চোরাস্রোত
গ্রীষ্মের দুপুর, রাস্তাঘাট মোটামুটি খালি, খুব দরকার না পড়লে কেউ বাইরে বেরোয়নি। সূর্য যেন নিজের পুরো তেজ ঢেলে দিয়েছে। কিছুক্ষন দিবানিদ্রা দিয়ে নিলয় গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে সন্ধ্যার শেষ লোকাল টাও মিস হয়ে যাবে। তড়িঘড়ি পিঠের ব্যাগে ময়লা বহুব্যাবর্হিত জামা প্যান্ট গুলো গুঁজে নিলো। মায়ের জন্য কেনা “মেয়েদের ব্রতকথা” বইটা সযত্নে ভরে রাখলো।
হঠাৎ নিলয়ের মনে পড়লো, বাবার জন্য একটা সস্তা সুতির জামা কেনার জন্য মা বলেছিলো অনেকবার, পড়াশোনার চাপে একদম ভুলেই গেছিলো নিলয়। একবার মনে হলো পাড়ার মোড়ে যে দোকান আছে সেখান থেকে কিনে নেবে, কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো যদি ট্রেন টা মিস হয়ে যায়? আর বাবার একটা জামা তো আছেই, সে পরের বার কিনে নিয়ে যাওয়া যাবেক্ষণ। হাত ঘড়িতে ২:৩০ টা বাজে, হোস্টেল থেকে হাওড়া হয়ে বাড়ি পৌঁছাতে রত ১১ টা -১১:৩০টা বেজে যাবে। প্যান্টের উপর একটা টি শার্ট গলিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিলয়।
হাওড়া স্টেশন এ ট্রেনে উঠে নিলয় একটা জানলার পাশে বসে গল্পের বই বার করলো। ট্রেন এর কামরাটাতে অফিস ফেরত কিছু যাত্রী তাস খেলতে আর ঘাম মুছতে ব্যস্ত, লোকাল ট্রেনের ফ্যানের হাওয়া নিচে পর্যন্ত আসেই না। নিলয় গল্পের বইয়ের পাতায় চোখ রাখলো, কিন্তু মন বসাতে পারলো না, মাথায় হাজার চিন্তা ভিড় করে আসছে, ফিরে এসেই কলেজের ফিস টা দিতে হবে, বাবা কে বলতে হবে টাকাটা দিতে। কিন্ত, নিলয় ওর বাবার আর্থিক অবস্থা জানে, এ বছর ভালো ফলন হয় নি চাষে, ধানেই দর ভালো পাইনি বাবা। বাবা এমনিই কথা কম বলেন, আর্থিক চিন্তায় আরো চুপচাপ হয়ে গেছেন। নিলয় এটা বোঝে, বয়সের সাথে সাথে বাবার আর ওর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বাবার মতের সাথে ওর মত মেলে না। ও এটাও বোঝে না বাবা ওকে ভালো বাসে কিনা। এই তো সেদিন ওর উচ্চ মাধ্যমিক ফল বেরোলো, স্কুলের সবাই কত প্রশংসা করলো, মা তো আনন্দে কেঁদেই ফেলল, বাবা তো কিছু বললো না। নিলয়ের খুব অভিমান হয়েছিল সেদিন। তারপর কলকাতার কলেজে ভর্তির সময় সবার বাবা মা এসেছিলো, শুধু তার বাবা মা আসে নি। মা বলেছিলো বাবার গ্রামে বসন্তবাবুর সাথে খুব দরকার। বসন্ত হালদার লোকটাকে নিলয়ের একদম ভালো লাগে না, ওর নাকি অনেক দুনম্বরি ব্যবসা আছে, সুদে টাকা ধার দেয়, বাবার ওর সাথে কি দরকার ও বুঝতে পারে নি। পুরো ফিস টাও সেবারে ও দিতে পারে নি, পরের হপ্তায় বাড়ি গিয়ে ফিস টা নিয়ে আসে।
হঠাৎ একটা ধাতব শব্দ করে ট্রেনটা থেমে গেলো, নিলয়ের চিন্তার সূত্র টা ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরে এলো সে। বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখলো বর্দ্ধমান স্টেশন। হরেক রকম খাবার নিয়ে হকাররা উঠছে ট্রেনে। এখনো ৩-৪ ঘন্টার পথ, নিলয় একঠোঙা ঝালমুড়ি কিনে খেয়ে জল খেয়ে নিলো। স্টেশন এ নেমে ৬-৭ কিমি দূরে ওর বাড়ি, যখন নামবে শেষ বাসটাও ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, তবে ওর চিন্তা নেই, স্টেশন এর কাছেই ওর সাইকেল রাখা থাকে, মাঝে মাঝে ওর বাবাও স্টেশন এ চলে আসে। কতবার ও বারণ করেছে বাবাকে, কি দরকার বাবার আসার, ও কি বাচ্ছা ছেলে! তার ওপর বাবার চোখে ছানি পড়েছে, ভালো ভাবে চোখেও দেখে না, কিন্তু বাবা কোনোদিন উত্তর ও দেয় না, কথাও শোনে না।
ট্রেন স্টেশন এ যখন পৌছালো তখন ১০:৩০ টা বেজে গেছে। নিলয় ব্যাগ টা নামিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে নেমে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেনটা বিকট শব্দ করে বেরিয়ে গেলেই যেন হঠাৎ করে একরাশ নিস্তব্ধতা নেমে এলো। নিলয় সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল টা বের করতেই দেখে বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
“বাবা! তোমাকে আবার কে আসতে বললো?” – নিলয় একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন টা ছুড়ে দিলো।
বাবা বললো – “না, আসলে এদিকে একটু কাজ ছিল, তো ভাবলাম তুই যখন আসছিস একসাথেই চলে যাবো”।
নিলয় ভালোভাবেই জানে বাবা এটা মিথ্যা বললো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিলয় সাইকেল এর প্যাডেল এ পা রাখলো। পুরো রাস্তায় আর দুজনের কথা হল না।
মা বাড়ির বারান্দায় ওদের অপেক্ষায় বসে। নিলয় কে দেখেই জীর্ণ মলিন শাড়িতে শীর্ণ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাকে দেখলেই নিলয়ের মনটা ভালো হয়ে যায়, পথের ক্লান্তি, শতচিন্তা কিছুক্ষনের জন্য সব ভুলে যায়।
“কখন বেরিয়েছিস? ট্রেন এ কোনো অসুবিধা হয় নি তো? কিছু খেয়েছিস?” – প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুললো মা।
নিলয় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
“যা! তাড়াতাড়ি হাত পা টা ধুয়ে আয়, আমি খাবার দিচ্ছি”- মা বললো ।
নিলয় পোশাক বদলে খাবার খেতে বসে মা কে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা খাবে না?”
“না রে, ওর শরীর টা ভালো নয়” – মা উত্তর দিলো।
রাত্রে বিছানায় শুতেই ক্লান্তি তে ওর চোখ টা জুড়ে এলো।
পরের দিন দুপুরে খেতে বসে নিলয় বাবাকে বললো, “বাবা! আমার কলেজের ফিস টা জমা দিতে হবে পরশু”। বাবা চুপচাপ খেতে খেতে কোন উত্তর দিলেন না। নিলয় গলাটা পরিষ্কার করে আবার বললো – “৫০০০ টাকা দিতে হবে”। বাবা একবার ওর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর আবার খেতে লাগলেন। খাওয়া হলে ধীরে ধীরে উঠে চলে গেলেন।
নিলয় এর খুব রাগ হলো, বাবা কিছু উত্তর দিলো না কেন? ওর কলেজের ফিস টা কতটা জরুরি বাবা কি বোঝে না? খাবার শেষ না করেই ও উঠে পড়ল, পিছন থেকে তখনো মা বলে যাচ্ছেন – “আরে! খাবার টা পুরোটা শেষ করে উঠবি তো”।
দুপুরে শুয়ে বাবা মায়ের ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা নিলয়ের কানে এলো –
মা: “কিন্তু তুমি তো এই তিন হাজার জমিয়েছ চোখের অপারেশন এর জন্য, তাছাড়া ওর তো পাঁচ হাজার চাই, কিভাবে জোগাড় করবে? বসন্ত হালদার কি আর ধার দেবে? আগের সুদ টাই তো দিতে পারো নি”।
বাবা অনেকক্ষন চুপ থাকার পর বললেন – “দেখি !”
নিলয় চিন্তায় ডুবে যায়। ও ফিস টা দিতে না পারলে যদি ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়! না আর ও ভাবতে পারে না ।
পরের দিন দুপুরে ট্রেন। সকাল থেকে বাবাকে সে বাড়িতে দেখে নি, তাহলে কি বাবা টাকাটা জোগাড় করতে পারে নি? বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা তিন হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো “এটা নিয়ে যাও, পরের হপ্তায় এসে বাকিটা নিয়ে যেও”।
“কিন্তু মা, ওরা বলেছে পুরো টাকাই দিতে হবে” – নিলয় বললো ।
“তুমি বড় হয়েছো, সবই তো বুঝছো, ওদের সাথে কথা বলে বুঝিও।”
নিলয়ের প্রতিবার কলেজে গিয়ে কিছুদিনের সময় চাইতে খুব লজ্জা লাগে ,কিছুটা রাগে কিছুটা অভিমানে নিলয় পিঠের ব্যাগ টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
নিলয় এর বাবা সাইকেল নিয়ে বাড়িতে আসছিলেন। সকাল থেকেই বসন্ত হালদার এর কাছে বসে ছিলেন, যদি কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়। বসন্ত হালদারের কাছে প্রচুর দেনা হয়ে গেছে। আবার ধার চায় শুনে দেখাই করতে চাইছিলো না সে।
“সুদে আসলে কত জমা হয়েছে হিসাব করেছো? কোন মুখে আবার ধার চাও? ছেলেকে এতো পড়িয়ে কি হবে? ছেলেকে আমার গুদাম এ কাজে লাগিয়ে দিতে বললাম, আমার কথা তো শুনলে না। চাষীর ছেলে এতো পরে কি করবে?”
“ছেলেটা পড়তে চায় দাদা। ও তো পড়াশোনাতে খুব ভালো জানো! একটু সাহায্য করো”
“দেখো, ভিখিরির মতো সাহায্য চেয়ো না। আগের ধার মেটাও তার পর এসো।”
নিলয়ের বাবার মুখ লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়, নিজের প্রতি ঘৃনায়।
অনেক কাকুতি, মিনতি করার পর টাকাটা পাওয়া গেছে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাওয়া গেছে যে পরের মাসে ধার শোধ না করতে পারলে জমি বন্ধক রাখতে হবে।
গ্রীষ্মের দুপুরে টাকাটা নিয়ে পড়ি মরি করে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। ক্লান্ত দেহে এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই, ছেলেটার ট্রেন একটু পরেই বেরিয়ে যাবে, ওকে টাকা টা দিতেই হবে, অভিমানী ছেলে নিলয়, সেটা উনি জানেন, তবে ছেলের সম্মান যেন কলেজের সকলের কাছে উঁচু থাকে।
স্টেশন এ ঢোকার মুখে শুনতে পেলেন ঘোষণা হচ্ছে –
“ইন্টারসিটি ছাড়তে দেরি হবে……“
“কি হয়েছে দাদা?”
“একটা ১৮ -১৯ বছরের ছেলে ট্রেন এ কাটা পড়েছে।”
অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু বুকে স্টেশন এর দিকে এগিয়ে গেলেন। দূর থেকে দেখলেন একটা ১৮-১৯ বছরের ছেলে রক্তের মাঝে পড়ে আছে। মুখটা দূর থেকে বোঝা গেলো না।
যন্ত্রের মতো ধীরে ধীরে উনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন দেহ টার দিকে, দুই চোখ চিন্তায় ভাবনায় ভয়ে ছলছল করছে। হঠাৎ পাস থেকে চেনা গলা শুনতে পেলেন,
“বাবা!”
যেন একটা বরফের টুকরো হৃদয় থেকে নেমে গেলো। পাশে দাঁড়ানো নিলয় কে উনি জড়িয়ে ধরলেন, দুচোখ বেয়ে তখন জলের ধারা নেমে নিলয়ের পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
নিলয় বাবার ভালোবাসার চোরাস্রোতের ধারার স্নিগ্ধতা অনুভব করতে পারলো। মনে জমা বরফ গলে নিলয়ের চোখে থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো….
লেখক পরিচিতি ~ আনন্দ-র জন্ম 1st April 1984, বীরভূম জেলার চৌহট্টে। এম.সি.এ এবং এম.বি.এ পাশ করে বর্তমানে কলকাতায় তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র কগনিজ্যান্ট-এ কর্মরত। প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শীতার পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও অতুলনীয়! একটি স্বরচিত কবিতা সংকলনের বই প্রকাশ আনন্দর স্বপ্ন। সেই তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বপ্নের স্বাদ পেতে পারেন Whispering Mirror -এ। দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা ওনার মুখ থেকে শোনার আনন্দই আলাদা। অশেষ ধন্যবাদ আনন্দ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ ওনার প্রথম ছোটগল্প পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গল্পমালা।
প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ time.com
প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds
37 comments
Darun laglo….
Very nice story!
besh valo …
Thank you angshuman,….
Ananda, tumi erokom likhte paro jantam na…it industry r shorotchandra dekhchi tumi. Tomar Srikanta porar jonno amra opekhay roilam…
Dhanyabaad Sankarshan ….. 🙂
Mon chuye gelo, Ananda da!!! Emotional!
Thanks Rishav
Very nice story boss,
Thanks arup
Darun gopo, data fati
Ashadharon Ananda Da …
Thanks sayan
Travelling by train takes me back to my old college days. Finally Asadharan upasanhar Tragedy r sathe comedy misie.
Thanks Nirmal
besh onekdin por baba chheler shomporko nie eto sundor ekta golpo pelaam……Anandadar emotional quotient er durdaanto porichoy pawa gelo……aaro ei dhoroner srishtir opekkhay roilaam !
Thank you Samali
Ananda babu ke kurnish janai asadharon ei lekha ti amader sathe share korar jonno. Pita putrer samparker ek sundor gatchhora bedhechhen apni. Ek lahomae kato dure chole jawa samparko abar kato kachhe fire ase. Sotti khub bhalo laglo apnar lekha pore. Anari der dol e apnake swagato! Aro sundor lekha porar ashae roilam. Asha kori hotash korben na. 🙂
Thank you Dibakar…eti amar prothom proyash…bhalo legeche sune bhalo laglo…chesta korbo bhalo golpo debar…
Besh sundor choto golpo
Thank you
Beautiful
thank you
Ananda da just awesome likhecho … Tomar lekhte abar dekhiadilo sontan sneho ki …
Thank you
Khub bhalo Ananda da….. 🙂
Thank you
অসাধারণ।।।
Very emotional…..toooo good..Ananda da☺
Thank you.. 🙂
Superb story Ananda da … Niloy er moto last ek fota jol amar chokeho eseche … Osadharon .. 🙂
Thank you
Khub bhalo Ananda da 🙂
Thank you … 🙂
Seriously too emotional story !! Too good Ananda da.. waiting for ur next story !!
Thank you
Arey bah… Ananda, ending ta Bhalo hoyeche. Aro likhe jao .. Amraa porar jonno opekhha kore roilaam 😌
Thank you..
Comments are closed.