অঙ্ক কি কঠিন

Anirban & Arijit, Biography, Childhood, আদতে আনাড়ি, বাংলা

আজ একটা অদ্ভুত গল্প বলব। একটা অঙ্কপাগল লোকের গল্প। না না, বিশ্ববিখ্যাত কোনো ম্যাথামেটিশিয়ান নয়, আমাদের চেনাজানা শহরেরই একজন।

সিলি মিসটেক। এই গেরো টা কে কাটাতেই পারছিলাম না, আর তার মধ্যেই মাধ্যমিক এসে হাজির। শীতলাতলা বারোয়ারি তে সাপ্তাহিক ইনভেস্টমেন্টের ওপর ভর করে উতরে তো দিলাম ভালোভাবেই, কিন্তু বাপির মাথায় ভাঁজ পড়ল। এই ছেলে হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক কি ভাবে সামলাবে, একজন ভালো টিচার তো লাগবেই। তাই খোঁজ খোঁজ!

বাবার বন্ধু খোঁজ দিল সুধাকর বাবুর, বলল জাত মাল পুরো, পরীক্ষার আগে সাজেশান যা দেয়, সব ওর থেকেই আসে। কোচিং-এ নোট ফেলে দেয়, সবাই টোকে, মাসের শেষে টেস্ট। অঙ্কের নোটস! স্যাট করে বাতিল হয়ে গেল।

এহেন বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর আমি আর বাবা যখন দুজনেই হাল ছাড়তে উদ্যত, ঠিক তখনই খোঁজ পাওয়া গেল অঙ্কপাগল সেই লোকটার। সপ্তাহে খুব লিমিটেড ব্যাচ পড়ান, তবে ভর্তি হতে গেলে উনি পরোখ করে নেন আগে, ছাত্র পছন্দ না হলে দূর করে দেন। কিন্তু যারা সুযোগ পায়, তাদের আর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

এহেন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে আমিও হাজির হলাম স্যারের বাড়ি। গলির ভেতর একখানা দোতলা বাড়ি, বাইরে ৫ খানা সাইকেল হেলান দিয়ে রাখা, চৌকাঠ পেরোতেই ৫ জোড়া চপ্পল ডিঙিয়ে এসে পড়লাম স্যারের ঘরে।

ঘরের ৫০% জুড়ে একটা ইয়াব্বড়ো পালঙ্ক গোছের খাট। সেই খাটের লাগোয়া ডাইনিং টেবিলের চারদিকে ছাত্ররা বসে, দুজন আবার খাটেই। টেবিলের অপরপ্রান্তে চোখে চশমা, কাঁচা পাকা চুল নিয়ে স্যার বসে।

– কি চাই?
– স্যার, আমি আপনার কাছে পড়তে চাই।
– কোন স্কুল?
– বিবেকানন্দ স্যার।
– মাধ্যমিকে কত হবে মনে হচ্ছে অঙ্কে?
– স্যার ৯০ তো হয়েই যাবে মনে হচ্ছে।
– মনে কেন হচ্ছে?
– না মানে স্যার, আসলে….
– এদের কাউকে চিনিস?
– স্যার অনির্বাণ আর প্রসেঞ্জিত কে চিনি।
– কি করে চিনলি?
– স্কুল আর পাড়ার বন্ধু স্যার।
– বোস দেখি ওই টুল টা টেনে।

কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে, অনির্বাণের কাছে পরে শুনলাম অন্যদের নাকি রীতিমতো স্যার পরীক্ষা নেন, আর আমাকে বোধহয় মুখ দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল আমাদের জীবনের একটা অন্যতম অধ্যায়, স্যার অশোকবাবুর কোচিং।

লোকটা কোনদিন স্কুলে পড়াননি, শুরু থেকেই টিউশান করতেন, কিন্তু ওনার পড়ানোর স্টাইল দেখলেই বোঝা যেত ওনার ক্যারিশমা। একটা অঙ্ককে অন্তত পাঁচরকম ভাবে করে দেখাতেন, টেবিল চাপড়ে, হাত নেড়ে, ঘুঁষি পাকিয়ে, গালি দিয়ে এমনভাবে বোঝাতেন যেন মনে হত উনি ঢুকে গেছেন অঙ্কটার মধ্যে।

এহেন লোকেরও দিন খারাপ যায় বৈকি। পড়লেন সিঁড়ি দিয়ে, ফ্র‍্যাকচার হল শিড়দাঁড়ায়। জাস্ট ২ মাস রেস্ট নিয়ে আবার কোনরকমে দাঁতে দাঁত চিপে লেগে পড়লেন পড়াতে।

“আমি যখন বোঝাব কিছু, তখন আমি কোথায় কোন্ কথা জোর দিয়ে বলছি, সেগুলো খেয়াল করবি। থেমে যা!!” বলে টেবিলে হাত চাপড়ালেই আমরা বুঝতাম টার্নিং পয়েন্ট এসে গেছে অঙ্কটার, খেলা যেকোন দিকে ঘুরতে পারে এবার।

তবে ওনার কোচিং-এ যেতে এত ভালো লাগার পেছনে আরও কিছু কারণও ছিল। স্যারের দোতলায় আমাদের পেন ফাইটিং এর আসর বসত প্রতিদিন স্যার যতক্ষণ না নীচে ওনার ঘরে ডাকছেন, তার আগে অবধি। পড়া হয়ে গেলে স্যারের থেকে বাদাম কেনার টাকা সংগ্রহ করতে আমাদের বন্ধু ভীমুর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম আজও ভুলতে পারিনি।

বয়স বেড়েছে, কিন্তু অশোকবাবুর অদম্য ইচ্ছাশক্তি আজও একইরকম রয়ে গেছে। আজও উনি একইভাবে বেছে বেছে ছাত্রদের নেন, আর তারাও খেলার ছলে শিখে যায় নতুন নতুন অঙ্কের টিপস। সিলেবাস কতো বদলে গেছে, স্যারও নিজেকে সবসময় নতুন সিলেবাসের সঙ্গে আপগ্রেড করে নিয়েছেন, কিন্তু বদলাননি ওনার শেখানোর স্টাইল। তাই আজও ভালো লাগে যখন বোনের বন্ধুর কাছে শুনি স্যারের হরেক রকমের গল্প।

আমরা হয়তো বিউটিফুল মাইন্ড টিভি তেই দেখেছি, বা শকুন্তলা দেবীর বই ছুঁয়ে দেখেছি, কিন্তু আমরা খুব লাকি যে হাওড়ার কাসুন্দিয়া শিবতলার কাছে অশোকবাবুর মতো একজন অঙ্কপাগল লোকের হাতে আমরা সবচেয়ে কঠিন সাবজেক্ট টা এতো মজা করে শিখতে পেরেছি। তুলনা টা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল মনে হচ্ছে? হায়ার সেকেন্ডারি তে পটাপট সব অঙ্ক নামিয়ে বাইরে এসে শুনেছিলাম যে প্রশ্নপত্র নাকি বেশ শক্ত হয়েছিল, হাঁসব না টেনশান করব সেদিন বুঝতে পারিনি, স্যারকে গিয়ে বলতে উনি বলেছিলেন এটা শোনার জন্যই উনি অপেক্ষা করছিলেন।

আজও স্যার একইভাবে একই উদ্যমে নিরলস ভাবে অঙ্ক শিখিয়ে যাচ্ছেন। এগিয়ে যান স্যার, আপনার মতো কারিগর না থাকলে আজ আমাদেরও হয়তো অঙ্ক মুখস্থ করে নামাতে হত।

এতটা পড়ার পর যদি কারুর মনে হয় যে অঙ্কের টিচার ভালো পাওয়া যাচ্ছে না, বা অশোকবাবুর কাছে গেলে উনি ভর্তি নেবেন কিনা, তাহলে একবার গিয়ে ওনাকে এই গল্পের কিছু অংশ বলে দেখো না, ধন্যবাদ না হয় পরে জানিও।

ওই দেখো, কথায় কথায় বলতেই ভুলে গেছি ওনার সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে। +919874393189 এ ফোন করে কথা বলো, রেফারেন্স হিসেবে আমার আর অনির্বাণের নামও বলতে পারো। না না, আমরা কমিশান পাই না, ওনার কাছ থেকে যা পেয়েছি তাতেই আমরা ধন্য।

 

লেখক ~  অরিজিত গাঙ্গুলি