শিকার

Friends, Journey, Protest, Short Story, Subhra's Chronicles, Thriller, বাংলা
..ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই শরীরটা এলিয়ে দিলাম সিটে। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ, ড্রাইভারের সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নাম্বারটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম….

 

১।

 

দিনটা ছিল ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৬। প্রতিবারের মত এইবারও সকালটা বরাদ্দ ছিল পরিবারের জন্য আর রাতে প্ল্যান ছিল স্কুলের বন্ধুদের সাথে কোনও নামকরা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার। যদিও চাকরি করি প্রায় ৩ বছর হয়ে গেল তবুও কেন যেন এইসব বিশেষ দিনগুলোতে বন্ধুদের বাদ দিয়ে অফিস কলিগ দের সাথে সময় কাটাতে মন চায় না।

 

ঘড়িতে তখন রাত আটটা বেজে দশ মিনিট। আমার লেক গার্ডেন্সের বাড়ি থেকে বাবার বাইকটা নিয়ে বেরলাম। এমনি সময়ে বাস, অটো বা ট্যাক্সিতেই যাতায়াত করি, কিন্তু আজকের দিনটায় পার্ক স্ট্রিটের যানজটের যা সুনাম (?), তাতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের উপর বিশেষ ভরসা হল না আমার। তাই বাইক-ই একমাত্র বিকল্প; সহজে এদিক ওদিক দিয়ে গলে যাওয়া যায়।

 

আমার গন্তব্যস্থল পার্ক স্ট্রিটের নামকরা রেস্তোরাঁ-কাম-বার ‘ম্যাডলি বাঙালি’। বড়জোর তিরিশ-চল্লিশ মিনিট লাগল পোঁছতে। রেস্তোরাঁর বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আমার বন্ধু আশিস। বাইকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্ক করে দুজনে ভেতরে ঢুকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দলের বাকীরাও অর্থাৎ কুণাল, সায়ন, অর্ণব, শৌভিক রা এসে পড়ল; আর তারপর জমে উঠল আমাদের আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া। খাবারের সাথে রঙিন পানীয় বেশ কিছুটা পেটে পড়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই শরীরটা খানিক বেসামাল হয়ে পড়েছিল। অভ্যেস না থাকলে যা হয় আর কি…

 

রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। যদিও নেশা টা কাটেনি পুরোপুরি আর তাই বন্ধুরাও বারণ করছিল, তবু খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই ওদের বিদায় জানিয়ে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

 

রাস্তায় মানুষের ঢল কমে এসেছে অনেকটা; আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তা, ঝলমল করছে রাতের কলকাতা। আমার বাইক ময়দানের পাশ দিয়ে ছুটছিল পক্ষীরাজের মত। সামনের ট্র্যাফিক সিগনাল টা সবুজ থাকতে থাকতেই বেরিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে ব্রেক কষতে হল।

 

নিরাশ হয়ে লাল সিগনালের নিচে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে পাশে একটা ট্যাক্সি এসে থামল। এমনিতে ময়দানের এদিকটা একটু অন্ধকার। তবু তার মধ্যেই দেখলাম ট্যাক্সির সবকটা কাঁচ তোলা। শীতের রাতে সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়, তবে আর একটু ভাল করে দেখতে গিয়ে যেটা আমার মনে সন্দেহ জাগাল তা হল ট্যাক্সির পিছনের সিটে পড়ে থাকা একটি মেয়ের দেহ। তার মুখ না দেখতে পেলেও এটুকু বুঝলাম যে তার পরনে হলুদ রঙের কিছু একটা রয়েছে কারণ অন্ধকারেও সেই হলুদ রং আমার চোখে ধাঁধাঁ লাগাচ্ছিল। আরও দেখলাম যে ড্রাইভারের নাক মুখ কালো রুমালে বাঁধা। কিন্তু মেয়েটি সজ্ঞান নাকি বেহুঁশ; সুস্থ নাকি অসুস্থ সেসব কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিগনাল সবুজ হয়ে যাওয়ায় ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল। কী মনে হওয়ায় আমিও খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছু নিলাম ট্যাক্সিটার। অসম্ভব তীব্র গতিতে ছুটছিল ট্যাক্সিটা। নেশার ঘোরটা না কাটায় ঝাপসা চোখে আমিও তারমধ্যেই যতটা জোরে চালানো সম্ভব, চালাচ্ছিলাম আমার বাইক। কিন্তু অনেকটা দূর অবধি ধাওয়া করেও তারপর আর পারলাম না। স্পিড কমিয়ে বাইকটাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে নেশাগ্রস্ত চোখে দেখলাম ট্যাক্সিটাকে দূরে মিলিয়ে যেতে। আর নির্জন রাস্তায় আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, একা। চারিদিক নিস্তব্ধ আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা, সাথে শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। হঠাৎ মনে হল, কোথায় আমি?

 

২।
কোনওমতে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন।

 

২রা জানুয়ারি, ২০১৭-

 

সকালে উঠে চা-এর কাপে চুমুক দিয়ে কাগজটা দেখছি। ভেতরের পাতার তলার দিকের একটা খবরে হঠাৎ চোখটা আটকে গেল। লেখাটা ছিল এরকম যে, হেস্টিংসের কাছে একটি মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে; টাকাপয়সা, গয়না-গাটি লুঠ করে মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। খবরটা পড়ে আমার সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ে গেল। সেই মেয়েটি নয় তো?

 

পরে নিউজ চ্যানেল দেখে জানতে পারলাম যে, মৃত মেয়েটির নাম ছিল প্রিয়া। পুলিশ তদন্তে জানিয়েছে, ৩১শে ডিসেম্বর পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁর সামনে থেকে একটি ট্যাক্সি ধরে সে। রেস্তোরাঁর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ড সেটা নিজের চোখে দেখেছে। রাত পৌনে একটা নাগাদ মেয়েটির মা তার কাছ থেকে একটি কল পায়, যাতে মেয়েটি তার মা কে জানায় যে সে ট্যাক্সি পেয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তার পর থেকেই তার নাম্বারে যতবার রিং করা হয়েছে, ফোন সুইচ্ড অফ পাওয়া গেছে।

 

বারকয়েক মেয়েটির জীবন্তাবস্থার ছবি দেখাল নিউজে, আর তার সাথে দেখাল তাকে মৃত অবস্থায় যেভাবে উদ্ধার করা হয়েছে সেই ছবি। আর তখনই আমি বুঝতে পারলাম যা ভাবছিলাম সেটাই হয়েছে। সেদিন রাতে মেয়েটির মুখ না দেখতে পেলেও তার পরনের হলুদ কাপড় আমার চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়েছিল। আর টি.ভি. তে দেখানো উদ্ধার করার পরবর্তী অবস্থার ছবিতে মেয়েটির পরনেও সেই হলুদ কাপড়।

 

সব দেখেশুনে আমার মনে হল এটা ওই মেয়েটি আর ওই ট্যাক্সিটা ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা। গাড়িতে যাত্রী তুলে অন্যপথে নিয়ে গিয়ে লুঠ করে মার্ডার, আর তারপর মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে রেখে যাওয়া, এরকম কেস আগেও দু’বার হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পুলিশ দু-দু’বারই অসমর্থ থেকেছে খুনী কে ধরতে। আমি সেদিন বাইকে করে পিছু নেওয়ার সময়ে ট্যাক্সির নাম্বারটা দেখেছিলাম, কিন্তু এখন আর মাথার চুল ছিঁড়েও কিছুতেই সেটা মনে করতে পারছি না। নেশার ঘোরে যা দেখেছিলাম তার মধ্যে ১, ৯ আর ৩ এই ডিজিট গুলোই এখন চোখের সামনে ঘোরা ফেরা করছে।

 

পরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও নাম্বারটা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, আবার ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বের করে দিতেও পারলাম না।

 

৩।
৮ই জানুয়ারি, ২০১৭-

 

দেড়টা থেকে দুটো টিফিন টাইম অফিসে। টিফিন সেরে হাতে আর যে দশ মিনিট থাকে জিরোবার জন্য, সেই সময়টায় কানে হেডফোন গুঁজে এফ.এম অন করে ঘাড়টা চেয়ারে এলিয়ে বসেছিলাম। সবে একটু হালকা তন্দ্রা মত এসেছে, হঠাৎ, হেডফোনের ওপাশ থেকে বেজে উঠল অঞ্জন দত্তের সেই বিখ্যাত গান, ‘এটা কি ২৪৪-১১৩৯, বেলা বোস তুমি পারছ কি শুনতে..’, আর সাথে সাথেই বিদ্যুচ্চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই ট্যাক্সির নাম্বারটা। ইয়েস, সেটা ছিল ‘w-১১৩৯’। পুলিশের কাছে গিয়ে এটা বলতে পারলে তারপর সেই ট্যাক্সির চালক কে খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে জলভাত। সেদিন ব্যর্থ হলেও মনে হল এবার আমি এমন কিছু একটা করতে পারব যাতে সেদিনের সেই নিরীহ মেয়েটা এবং তার মত আরও অনেকে এবার বিচার পায়।

 

সেদিন অনেক রাত হয়ে গেল অফিস থেকে বেরোতে। মনে হল থানায় আজ আর এত রাতে গিয়ে লাভ নেই, কাল সকালে বরং অফিস আসার আগে থানায় ঘুরে আসা যাবে। এখন অফিসে কাজের চাপ অনেক। আর আই.টি সেক্টরে অফিস ছুটির কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। তবু এত কাজের মধ্যেও অফিসে অনেকের সাথে আলোচনা করেছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু সবাই একটাই শলা দিল, ‘থানা-পুলিশ করিস না। অনেক ঝামেলা, অনেক হাঙ্গামা। ভুলে যা ওসব।’ কিন্তু একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের ছেলে হয়ে আমি কি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে থাকতে পারব?

 

রাত তখন বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। কোনও অফিস ক্যাব না মেলায় বাধ্য হয়েই একটা ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই শরীরটা এলিয়ে দিলাম সিটে। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ, ড্রাইভারের সিটের পেছনে লেখা ট্যাক্সির নাম্বার টা চোখে পরতেই চমকে উঠলাম… ‘w-১১৩৯’। মাথাটা কেমন বোঁ করে ঘুরে গেল। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকেই কেমন যেন একটা মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম। সবকটা স্নায়ু ধীরে-ধীরে অবশ হয়ে আসার আগে বুঝতে পারলাম ওটা ছিল ক্লোরোফর্ম। বুঝতে পারলাম সেদিন রাতে ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাক-মুখ রুমাল দিয়ে কেন বাঁধা ছিল। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখলাম লেকটাউন ছাড়িয়ে ট্যাক্সি ঝড়ের গতিতে দমদমের দিকে ছুটে চলেছে। কিন্তু, আমার বাড়ি তো.. চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পাবার আগে শুধু একটাই কথা মনে এল আমার, ‘তাহলে কি.. এবার আমি?’

 

 

Author ~ Subhra Raha. Born on 27th April, 1992, at Kolkata, West Bengal. A B-Tech Graduate from St. Thomas College of Engineering & Technology, Kolkata, currently working at Cognizant as a Programmer Analyst. Besides reading and writing stories and poems, Subhra also loves to play Cricket. Cooking and Travelling are also there among his hobbies. Connect him at – [email protected] or follow him @subhra.raha.35

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ upload.wikimedia.org

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds