অটোগ্রাফ

Biography, Friends, Nostalgia, Short Story, বাংলা

“ট্যাক্সি চাপা পড়ে মরার শখ হয়েছে!কোথা থেকে আসে…সব”…তীব্র গতিতে ব্রেক কষে একবার দাঁড়িয়ে অশ্লীল একটা শব্দের সাথে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা বেরিয়ে যায় বিশ্রী দুর্ঘটনা বাঁচিয়ে।একটা সবল হাতের হ্যাঁচকা টান ততক্ষণে ফুটপাতে এনে ফেলেছে শঙ্করকে…থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বসে পড়েছে। অরোরা স্টুডিও থেকে বেরিয়ে সামনের দোকানটা থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে রাস্তা পেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোনোর সময় হঠাৎ ঘটে গেলো পুরো ব্যাপারটা। আসলে আনমনা শঙ্করের মাথায় ঘুরছিল স্টুডিও বাইরে নবুদার দামি সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বেশ ভারিক্কি চালে বলা কথাগুলো।

“শঙ্কর, অ্যাডে গাওয়াটা তুই ঠিক সিরিয়াসলি নিচ্চিস না। আগের হপ্তায় অতো বড় বিসকুটের অ্যাডটায় কি সব সুরটুর ঠিক না বলে প্রব্লেম করলি। তাও আমি আছি বলে মাথার তেলের নেকস্ট বিজ্ঞাপনটায় তোর চান্স পাকা..গলাটা ভালোই তো সব না।” বোঝার ভঙ্গীতে মাথা নেড়েছিল শঙ্কর। নবুদার  শেষ কথাটা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল সেই সন্ধ্যার ঘোষনাটায় “বাংলা গানের সবচেয়ে বড় রিয়্যালিটি শো, আমার বাংলা চ্যানেল আয়োজিত ‘সংগীতের সেরা প্রতিভার’ এ বছরের বিজেতা হল শঙ্কর সিংহরায়।” রাতের আকাশের রংটা সেদিন কালচে নীল নয়… আতশবাজীর রোশনাইতে রামধনু দেখেছিল শঙ্কর। যতীন মৈত্রের মত ভারতখ্যাত শিল্পী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অডিয়েন্সকে বলেছিলেন “দেখুন আপনারা পেতে চলেছেন পরের প্রজন্মের বাংলা প্লে-ব্যাক তারকাকে…তাই বলছি অটোগ্রাফটা আজি নিয়ে রাখুন।”

প্রথম তিন-চার মাস এসেছিল কিছু স্টেজ শোর ডাক কোলকাতা আর জেলা শহরগুলো থেকে, কালীপূজোর পর থেকে সিজন শেষের দিকে যেতে থাকলে ধীরে ধীরে তাতেও ভাঁটা। না শঙ্করকে প্লে-ব্যাক গাইতে ডাকেনি কেউ।…পাড়ার মানিক ঘোষ ডেকে বলেছিল অবশ্য “মাচায় গাইবে তো চলে এসো। মাসে চারটে শো…টলিপাড়ার সব বড় স্টারদের স্টেজ ধরিয়ে দিই আমি। যাতায়াত আর রাতের খাওয়া বাদে টোটাল চল্লিশ। পাড়ার ছেলে তায় চ্যাম্পিয়ন…তাই এত দেব।” শেষ কথাটায় প্রশংসা না ব্যাঙ্গ কোনটা বেশী ছিল ধরতে পারেনি শঙ্কর। প্লে-ব্যাকের স্বপ্নে বিভোর বাংলার সম্ভাব্য তারকা অবশ্য আমল না দিয়ে ফিরে এসেছিল। তবে হ্যাঁ, যেতে তাকে আবার হয়েছিল,যখন প্রায় ছমাস বসে থাকার পরেও যখন না চ্যানেল না কোন শো পার্টি তাকে কল দিল; যখন যতীন মৈত্রকে করা ই-মেলের বা ফোনকলের কোন উত্তর পেল না শঙ্কর, যখন চ্যাম্পিয়নশীপের পঞ্চাশ হাজার টাকাটা শেষ হলেও হাসপাতাল বাবার নিথর দেহটা নিয়ে যেতে কল দিল; যখন “বাবু সংসারটা চালানোর জন্য কিছু একটা দ্যাখ” বলে মায়ের কাতর কলটা আর অস্বীকার করা গেল না। পান ক্ষওয়া দাঁতে হেসে মানিক ঘোষ বলেছিল “যাক শো এর জন্য এ অধমকে দরকার তবে হল। কিন্তু স্লট তো নেই বাপু…রথের পর এস।” হতমান মুখ নিয়ে বেরনোর সময় ঘোষের অ্যাসিস্টেন্ট নবুদা আড়ালে ডেকে বলেছিল “যদিও তুই এত ভালো সিঙ্গার তাও বলছি দরকার যখন অ্যাডে গান গাইবি? পেমেন্ট ভালো।” সেই নবুদাও কিনা আজ বেরোনোর সময় শুনিয়েছে “এদ্দিনে তো বুঝেছিস যে বিজ্ঞাপনেই করে খেতে পারবি। সিনেমাতে গান গাইতে চান্স পাবি আর লোকে তোর সই নিতে ছুটবে ওসব স্বপ্ন ছাড়।”

“জলটা খেয়ে নিন” সবল হাতের অধিকারী মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোকের মুখের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে বাড়ানো বোতলটা থেকে জল খেল শঙ্কর… মধ্যবিত্ত ভদ্র মুখাবয়ব। “এখন একটু ঠিক আছেন?” সস্নেহ কণ্ঠের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে গিয়ে পরের কথাটায় অবাক হয়ে যায় সে “এরকম আনমনে রাস্তা পেরোবেন না আর। আপনার মত গুনী গায়কদের কিছু হয়ে গেলে খুব খারাপ হবে।” ভদ্রলোক তাঁর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা শঙ্করকে লক্ষ্য করে বলেই চলেছেন “আপনাকে দেখেই দূর থেকে চিনেছি ‘সংগীতের সেরা প্রতিভার’ গতবারের চ্যাম্পিয়ন শঙ্কর সিংহরায়। আমি, আমার গিন্নী, মেয়ে সবাই আপনার বড়…কি যেন বলে ইয়ে…ফ্যান।” প্রশংসার বিনিময়ে ম্লান হেসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় শঙ্কর…ভদ্রলোক  বুক পকেট থেকে এক চিলতে কাগজ আর ডটপেনটা সহাস্যে বাড়িয়ে ধরেছেন “প্লিজ, একটা অটোগ্রাফ।”

 

লেখক পরিচিতি ~ তথাগত চ্যাটার্জী

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ media.mnn.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds