

Biography, Childhood, Friends, Humor, Ideas, Series, Story, বাংলা

রবিবারের সকাল। ক্লাস নেই কারো। সাত নম্বরে আমরা সবাই আছি। শুধু মিতু অন্য উইক এন্ডের মত এবার ও বাড়ি গেছে। তবে মিতুর বসার জায়গাটা খালি নেই। ওখানে আজকাল বাতেল এসে বসে। বাঘ নখ এপিসোড এর পর থেকে ও এখন চার্নকদার ফ্যান। মিতু না থাকলে ও আমাদের আলোচনার বিষয় কিন্তু ও।আরো ভালোভাবে বলতে গেলে মিতুর উদ্ভট স্বভাবগুলো।

জানিস! মিতু ‘ইউজ এন্ড থ্রো’ বারমুডা ব্যবহার করে“- দিপু শুরু করলো। “বলিস কি? সেটা আবার কি বস্তু? ” – বাতেলও শুরুতেই নিজের অবস্থান জানান দেয়।

দিপু ব্যাপারটা খোলসা করতে শুরু করে – “আসলে ও একটা বারমুডা কেনার পর সেটা পরতে শুরু করে। আর ততক্ষণ অব্ধি সেটা পরে যতক্ষণ না সেটা নষ্ট হয়ে যায়।মাঝখানে কাচাকাচির কোনো ব্যাপার নেই“।

সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এক্সপায়ারি ডেট কিভাবে ঠিক করে?” অগা জানতে চায়।

যতক্ষন না অবধি ফুটো হয়ে যায় বারমুডা টা“-সিটু পাদপূরণ করে।

মূর্তিমান প্রবেশ করলেন এইসময়। কান দুটো যথারীতি খাড়া। সমবেত সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে নিজের জন্য নির্দিস্ট বেডে গিয়ে বসেন যেটার উপর দিপু আগে থেকেই বসে আছে।
আমাদের নজর গেলো তাঁর বারমুডার দিকে। পুরানো তো বটেই। শতচ্ছিন্ন বললে ও অত্যুক্তি করা হয়না। “ইশ! আপনার বারমুডা তে ফুটো।” বাতেল পুরানো ঘটনা বোধহয় ভুলে যায়।

হ্যাঁ। তাই।” তিনিও নিরুত্তাপ। বাতেলের দিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলেন বোধহয়।

সিগারেট এর আগুন লেগে বোধহয় হয়েছে।“-আমি আলটপকা মন্তব্য করি। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন তাঁর চোখের আগুনে আমায় ঝলসে দেবেন। কিন্তু মুখে স্পিক্টি নট।
গল্পের আশায় আমরা উশখুস করতে থাকি। কিন্তু তাঁর আর মর্জি কোথায় হচ্ছে! সিটু ফিসফিস করে বলল -“আজ বোধহয় গল্প রেডি নেই।মাথাও খাটিয়ে উঠতে পারেননি।” খাড়া খাড়া কান দুটো কি এক্সট্রা অ্যন্টেনা! ঠিক ক্যাচ করলেন। “ওহ তোমাদের ধারনা আমি গল্পগুলো বানিয়ে বলি?

চার্নকদা সচরাচর আমাদের ‘তুমি’ করে বলেননা। বুঝলাম আঘাতটা ঠিকঠাক জায়গায় লেগেছে। এইবার শুধু ওনার মুখ খোলার অপেক্ষা।

সেবার সব ছেড়েছুড়ে শূন্যমার্গে বিচরণের সাধনা করছি ব্যোমকাই বাবার কাছে। দুবেলা স্পেশাল জড়িবুটী খাই, আর পদ্মাসনে বসে শুন্যে ওঠার সাধনা করি। মনে হয় হবে হবে, কিন্তু কিছুতেই আর পেরে উঠি না। বাবা হাসেন আর বলেন “চালিয়ে যা বেটা।” আমিও চালিয়ে যাই। বাবা কিন্তু মাঝেমাঝেই শুন্যমার্গে ভেসে ওঠেন। আমিও হাল ছাড়ি না।। এমন সময় গোগা ডেকে পাঠালো। বেচারাকে কোথায় না কোথায় পাঠাবে সবাই মিলে। একা যেতে ভরসা পাচ্ছেনা”।

গোগা মানে“- বাতেল চুপ থাকতে পারেনা। “গ্যাগ্যারিন। ইউরি আলেক্সিয়েভিচ গ্যাগ্যারিন। বুঝলি?”

গুল!” সিটু না বলে থাকতে পারেনা। চার্নকদার কান এবারেও ক্যাচ ফস্কালোনা। বাজখাঁই গলাটা শোনা গেল – “কি বললি? গুল?” – তিনি এবারে ফর্মে ফিরলেন। “না মানে ‘ভুল'”-সিটুর ভীতসন্ত্রস্ত জবাব।-“ঠিক বলেছিস। ভুলই তো। গোগার মত একটা বাচ্চা ছেলেকে একা একা মহাকাশে পাঠিয়ে দেওয়াটা একটা ঐতিহাসিক ভুল হচ্ছিল। কিন্তু আমি তো সেটা হতে দিতে পারিনা। তাই ব্যোমকাই বাবাকে একটা প্রণাম ঠুকে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে রওয়ানা দিলাম রাশিয়ার উদ্দেশ্যে”।

গোগা এর আগে কখনো মহাকাশ ভ্রমণ করেনি।স্বভাবতই নার্ভাস। আমিই অভয় দিলাম। বললাম আমি থাকতে কোনো চিন্তা নেই। আমিও ঠিক সময়ে ভস্টকে ঢুকে পড়ব”।

তো আমি ঢুকেও গেলাম আর ‘’পোয়েখালি” বলে যাত্রা শুরু করলাম”।

কি খালি?” অগা প্রশ্ন করে।-‘’পোয়েখালি, মানে রাশিয়ান ভাষায় ‘লেটস গো’। তো ভোস্টক 1 এর গল্পটা সবাই কম বেশি জানিস তোরা। কিন্তু যেটা কেউ জানিসনা সেটা হলো ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই ভোস্টক ধাক্কা লাগে একটা কসমিক পার্টিকেল এর সাথে। যার জন্য ওর একটা দেওয়ালে একটা ফুটো হয়ে যায়, যেটা পুরো অভিযানটাকে ব্যর্থ করার জন্য যথেস্ট ছিল”।

সেটা ম্যানেজ করলেন কিভাবে?” দিপু কৌতূহলী। “এখানেই তো রাশিয়ান আর ইন্ডিয়ানের তফাৎ। উপস্থিত বুদ্ধি! স্রেফ উপস্থিত বুদ্ধি। ম্যানেজ করে দিলাম তাই দিয়ে।

ওদের কন্ট্রোল রুম অবশ্য কিছু নাম কা ওয়াস্তে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটা মেনে চললে আজ পৃথিবী ইউরি গাগারিন এর নামই জানতোনা। ভাগ্যিস আমি ছিলাম। রুটিন কিছু কাজ আর পৃথিবীর অরবিট এ চক্কর দিয়ে আমাদের অভিযান শেষ হলো”।

এবারে ফেরার পালা। কিন্তু সমস্যা হল ফেরার সময় শেষ ধাপে ইউরি অবতরণ করবে ছোট একটা ক্যাপ্সুলে। সেটাতে দুজনের জায়গা হবেনা। আর তাছাড়া নামার পর ভস্টক থেকে আমাকে বেরোতে দেখলে দুটো সমস্যা হতে পারে। প্রথমত রাশিয়ান আইনে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ড। দ্বিতীয়ত মহাকাশ অভিযানের সমস্ত কৃতিত্বটাই পাবো আমি”।

“প্রথম সমস্যা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। আমি ইচ্ছা করলে পৃথিবীর কোনো আইন আমাকে ছুঁতে পারবেনা। আমার সমস্ত চিন্তা দ্বিতীয় সমস্যাটা নিয়ে। ইউরির কৃতিত্ব ছোটো করতে চাইনা। তাই ওকে বললাম -“কুছ পরোয়া নেহি। তুই হিসাবমতো নামবি। আমি থাকবো ক্যাপসুলের বাইরে।

-“কিন্তু বাইরে তুমি থাকবে কি করে আর পৃথিবীতে নামবে কি করে?” – ইউরি জানতে চাইলো।

অত ভাবিসনা বলে আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম আমি বোমকাই বাবার শিষ্য, পুরো ব্যোমজগৎ আমার হাতের মুঠোয়”।

বুঝলি তো, ওপরে ওঠাটা যতটা সহজ ছিলো; নামার ব্যাপারটা ততটাই জটিল। ইউরি কে ওর ক্যাপসুলের মধ্যে বসিয়ে বাকি কলকব্জা আমি সামলে নিলাম। সব কিছুই প্ল্যান মাফিক হলো। ইউরি নিরাপদে ওর ক্যাপসুল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করলো।ইতিহাস তৈরি হলো”।

আর আপনি?” – বাতেলের গলাটা উদ্বিগ্ন শোনায়। “আমিও নামলাম। ওই ক্যাপসুলের গায়ে লাগানো একটা হ্যান্ডেল চেপে ধরে।” – নির্লিপ্ত ভাবে বললেন চার্ণকদা। “ওই সুপারসনিক বেগে নামলেন আর কিছু হলোনা? আপনার গোটা শরীরটা তো ছাই হয়ে যাওয়ার কথা।“-সিটু নিজের ফিজিক্স এর জ্ঞান জাহির করতে ছাড়েনা।
ভালো করে এই বারমুডা টা দেখ। এটাকে যে শতছিন্ন দেখায় তা কি এমনি এমনি! নেহাত একটু রং চটে গেছে তাই, নাহলে এখনও দিব্যি স্পেস সুট বলে চিনতে পারতিস।

কিন্তু তাহলে এই ফুটোটা? এটা সিগারেটের আগুনে নয় বলছেন?” – আমিও প্রশ্ন করে ফেলি। “আরে স্পেস শিপে যে ফুটোটা হয়েছিলো সেটাকে এটার থেকে কেটে নেওয়া অংশ নিয়েই তো মেরামত করেছিলাম। দেখছিসনা ফুটোটা কি নিখুঁত! বলেছিলাম না উপস্থিত বুদ্ধি।“-তিনি থামলেন।

কিন্তু একটা ব্যাপার এখনো পরিষ্কার হলোনা। আপনি তো ইউরির সঙ্গে একসাথে ল্যান্ড করেননি?” – অগা জানতে চাইলো। “একদম ঠিক। শেষ দশ হাজার ফুট আগে হ্যান্ডেল টা ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্যারাসুট না থাকলেও ল্যান্ড করতে প্রবলেম হয়নি। ব্যোমকাই বাবার স্পেশাল জড়িবুটি একটা ওইসময় খেয়ে নিয়েছিলাম। তাতেই তো হালকা হয়ে নামলাম।

পুরো গ্যাস“-বাতেল বললো।

ঠিক । ওই জড়িবুটিতে প্রচুর গ্যাস তৈরি হয় পেটের মধ্যে। ওটাই ব্যোমকাই বাবার শূন্য মার্গে বিচরণের সিক্রেট“- আরো একবার কিস্তিমাত করে তিনি প্রস্থান করলেন।

 

লেখক পরিচিতি ~ ডঃ স্বদেশ মান্না-র জন্ম 4 April 1986, কলকাতায়। এন আর এস মেডিকাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করে বর্তমানে হলদিয়া পোর্ট হসপিটাল এবং ডায়মন্ড হারবার জেলা হসপিটাল-এ কর্মরত। জীবসেবা-র পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও প্রশংসনীয়! অশেষ ধন্যবাদ স্বদেশ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ লেখা পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গুল্পগুচ্ছ।

 

প্রচ্ছদচিত্র ~ ডঃ স্বদেশ মান্না

One thought on “চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৫ম কীর্তি – বারমুডা

Comments are closed.