হিস্ট্রির মিস্ট্রি – ৫ ~ মোনালিসা কোথায়!
২২শে অগাষ্ট, মঙ্গলবার, ১৯১১
ল্যুভর মিউজিয়াম, প্যারিস
লম্বা করিডরটার মাঝ দিয়ে হনহন করে হাঁটছেন মঁসিয়ে বেনেডিট। হাঁটা না বলে দৌড়নো বলাই ভাল। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে করিডরের পাশের বিশাল থাম গুলোর ভুতের মতো ছায়া পড়েছে। মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় এখন, চারিদিক বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মার্বেলের মেঝেতে বেনেডিটের বুটের আওয়াজই দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে।
করিডরের শেষেই বাঁদিকে উঠে গেছে চওড়া সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি শেষ হচ্ছে গ্র্যান্ড গ্যালারিতে, আর তারপরেই একটা বেশ বড় ঘরে। এর নাম সাঁলো কারে, বা চৌকো ঘর। ঘরের দেওয়াল জুড়ে একের পর এক দারুন পেন্টিং ঝুলছে। কি নেই সেখানে, মিকেল অ্যাঞ্জেলো, দা ভিঞ্চি, বতিচেল্লি থেকে শুরু করে রেমব্রা, কি নেই এখানে। সাঁলো কারের পূর্বদিকের দেওয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড আঁন্দ্রে, কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
-কি ব্যাপার আঁন্দ্রে? আমাকে আজকে একটু জলদি বেরতে হবে। এখন না ডাকলেই হত না?
আঁন্দ্রের মুখটা ফ্যাকাশে, বেনেডিটের কথা গুলো কানে গেল না ওর। শূন্য দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে সামনের দেওয়ালটার দিকে। লাল দেওয়ালটাতে পাশা পাশি ঝোলানো আছে ছবি গুলো। শুধু একটা জায়গা ফাঁকা, সেখানে চারটে পেরেক পোঁতা আছে। ফাঁকা জায়গাটার দুপাশে ঝুলছে তিতিয়ানের আঁকা অ্যালিগরি অফ ম্যারেজ আর রাফায়েলের আঁকা সেন্ট জর্জ। আর দেওয়ালের রংটাও অনেকটা গাঢ়। আরেকটা ছবি যে এখানে ঝোলানো ছিল সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
– ওহ, এই ব্যাপার, এখানে লিওনার্দোর আঁকা সেই প্রোট্রেটটা ছিল না?
– হ্যাঁ।
– এখন নেই বলে ঘাবড়ে গেছ তো, আমি কাল সকালেই ছবিটাকে ঝুলতে দেখেছি, দেখ ওপরের ঘরে ফোটো তোলার জন্য হয়ত নিয়ে গেছে।
আঁন্দ্রে সেই শূন্য দৃষ্টি নিয়েই এবারে তাকাল বেনেডিটের দিকে, তারপরে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
– আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওখানে মসিয়েঁ, ওদের কাছে নেই ছবিটা।
– তাহলে কি পরিষ্কার করার জন্য নিয়ে গেল?
– না ওখানেও নেই।
– কি বলছ তুমি!
– মিউজিয়ামের যেখানে যেখানে ছবিটা থাকা সম্ভব আমরা খুঁজে ফেলেছি, কোথাও নেই।
হতভম্ব বেনেডিটের মুখ থেকে এর পরে তিনটে শব্দ বেড়িয়ে এসেছিল,
“এলে এস্ট পার্তি”,
মেয়েটা আর নেই!
ফেব্রুয়ারি, ১৫১৭
ক্লোস লুসে নামের একটা বাড়ি, ফ্রান্সের মাঝখানে অ্যাম্ব্রয়েস নামের একটা ছোট শহরে।
-এই মেয়েটি কে?
রাজা প্রথম ফ্রান্সিস মিলান জয় করেছেন। আর ইতালির শ্রেষ্ঠ সম্পদকে তাই হাতছাড়া করেন নি, মাস দুয়েক হল লিওনার্দো ফ্রান্সিসের সাথে এখানে এসেছেন, এখানে থাকবেন আরো কয়েক বছর । রাজার একটা অদ্ভুত আবদার তাকে রাখতে হবে। একটা ধাতব সিংহ বানিয়ে দিতে হবে যেটা নাকি হাঁটবে আর তার বুক খুলে বেড়িয়ে আসবে এক গোছা লিলি। সেই কাজই চলছে। তাছাড়া লিও নিজের সাথে বেশ কিছু অর্ধেক আঁকা ছবি নিয়ে এসেছেন এখানে। সেগুলোরও কাজ চলছে একটু একটু করে। ফ্রান্সিস আজকে লিওর ওয়ার্কশপে সেই কাজ দেখতেই এসেছিলেন, কিন্তু তার চোখ আটকে গেছে আড়াই ফুট বাই দেড় ফুট মাপের একটা ছবিতে। পপলার কাঠের ওপরে আঁকা এক মেয়ে। চেয়ারে বসা, তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। শান্ত চোখ,স্মিত হাসি।
– ইনি লিসা ঘেরার্দিনি, ফ্লোরেন্সের ফ্রানসেস্কো দেল জ্যাকোন্দের স্ত্রী, ওনারই অনুরোধে প্রোট্রেটটা আঁকা শুরু করেছিলাম বছর বারো আগে।
– বাহ, আঁকার পরে ফেরত দিলেন না ছবিটা? বগলদাবা করে নিয়ে চলে এলেন ফ্রান্সে?
লিও একটু হেসে বললেন,
– ফেরত তো দিতামই, কিন্তু কাজই শেষ হয়নি যে এখনো।
লিওর কাজ শেষ হয়েছিল বটে, কিন্তু লিসার ছবিটা তার মালকিনের কাছে আর পৌঁছয়নি, ২ রা মে, ১৫১৯শে পৃথিবীতে লিও সময় ফুরিয়ে যায়, এই ক্লোস লুসেতেই। তার প্রায় সব কটা কাজই নিজের কাছে রেখেছিলেন তার শিষ্য সালাই। লিও মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরে সে ফ্রান্সের রাজার কাছে বিক্রি করে দেয় ছবিটা। তখন সবাই ছবিটাকে চিনত লা জ্যাকোন্দে বলে, তবে মোনালিসা নামটা এল আরো বছর কুড়ি পরে, লিওর গুনমুগ্ধ ভক্ত ভাসারি যখন তার জীবনী লিখলেন ১৫৫০ সালে। মোনা শব্দটা ম্যাডোনার অপভ্রংশ। বাংলায় এর ভাল প্রতিশব্দ পাইনি । ইংরাজীতে লেডি বলা যায়।
রাজার হাতে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর মোনালিসার জায়গা বদল হয়েছে অনেক বার, কিন্তু সবই ফ্রান্সের মধ্যে। ভার্সেই প্যালেসে বেশ কিছুকাল, তার পরে টিউলারিসে নেপোলিয়নের বেডরুমের দেওয়াল ঘুরে লেডি লিসার জায়গা হয় ল্যুভর মিউজিয়ামে, ফরাসি বিপ্লবের পরেই। তারপর থেকে ওখানেই বাস। সালোঁ কারের ঘরেতে আরো গোটা কুড়ি ছবির মাঝে। কিন্তু সেই ছবিই একদিন চুরি হয়ে গেল।
কিভাবে?!
২১শে অগাষ্ট, ১৯১১, সোমবার
প্যারিস।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম গুলোর একটা হল প্যারিসের ল্যুভর, স্যেন নদীর পাশে ৫০ একর জমির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় চারশোর ওপরে গ্যালারিতে ঠাসা কয়েক লাখ দর্শনীয় বস্তু , কেউ কেউ বলে সব খুঁটিয়ে দেখতে গেলে একটা গোটা জীবন কেটে যাবে।
সোমবার দিনটায় ল্যুভর দর্শকদের জন্য বন্ধ থাকে। সেদিন মিউজিয়ামে পরিষ্কার হয়, তাই হাতে গোনা কয়েকজন কাজের লোক, কিউরেটর আর কিছু গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। সবার পরনে সাদা ঢিলে পোষাক যাকে স্মক বলে। আর বাদবাকি দের সাথে ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়াও সেদিন ল্যুভরে ঢুকল। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির লম্বা রোগা পাতলা চেহারা, মোটা গোঁফ। বাঁ চোখের নিচেতে একটা কালো জরুল। তার পরনেও সাদা স্মক। কয়েক বছর আগে ভাগ্যিস এখানে সাফাইয়ের কাজ করত ও। তাই স্মকটা সাথেই ছিল!
ডানদিকের ডেনন উইং দিয়ে মিউজিয়ামে ঢুকেই ভিনসেঞ্জো সোজা চলে এল দোতলায়। উঠেই ডানদিকে গ্র্যান্ড গ্যালারি, আর তারপরেই সালোঁ কারে। ঘরটাতে ঢুকেই কিছুক্ষন হাঁফালো ও, প্রায় এক নিঃশ্বাসে এতোটা পথ চলে এসেছে। কেউ দেখেনি তো! কে আর দেখবে? এদিকটা একদম ফাঁকা। আর কেউ দেখলেও ভাববে মিউজিয়ামেরই লোক। এবারে আসল কাজটা।
বাঁদিকের দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইল ভিনসেঞ্জো। এই ছবিটাই ওর জীবনটাকে বদলে দেবে! দেওয়ালে টাঙানো বাকি ছবি গুলোর তুলনায় এটা সবচেয়ে ছোট, তাই লুকিয়ে রাখাও সহজ হবে। তাই এটাকেই বেছে নিয়েছে ও।
ছবিটা শুধু মাত্র চারটে বড়-সর পেরেকের ওপরে ঝোলানো ছিল। টুক করে দেওয়াল থেকে নামিয়ে আনতে খুব একটা কসরত করতে হল না, একটু ভারী এই যা। নামিয়েই আগে ফ্রেম আর ওপরের কাঁচের কভারটা খুলে ফেলল। বেড়িয়ে এল ভিতরের আয়তকার পপলার কাঠের প্লেটটা। মোনালিসা এবারে ভিনসেঞ্জোর হাতের তালুতে! মুখে একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু এখন হাঁ করে মোনালিসাকে দেখার সময় নেই, এখনি কেউ এসে পরতে পারে। চট করে নিজের গায়ের ফ্লকটা খুলে ওটাতেই জড়িয়ে নিল ছবিটাকে।
একতলায় নামার চওড়া সিঁড়িটা ব্যবহার করা যাবে না এখন আর! তবে ঘরের পিছনেই একটা ছোট প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। মিউজিয়ামের কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য। ওটা দিয়েই নামতে থাকল। সিঁড়ির শেষে একটা বন্ধ দরজা, বেশ পুরোনো। এইটার একটা ডুপ্লিকেট চাবি ভিন্সেঞ্জো আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছিল। চাবিটা নিয়ে এসেছে তো? হ্যাঁ প্যান্টের পকেটেই আছে, এবারে টুক করে… কিন্তু একি! চাবি দিয়ে তো দরজাটা খুলছে না! তাহলে কি তালাটা বদলে ফেলেছে এরা! কি হবে এবার?! অনেক টানাটানির পরে দরজার হাতলটাই খুলে হাতে চলে এল। আর তখনই পায়ের আওয়াজ পিছন থেকে।
সিঁড়ি দিয়ে কেউ একটা নামছে!
——————————————————————
২
গ্র্যান্ড গ্যালারির পাশের টয়লেটে একটা জলের পাইপ ফেটেছিল, তাই ডাক পরেছিল সভেতের। সেই কাজ শেষ করে সভেত নেমে আসছিল একতলায়, পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়েই একটু থতমত খেয়ে গেল। ওর দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছে একটা লোক। কপাল দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পরছে, বাঁ চোখের নিচের জরুলটায় যেন চোখ আটকে যায়।
– ব জঁ মসিয়েঁ।
-ব জঁ।
-কি ব্যাপার খুব ঘামছেন দেখছি।
– হ্যাঁ এই জায়গাটাই এমন গুমোট না, দেখুন না ফ্লকটাকেও খুলে ফেলতে হল।
– তা ঠিক, কিন্তু হাতে দরজার হাতলটা নিয়ে কি করছেন?
– আর বলবেন না, আজকে চাবিটা আনতে ভুলে গেছি, ভাবলাম আদ্দিকালের দরজা, একটু টান মারলেই যদি খুলে যায়। তো টান মারতে গিয়ে এই হল।
– দরজা আদ্দিকালের হলে কি হবে, ভিতরের তালাটা খুব শক্তপক্ত, বছর চারেক আগেই কয়েকটা আইবেরিয়ান মূর্তি চুরি হয়েছিল, তারপরেই এদিককার তালা গুলো সব বদলে দিয়েছে। দাঁড়ান আমি দেখছি।
সভেত এবারে নিজের পকেট থেকে চাবি বার করে দরজাটা খুলে দিল,
-এই নিন।
-মার্সি।
– আরে না না, এরকম তো আমার সাথেও হতে পারত।
দরজা থেকে বেড়িয়ে সভেত চলে গেল অন্য উইংটাএ দিকে, আর মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বেড়িয়ে ভিনসেঞ্জো সোজা এগিয়ে গেল বাইরের গেটের দিকে। আসার সময় দেখে এসেছিল একজন মাত্র গার্ড আছে আজকে, কি ভাগ্যিস ওই ব্যাটাও দুরের ফাউন্টেনটা থেকে জল ভরছে।
ল্যুভরের উল্টোদিকের ফুটপাথে শুয়ে থাকা ভিখারিটা দেখল মোটা গোঁফওলা একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রিভলির রাস্তাটায় হারিয়ে গেল। আর যাওয়ার পথে ডাস্টবিনটায় চকচকে কিছু একটা ফেলে দিল, একটা দরজার হাতল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের বছর গুলোতে প্যারিস শহর তখন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দরতম সময়ের তখন চলছে। ফ্রেঞ্চরা গর্ব করে একে বলে বেল এপোক। প্রযুক্তিবিদ্যা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফ্রান্স সেইসময় ইউরোপের এক নম্বর দেশ। অন্যদিকে সাহিত্য, নাটক, নাচ, স্থাপত্য সব কিছুতে তখন প্যারিস বিশ্বের বাকি আর যে কোন শহরের থেকে এগিয়ে। ১৮৮৯ এর বিশ্বমেলাতে আলো ঝলমলে আইফেল টাওয়ার দেখে তাক লেগে গেছে সবার। সবাই শহরটাকে ডাকছে সিটি অফ লাইটস বলে, আলোর শহর। এমন একটা সময়ে মোনালিসার চুরি যাওয়াটা প্যারিসের মুখে একটা থাপ্পড়ের মতো এসে পরল।
ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছেলেটার বুকপকেটের পেনটা যদি লিক করে, আর তাতে যদি জামায় দাগ লেগে যায় তাহলে বাকিদের কাছে সেটা একটা উল্লাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ায় বইকি। অন্যের অবনত অবস্থার প্রচার করে নিজের আপাত উন্নত ভাবের ওমে গরম হওয়ার অভ্যাসটা মানুষের চিরকালীন। আর ঠিক সেটাই হল প্যারিসের সাথে।
মোনালিসা চুরি হয়ে গেছে, এটা বুঝতে পারার সাথে সাথে সেই মঙ্গলবার থেকেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ল্যুভর। প্যারিসের দুটো সংবাদপত্র নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে প্রথমে ৪০,০০০ তার পরে ৫০,০০০ ফ্রাঁ-য়ের ইনাম ঘোষনা করে দেয়। আর ছবিটার প্রায় ৩০,০০০ কপি ছাপিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় প্যারিসের দেওয়ালে দেওয়ালে।এই অবধি খবরটা ফ্রান্সেই আটকে ছিল। কিন্তু সেই ছাপানো পোস্টারের কয়েকটা চলে আসে কিছু আমেরিকান আর ইংলিশ সাংবাদিকের হাতে। পরের দিনই টাইমস অফ লন্ডন,ওয়াশিংটন পোষ্ট আর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় ছাপা হয় খবরটা। আর তার সাথে বড় করে মোনালিসার ছবি, সেই প্রথম বিশ্বের মানুষ জানতে পারল এরকম একটা ছবির অস্তিত্ব, যে ছবি দেখতে গুটি কয়েক শিল্প সচেতন মানুষ ল্যুভরে আসতেন সেই ছবি রাতারাতি পূর্ব আর পশ্চিমের তাবড় তাবড় খবরের কাগজে জায়গা করে নিল। তৈরি হওয়ার ৪০০ বছর পরে মোনালিসা বিখ্যাত হল। যে মানুষ রেনেসাঁর র ও জানেনা সেও তখন মোনালিসা নিয়ে দুকথা বলে দিতে পারবে। কিন্তু ছবিটা গেল কোথায়?
চুরির ঘটনাটা টের পাওয়ার সাথে সাথেই ফ্রান্সের সীমানা বন্ধ করে সব ট্রেন, জাহাজে, গাড়িতে তল্লাশি শুরু হয়। যে জাহাজ ততক্ষনে মাঝ সমুদ্রে সেটা গন্তব্যস্থলে পৌঁছনো মাত্র তাতেও ছানবিন চলে। কিন্তু তাকে তো পাওয়া গেল না। বছর চারেক আগে ল্যুভর থেকে যে আইবেরিয়ান মূর্তি গুলো চুরি হয়েছিল তার চোরকে আবার ধরে এনে উত্তম মধ্যম দেওয়া হল। তাতে জানা গেল অ্যাপোলিনিয়ার নামে এক ব্যর্থ কবির চ্যালা সে। অ্যাপোলিনিয়ারকে যখন জেরা করা হল তখন সে বলল আমি জানি কোন ব্যাটা চুরি করেছে। আইবেরিয়ান মূর্তি গুলো ওই নিয়েছিল নিজের একটা ছবি আঁকার কাজে। অতএব ধরে আনা হল তাকেও। এবারে কাঁপতে কাঁপতে কাঠ গড়ায় উঠলেন বেঁটে খাটো বছর তিরিশের এক যুবক। ভয়ের চোটে নিজের জামার বোতাম গুলোও ভালভাবে লাগাতে ভুলে গেছে সে। নাম পাবলো পিকাসো! পিকাসোর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয় যদিও। দিন চারেক পরেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে সবাই ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিল, সবাই মোটামুটি ধরেই নিল লেডি লিসা আর ফিরবে না প্যারিসে। মিডিয়ার মাতামাতি জারি ছিল যদিও,কিন্তু তাদের নজর ঘুরে গেল ১৪ই এপ্রিল, ১৯১২ এর একটা ঘটনাতে, সারা বিশ্ব আবার তোলাপাড় হয়ে গেল সেটা নিয়ে। মোনালিসার কথা সবাই ভুলেই গেল।
কি হয়েছিল সেই ১৪ই এপ্রিলের দিনটাতে? খুব বেশি কিছু না, ভেসে থাকা বরফের চাঁইতে ধাক্কা খেয়ে অ্যাটলান্টিকে ডুবে গিয়েছিল একটা জাহাজ।
নাম টাইটানিক।
১৯১১ র সেপ্টেম্বরের প্রথমের দিকে ল্যুভর আবার খোলে, আর খোলার সাথে সাথেই ভীড় সামলাতে হাবুডুবু খেতে থাকেন কতৃপক্ষ। সবাই ওই চার পেরেক পোঁতা ফাঁকা দেওয়ালটা দেখতেই ছুটে আসছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবারে মোনালিসার একটা নকল ছবি লাগানো হয় সেখানে। কিন্তু তার মান এতোটাই খারাপ ছিল যে সমালোচনার চাপে তাও নামিয়ে নিতে হয়। সেই জায়গাতে স্থান হয় রাফায়েলের আঁকা বালডাসারে ক্যাস্টিগ্লিওনির। এক দাঁড়িওয়ালা বুড়ো, বসে আছে অবিকল মোনালিসার মতো।
পরের আরো দুটো বছর মোনালিসাকে কিন্তু আর পাওয়া যায়নি। সে তখন ভিনসেঞ্জোর রান্না ঘরে স্টোভের নিচে হাত সেঁকছে। তবে তার ফিরে আসার গল্পটাও কিন্ত সমান রকম অবাক করা!
——————————————————————-
৩
নভেম্বর,১৯১৩
ফ্লোরেন্স,ইতালি
‘ আমার কাছে লিওনার্দোর মোনালিসা আছে, যে ছবি অন্যায় ভাবে ইতালীয়দের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সেই ছবিকে তার জন্মভূমিতে আমি ফিরিয়ে আনতে চাই। আমার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাই এর জন্য আমাকে মোটা অঙ্কের পুরষ্কার দেওয়া হলে আমি তা অস্বীকার করব না। কবে কোথায় দেখা করতে হবে জানাবেন।
ইতি- লেওনার্দ।’
চিঠিটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে অ্যালফ্রেডো ঘেরিকে। ফ্লোরেন্সের একটা ছোট আর্ট গ্যালারির মালিক তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন কেউ মশকরা করছে, তাই পাত্তা দেননি। কিন্তু একই বয়ানের চিঠি দিন কয়েক পর পরই আসতে লাগল। আর সব কটাতেই প্যারিসের স্ট্যাম্প লাগানো। তাহলে কি একবার দেখবেন ছবিটা? কিন্তু এখন গোটা ইউরোপ মোনালিসার নকলে ভরে গেছে।যদি তাকে ঠকিয়ে দেয়! কিন্তু একজন আছে, খাঁটি সোনা চিনতে তার কোন ভুল হবে না। ঝট করে টেনে নিলেন কাগজ পেন। এখনি একটা চিঠি লিখতে হবে।
ল্যুভরের থেকে বেশি রেনেসাঁর ঐশ্বর্য আছে পৃথিবীর একটা মাত্র মিউজিয়ামে, সেটা ফ্লোরেন্সের উফিজি। জিওভানি পগি হলেন এই উফিজির ডিরেক্টর। ঘেরির চিঠিটা পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে গেলেন ঘেরির গ্যালারিতে, তারপরে দুজনে মিলে ঠিক করেন লেওনার্দকে ডাকা যাক ফ্লোরেন্সে। হয়ত নকলই, তাও একবার ছবিটা পরখ করে দেখতে তো ক্ষতি নেই।
৯ই ডিসেম্বর সিনিওর ঘেরি একটা টেলিগ্রাম পেলেন,
মিলানে আছি. কাল ফ্লোরেন্সে পৌঁছব. লেওনার্দ।
পরের দিন অফিসে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ঘেরি আর পোগি। মিটিং হওয়ার কথা সকাল আটটা থেকে, পনেরো মিনিট হয়ে গেল, এখনো লেওনার্দের দেখা নেই। আটটা তিরিশ নাগাদ একটু পরেই একজন স্যুট টাই পরা সপ্রতিভ যুবক অফিসে ঢুকলেন।
– বন জর্নো, আমি লেওনার্দ।
লেওনার্দ রোগা মানুষ, মাঝারি উচ্চতা। তবে আর পাঁচ জনের থেকে তাকে আলাদা করে দেওয়া যায় বাঁ চোখের নিচের জরুলটা দিয়ে! ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়ার লেওনার্দ ছদ্মনামটা কিন্তু মন্দ হয়নি, বেশ লিওনার্দোর সাথে একটা মিল আছে।
প্রাথমিক গৌড়চন্দ্রিকার পরে কাজের কথায় এলেন সিনিওর ঘেরি,
– আচ্ছা আপনি নিশ্চিত আপনার কাছে থাকা ছবিটা আসল?
– আসল না হয়ে উপায় আছে? ছবিটা আমি নিজে ল্যুভর থেকে নিয়ে এসেছি।
কথাটা শুনে ঘেরি বিষম খেলেন। ওদিকে পেরুজিয়ার মুখ কিন্তু বন্ধ নেই।
– মোনালিসাকে তার মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিতে পারছি বলে আমি যারপরনাই গর্বিত বুঝলেন, আমার জন্ম এদেশেই, বলতে পারেন তারই ঋণ শোধ করলাম। তবে ওই যে টাকাটার কথা বলেছিলাম না? আমি নিজের মনে একটা সংখ্যা ভেবে এসেছি, খুব বেশি নয়। পাঁচ লাখ লিরার মতো দিলেই হবে।
টাকার অঙ্কটা শুনে আরেকবার বিষম খেলেন ঘেরি, তবে পগি চট করে পরিস্থিতি সামাল দিলেন,
– মাত্র পাঁচ লাখ, এ আর এমন কি কথা? হয়ে যাবে। তা ছবিটা কি এবারে দেখা যায় একটু? সাথে এনেছেন?
– আপনার মাথা খারাপ নাকি মশাই? ওই ছবি সাথে নিয়ে কেউ ঘোরে নাকি? আমার হোটেলের ঘরে রেখে এসেছি, দেখতে হলে আসতে হবে আমার সাথে।
সেই ১০ই ডিসেম্বরেই বিকেল নাগাদ তিনজনে হাজির হল ভিনসেঞ্জোর হোটেলে। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ডুওমোর পাশেই ছোট্ট সস্তার হোটেল ত্রিপোলি ইতালিয়া। তার কুড়ি নম্বর ঘরটা নিয়েছে ভিনসেঞ্জো। ঘরে ঢুকে ঘেরি আর পগি দুটো চেয়ার টেনে বসলেন। আর চোর বাবাজি খাটের তলা থেকে টেনে বার করল একটা কাঠের ট্রাঙ্ক, সাদা রঙ করা, জায়গায় জায়গায় হলুদ ছোপ লেগেছে। ট্রাঙ্কটা খুলতেই দেখা গেল তাতে রাজ্যের অদরকারী জিনিস ঠাসা, ছেঁড়া জুতো, মরছে পড়া লোহার স্ক্র্যু ড্রাইভার, অনেক পুরোনো একটা টুপি আর একটা সাদা স্মক।
– কি ব্যাপার, ট্রাঙ্ক তো খালি করে ফেললেন? ছবিটা কোথায়?
পগির কথার উত্তর না দিয়ে লেওনার্দ ট্রাঙ্কের তলার অংশটা খুলে ফেলল, তার নিচেই আত্মপ্রকাশ হল লাল সিল্কে মোড়া আয়তকার কিছু একটার। সেটা তুলে দিল ঘেরির হাতে।
সিনিওর ঘেরি সিল্কের কাপড়টা সরাতেই মোনালিসা উঁকি মারলেন। কিন্তু এটাই আসল তো?
– আমাদেরকে ছবিটা ভাল করে দেখতে হবে, কিন্তু এ ঘরে আলো তো দেখছি বেশ কম। আমরা ছবিটাকে উফিজিতে নিয়ে যেতে পারি? সেখানে ভাল করে যাচাই করার ব্যবস্থা আছে।
– আমি জানতাম আপনাদের বিশ্বাস হবে না, কোন ব্যাপার নয়, চলুন উফিজিতেই নিয়ে যাওয়া যাক একে।
বাইরের ঘরে পেরুজিয়াকে বসিয়ে ঘেরিকে নিয়ে নিজের অফিসে ঢুকলেন পগি। একটা চেয়ারে বসে কোলের ওপরে ছবিটা নিয়ে দেখতে লাগলেন, হাতে একটা আতস কাঁচ, আর একটা মোনালিসার ফোটগ্রাফ, যেটা ল্যুভরে তোলা হয়েছিল। প্রথমে যে চোখে ছিল অবিশ্বাসের ভ্রুকুটি কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে জায়গা করে নিল হারানো গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার বিস্ময় মেশানো আনন্দ! ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও পগি ঘামতে শুরু করলেন। নোনা জলের একটা ফোঁটা ছবির গায়ে পরার আগে মুঝে নিলেন রুমালে।
– আপনি নিশ্চিত সিনিওর পগি যে এটাই আসল ছবি?!
– দুশো শতাংশ নিশ্চিত, এই দেখুন ছবির পেছনে ল্যুওভরের ক্যাটালগ নাম্বার আর স্ট্যাম্প লাগানো আছে।
– এ গুলো কিন্তু নকল করা কোন ব্যাপারই নয়।
– আমি জানতাম আপনি এটা বলবেন, কিন্তু আরো দুটো চিহ্ন যে বলে দিচ্ছে এটাই লিওর মোনালিসা।
– কোন দুটো চিহ্ন? ঘেরি এবারে ঝুঁকে পরলেন পেন্টিংটার ওপরে।
– প্রথমত কাঠের প্যানেলের বাঁদিকে ওপরের অংশটা দেখুন, একটা লম্বালম্বি চিড় দেখতে পাচ্ছেন? এটা হয়েছিল বছর কুড়ি আগে ছবিটা পরিষ্কার করার সময়।
আর দ্বিতীয়ত, গোটা ছবি জুড়ে হাল্কা ভাঙা ভাঙা দাগ দেখতে পাচ্ছেন? একে বলে..
– জানি, ক্র্যাকুলুরে।
– একদম ঠিক, যত সময় যায় তত ছবির ওপরের রঙের আস্তরণ শুকিয়ে গিয়ে এই প্যাটার্ন তৈরি হয়। জোচ্চর শিল্পীরা যে কোন পেন্টিংয়ের নকল করে ফেলতে পারে, কিন্তু এই ক্র্যাকুলুরে গুলোকে নকল করা অসম্ভব। আর কোন চিন্তা নেই সিনিওর।
মোনালিসা ফিরে এসেছেন!
উত্তেজনা যতটা সম্ভব চেপে রেখে পাশের ঘরে গিয়ে দুজনে পেরুজিয়াকে জানালেন যে তারা খুব খুশি এই অসামান্য শিল্পটা ফেরৎ পেয়ে, এবং পেরুজিয়ার জন্য কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। তবে টাকাটা ইতালির সরকার থেকে আসতে একটু সময় লাগবে, ততদিন উফিজিতেই মোনালিসাকে রেখে দেওয়া ভাল।
পগি আর ঘেরির কথা বিশ্বাস করে মোনালিসাকে তাদের জিম্মায় রেখে হোটেলে ফিরে এল পেরুজিয়া। তবে ঘরে ঢোকার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দরজায় টোকা পরল। দরজার ওপাশে তখন দাঁড়িয়ে ফ্লোরেন্সের একজোড়া পুলিশ।
১৩ই ডিসেম্বর, ১৯১৩ তে ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসাডর ঘোষনা করলেন মোনালিসাকে পাওয়া গেছে। চুরি হয়ে যাওয়ার ঠিক দুবছর চার মাসের মাথায় পৃথিবীর প্রায় সব কটা বড় খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে আবার থাকল মোনালিসার ছবি।
ইতালিতে কয়েকদিন কাটিয়ে পরের বছরের ৪ঠা জানুয়ারিতে ল্যুভরে আবার ফিরে এল মোনালিসা। ফিরে আসার পরের দুদিনে তাকে দেখতে ভীড় হল এক লাখেরও বেশি।
অন্যদিকে আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটল,
* সেই বছরেরই জুন মাসে পেরুজিয়ার বিচার হল, সাজা হল এক বছর পনেরো দিনের। কিন্তু ইতালির সাধারণ মানুষের কাছে পেরুজিয়া তখন দেশপ্রেমিক। তাই তাদের চাপে পরে সেই সাজা কমে দাঁড়াল সাত মাসে, এদিকে ধরা পরার পরে ততদিনে তার সাতমাস হাজত বাস হয়ে গেছে, তাই বস্তত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে মাত্র নয়দিন জেলে কাটিয়ে ছাড়া পেয়ে গেল সে, ছাড়া পাওয়ার দিনে জেলের বাইরে তাকে বীরের মতো সম্বর্ধনা দেয় ইতালিয়রা।
* মোনালিসাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য ল্যুভর প্রেমীদের ঘোষনা করা ২৫,০০০ ফ্রাঁ যায় অ্যালফ্রেডো ঘেরির পকেটে। তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান লিজঁ দা ওরও দেওয়া হয়। অনেক বাঙালীই এর নাম শুনে থাকবেন। আমাদের সত্যজিতও এই সন্মান পেয়েছিলেন।
* ফ্লোরেন্সের যে এক রত্তি হোটেলে পেরুজিয়া উঠেছিলেন সেটা রাতারাতি নিজের নাম বদলে ‘লা জ্যাকোন্দে’ রেখে দেয়, তারপরে তার বিখ্যাত হয়ে ওঠা কেউ আটকাতে পারেনি।
*ল্যুভরে ফিরে আসার পরেই মোনালিসার ছবির ইন্স্যুরেন্স করা হয়, এখন তার মূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার। এই পৃথিবীর আর অন্য যেকোন শিল্প কর্মর মূল্য এর থেকে কম।
——————————————————————
শেষের কথা-
লিওনার্দোর মোনালিসা একেবারেই তার সেরা সৃষ্টি গুলোর একটা নয়। যারা ম্যাডোনা অন দা রকস বা লাস্ট সাপার দেখেছে তারাও একমত হবে। মোনালিসার বিখ্যাত হওয়ার কারণই হল তার অন্তর্ধান, যেটা তাকে সাধারন মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। রেনেসাঁর আর কোন ছবিরই সেই সৌভাগ্য হয়নি।
লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ
প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ http://www.independent.co.uk
প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds