প্যারিসের পাঁচদিন – যাত্রা শুরু
– “কোথায় আপনি?”
– “এই তো হাঁটছি।“
– “কোন রাস্তায়?”
– “সেটা তো জানি না।“
– “বাঃ, খুব ভাল, ডাইনে–বায়ে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?”
– “পাচ্ছি তো , সিন নদী।“
– “ভেরি গুড, নদী টা কে বাঁ দিকে রেখে হাটতে থাকুন।“
মিনিট তিনেক পরে শ্বশুর মশায়ের দেখা পেলাম, বেশ এদিক সেদিক দেখতে দেখতে আসছেন আমার দিকে, যেন এটা প্যারিস নয়, চারাবাগানের মোড়।
ঘটনার সুত্রপাত বেশ কয়েক মাস আগে, যখন আমি আর জয়িতা ঠিক করলাম যে দুই জোড়া বাবা মা কে একসাথেই বিলেতে আনা উচিত। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ , হয়ে গেল ব্রিটিশ টুরিস্ট ভিসা বানানো। এর পরে বাকি থাকে ইউরোপের আর কোন একটা দেশ ঘোরা ওদের কে নিয়ে, খুব একটা বেশি ভাবতেও হলনা, বাঙ্গালির ইউরোপ বলতে একে আসে লন্ডন ব্রিজ (কলোনিয়ালিসম জিন্দাবাদ) , আর দু নম্বর টাই হয় মোনালিসা আর আইফেল টাওয়ারের মধ্যে। অতঃপর শেঙ্গেন ভিসাটাও তৈরি হয়ে গেল।
চার জনেই নির্বিঘ্নে লন্ডন পৌঁছল। মা কে শুধু ইমিগ্রেশন অফিসার আটকেছিল হাতের ছাপ মিলছিল না বলে, মধ্য বয়স্কা শাড়ি পরা ভারতীয় ভদ্রমহিলাটি অসাধু ইমিগ্রান্ট বা কোমরে বোম বাঁধা টেররিস্ট হতেই পারতেন, কিন্ত মা যে বাবার স্ত্রী সেটা পাসপোর্ট থেকে প্রমানিত হওয়ার পরে মা ছাড়া পায়। ফ্যামিলি নিয়ে কোন টেররিস্ট এ দেশে আসে না, সেই যুক্তি থেকেই বোধহয়।
দিন চারেক কাটল জয়িতার হাতের হাই কালরি ডায়েট খেয়ে, এ দেশে রাত কেন সাড়ে দশ টা তে হয় সে ব্যাপারে মাথা চুলকে আর দিনে দশ বার বাথরুমের ফ্লোরের জল পরিস্কার করে (ম্লেচ্ছ সাহেব রা পটি করে জল ব্যবহারে অপারগ, টিস্যু দিয়েই কাজ চালায়, তাই বাথরুমে কোন নালা নেই)। ১১ তারিখ চড়ে বসলাম ইউরো-স্টারে।
লন্ডন থেকে প্যারিসের দুরত্ব ৪৫০ কিলোমিটার। এই পথ আপনি ফ্লাইটেও যেতে পারেন, সাড়ে ৪ ঘন্টার লং ড্রাইভ ও করতে পারেন, খেপে গিয়ে সারারাত হেঁটেও মেরে দিতে পারেন (গুগুল ম্যাপ এরকমই দেখায়)। তবে সবচেয়ে আকর্ষক উপায় মনে হয় ইউরো-স্টারে যাওয়া, ২২০ কিমি/ ঘণ্টায় ছুটে চলা এই ট্রেন আপনাকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁউছে দেবে প্যারিসে, মাঝখানের ২০ মিনিট আবার ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে। কেন জানি না , কিন্ত ইংলিশ চ্যানেলের নাম শুনলেই বাঙালি এক্টু সেন্টিমেন্টাল হয়ে পরে, যেমন টা হল আমার বাবা আর শাশুরি মা কে নিয়ে, ট্রেন চলতে শুরু করতেই মিনিট দশেক পর পর শুনতে হল –
“ইংলিশ চ্যানেল এল রে?”
“এই বুঝি সমুদ্রের তলায় ঢুকল!”
“বিচ দেখা যাচ্ছে?”
“এই টানেলের ছাদ ভেঙ্গে পরলে আর রক্ষে নেই!”
বিশ্বাস করুন, গোটা রাস্তায় ট্রেন টা ৫ টা টানেলের মধ্যে দিয়ে যায় , তার মধ্যে কোনটা ইংলিশ চ্যানেলের সেটা বোঝা বেশ চাপের, অবশেষে জিপিএস দেখে ওদের কৌতূহল মেটালাম।
শিয়ালদা রাজধানির শৌখিনতা কে ২৫ দিয়ে গুন করলে তা ইউরো-স্টারের সমান হয়। ইতালি তে এই রকম ট্রেনেই গুছিয়ে টোয়েন্টি নায়িন খেলে তাকে নৈহাটি লোকালের তৃনমূল স্তরে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলুম, এবারে বাবা মায়েরা থাকায় খুব বেশি খাপ খুলতে পারিনি। ট্রেনে সবাই একটু-আধটু ঘুমিয়ে নিল, শুধু আমি আর বেটু জেগে রইলাম, যেকোনো সময়ে কামরায়ে ‘ফক্স’ এসে জেতে পারে ভেবে ভয় পেলাম, সামনের সিটের যাত্রী র খাবারে নজর দিলাম, আর কয়েক মিনিটের জংলি নাচ নাচলাম।
আর যেটা না বললে এই ট্রেনযাত্রাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটা হল মেইসি উইলিয়ামসের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া, “গেম অফ থ্রোনস” এ আরিয়া স্টার্কের ভুমিকাতে অভিনয় করে যে এখন খ্যাতির শিখরে, এইরকম সেলেব্রিটির সাথে দেখা হওয়ার আনন্দ আর সৌভাগ্য ডাউন কল্যানি লোকালে ফাঁকা সীট পাওয়ার সমান।
বিকেল ৪ টে ১৫ তে ট্রেন এসে পৌঁছল প্যারিসের গারে-দু-নর্ড স্টেশনে (হ্যাঁ! ফ্রেঞ্চ রা এই ভাবেই উচ্চারণ করে, এই নিয়ে কোন প্রকার খিল্লি আমি বরদাস্ত করব না)। একটা বাস এ উঠে পৌঁছলাম আমাদের ফ্ল্যাটেতে। ফ্ল্যাটটা খুজে পাওয়াটাও হল গুপ্তধন খোঁজার সামিল, প্রথমে ৪ ডিজিটের ইলেক্ট্রনিক কি টিপে খুলল একটা বড় দরজা, তার ভেতরে একটা লেটার বক্স থেকে মিলল আর একটা চাবি, সেটা দিয়ে খুলল আরেকটা দরজা, তারপরে স্পাইরাল সিড়ি বেয়ে উঠলাম তিনতলাতে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে, সেখানে আরেকটা ৪ ডিজিটের কি প্রেস করে পাওয়া গেল ফ্ল্যাটের চাবি, এ হেন বাড়িতে চোর চুরি করতে এলে বোর হয়ে ফিরে যাবে নির্ঘাত।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই কয়েকটা অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার চেক করে নেওয়া হল, যেমন কটা বালিশ কম্বল আছে, বাথ্রুমে ফ্লাশ কাজ করছে কিনা, সব কটা জানলা খুললে ক্রস ভেন্টিলেশন হচ্ছে কিনা (এটা আমার বাবার একটা অবসেশন), রান্না ঘরে ওভেন কাজ করছে কিনা, বেটুর ভাঙ্গার উপযোগী কোন শোপিস আছে কিনা। তারপরে চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পরলাম রাতের শহর দেখতে।
বাস থেকে নামলাম লুভ রিভলি স্টপে, যেখানে ফ্রান্স টুরিসমের অফিস, এখান থেকেই আমরা উঠব একটা দোতলা বাসে যার হুডটা খোলা, এই বাস দের ঘন্টা ধরে শহর টা ঘোরাবে।
লুভ রিভলি স্টপে নেমেই জয়িতা খেয়াল করল যে আমার শশুর মশাই বাসের মধ্যেই রয়ে গেছেন, ততক্ষনে বাসও হাওয়া হয়ে গেছে, কল করলাম ওনার মোবাইলে। প্রথম প্যারার কথোপকথনটা তখনই হল। খুঁজে পাওয়ার পরে বললেন যে নামার সময়ে আমাদের ডাক উনি শুনতে পাননি, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, তাই রাস্তার কোন দৃশ্য ওনাকে মোহিত করেছিল কিনা সেটা জানার আর সাহস পেলুম না।
বাসের আসার আগেই আমাদের বাঙালি মস্তিস্ক কাজ করেছিল, তাই বাস স্টপে এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড়িয়ে পা মারিয়ে ঠেলে ঠুলে দোতলায় এসে সিটের দখল নিলাম। জয়িতা আবিস্কার করল যে ওর সামনের অডিও গাইডটা কাজ করছে না, ওকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম যে গাইডের তুলনায় আমি অনেক বেশি জানি, বেটুর যদিও বিচলিত হওয়ার কোন কারন ছিল না, ও আমাদের দুজনের হেডফোন গুলো নিয়ে “ম্যাগি” বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরল।
রাতের প্যারিস তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত সুন্দর, গোটা শহরটাই ঝলমলে আলোয় ভেসে থাকে, আমরা পরপর দেখলাম কনকর্ড , গ্র্যান্ড ক্যারাউসেল, আর্ক দি ট্রাইওম্ফে, মুলে রুজ, অপেরা গারনিয়ার। তবে সেরা হল আইফেল টাওয়ার, ঠিক রাত ৯টা ৫৫ তে বাস আমাদের নিয়ে এল আইফেলের সামনে, কয়েক মিনিট পরেই গোটা টাওয়ারটা জ্বলে উঠল সাদা আলোয়, দেখে মনে হয় যেন হাজারটা হিরে চকচক করছে একসাথে, যারা এটা আগে দেখেননি তাদের জন্য একটা লিঙ্ক দিলাম এখানে।
রাত ১২ টা নাগাদ ফিরলাম ফ্ল্যাটে, ভাত ছাড়া বাঙ্গালির ঘুম হয় না, তাই রাতের মেনু ভাত,ডাল আর ডিম সেদ্ধ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বালিশে মাথা, কালকে আবার আইফেল টাওয়ারের মাথায় চরতে হবে!
লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ
স্থিরচিত্র উৎস ~ ডঃ অনির্বাণ ঘোষ
প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds
12 comments
darun laglo ani..osadharon
Thank you Dipu
অতি উত্তম !!
Dhonyobaad Subham!
Khub sundor…Porer diner golpo gulor jonno wait korchi
Thank you Ananda. Amrao apekkhay roilam tomar porer galper jonno. 🙂
Bah besh hoyeche…tor shonge shohor ta ke abar notun kore dekhchi…
Songe thak. Ekhono anek ghora baki. 🙂
Darun legeche lekha ta. Ami bangla Porte onek khon ni Aar Majh pothe dhairjyo harie pora bondo kore di, kintu Tomar ei lekha ta ek baar e Puro ta porlaam. Besh Bhalo likhecho.. Mone holo ami o Tomader songe Paris ta dekhte dekhte e jachhilam. Poroborti din gulo r ghotona gulo asha kori taratari e post habe ! Keep it up ???
Thank you Snigdha. Eta to anek baro compliment! Khub casually e lekha. Asha korchhi porer episode ei baki ta puro likhe felte parbo. Poro.
Darun laglo.
Thank you Sourav. Porte theko.
Comments are closed.