কিছু খুচরো লেখার চেষ্টা

Freedom, Friends, Journey, Love Story, Short Story, বাংলা

(১)

এই শহরের ফুটপাথে ওরা হেঁটে গিয়েছিলো । শহর দেখেনি তাদের । শহর দেখেও দেখেনা । ওদের কথাগুলো কোথাও মুক্তোর মত কোথাও বা আরশির ভাঙ্গা কাঁচের মত ঝরেছিল ফুটপাথে । সে অনেকদিন আগের কথা । তোমার বয়স তখন আট কি নয় । সদ্য শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছ তুমি । প্রেম মানে তখনও বোঝোনা । শুধু দুচোখ ভরে দেখেছিলে তাদের । দামাল হাসি আর নীলচে চোখ দুটো নজর কেড়েছিল তোমার । তুমি হয়ত ভেবেছিলে তাকে তোমার পাশে । আলসে দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে কত বার তাকে কল্পনা করেছো আর বার বার নোংরা করেছো নিজেকে । নাম জানোনা, আর জেনেই বা কি করতে ? সে তো তোমার ধরা ছোঁয়ার অনেক দূরে । আর তাই তো, চিরকাল অন্যের মাঝে তাকে ভেবে ব্যর্থ করেছো তোমার ভালবাসা । কামুক সেজেছ, প্রেমিক সাজতে পারনি ।
আজ, বছর কেটেছে অনেক । এখন তুমি যুবক । তরতাজা বাইশ টা বছর তুমি দেখেছ নিজের লাম্পট্যের । নিজের চোখে অনেক নেমেছ । নগ্নতা দেখে দেখে তোমার চোখ ক্লান্ত । নিজের সংসার ভাবতে ভয় হয় তোমার । এর পর…

 

(২)

একটা ফানুস উড়ছে আকাশে । ঘুপচি ঘরের জানলা দিয়ে মেয়েটা অপলক দেখে চলেছে তাকে । এ পাড়া দিয়ে লোকে বেশি যাতায়াত করেনা । এখানে ভদ্রলোকের আসা মানা । বাইরে থেকে খদ্দেরের ডাকাডাকিতে নজর ঘোরালো সে । দরজা খুলতেই মধ্যবয়সি মাতাল ঘরে ঢুকলো । ধীরে ধীরে শুরু হল শরীর খেলা । বয়স নিয়ে কিছু আসে যায় না । উত্তরপ্রদেশের গ্রাম থেকে যখন তাকে ধরে আনে, তখন ছিলো নয় বছর । সে তো আজ ছয় বসন্ত আগের কথা । প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিলো । পালানোর চেষ্টা ও করেছিলো । পারেনি । তারপর থেকে এটাই বাড়ি, এটাই ঘর । রোজ রাতে আসে অতিথিরা । ভোর হলে চলে যায় । শরীরে দাগ রেখে যায়, ভালোবাসার । আজ ফানুসের দিকে চোখ রেখেই সে ব্যস্ত শরীর খেলায় । লম্পটটা ছিঁড়ে নিচ্ছে তার শরীরটাকে । যন্ত্রণাএ কঁকিয়ে উঠলো একবার । ফানুসটা তখনও মধ্য আকাশে । ধিক ধিক করে জ্বলছে আগুনটা । ভোরের দিকে এগোচ্ছে রাত । একটা সময় মিলিয়ে গেলো ফানুস । মাঝবয়সি মাতালও শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো পাশে । বিবস্ত্র হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পনেরো বছর বয়সটা । নিজেকে বড় ভয়ঙ্কর লাগলো দেখতে । তারপর নিজেই নিজেকে গ্রাস করলো বয়স পনেরো । আর…

 

(৩)

নগ্নতাকে তুমি চিনেছ কিছুটা নিজের মত করে । ভালোবাসো নগ্ন শরীর । জীবন বিজ্ঞান বলতে বুঝতে জনন আর হরমোনের চ্যাপ্টার । সেই তুমি একদিন বড় হলে । এত বড় যে চারদিকের অনুভূতিগুলো তোমার হাঁটুর কাছে এসে থামল । এবার তুমি শরীর চিনলে । নিজের । ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে নিজেকে । শক্ত হতে দেখলে, দুর্বল হতে দেখলে । নিজেকে পুরুষ বলে বেশ বাহবা দিলে নিজেই । কামসূত্রর ধারে তুমি কোনদিনই যাওনি । অতটা শিক্ষা তো অর্জনই করা হয়নি তোমার । তাতে তোমার বিন্দু মাত্র আক্ষেপ নেই । তুমি পুরুষ, তুমি সবল । এরপর একদিন উদ্ধত তুমি ঢুকে পড়লে আর এক শরীরে, ছিন্নভিন্ন করলে । প্রবল বিক্রমে চালালে নিজের ঔদ্ধত্ত । রেপিস্ট বলে গাল দিলে থোড়াই কিছু যায় আসে তোমার । তুমি না পুরুষ । প্রবল যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকা দেহটা ছুঁড়ে ফেললে রাস্তায় । স্নান করলে, শুদ্ধ হলে । তারপর তুমি এসে দাঁড়ালে পুষ্পাঞ্জলির মঞ্চে “ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেণ…” ।

 

(৪)

ওই মেয়েটাকে তুমি ভালবাসতে । নিজের থেকে বেশি । বিশ্বাস করতে, শ্রদ্ধা করতে । ওর হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার সময় নিজেকে কত বার অচিরেই বলেছ “সাবধান” । ওর বুকের ওড়না সরে বিপদ উঁকি দিলেই নিজের থেকে সতর্ক হয়েছো বহুবার । বিপদের ঘোর লেগেছে তোমার চোখে-মুখে, প্রত্যেক চুম্বনের পরে । ঘাসের আংটি পরিয়ে সোহাগ করেছো প্রণয়ের । মাথায় আলতো চুমু এঁকে প্রশ্রয় দিয়েছ সকল দামাল আবদারকে । তারপর একদিন ছাদনাতলায় মালাবদল করে, সিঁথিতে লাল টুকটুকে সিঁদুর দিয়ে ঘরে এনে বউ করে তুললে । সংসার জীবন শুরু হল তোমার । দায়-দায়িত্বে জর্জরিত তুমি । অশান্তির পারদ চড়তে না চড়তেই তোমার মেজাজ সপ্তমে । আর তারপর অষ্টম, নবম সকল স্তর পেরিয়ে তোমার প্রিয় মানুষটা তোমারই ঘরের সিলিং থেকে নিথর হয়ে ঝুলে । আজ এক বসন্ত, দুই শীত আর তিনটে গ্রীষ্ম পেরোনোর পর তোমার শোভাযাত্রা চলেছে এ শহরের রাজপথে । বাজনায় বেজে চলেছে “আজ মেরে ইয়ার কি সাদি হ্যা…

 

(৫)

সেই যে গোলাপটা মেয়েটার হয়ে মিথ্যে বলেছিলো । বহুদিন পর কাল তার সাথে দেখা হল । পুরনো ডাইরির ফাঁকে অপেক্ষা করছিল । ছেলেটা কিছু একটা লিখবে বলেই বোধহয়, পাতা উলটাতেই দেখা হয়ে গেলো । আর একটা পোড়া বিকেলের ঝাঁজালো গন্ধে ভরে গেলো পুরো ঘরটা । সিগারেটের ধোঁয়া, চাপা কান্না আর বেশ কিছুটা দীর্ঘনিঃশ্বাসে ভর করে গোলাপি একটা ওড়না নীল সাইকেলে চেপে ঘরময় ঘোরাঘুরি করতে লাগলো । ছেলেটা তখন প্রাণপণে স্মৃতির পাতা উলটে চলেছে । গঙ্গার পাড়ে পড়ন্ত আলোয় দুটো ছায়া । ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা মুখগুলো । কথার পিঠে কথা সাজিয়ে তৈরি করছে স্বপ্নমহল । ইটভাঁটার ধিকধিকে ধোঁয়াটা সেই স্বপ্নমহলের খিড়কির ঠিক উলটো পাড়ের কথা শোনাচ্ছে যেন । স্বপ্নেরও বয়স বাড়ে । বাড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাসের বয়স । বয়স বাড়েনা প্রেমিকের । ডায়েরির মাঝে লুকানো গোলাপগুলো তাই তো হাজারো পোড়া বিকেল এনে ভিড় করে বারে বার…

 

(৬)

তোমার শহর বদলায় না । বদলাতে পারেনা । মুখোশ বদলায় । মুখ বদলায় না । ধর্ষণ ব�দলায় । ধর্ষক ব�দলায় না । এক ১৬ যায় আর এক ১৬ আসে । ধর্ষণ জমা হয় আদালতে আদালতে । এরপর সেলাই মেশিন, নাবালক, সহানুভূতি পেরিয়ে ধর্ষক ফেরে ঘরে । রোল মডেল হয়ে কলার তুলে ঘুরে বেড়ায় সে । দাপিয়ে বেড়ায় সমাজ । আর ঘরের কোণে কুঁকড়ে থাকে তোমার মেয়েগুলো । তুমি হয়ত জ্বলে উঠতে পারতে । পারতে উদ্ধত পুরুষত্বকে এক কোপে নামিয়ে সকল ধর্ষকের কলারগুলো নামিয়ে দিতে । বিশ্বাস করো তুমি পারতে । কিন্তু তুমি তো সামাজিক, এসব যদি তুমি করো তবে কাল সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাগজের পাতায় খবর খুঁজবে কে? তুমি বরং মোমবাতি জ্বালো । প্রার্থনা করো ধর্ষিত আত্মাদের শান্তির । তারপর এক লম্বা নামের লিষ্ট তৈরী কোরো । নির্ভয়া, দামিনী আরও কত কি । আসল নাম জানতে চেও না । যদি তোমার মেয়ের, বোনের কিংবা তোমার প্রেমিকার নামের সাথে মিলে যায়…

 

(৭)

একটা ফোন আসার কথা ছিলো । সত্তর বছর বয়সটা দালানে চেয়ার নিয়ে অপেক্ষায় । আর কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে কেটি পেরির মিউজিকে উদ্দাম নাচে ব্যস্ত বছর তেত্তিরিশের মদ্যপ । কর্মব্যস্ত জীবন । তার ফাঁকে হাল্কা বিনোদন এই পার্টিগুলো । এ শহর ইমোশন বোঝেনা । চেনে ডলারের গন্ধ । তাই তো মাসের প্রথমে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন পৌঁছে দেয় এক খাম দায় । তাই দিয়েই এখানের খরচ খরচা চলে । দুধের স্বাদ মেটে ডলারের ঘোলে । নাতি নাতনী শব্দগুলো পূর্বজন্মে শোনা কোন রূপকথার চরিত্র বলে মনে হয় । মাস যায়, বছর যায় । আস্তে আস্তে বিদায় নেয় সঙ্গী সাথীরা । এ বয়সে বিয়োগ ছাড়া অন্য কোন হিসাব মেলেনা । অপেক্ষা, আরও অপেক্ষা, তারও বেশি অপেক্ষা । শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম । গ্রীষ্ম-শরৎ-হেমন্ত । এরপর একদিন পোড়া কাঠের ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে ওঠে শূন্যতা । উগ্র ধূপের গন্ধ ব্যস্ত হয়ে ওঠে শান্তি পৌঁছে দিতে । কিছু সময় গেলে ফাঁকা ঘর আবার ভরে ওঠে নতুন আসবাবে, নতুন অতিথিতে । নতুন অপেক্ষা সঙ্গী করে ।

 

(৮)

দিন তিনেক হলো এ শহরে এসেছো । প্রায় একই আছে শহরটা । বেশ কিছু উঁচু বাড়ি আকাশে উঁকি দিচ্ছে, তবে তারা নতুন বাসিন্দা পরিচয় নেই তোমার সাথে । আজও শহরটায় এলে সেই পুরনো শিহরণ জাগে । দূরত্ব তো অনেক দিনের । তবুও । ভিক্টোরিয়া, শহীদ মিনার মনে রাখেনি তোমায় । মনে রেখেছে আমার চব্বিশ বছর বয়সটা । পুরনো কফির কাপগুলো, চায়ের ভাঁড়গুলোও মনে রেখেছে সেদিনটা । আজ চুলে পাক ধরেছে । চশমায় বাস্প জমেছে । হাঁপিয়ে উঠি কিছুদূর গেলে । তোমাকে আজ বড় সুন্দর দেখাচ্ছে । বয়স হয়েছে । এককালের যে ঘন কালো চুলে সন্ধ্যা নামতো দিন দুপুরে । সেখানে আজ খয়েরি আর সাদা অভিজ্ঞতাদের ভীড় । তোমার ছেলে মেয়েরা বিলেতে । ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছে ওরা । সেই সকল গল্পেই কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে খেয়াল হয়নি । এবার ফেরার পালা । ক্লান্ত ট্রাম, বেসামাল দিন আর বহু স্বপ্নের সিনিয়র সিটিজেন্ সিট…

 

(৯)

প্রেম করছে ওরা । ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে ডুবে যাচ্ছে একে অপরের মধ্যে । কামড় দিচ্ছে কানের লতিতে । হাঁপিয়ে উঠছে চুমু খেতে খেতে, হাঁপাতে হাঁপাতে আবার জাপটে ধরছে দুজন দুজনকে । নগ্ন করছে অন্য জনকে । চোখ ভর্তি তৃষ্ণা । আর চোখ ভরা ঘৃণা নিয়ে তুমি আড়চোখে দেখছো বার বার । তোমার ব্যলকনি থেকে ঘরটা দেখা যায় । তাই তোমার অধিকার উঁকি দিয়ে দেখার । ওরা তোমার দিকে চেয়েও দেখেনি । আদর আর ভালোবাসা মাখা শরীর পার করে তুমি দেখতে পেলে দেওয়ালে লেখা “Love has no gender. Take whoever loves you. Whoever makes you happy, who cares?” ছিঃ ! ঘৃণা আরও বেড়ে গেলো । গা গুলিয়ে উঠলো । ভাবলে তোতন ভাগ্যিস ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলো নাহলে সমাজে মুখ দেখাতে কেমন করে । নাহ্ আর ভাবতে পারছো না । ক্লান্ত পায়ে ফিরে এলে । গায়ের চাদরটা টেনে দিলে তোতনের গায়ে । অক্সিজেন মাস্কটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিলে । চেয়ারে বসে শুনতে পেলে ভেসে আসছে গান । আহা, এ বড় প্রিয় গান তোমার । “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়, বাজায় বাঁশি ….”

 

(১০)

এ শহরটা বড় দ্রুত বদলাচ্ছে । চেনা মুখগুলো সবাই শহর পাল্টেছে । বিভিন্ন শহরে অচেনা মুখের ভীড়ে হারাচ্ছে রোজ । নিজের বিছানা বালিশ চাদরের চেনা গন্ধ ছেড়েছে ওরা । নিজের যাপন ছেড়েছে । রুটি রুজি আর ক্যরিয়ার এই ত্রিভুজের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে রোজ । হাঁপিয়ে উঠছে কিছু সময় গেলে । দম নিতে ছুটে আসছে নিজের শিকড়ের কাছে । আর দম নেওয়া শেষ হলে । আবার সেই ত্রিভুজ । শিকড় তাদের টানলেও অনন্ত মুক্তির স্বাদ আর এক রঙিন কাঁচ মোড়া নতুন শহর ফিরতে দেয়না এদের । সময় পরিযায়ী বানায় । আর ঘরের আদরের মুখটা কখন যে অতিথিতে বদলে যায় সময় নিজেও বলতে পারেনা । এরা তোমার আমার খুব পরিচিত মুখ, এরা সেই ভালোছেলের দল যাদের পড়ার কথা, মনযোগের কথা শুনে তুমি বড় হয়ে উঠেছ । বারবার ভেবেছো এর মতো রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দেবে সকলকে । সেটা হয়নি, আর তাই তো নিজের চেনা গলি, চুন খসা দেওয়াল আর মায়ের আঁচলের হলুদের গন্ধ নিয়ে তুমি পড়ে আছো আশৈশবের এ শহরে কোন পরিযায়ীর সুখের গল্প শুনবে বলে ।

 

 

লেখক ~ সুমন চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদচিত্র ~ s-media-cache-ak0.pinimg.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds