পেটের টান

Facts, Friends, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, Story, বাংলা
রেশন দোকানের সামনে লম্বা লাইনটার অনেক পেছনে দাঁড়িয়ে ফুলমণি। আজ চাল আর গম দেবার দিন। দূর থেকে দারিপাল্লার ওঠানামা দেখে অধৈর্য হয়ে পরে। যদি চাল শেষ হয়ে যায়! গম ভাঙ্গানোর অনেক ঝামেলা এই গ্রামে। এগারো মাইল হেঁটে যেতে হয় বকুলতলা গ্রামে। তবে গিয়ে একটা গম ভাঙ্গাই কল পাওয়া যায়। তাও আবার সেই কলের মালিক বাকিতে গম ভাঙ্গিয়ে আটা দিতে চায়না। টাকা না থাকলে আটার খানিকটা দিয়ে আসতে হয়। রেশন থেকে চাল আর গম নিয়ে ফেরার পথে মুদির দোকান থেকে বাকিতে একটু তেল নিয়ে নেয় সে।

 

 

তারক সোমবার ঘরে ফিরেছে মফস্বল থেকে। বারোদিন পর। গ্রাম পঞ্চায়েতের হরি সামন্ত কাজটা পাইয়ে দিয়েছিল অনেক হাতেপায়ে ধরার পর। কিসব নাকি একশো দিনের কাজ চালু হয়েছে। রাস্তা তৈরির ইট বওয়ার কাজ করছিল সে। এগারোশ টাকা ধরে ফিরেছে সে।

 

বাকী টাকা সময় হলে পেয়ে যাবি” – হরিদা জানিয়ে দিয়েছে। গেলো দুই মাসে এই প্রথম টাকার মুখ দেখল তারক আর ফুলমণি। মাঝেমধ্যে হরিদার বাড়িতে ফাইফরমাস খেটে বাসিরুটি, চিঁড়ে আর কিছু গুঁড় জোটাতে পারে ফুলমণি।

 

 

পরিবারের পাঁচজন আজ অনেকদিন বাদে দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্যই। ফ্যান না ঝড়ানো ভাত, উঠানে লাগানো গাছের লঙ্কা আর দু-চার ফোঁটা করে সর্ষের তেল। শিবুর পাতে ভাত পরার সঙ্গে সঙ্গেই তা গোগ্রাসে গিলে নেয়। বছর বারোর ছেলে। পেটে ক্ষিদে থাকবেই। তার উপর ভাত তো শুধু দুপুরেই। রাতে হয় বাসী রুটি না হয় মুড়ি। তারক নিজের থালা থেকে খানিকটা ভাত তুলে দেয় শিবুর পাতে। একগাল হেসে শিবু আবার খাওয়ায় মন দেয়। কানাই আর গীতাও খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়ে চলেছে দাদার দুই পাশে বসে। ভাঙ্গা ঘরে পাঁচটা হাসিভরা মুখ। দেখে কে বলবে সংসারে এত দুঃখ কষ্ট।

 

 

কিন্তু সুখ যে ক্ষণস্থায়ি। টাকা, চাল, আটা সবই ফুরায় – কিন্তু ক্ষিদে ফিরে আসে। হরি সামন্তর কাছে হত্যে দিয়ে পরে থেকে না পাওয়া যায় বাকী টাকা না নতুন কাজের সন্ধান। উল্টে জোটে গলাধাক্কা – “ছোটলোকগুলোর ভাল করতে নেই। লাই দিলেই মাথায় ওঠে।

 

 

মাঠে আগাছা পরিষ্কারের কাজ করে, গোয়াল ধুইয়ে দিয়ে, হাটে মাল বয়ে দেওয়ার ঠিকে কাজ করে কোনমতে আধবেলার পোঁকাধরা চাল আর গম জোগাড় করছিল তারক। নিজের খানিক জমি থাকলেও কিছু ফাসল ফলানো যেতো। কিন্তু বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে যা একফালি জমি ছিল, তাও বিক্রি করে দিতে হল। বাবা আর জমি – একই সঙ্গে খোওয়া গেছিলো।

 

 

গ্রামের অনেকে আগে বেশ কয়েকবার বলেছিল শিবুকে শহরে কাজে পাঠাবার জন্য। ফুলমণি কিছুতেই রাজী হয়নি। শ্বশুর কলকাতার হাসপাতালে থাকার সময় গেছিলো একবার। শহরের মানুষগুলোকে কেমন যেন মনে হয়েছিল। বড় বড় বাড়ী ঘরের মতোই রুক্ষ।

 

 

কিন্তু এবার মনে হচ্ছে শিবুকে কাজের খোঁজে পাঠাতেই হবে। শুক্রুবারের হাটে খোকনের সাথে দেখা হয়। সে শহর থেকে ফিরেছে সবে। কাজ থেকে ছুটি নিয়ে। তার কাছেই শুনল শহরে কতরকম কাজ। সেখানে নাকি বাড়ীর ওপর বাড়ী তৈরী হয়। মেলা কাজের লোক দরকার। মাল বয়ে দেবার কাজই তো করে পঞ্চাস-ষাট জন। টাকাও পাওয়া যায় মন্দ না। সপ্তাহে এলাকার এক হোমরা চোমরা লোক এসে দু’শ টাকা নিয়ে যায়। বাকী সব টাকা নিজের। এখানেও তো হরিশালা কত টাকা মেরে দেয়।

 

 

হাট থেকে ফিরে ফুলমণিকে বলে সব কথা। শুনে ফুলমণি কাঁদতে শুরু করে। সেও বুঝতে পেরেছে ছেলেকে বাইরে না পাঠালে এবার না খেয়ে মরতে হবে। শুধু তারা দু’জন হলেও হতো – কিন্তু আট আর নয় বছরের ছেলে-মেয়ে দু’টোর কথা ভেবে বুক ভেঙ্গে যায়। শিবু পারবে কি শহরে গিয়ে একা থাকতে? একা ছেলেটা কোনোদিন গ্রামের বাইরে এক রাতও কাটায়নি। চোখের জল থামতেই চায়না। তারক নিজেও যেতে পারে। কিন্তু খোকন শিবুকে পাঠাবার কথা বলছিল। নিজের বয়সটাই নিজের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো শহরের কাজের জন্য। মাল বওয়ার কাজে নাকি ওখানে কম বয়সী ছেলেপুলেদের নেয়।

 

 

খোকন ছুটি থেকে ফেরার সময় শিবুকে সঙ্গে নিয়ে এলো কলকাতায়। সারা রাস্তা শিবুর কত প্রশ্ন। আসার পথ বদলে যেতে দেখল সে। শহরটা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাস্তায় কত গাড়ী। হুড়মুড় করে ঘারের উপর চলে আসে। রাস্তাগুলোও কতো চওড়া। রাজারহাট পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সেই কোন ভোর বেলায় বেরিয়েছিল। খোকনের ভাড়ার ঘরেই কাটিয়ে দিল রাতটা। পরদিন ঠিকাদারের কাছে নিয়ে গেল খোকন।

 

এইটুকু ছেলে কি করবে রে? ফুল কেস খাওয়াবি তো।” ঠিকাবাবু চোখ কুঁচকে থাকে। খোকন ঠিকাবাবুকে হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে যায়। খানিকপরেই ফিরে আসে বলে – “ম্যানেজ হয়ে গেছে। আজ থেকেই কাজে লেগে পর।

 

 

রাস্তার ধারে লাল পতাকা হাতে দাঁড়াবার কাজ পায়। কাজ বলতে গর্ত খোঁড়া জায়গার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে যাওয়া গাড়ীগুলোকে পতাকা দেখিয়ে সাবধান করা। বেশ মজাই পায় সে। এইটুকু কাজের জন্য টাকা পাওয়া যাবে। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ীগুলোকে দেখতেও বেশ ভাল লাগে। মাঝে মাঝে অবশ্য ঠিকাবাবুর ফরমাশ খাটতে হয়। জল আনে দেওয়া, চা এনে দেওয়া – খারাপ লাগেনা।

 

 

প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। বেশ কিছু টাকাও জমেছে। কবে বাড়ী যাবে ভাবতে থাকে শিবু। বাড়ীতে বাবা মা ছোট ভাই বোনের জন্য তার মন কেমন করে। ফেরার সময় এবার ওদের জন্য দু’টো খেলনা নিয়ে যাবে। এক শনিবার সন্ধ্যেবেলায় কাজ সেরে পাশেই একটা জায়গায় নিয়ে গেছিলো খোকনদা। বিশাল বড় একটা বাড়ীর মত জায়গা। প্রচুর আলো আর লোকজন। দূর থেকে দেখছিল সে। সবাই কতো ভাল জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ এবার কিসব খাচ্ছে। তার কিছুই সে আগে কোনোদিন দেখেনি। খোকনদাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিল ঐ বড় বাড়ী মতন জায়গাটাকে মল বলে। কি বিদঘুটে নাম। দূর থেকে দেখেই সে ফিরে এসেছিল। ঢোকার সাহস হয়নি। খোকনদা জোর করা সত্ত্বেও না। শুনেছে ওখানে নাকি সব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়। অনেক দাম। মায়ের শাড়ীটা ওখান থেকে কেনা যাবেনা সেটা ঐদিনই বুঝতে পেরেছিল। ফিরে গিয়ে হাট থেকে মাকে একটা হলুদ শাড়ী আর বাবাকে লুঙ্গি গেঞ্জি কিনে দেবে সে। ভাবতে ভাবতে কখন যে হাতের পতাকাটা নামিয়ে ফেলেছিল খেয়ালই করে নি। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা লরির ড্রাইভার বুঝতেই পারেনা সামনে মেট্রলাইনের বড় গর্ত আছে। আর যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। জোড়ে ব্রেক কষতে গিয়ে লরিটা উঠে যায় রাস্তার মাঝে মাটির ঢিপির উপর। বোঝাই লরি ভার সামলাতে না পেরে উল্টে পরে। পাশ থেকে হৈ হৈ করে ছুটে আসে সব ঠিকে কাজের লোক। লরির ড্রাইভার-খালাসি ছুটে পালায়। কিন্তু উল্টে পরা লরির নিচ থেকে তাজা রক্ত গড়িয়ে আসে। একপাশে পরে থাকে একটা লাল পতাকা।

 

 

হরি সামন্তর বাড়ীর ল্যান্ডফোনে খবরটা আসতেই গ্রামের সবার কানে ছড়িয়ে পরে নিমেষে। ফুলমণি নিজের পায়ে পুকুরঘাট থেকে বাসন মেজে ফেরার শক্তিটুকুও পায়না। ক্ষেতমজুরি থেকে আগল ভাঙ্গা দৌড়ে বাড়ী আসে তারক। ছোট ছেলে-মেয়ে দু’টো খেলা থামিয়ে ভয়ে উঠোনের এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই রাতেই তারক রওনা হয় কলকাতার উদ্দেশ্যে।

 

 

দুদিন পর মর্গ-এর সামনে দাঁড়িয়েও তারক বিশ্বাস করতে পারেনা কি ঘটে গেছে তাদের জীবনে। দুজন ডোম প্লাস্টিকে মোড়া দেহটা যখন ঠাণ্ডা ঘরের বাইরের মেঝেতে নামিয়ে রাখে – তারক চিৎকার করে গুঙিয়ে ওঠে। ছেলের মুখটাও দেখার উপায় নেই। কান্না তার থামতে চায়না – সঙ্গে বুকফাটা আর্তনাদ। জড়িয়ে ধরে তারক যেন দেহটার মধ্যে ঢুকে যেতে চায়। খোকন আর দুজন গ্রামের লোক অনেক চেষ্টায় তারককে তুলে দাঁড় করায়। মর্গের দেওয়ালে মাথা খুঁটে কাঁদতে কাঁদতে অদৃষ্টকে শাপশাপান্ত করতে থাকে সে।

 

 

শ্মশান থেকে ফেরার পথে কানাই সারাটা রাস্তা বাপের হাত শক্ত করে চেপে থাকে। ভয়ে, না বাপকে শক্তি দেবার জন্য – কে জানে। বাড়ী ফিরে চারটে মানুষ বসে থাকে ঘরের দাওয়ায় – নির্বাক। সবার মনেই তখন পুরনো দিনের টুকরো টুকরো ঘটনা, আর সেসব ঘটনাই শিবুকে ঘিরে। আজ আর বাড়ীতে আগুন জ্বলবে না। পড়শিরাও ফিরে গেছে যে যার ঘরে। ফুলমণি শিবুর জামা জড়িয়ে বসে থাকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। কলকাতায় কাজ করার সময় শিবু যা সব জিনিস নিয়েগেছিল – খোকন সব কিছু একটা প্লাস্টিকে ভরে দিয়েছিল তারককে। আর সঙ্গে দিয়েছিল খবরের কাগজে মোড়ানো ন’হাজার সাতশো টাকা।

 

 

ব্রাহ্মণ খরচ থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধের দিন বিশজনকে খাওয়ানো – সবকিছুই মিটে যায় শিবুর আয় করা টাকায়। তারপরও বেশ কিছু টাকা বেঁচে থাকে। ফুলমণি তা তুলে রেখেছে নিজের বিয়ের ট্রাঙ্কে। দিন কাটে শিবুর স্মৃতি আঁকড়ে। বারান্দায় রাখা বঁড়শি, কানাইয়ের জন্য নারকেল মালা দিয়ে বানানো ঢাক – মনে করিয়ে দেয় শিবুর ছোঁয়া। ঘরে বসে আর ছুটকো কাজ করে কোনমতে দিন চলে পরিবারটার। এদিকে ট্রাঙ্কের টাকাও তলানিতে। গমকল আর মুদির দোকানের পুরো টাকাও শোধ হয়নি।

 

 

মাদুরের ওপর কানাই আর গীতা ঘুমিয়ে আছে। রাতে পেট ভর্তি খাবার পর বাচ্চাদু’টো আর চোখ খুলে রাখতে পারেনা। তারক আর ফুলমণির মাথায় একটাই চিন্তা। নিয়মিত আয় নাহলে আর যে চলেনা।

 

 

কাল সকালে একবার খোকনের কাছে যেতে হবে তারককে। কলকাতা থেকে এসেছে সে এক সপ্তাহের জন্য। কথা বলে দেখতে হবে যদি খোকন কাজটা জোগাড় করে দিতে পারে। এই বয়সে কিছুনা কিছু পেরে যাবেই। চারটে পেট চালাতে হবে। কানাই ও বড় হচ্ছে। কদিন পর সেও যেতে পারবে শহরে। গীতার বিয়ে দিতে হবে কয়েক বছর পর। টাকা না পেলে চলবে?

 

মরে গেলে শরীরটা পুড়বে একবার, কিন্তু পেট রোজ জ্বালায়।

লেখক পরিচিতি ~ শান্তনু দাস

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ blogs.wsj.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

2 comments

Comments are closed.