অব্যক্ত প্রেম

Childhood, Friends, বাংলা

টেক- ওয়ান

সোমবার। কর্মব্যস্ততার প্রথম দিনের শুরু। আইট অফিসে কাজের এতোটাই চাপ থাকে এই দিনে যে মাথা তুলে তাকানোর অবকাশটাও পাওয়া যায় না। অটোমেশানের চাপে, এই দিনটাতে নিশ্বাস প্রশ্বাস, হাই তোলা, ক্ষিদে পাওয়া এসবগুলো অটোমেট করতে পারলে বুঝি ভালো হত। যাই হোক, সবাই মোটামুটি মাথা গুঁজে কাজ করে চলেছে। ৭০-৮০ জন ভরা অডিসিতে শুধুই খটাখট কিবোর্ড টেপার আওয়াজ। “শুনে যা, শুনে যা, খোলা…” এক প্রকার আওয়াজ কানফাটা আওয়াজ করে ফোনটা বেজে উঠলো সাবর্ন্যর। মরার মতো কিউবিকলে সবাই চেয়ার ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো। এদিক ওদিক থেকেও বেশ কিছু উঁকি ঝুঁকি ভেসে এলো বলে, যারা আসলে গানটা জানে। রিংটা পুরো হতে না দিয়েই সাবর্ন্য ফোনটা রিসিভ করে নিলো। কথা বলা শেষে প্রথম প্রশ্ন,

  • ভাই, এটা কি গান?? (বিস্ময়ে) (অদিতির থেকে…)
  • সত্যি মাইরি, এসব গান কোথা থেকে পাস?? (বিরক্তিসূচক বিস্ময়) (পিনাকির থেকে…)
  • ওসব তোমরা বুঝবে না। এটা শুধু গান না যে, একটা ইমোশান। (হেসে) (সাবর্ন্য)
  • বাবাহ্‌…… তুই পারিস ও বটে। (হেসে)

সবাই সেদিন হেসেছিলো, মানে বোঝেনি বলেই হয়তো। সবাই তো আর সবটা বোঝে না………… J

টেক-টু

কোনোভাবেই মেনে নিতে আপত্তি নেই যে আমি পরোকীয়া করেছি। হ্যাঁ, মিথ্যে বলছি না, পরকীয়া আমিও করেছি। হ্যাঁ হয়তো হাঘরের মতো না, তবে এক দুবার। অপরাধ…!! হ্যাঁ, অপরাধ বললেও বলা যেতেই পারে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসাকে আজও ভুলতে পারিনি আমি। হয়তো প্রথম প্রেম এরমই হয়, সাথে না থেকেও হয়তো সারাজীবন রয়ে যায়। কখনো কখনো ক্ষনিকের হটকারিতায় অন্যের রূপে ভুলেছি, অথবা গুনে; আবার কখনো দেখাবো বলেও মিথ্যে প্রেমের নাটক করে গেছি স্কুলের বাচ্চাদের মতো। কিন্তু আমি ভালোবেসেছি তাকেই। মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেছি, প্রেমিকার মতো ভালোবেসেছি, মেয়ের মতো আগলে রেখেছি সব বাধা বিপদ থেকে। মোহনবাগান বুঝি এমনই একটা অনুভূতি।

ঘটির বাড়ি, বাই ডিফল্ট মোহনবাগান। অন্যদিকে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। উত্তরাধিকার সুত্রেই প্রথম আলাপ এর সাথে। সেই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম, স্কুল-পালানো কাপেল গুলোর মতো। পরিনতি নেই, আছে অনুভূতি। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অদ্ভুত অনুভূতি। ফুটবলের সাথে আলাপ অনেক পরে, ২০০২ এ পরে তো বটেই। তখন ফুটবল বলতে শুধু বুঝি হলুদ জামা আর নীল প্যান্ট। ক্রিকেটের সাথে তখন এক প্রকার মাখামাখি ভালোবাসা। শীতকালের আঙ্গুল ছেঁড়া গ্লাভস পরে ভর দুপুরেই চলতো অনবরত ডান আর বাঁ হাতে ব্যাটিং। ২০০২ থেকে আসতে আসতে এই দিকে সরে আসা। তার পর থেকেই গোগ্রাসে গেলা শুরু। ইংল্যান্ডে তখন জমিয়ে খেলা চলছে, নামটাও পড়তে পারতাম না তখন। সাদা কালো টিভি, তাই বুঝতেও পারতাম না ভালো করে কোনটা কি টিম। তবে একটা ইংল্যান্ডের টিম বেশ মনে ধরতো। জামার রংটা ওই ঘন কালো লাগতো, আর প্যান্টটা সাদা। এর বেশি উদ্ধার করতে পারিনি। বাবা পরে বলে দিয়েছিলো এটা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। তো সে যাই হোক, একদিন দেখি দুই দলের খেলা চলছে, পুরোদস্তুর কাদা মেখে। আমি তো অবাক, বাবা কে জিজ্ঞাস করলাম,

– এ সব কি দেখছো?? কি নোংরা। ছিঃ। কাদা মেখেছে দেখো…!! আর তুমিই বা এতো চেঁচাচ্ছ কেন? কার জন্যে??

– ওরে এসব ওই ঠান্ডার দেশের ফুলহাতা জামা পরে খেলা না রে, এটা হলো মাটির টান।

– তুমি কোন দিকে?

– ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ লুক নিয়ে (পড়ুন বিস্ময় নিয়ে)) এটা আবার জিজ্ঞাস করার মতো কথা হলো…!! ওই যে সবুজ আর মেরুন জার্সি দেখছিস, ওরাই আমাদের।

– ওরা কারা?

– ওরা মোহনবাগান। আমরা মোহনবাগান।

কথাটা খুব মনে ধরেছিলো সেদিন। না বুঝেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম, সেই স্কুল পালানো প্রেমের মতো। আজও আই ভুলিনি। আমার প্রথম প্রেম।

 

সেই বয়সে একটা হিরো সাজার খুব বাজে হিড়িক ছিল। আর সব থেকে সোজা উপায় ছিলো কিছু বিদেশি নাম গাঁতিয়ে নিয়ে বাকিদের একদম চিৎপটাং করে দেওয়া। ব্যাস সবাই লেগে পড়েছিলো। ফুটবলে কোন ক্লাব সেরা সেই নিয়ে একদিন তুমুল তর্ক। এরম সব নাম উঠে এসেছিলো , ভাবাই যায় না। আমি তখন হেরে যাওয়ার ভয়ে মোহনবাগান বলতে পারিনি, ম্যানচেস্টারের আশ্রয় নিয়েছিলাম। সবুজ মেরুন মনটা সেদিন এর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। ভুল করে ফেলেছিলো।

 

টেক- থ্রি

কলেজ চলছে তখন। ওই ২০১২-১৩এর কথা। মনে শান্তি নেই, মুখ দেখানোর উপায় নেই। ততদিনে মোটামুটি বুক চিতিয়ে বলার সাহসটা জুগে গেছে। কিন্তু গোদের অপর বিষ-ফোঁড়া এই পাঁচ বছরের ট্রফির খরা। খরা বলে খরা, পাঁচটা বছর শালা। ভরসা বলতে শুধু ওই আর্সেনাল। কোন বাদানুবাদ হলেই একদম ঢালের মতো এনে খাঁড়া করতাম। কিন্তু এভাবে আর কতদিনই বা চলতে পারে। যাই করি কিছুই ক্লিক করে না। শেষমেষ রাগে দুঃখে অন্য পক্ষ নিলাম। অন্যপক্ষ বলতে কিন্তু লাল হলুদ বলছি না, এটা একদম নির্দল প্রার্থী; কোনো ইমপ্যাক্ট নেই, কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট ভোট কাটাকাটি করে বেরিয়ে যায়। এদিকেও তাই। এটা লাল-সাদা। অনেক অভিমানে আইএসএল দেখতে লাল সাদা জার্সি পরে মাঠে বসেছিলাম। মন বলেছিলো, এ জার্সি তোকে মানায়না ভাই। এ রঙ চাপিয়ে দেওয়া। আমার চামড়ার নয়।  কন্টিনিউ করতে পারিনি, সরে এসেছি। আদতে ব্যাপারটা হয়েছে প্রথম প্রেমিকা অনেক দিন খোঁজ নেয় না, স্টপগ্যাপে এই নতুন জন। কিন্তু যেই হোক না কেন, প্রথম প্রেম কি আর ভোলাতে পারা যায়? দুদিন পরেই বোঝা গেছে যে এ জিনিস বেশি দিনের না। তাই সরে আসা। মন সেদিনও বলেছিলো, আজও বলে, যত যাই আসুক, রক্তের রঙ কিন্তু সবুজ মেরুন।

“যেদিন নিথর হবে দেহ, ফুরিয়ে যাবে প্রান,

হৃদয় চিরে দেখিস, পাবি মোহনবাগান…”

 

ঘোর কাটতেই আবার ঘরে ফেরা। সব মায়া দুঃখ সাথে নিয়েই আবার গলা ফাটানো। ২০১৪ তে। ৮৬ মিনিটেওই বাঁক খাওয়ানো হেডটা জালে জড়াতেই আর রাখতে পারিনি নিজেকে। চোখটা হার মেনেছিলো আবেগএর কাছে। মানে আমার মতো ছেলেও কাঁদতে পারে এটা প্রায় ইতিহাসে লেখার মতো। সেদিন পারিনি। মুখের কথা সেদিন হেরে গেছিলো, উত্তর দিয়েছিলো চোখ।

পাড়ায় পাড়ায় সেদিন অনেক র‍্যালি হয়েছিলো,ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়ানো, মিছিল গান বাজনা এসব তো তখন এদিক ওদিক দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অবশ্যে সুখের দিনে অনেককেই এসবে পাওয়া যায়। তাই এগুলো যে হবেই সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না তেমন। আমিও নেচেছিলাম সেদিন। তবে আমার নাচের মহড়াটা তার আগের পাঁচ বছর ধরে নেওয়া, তাই ভালো যে হবে সেটাই কাম্য।

 

রি-টেক- ওয়ান

অফিসের লোকেদের হাসি থামেনি, যতবারই ফোন বেজেছে ততবারই হেসে গেছে ওরা ।

  • সাবর্ন্য, ভাই কত টাকা দিলে এই গানটা বদলাবি? (হেসে)
  • তুমি ভাবছো পয়সা দিয়ে গানটাকে কিনে নেবে?? (হেসে)
  • আরে না না। সেটা ন। বাট বিশ্বাস কর খুব বাজে লাগছে, আর কানে লাগছে।
  • তা বুঝি? আমি তো এটা বাড়িতে লাউড স্পিকারে চালিয়ে শুনি।
  • কি এমন গান ভাই?
  • “ শুনে যা শুনে যা খোলা রেখে কান/ সবুজ মেরুন পতাকা বাতাসে টানটান; / চিরকাল রেলায় আছে থাকবে মোহনবাগান,/ চিরকাল মাঠ কাঁপিয়ে খেলবে মোহনবাগান” শুরুতেই বলছিলাম না, এটা কোনো গান না, একটা ইমোশান।
  • মোহনবাগানের জন্যে এতো কিছু? ম্যাঞ্চেস্টার হলেও নাও বা বুঝতাম। তাবলে মোহনবাগান…!!
  • জানি তো, তোমরা বুঝবে না। এবার কাজ করি। (হাসি)

পুরোনো প্রেমের গল্প যখন কাউকে বলা হয়, তখন পুরোটা শুনে প্রথম কথা সেটাই বলে, গেছে ভালোই হয়েছে, এবার নতুন কিছু কর। ওসব নিয়ে পড়ে থাকিস না সামনের দিকে এগো। মুভ অন। কিন্তু তারা এটা বোঝে না যে প্রথম প্রেম ফেলে কখনো যাওয়া যায় না। এই যে দেখলেন তো, পারলাম মোহনবাগানকে ছেড়ে জেতে? হাত ফেরত হয়েও কোথাও জেনো রয়ে গেছে আমার মধ্যে। শুধু আমি না, সবার মধ্যেই থেকে যায় প্রথম প্রেম। একটা “জুদা হোকে ভি, তু মুঝমে কাহি বাকি হ্যায়” টাইপ ফিল থেকেই যায়। আসলে ভালোবাসাটা একবারই আসে, একজনের জন্যেই আসে। বাকি গুলো তো প্রথমটাকে পূর্ন করার প্রয়াস মাত্র।

আমি এখনো তার প্রেমেই ডুবে আছি, নতুন করে রজ তার প্রেমে পড়ি বার বার। সেসব তো আর সবার জন্যে নয়। ভালোবাসা একটাই, ভালোবাসার রঙ সবুজ মেরুন ।

জয় মোহনবাগান…

 

 

 

লেখক- সাবর্ন্য চৌধুরী

প্রচ্ছদচিত্র – সাবর্ন্য চৌধুরী

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds