খুনি

Freedom, Friends, Red, Short Story, বাংলা

ডাকাতরা যখন চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল লাজকন্যার তখন খুব বয় করতে লাগল…
হারে রে রে রে রে ….. কি বয়ানক চিৎকার…
আর ঠিক তখনই …তবেরে….বলে ইয়া মস্ত বড় তলোয়াল নিয়ে …লাজকুমাল হাজিল!!
সবার মুণ্ডু কেটে লাজকুমালি কে উদ্ধার করে লিয়ে গেল….

“আচ্ছা মা… সবসময় লাজকুমার ই কেন লাজকুমালীকে উদ্ধার করবে ?…. লাজকুমালও তো অনেক সময়ে বিপদে পরতে পারে !…. তখন লাজকুমালকে কে বাঁচাবে ?”

…. পরীর মা এবার পরল ফাঁপড়ে! এতক্ষণ এক নাগাড়ে নিজের দু চারটে পুতুলকে শ্রোতা বানিয়ে বড়বাবুর দেওয়া টাট্টু ঘোড়াটার উপর চোড়ে সুন্দর করে গল্প বলে যাচ্ছিল পরী; এই ফাঁকে নিজের কাজ সেরে নিচ্ছিল সুলতা… কিন্তু এবার ব্যাঘাত ঘটল তাতে… আদর করে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে সুলতা বলল… ‘কেন অনেক সময় তো রাজকুমারকে রাজকুমারীও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে!’
–‘কই শুনিনি তো কখনও’…
–‘সে গপ্প কোনদিনও ছাপা হয়না মা..সে কথা কেউ মনেও রাখেনা’..পরীর অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বলে সুলতা|

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজেকে যতই উদার বলে গলা ফাটাক না কেন… আদপে সেই নতুন রাংতায় মোড়া পুরনো চকলেট!

সুলতার এখন টাটকা স্মৃতি… যেদিন ধানকলে আগুন লাগানোর ঘটনায় গোটা গ্রাম বটি কাটারি নিয়ে বড়বাবুকে কাটতে তেড়ে এসেছিল… সেদিন এই সুলতাই বুদ্ধি করে ওকে নিজের গোয়ালে লুকিয়ে ওঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল…  আর আজ স্বামির আকস্মিক মৃত্যু সুলতাকে সেই বড়বাবুর বাড়ির আর দশটা কাজের লোকের সাথে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে… তবে শুধু কাজের লোক বললে ভুল বলা হবে…. আজ ওর আরও একটা পরিচয় আছে…. ‘বড়বাবুর দাসী!’
ওর জীবনে প্রতিটা রাত এখন অনেক বেশী কালো…অনেকটা লম্বা….  অথচ… একদিন এই সুলতার হাতেই বড়বাবু প্রাণে বেঁচেছিলেন… সে কথা তিনি বেমানুম ভুলে গেছেন… পিতা হারা দুধের শিশুটিকে উনি আশ্রয় দিয়েছেন …এটাই এখন ধ্রুব সত্য| তাই পরীর মুখ চেয়ে সুলতা এখন সব অভ্যেস করে নিয়েছে…কিন্তু আর কতদিন….পরীও তো বড় হচ্ছে… ওর বোধবুদ্ধি বাড়ছে….এসব চিন্তা মাঝে মাঝে সুলতাকে  উতলা করে তোলে!

“কি ভাবছ মা?”- পরীর ডাকে হুঁস ফেরে সুলতার,
“কিছু না মা…তুমি খেলা কর… আমি একটু কাজ সেরে নিয়ে তোমায় খেতে দেব|”
“তুমি খাবে না ?”
পরীর এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুলতা নিজের কাজে মন দেয়|  সত্যিই আজকাল সুলতার খেতে ইচ্ছে করেনা… শরীরটাও কদিন হল ভাল যাচ্ছে না… কিছু খেতে গেলেই গা পাক দিয়ে ওঠে… সারাদিন ঘুমোতে ইচ্ছা করে… এসব তো প্রথমবার মা হওয়ার সময়ে হয়েছিল… ও কি তাহলে…আবার…নিজের অজান্তেই সুলতা যেন শিউরে ওঠে… না.. এবার বড়বাবুকে বলতেই হবে… এসব বন্ধ করতেই হবে… কিন্তু উনি যদি না মানেন… যদি মাথার ছাদটা কেড়ে নেন… পরীর কি হবে !! পরীর চিৎকারে সুলতার হাত থেকে দুধের বাটিটা পরে যায়…ছুটে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় সুলতা…
দরজায় টলমল..বড়বাবু লোলুপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরীর দিকে…. পরী বরাবরই ভয় পায় ওঁকে! এক ঝটকায় পরীকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে সুলতা..
-“আপনি এখন!”
-“কেন….কি হয়েছে…আমার বাড়ি…যখন ইচ্ছা আসতে পারি… আর তুইও আমার.. যখন ইচ্ছা….”
-“দোহাই আপনার বড়বাবু…এসব বন্ধ করুন….আর নয়…”
-“কেন রে! অন্য বাবু জুটিয়েছিস নাকি?…তা তোর মেয়েটিতো বেশ ডাগর হয়ে উঠছে রে সুলতা” ….. সুলতার আলগোছে করা খোঁপা খুলে দিয়ে বড়বাবু বললেন…
মনের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত কর  ঘুরে দাঁড়ায় সুলতা…
-“বেরিয়ে যান …এখনি চলে যান এখান থেকে.. অনেক সহ্য করেছি…. মেয়ের মুখ চেয়ে মেনে নিয়েছি সব…আর আজ কিনা এই একরত্তি মেয়ের উপরেও চোখ পরেছে আপনার! ..একখুনি বেরিয়ে যান…নাহলে …”
-“নাহলে কি করবি তুই….চিৎকার করবি…নাকি লোক ডাকবি?… শোন …আমার এক কথায় এখানে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়…আর তোর স্বভাব চরিত্তি সব্বাই জানে…চুপচাপ থাক…ভালই তো রেখেছি তোকে..অল্প বয়সে বিধবা… সবই তো বুঝি…”
আর সহ্য করতে পারেনা সুলতা… ঠাঁটিয়ে এক চড় কষিয়ে দেয় বড়বাবুর গালে… ছোট্ট পরীর চোখের সামনেই ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায় ওর মা আর বড়বাবুর … হিংস্র সিংহের মতন ঝাঁপিয়ে পরে বড়বাবু ওর মা এর উপর…মাকে বাঁচাতে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ও… নিজের খেলনা চাকুটা নিয়ে তেড়ে আসে পরী… কিন্তু ততক্ষণে  যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে…. রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে… ভয়ে ছোট্ট পরীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে.. মা বলে চিৎকার করতে যায়…গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না….

…”আমি খুন করেছি…আমি খুনি”… বলে কান্নায় ভেঙে পরে সুলতা|

-“না মা… তুমি খুন করনি… তুমি থিক করেছ!”.. ছুটে এসে মা কে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট পরী|

যদি এভাবেই দুষ্টের দমন করা যেত…তাহলে সমাজের প্রতিটি কোণায় সুলতাদের হয়ত খুনি হয়ে উঠতে হত না!

লেখিকা ~ উদিতি মজুমদার

প্রচ্ছদচিত্র উৎসtopyaps.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds