ভূত আমার পূত – গল্প ১ ~ আমার জানলা দিয়ে

Anirban & Arijit, Facts, Humor, Series, Short Story, Supernatural, Thriller, বাংলা, ভূত আমার পূত

(আমার সত্যিকারের ভয় পাওয়া অবলম্বনে)

হ্যাঁ আমি ভূতে ভয় পাই। আগেই স্বীকার করে নিলাম, পরে টিটকিরি দেবেন না। তা এহেন ভীতু ছেলেটার বেশ কয়েকবার ভূতুরে অভিজ্ঞতা হয়েছিল বৈকি। যদি এখন রাত হয়, আর আপনার ঘরের জানলা টা খোলা থাকে, তাহলে সেটা বন্ধ করে দিন, নয়তো গল্প টা রেখে দিন, কাল পড়বেন খন।

শুনলেন না তো কথা, পরে দোষ দেবেন না আমায়। শুনুন তাহলে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। বলে রাখলুম এগুলো কিন্তু একটাও বানানো নয়।

১.
কয়েক বছর হল চাকরি তে জয়েন করেছি। ভাববেন না অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে থাকতে হয়, নিজের বাড়িতেই থাকি। সালটা ২০০৯ কি ১০। অফিস থেকে ফিরতে আমার রাতই হয়, মানে ১০টা ১১টা আর কি। বাড়ি হাওড়ার শিবপুরে। রাতে দোতলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ঘরটাতে আমি একা শুই, আর অন্যদিকের ঘরে বাবা মা বোন, একতলাটা ফাঁকাই থাকে। না, আমার তখনো বিবাহ হয়নি, তবে হ্যাঁ, গল্পের প্রয়োজনে বলে রাখা ভালো, আমার হবু বউটি একই পাড়াতে থাকে, দুটো বাড়ি পরেই, ভেবেচিন্তেই ছিপ ফেলেছি আর কি। আসলে আমি তো জাত ল্যাদ, তাই বুঝতেই পারছেন।

তো এমনই এক শীতের রাতে বাড়ি ফিরলাম রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ। গেট খুলে ঢোকার আগেই নাকে একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। আশেপাশে তাকাতেই দেখি পাশের বাড়ির পাঁচিলঘেরা উঠোন থেকে বেশ জোরালো একটা আলো আসছে, অনেকটা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালালে এমন কাঁপা কাঁপা আলো হয়। দোতলায় উঠে আমার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি প্রতিবেশির বাড়ির উঠোনে কাঠে আগুন লাগিয়ে বিশাল যজ্ঞ চলছে, আর বাড়ির মালিক একটা রক্তলাল ধুতি পরে সেই যজ্ঞের আগুনে মুঠো ভরে ভরে শুকনোলঙ্কা ছুঁড়ছে।

পিলে চমকে গেল। মা কে জিজ্ঞেস করতে বলল বিকেল থেকেই নাকি চলছে এইসব, আজকে অমাবস্যার রাত, তন্ত্রসাধনা হতে পারে। লঙ্কাপোড়ার গন্ধে কাশি সামলানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়ল। মায়েদের সাথে আজ অন্যঘরে শোবার অফার টা অবশ্য ফিরিয়ে দিলাম, কারণ রাতে এম টিভি রোডিস-এর রিপিট টেলিকাস্ট টা আমার ফেভারিট। ওরা দরজা বন্ধ করে শুতে চলে গেল, আমিও আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠান্ডা বেশ ভালই বাইরে, পাখাও বন্ধ এক সপ্তাহ হল, তাই ঘরের একটা জানলা শুধু খোলা রেখে পর্দা টেনে দিলাম।

বন্ধ জানলায় এখনো আগুনের ছায়া দেখা যাচ্ছে। আমার ঘরের পাশেই ওদের একতলা বাড়ির ছাদ আর সেখানেই ওদের চিলেকোঠার ঘর। খুব বয়স্কা এক মহিলা থাকেন ওই ঘরে, কে হন অতশত জানি না। বাকিরা সবাই নিচেই থাকেন ওদের।

সবে প্রেমে পড়েছি, তাই রাতের বেলা নাইট ডিউটি মিস করলে বেশ চাপ হয়ে যায় পরের দিন। ফোনের ডিউটি আর কি, তাও পাশের বাড়ি। তবে হ্যাঁ, দুইবাড়ির কেউ ই এখনো জানে না এই কেচ্ছাকাহিনি, তবে পাড়ার লোকের সবচেয়ে বেশি কৌতুহল, সুযোগ পেলেই খোঁচা মারার চান্স মিস করে না কেউ।

যাজ্ঞে, আজ ৩-৪ বার রিঙ করেও নাগাল পেলাম না তেনার। নির্ঘাত ঘুমিয়ে গেছে তাড়াতাড়ি। রোডিস চালিয়ে দেখতে শুরু করলাম লেপমুড়ি দিয়ে।

কখন হাল্কা একটা ঝিমুনি এসে গেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ জানলার পাল্লা আছড়ে পড়ার শব্দে চমকে উঠলাম। জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি পর্দা টা উড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ একটা দমকা গরম হাওয়া ঘরে ঢুকলো, আর মুহূর্তের মধ্যে ঘরটা গরম হয়ে গেল ওই ঠান্ডার রাতে, আর পর্দাটা ঠিক ৪৫ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে হাওয়ায় আটকে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন। কোনরকমে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে দরজা টা খুলে বাইরে দালানে বেরোলাম, বেশ ঠান্ডা বাইরে। বাপি কে ডাকব কিনা ভাবলাম একবার। আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি ঘরটা এখনো বেশ গরম হয়ে আছে, পর্দা টা সরে গেছে, জানলার বাইরে দিয়ে পাশের বাড়ির ছাদ আর চিলেকোঠা দেখা যাচ্ছে। যজ্ঞ মনে হয় শেষ।

সাহস করে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করলাম। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ঘরটা স্বাভাবিক হল। মাথায় কুচিন্তা ঘুরপাক দিতে শুরু করল। শুনেছি ভুতুড়ে হাওয়া হিমেল হয়, কিন্তু এই হাওয়া টা তো গরম ছিল। এই কনকনে শীতের রাতে গরম হাওয়া কেন ঢুকল। পাশের বাড়ির তন্ত্রসাধনায় কোনো পিশাচ সেঁধিয়ে গেল না তো আমার ঘরে। নাহ্, ব্যাখ্যা কিছুতেই পেলাম না। টিভিটা বন্ধ করতে উঠলাম, রিমোট টা সামনের টেবিল থেকে নিতে যাব, হঠাৎ আবার শিহরণ খেলে গেল সারা শরীরে। টেবিলের সামনের ফাঁকা জায়গা টা বেশ গরম হয়ে আছে। সরে এলাম একবার, আবার টেবিলের সামনে গিয়ে দেখি গরম, প্রায় ছ্যাঁকা লাগার মতো। আর নয়, সোজা দরজা খুলে দালান পেরিয়ে পাশের ঘরে নক্ করতে শুরু করলাম। বাপি বেরিয়ে এল।

দাবি করলাম আমার সাথে শোবে চলো আজ। কারণ জিজ্ঞেস করল বেশ কয়েকবার, কিন্তু বোঝাবার রিস্ক নিলাম না আর।

||

সকালে উঠে দেখি বাপি বসে আছে চায়ের কাপ নিয়ে। উঠতেই প্রশ্ন কাল রাতে কি হয়েছিল। বলতে বাধ্য হলাম যে ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব হঠাৎ। ঠিক কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করাতে বললাম ঘটনাগুলো। বাপি মুচকি হেসে চুপ করে রইল।

মা ও দেখি মুখ টিপে হাসছে। কেস টা কি। মা কে চেপে ধরতে যা শুনলাম, তাতে ভয় কমা তো দূরের কথা, আরো দুগুণ বেড়ে গেল।

আমার ঘরের কেস টা হয়েছিল ঠিক রাত ২:১০ নাগাদ। আর বাপিরও নাকি ঘুম ভেঙে গেছিল ২ টোর সময়। বাপি বেশ ভালই নাক ডেকে ঘুমায়, তবে সেটা এক্সট্রিমে চলে গেলেই হেঁচেকেশে ঘুম চটকে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তা, বাপি চোখ খুলে দেখে ঘর অন্ধকার, সব দরজা জানলা বন্ধ। কিন্তু হঠাৎ দরজা টা আস্তে করে খুলে গেল ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়ে, আর ঠিক ৫ সেকেন্ড পর একইরকম ভাবে আস্তে আস্তে দরজা টা আবার বন্ধ হয়ে গেল, যেন কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দরজা খুলে। জানলা সব বন্ধ ছিল, তাই হাওয়ায় খুলে যাওয়ার লজিকও খাটেনি। বাপি সাহসি মানুষ, অবাক হলেও ভয় টয় পায়নি। মা এই ঘটনা টা আমাকে বলতে বারণ করেছিল যাতে আমি আরও ভয় না পেয়ে যাই।

তাহলে কি কাল আমাদের ঘরে সত্যি কিছু এসেছিল। হাতমুখ ধুয়ে ফোন টা নিতে গিয়ে দেখি ৭ খানা মিস্ডকল, ফ্রম দ্য গার্ল নেক্সট ডোর, মানে ওই দুটো বাড়ি পরে আর কি।

ওকে ফোন করে জানতে পারলাম কাল কেন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল সে। আর সেটা জানার পর থেকেই বিশ্বাস করুন আজও মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাই সেই দিনটার কথা ভাবলে।

||

আমার বউ ও জন্ম থেকেই ভীতু। নো কনফিউশান, অনলি গ্রেট কম্বিনেশান। তবে, আগের রাতের ঘটনার জন্য ওর ভয় পাওয়া স্বাভাবিক বলেই মনে হল। বিকেল থেকেই পাড়ার লোকেরা খেয়াল করে যে আমার পাশের বাড়িতে যজ্ঞের আয়োজন চলছে। ওরা তন্ত্রমতে বিশ্বাসী, তাই বেশকিছু জটাজুটধারি তান্ত্রিকেরও আনাগোনা চলছিল দুপুর থেকেই। তারপর বিকেল থেকেই শুরু হয় ওদের অগ্নিযজ্ঞ, আর সাথে চলতে থাকে অদ্ভুত কড়া কড়া সব মন্ত্রোচ্চারণ। অকস্মাৎ এই যজ্ঞের কারণ জানতে সবাই খুব আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। ওদের বাড়ির লোকদের জিজ্ঞেস করলেও নাকি কিছু বলছিল না, কেমন একটা উদাসীন আচরণ করছিল।

পরে সন্ধ্যের দিকে জানা গেল কারণ। ওদের নাকি বাড়ির কেউ মারা যাওয়ার সময় যদি বেশকিছু গ্রহের দোষ পায়, তখন এইভাবে যজ্ঞ হয়, শ্রাদ্ধ হয় না। এতে নাকি অশুভ প্রেতাত্মারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর যতক্ষণ না এই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে, ততক্ষণ মৃতদেহ কেউ স্পর্শ করে না বা সৎকার করতে নিয়ে যাওয়া হয় না।

এইসব শুনেই আমার প্রেমিকা কাল আর রাতজাগার রিস্ক নেয়নি। ওর মনে হয়েছিল প্রেতাত্মা যদি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওদের বাড়ি ঢুকে যায়!

এটা শুনেই শুকনো গলায় আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, “কে মারা গেছেন ওদের?”

– “ওই যে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে যে ঠাকুমা থাকত না, উনিই মারা গেছেন গতকাল ভোরবেলায়। আর কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ি আসবে, ওরা ছাদে উঠে বডি বার করবে।”

 

 

গল্প ২ – ফরাসি হোটেল

এবারে আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা শুনতে হলে যেতে হবে সুদূর ফ্রান্সে। হ্যাঁ, ওখানে হোটেলেই হয়েছিল সেই এক্সপিরিয়েন্স।

ফ্রান্সের মারসাই-তে আমাকে যেতে হয়েছিল ২০১০ সালে এক মাসের জন্য। অবশ্যই অফিসের কাজে। একটা সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট বুক করেছিলাম গোটা মাসের জন্যেই। হোটেলেরই মতো, অবশ্য কিচেনও পাওয়া যায়। দুটো ঘর ছিল দুদিকে, মাঝে একটা ব্যালকনি। রুম নাম্বার ৮২৩।

এই দেখুন, লিখতে লিখতে হুঁশই নেই, সব একবারেই লিখে যাচ্ছি, এটা তো দ্বিতীয় পর্বে থাকবার কথা। আগের টা কেমন লাগল জানাবেন, আর অবশ্যই জানাবেন এরপর আর নেক্সট পর্ব টা পড়ার সত্যিই কোনো ইচ্ছে রইল কিনা। ততক্ষণ আমি শুতে গেলুম। জানলা টা বন্ধ আছে তো!

 

~ ফুল সিরিজ ~

ভূত আমার পূত – গল্প ১ ~ আমার জানলা দিয়ে

ভূত আমার পূত – গল্প ২ ~ ফরাসী হোটেল

ভূত আমার পূত – গল্প ৩ ~ কড়ে আঙুল

ভূত আমার পূত – শেষ গল্প ~ কার্নিশ

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ fp.reverso.net

প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ~ Anari Minds

3 comments

Comments are closed.