ভালোবাসার বুদবুদ

Love Story, Marriage, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, বাংলা

বহুদিন পরে অস্মি সাইবার ক্যাফে টাতে এল| রজত জীবন থেকে এখন অনেকটাই দূরে; এই সেই সাইবার ক্যাফে যেখান থেকে ওদের সম্পর্কটা আস্তে আস্তে দানা বেঁধেছিল|

     মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে… এখন সেই স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা| সাইবার ক্যাফের কম্পিউটার গুলোর অবশ্য কোনও বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, শুধু দেওয়ালে নতুন রঙের পোঁচ। অস্মির মনে হল…মানুষের জীবনও খানিকটা এরকমই… বাইরে থেকে যতই পরিবর্তনের প্রলেপ পরুক না কেন ভেতরের আমি টা একই থাকে … মাউসে হাত রেখেই ও একটু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল|  না চাইতেও স্মৃতি গুলো অস্মিকে বিরক্ত করতে লাগলো|

সময়টা প্রবাবলি ডিসেম্বরের লাস্ট উইক , বিংশ শতাব্দীকে বিদায় জানিয়ে একবিংশ শতাব্দীর  আবাহনের প্রস্তুতি চলছে… কোথাও পার্টি হচ্ছে তো কোথাও ফাংসানের রিহার্সাল চলছে| দিনটা মেঘলা ছিল, সকাল থেকেই অস্মির কিছুই ভাল লাগছিল না| শীতের সকাল রোদ ঝলমলে না হলে ওর এমনি মন খারাপের দিন হয়ে ওঠে দিনটা|

‘নিতুদি, মা কে বোলো ..আমি একটু বেরিয়েছি.. ফিরতে দেরী হবে ‘…

বেরিয়ে পরেছিল অস্মি, ইচ্ছে ছিল একটু নিউ মার্কেটে যাবে উইণ্ড  শপিং এ| কিন্তু কিউপিডের অন্য ইচ্ছে ছিল।
গলির মোড়ে এসে কি মনে হল সোজা সাইবার ক্যাফে টাতে ঢুকে পড়ল অস্মি, গুগলে লগ ইন করতে না করতেই.. .. 1 friend request… “চিনতে পারছ?”

আরে ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে না ! হ্যাঁ..সেই চোখ…সেই চোখা নাক… আরে এতো রজত.. বাকি কথা গুলো মনে মনে বললেও… ‘রজত’ নাম টা আপনা থেকেই জোড়ে বলে ফেলল অস্মি.. রিপ্লাই দিল “কেমন আছ?”
আন্সারের ওয়েট করতে করতে আস্মির মনে পরে যেতে লাগল কলেজ লাইফের সেই দিনটার কথা….যেদিন ও প্রথম রজতকে দেখেছিল !

সেদিন টা ছিল ফ্রেসারস ডে| অস্মি শাড়ি পড়েছিল| গার্লস্ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কোয়েড কলেজে পা; মনে ভয় আর আড়চোখে ছেলেদের দিকে ঈষৎ তাকানোর ভীতু অভিজ্ঞতা… সব মিলিয়ে মনের মধ্যে একটা চাপা টেনশন কাজ করছিল ! গুটি গুটি পায়ে ক্যাম্পাসের অডিটরিয়াম হলের দিকে এগোয় অস্মি; কেন যে বারবার ছেলেগুলোর দিকেই চোখ চলে যাচ্ছে… আর ছেলেগুলোই বা কেমন.. হাঁ করে অস্মিকেই দেখছে.. অবশ্য দেখবে নাই বা কেন… লাল ঢাকাইতে ওকে যা মিস্টি দেখাচ্ছে ! … মনে মনে নিজের একটু প্রশংসা না করে পারল না অস্মি! হলের মাঝামাঝি এসে যেই একটা চেয়ারে সবে বসতে যাবে…
‘মাডাম, লেডিস সিট দোতলায়…’

হতচকিত অস্মি এবার সব ছেলেদের ওকেই দেখার আসল রিসনটা বুঝতে পারল! আর এটাও বুঝতে বাকি রইল না যে উপর থেকে ওর এই বোকামির মজা নিচ্ছিল পুরো গার্লস্ ডিপার্টমেন্ট!

লজ্জায় অপমানে অস্মির আর কিছুই ভালো লাগছিল না; ধুর,দেখবই না প্রোগ্রাম.. অডিটোরিয়ামের গেটের বাইরে সবে পা দিতে যাবে…

“কি হল.. চলে যাচ্ছো যে.. প্রোগ্রাম দেখবে না !!”

চমকে পিছনে তাকাল অস্মি. . সুন্দর সুঠাম গঠন.. চোখা নাক…ঠোঁটের কোণে নির্ভেজাল হাসি…আর দৃষ্টিতে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ভাব; কোন ছেলের চোখ এত সুন্দর হতে পারে…আইডিয়া ছিল না অস্মির!  আস্তে আস্তে মুখ টা হাঁ হয়ে যাচ্ছিল…কোনওরকমে সামলে নিয়ে বলল… “হ্যাঁ …না ..মানে..ইয়ে…  …. ”

“আরে এই ছোট্ট ঘটনায় এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে!… এর আগে তো তুমি কলেজ ফাংশনে আসনি, তুমি জাননা; কোয়েড কলেজ হলেও.. ক্লাসরুম বা ক্যান্টিন ছাড়া অন্য কোথাও ছেলে মেয়েরা একসাথে ব’সে আড্ডা দিলেই প্রিন্সিপালের ধাতানি খেতে হয় !… তা প্রিন্সিপালের সাথে আলাপ হয়েছে তো নাকি !”

অস্মি আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল| ছেলেটি উপরে যাওয়ার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিল…

“By the way. …I am Rajot…and you?”

অস্মি এতক্ষণ..একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন… কোনওরকমে ঘোর কাটিয়ে বলল…”অস্মি ‘

“বাহ্, নাইস নেম| আমি বিকম অনার্স.. সেকেণ্ড ইয়ার.. তুমি কোন স্ট্রিম?”

-” বিএ ফার্স্ট ইয়ার”

-” হ্যাঁ ফার্স্ট ইয়ার তো বটেই,তবেই না ফ্রেসার্স ! তোমাদের ওয়েলকাম করতেই তো এত আয়োজন ! আর তুমি কিনা না দেখেই কেটে পরার তালে ছিলে ! Very bad!”

  অস্মি কিছু না বলেই হেসে উপরে চলে গেছিল| প্রোগ্রামে কি কি হয়েছিল..সেটা মনে পরে না; কারণ পুরো অনুষ্ঠানেই অস্মির চোখ রজত কেই খুঁজেছিল! যত বারই লাইট অন হয়েছে..রেলিং থেকে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করেছে অস্মি –বেশ বুঝতে পারছিল মন পাখীটা ছটফট করছে…উড়তে চাইছে|

এর পর অনেক বারই কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, স্পোর্স্ট, কলেজের যে কোনও অনুষ্ঠানে.. ওদের দেখা হয়েছে ঠিকই..কিন্তু কোনওদিনই অস্মি এগিয়ে গিয়ে জোর করে কথা বলার সাহস যোগাতে পারেনি|

একটা হাল্কা ভাললাগার মধ্যে দিয়েই দু দুটো বছর পার হয়ে যায় , রজতও কলেজ ছেড়ে ইউনিভারসিটি জয়েন করে… অস্মিকেও হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনায় ইতি দিয়ে চাকরির সন্ধানে বার হতে হয়; কলেজের টুকরো টুকরো ভাল লাগাগুলো আস্তে আস্তে স্মৃতির পটে আশ্রয় নেয়|

          কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ আবার রজতের মেসেজ টা যেন সেই স্মৃতিকে নতুন করে উস্কে দিল|

-” আমি রজত, চিন্তে পেরেছ তাহলে… কেমন আছ?”

-” আমি ভাল আছি, কি করছ এখন…আই মিন.. জব নাকি বিজনেস ?”

-“আমি একটা আইটি কোম্পানিতে আছি… এখন মুম্বাই তে পোষ্টিং.. তবে খুব শিগগিরি কোলকাতা তে ট্রান্সফার্ড হব |”

-“বাহ্, খুব ভাল| আমি একটা প্রাইভেট  স্কুলে পড়াই|”

-” তুমি এখনও বেহালাতেই আছ তো?”

রজত জানতো যে ও বেহালাতে থাকে! … একটু অবাকই হল অস্মি!… কিন্তু রজতকে সেটা বুঝতে না দিয়ে “হ্যাঁ” বলে রিপ্লাই দেয়|

এভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের বন্ধুত্বের সেকেণ্ড ইনিংস্! … প্রথম দিকে হাল্কা হাসি ঠাট্টা দিয়ে শুরু হয়েছিল ঠিকই …কিন্তু আস্তে আস্তে হাসাহাসি, খুনসুঁটির পর্ব সিরিয়াস মোড় নেয়|  প্রত্যেকদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওরা online  হতে থাকে… ফোনে নিয়মিত কথা বলতে থাকে… অস্মি জানতে পারে কলেজ লাইফ থেকেই রজত অস্মি কে পছন্দ করত…এমনকি অস্মি কখন ক্যান্টিন যাচ্ছে. ..কখন কলেজের পাশের দোকান থেকে মিস্টি দই কিনে খাচ্ছে…কাদের সাথে মিশছে… সবই নাকি ও খেয়াল রাখত…কিন্তু কখনও  অস্মিকে সরাসরি বলতে পারেনি |
অস্মি এইসব শুনে যতটানা অবাক হয়েছে…তার থেকে অনেক বেশি খুশী হয়েছিল…. ও নিজেও বুঝতে পারছিল যে ও আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছে|

… অস্মি আস্তে আস্তে এই মোড়ের মাথার সাইবার ক্যাফের এক রেগুলার কাস্টমার হয়ে ওঠে|

…” অস্মি, good news… আমি কোলকাতায় ফিরছি|”

    যেদিন রজত কোলকাতা ফেরে সেদিন  প্রথম রজতের উষ্ণ পরশ অনুভব করে অস্মি, সাবলীল ছিল ওদের আচরণ, মনে ভয় থাকলেও..অপরাধ বোধ ছিল না… মনে হয়েছিল এ ছোঁয়া অনেকদিনের চেনা… অনেক পরিচিত..অনেক আপন… সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয় দুজন দুজনকে…তখনও বুঝতে পারেনি… অস্মি; ওর জীবনের অশনি সংকেত উপস্থিত!

কখন যে সন্ধ্যে নেমে আসে,আকাশ কালো মেঘে গা ঢাকা দেয়..প্রথমে খেয়ালই করেনি অস্মি! .. রজতের উষ্ণ আবেশে আচ্ছন্ন ছিল মন| রজতের ফোনটা বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে পরেছিল… ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে…রজতের কোলকাতার ফোন নাম্বারটাই নিতে ভুলে যায় অস্মি. …রজতেরও তাড়া ছিল বাড়ি ফেরার..
এরপর প্রায় একমাস কেটে যায়….রজতের না কোন ফোন…না মেসেজ ….কি করবে অস্মি বুঝে উঠতে পারেনা… এর মধ্যে অনেকবার ওর আগের ফোন নম্বরে ডায়াল করে ফেলেছে…. ‘not available!’
প্রথম দিকে কনফিউসড হয়ে গেলেও আস্তে আস্তে অস্মি রিয়েলাইস করে…যেটা ওর কাছে গভীর নিগুড় প্রেম ছিল সেটা রজতের কাছে নিছক খেলা ছিল… রজত বোধহয়..কোনদিন ভালোইবাসেনি ওকে…কিন্তু এতদিন পর তাহলে কেন ও আবার অস্মির জীবনে ফিরে এল….আর সেদিনের সেই হাতে হাত দিয়ে প্রতিশ্রুতি…. সব মিথ্যে ছিল !…মন মানতে চায় না কিছুতেই…মস্তিষ্ক এক, আর মন আর এক দিকে টানতে থাকে অস্মিকে….আর এই টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে অস্মির যেন দম বন্ধ হয়ে আসে! নানা ভাবে নিজেকে বোঝাতে থাকে…নতুন নতুন যুক্তি  তৈরী করে মন…কিন্তু সেই ‘কেন’ র উত্তর কেউই দিতে পারেনা….না মন…না মাথা!

  এরমভাবে আরও ক’মাস কেটে যায়…. পুজো এ বছর খুব তাড়াতাড়ি পড়েছে… নিজের জন্য নয়…কিন্তু মায়ের জন্য একটা ভাল শাড়ী তো কিনতেই হয়… প্রতিবছর পাড়ার দোকান সাবিত্রী থেকে কিনলেও…এবারে মাকে নিয়ে শপিং মল থেকে শাড়ী কেনার ইচ্ছা অস্মির। সেইমত একদিন স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে মাকে নিয়ে দক্ষিণ কোলকাতার নামী শপিং মলে আসে অস্মি. .. সেখানেই মুখোমুখি হয় চরম সত্যের… বোধহয় অস্মির জন্যই ওঁত পেতে বসেছিল…. এক সুন্দরী তনয়ার হাত ধরে মল থেকে বেরোচ্ছে রজত| কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন এলোমেলো পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অস্মি। কোনদিন দেখা হলে সোজা ওর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল … ‘কেন এরম করলে?… কি দোষ ছিল আমার’….. বেরোল না কথা গুলো….গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে রইল….যখন ওই মেয়েটির হাতে নতুন শাঁখা পলা…আর রাঙা সিঁথি চোখে পড়ল!

        সেদিন রাতে রজতের ফোন আসে…. অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ বারের মতন রজতের ফোন রিসিভ করে অস্মি… ওপারে সেই পরিচিত হৃদয় কাঁপানো বহুদিনের চেনা গলা….

– ” বিশ্বাস কর অস্মি. ..আমার হাতে কিছু ছিলনা… বাবা মা সব কিছু আগে থেকে… তোমাকে ফেস করার সাহস ছিল না আমার.. তাই গা ঢাকা দি… কিন্তু তোমাকে ঠকাতে চাইনি আমি…. আমি… আমি…এখনও তোমাকেই ভালবাসি! “

অস্মি কোন সাড়া দেয় না…শুধু দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে|

– “আচ্ছা অস্মি… আমরা কি সারা জীবন বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনা ? আমি জানি তুমিও আমায় খুব ভালবাস….আমরা কি ‘Friends with benefits ‘ হয়ে থাকতে পারিনা ?!”

অস্মি ফোনটা কেটে দেয়|

“Friends with benefits” – টার্মটার সাথে প্রথম পরিচয় হয় অস্মির |

আজ মা গত হয়েছেন প্রায় তিন বছর… অস্মি একা থাকে…সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট… আজ সেসব কথা ভাবলে এটাই প্রথম মাথায় আসে
মানুষ কতটা স্বার্থপর!

– “কত হয়েছে ভাই?”

– “দিদি আপনি তো ডেটা ইউসই করেন নি…চুপ করে বসে ছিলেন….কিছু ভাবছিলেন মনে হল!…. কি হয়েছে?…  আপনার শরীর ঠিক আছে তো..?. কিছু দিতে হবে না…আপনাকে এতদিন ধরে চিনি..!”

বড় রাস্তায় পা রাখল অস্মি… ঘড়িতে তখন রাত আটটা! ক্যাফেটার দিকে একবার কি মনে হল ঘুরে তাকাল অস্মি; একদিন ও এই ক্যাফের রেগুলার কাস্টমার ছিল !

            Friends with benefits … আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির দিকে পা বাড়াল অস্মি|

লেখিকা ~উদিতি মজুমদার

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ static.independent.co.uk

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

One thought on “ভালোবাসার বুদবুদ

Comments are closed.