ভূত আমার পূত – গল্প ৩ ~ কড়ে আঙুল

Anirban & Arijit, Humor, Series, Short Story, Supernatural, Thriller, বাংলা, ভূত আমার পূত

(আমার সত্যিকারের ভয় পাওয়া অবলম্বনে)

ভূত চতুর্দশী, হামারা আপনা হ্যালুইন! আজকের দিন টা আমার কাছে “সানডে সাসপেন্স” বা “শনিবারের বারবেলা”-র ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজের থেকেও অলটাইমের ফেভারিট। ভয় আর হাগু, এই দুটো পেলেই আমি কন্ট্রোল করতে পারি না। আজ নাকি সব ভূতেরা একসাথে বেরোয় রাতের বেলা হাত ধরাধরি করে। এই দিন তেনাদের মোচ্ছবের দিন, দুটো দুনিয়া যায় এক হয়ে।

ছোটবেলায় মা বলত এই দিনে ১৪ শাক না খেলে নাকি ভূতে ধরার চান্স বেড়ে যায়। তাই ১৪ শাকের নামে দোকানদার একগোছা দুব্বো ঘাসের ঝোপ বেচে দিয়েও পার পেয়ে যেত! ১৪ পিদিম লাগানো শুরু করতাম একধার দিয়ে ছাদের পাঁচিলে, ৫ নম্বরে পৌঁছতেই ১ নম্বর থেকে সেগুলো নেভা শুরু হয়ে যেত, এই লুপটা দুবার ঘুরতো, তারপর ধুত্তোর বলে টুনি জ্বালিয়ে দিতুম। তা এহেন আজকের দিনে ভূতের গল্পের জমপেশ একটা আড্ডা তো বানতা হ্যায় বস। ঘরের আলো টালো নিভিয়ে দিয়ে জমিয়ে বসে যান।

প্রথমেই বলে রাখি এই ঘটনা টা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নয়। আমার বন্ধুর মুখে শোনা। তবে সেদিন এই ঘটনা টা যারা যারা শুনেছিল, বা পরে আমি যাদের শুনিয়েছিলাম, তাদের ২-৩ রাত ঘুম হয়নি। ঘটনার সত্যতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, কারণ বন্ধুটাকে আমরা সামনে থেকে দেখেছি, ভয় পেলে একটা মানুষের চেহারা যে এইরকম হয়ে যেতে পারে তা আমার জানা ছিল না আগে। তাই কারুর মুখে গল্প শুনে আমার সত্যিকারের ভয় পাওয়ার ক্যাটেগরি তে এটা পড়ে গেছিল বলেই এই সিরিজে ঢুকিয়ে দিলাম।

২০১১ সাল। আমার অফিসের ওড়িয়া এক বন্ধু ছুটির জন্য অ্যাপ্লাই করল। লম্বা ছুটি বিয়ের জন্য। নেমন্তন্ন করল আমাদের সবাইকেই, কিন্তু উড়িষ্যা যাওয়ার মতো সময় আমরা কেউই বার করতে পারলাম না। তাই, বন্ধুকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নেওয়া হল যে বিয়ে করে এসে ওকে আমাদের ট্রিট দিতে হবে কলকাতা তেই।

ঠিক দেড় সপ্তাহ পরে বন্ধু কলকাতা ফিরে আমাদের সবাইকে একদিন চলে আসতে বলল সল্টলেকের হাক্কা রেস্টুরেন্টে। আমরাও দল বেঁধে হাজির হয়ে গেলাম। কিন্তু খাওয়ার সাথে সাথে যে এইরকম একটা গল্প অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য, সেটার কোনও আঁচ আমরা আগে থেকে পাইনি।

বেঁটেখাটো বন্ধুর মাঝের নাম চরণ, গল্পের খাতিরে এই নামটাই ব্যবহার করলাম, যাতে ওকে কেউ চিনতে না পারে। বিয়ে থা করে সুখে ঘরকন্না করছে এখন আমেরিকা তে।

গাণ্ডেপিণ্ডে গেলা মোটামুটি শেষের দিকে, কিন্তু চরণ একটু চুপচাপ। আমরা আওয়াজ দেওয়া শুরু করলাম, “কেয়া চরণ বাবু, শাদি হতে হি বোলতি বন্ধ হো গ্যায়া?”

চরণ খুব হাল্কা হেসে মাথা নাড়ল, আর বলল, “অউর পুছো মাত, মেরে শাদি মে ভুত আয়ি থি।”

খাওয়া উঠল মাথায়, চেয়ার আরও সামনে টেনে হাক্কার মৃদু আলোয় আমরা বসে গেলাম রগরগে একটা ভুতের গল্প শুনতে। খ্যাপাবার ছলেই বসেছিলাম, কিন্তু গল্প যত এগোল, আমাদের মুখগুলো দেখার মতো হতে থাকল।

রইল চরণের গল্প। বাংলা তেই অনুবাদ রাখলাম। তবে আমার আবার গল্প লিখতে গেলেই পার্সোনাল টীকা টিপ্পনী অ্যাড হয়ে যায়, তাই সেরকম কিছু পেলে বুঝবেন আমি ফোড়ন কাটছিলাম।

||

চরণের দেশের বাড়ি উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে একটা গ্রামে। মেয়ের বাড়ি কোথায় বলেছিল ভুলে গেছি। এই আমার এক দোষ, বিয়েবাড়ি গিয়ে বউ দেখতেই ভুলে যাই, খালি মনে হয় কতক্ষণে কবজি ডুবিয়ে সাঁটাবো।

তা চরণ গল্প শুরু করল একদম ফুলশয্যা থেকে। সারাদিন বিয়েবাড়ির কাজ গুছিয়ে আমাদের চরণ বাবাজীবন তার জীবনের প্রথম ইনিংগ খেলার জন্য রেডি। বউ ঘরে আসার আগেই তিনি ঘরে ঢুকে অপেক্ষারত। ননদ ননদিনী দের সাথে ফাজলামি মেরে বউ যখন ঘরে এল তখন রাত ১ টা। সম্বন্ধ করেই বিয়ে এদের, তাই আলাপ পরিচয়ের পালা আজ রাতেই যা হওয়ার হবে, কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় হবে সেই প্ল্যান ওদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক না।

চরণ দরজার ছিটকিনি তুলে জানলা সব বন্ধ করে নতুন বউয়ের পাশে এসে বসল। কথায় কথায় রাত হল একটু, ঘরের আলো নিভল, ওপেনিং জুটি তে ভালো রান হল, কিন্তু ঘটনা টা ঘটল ঠিক আলো নেভার ১ ঘন্টা পরেই। চরণ আর ওর বউ পাশাপাশিই শুয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ ওর বউ খাট থেকে উঠে মাটি তে পা না ফেলেই সটান এক লাফ দিয়ে দরজার ছিটকিনি টা ধরে ঝুলে পড়ল, আর খুব তাড়াহুড়ো করে সেটা খোলবার চেষ্টা করতে থাকল।

চরণ হকচকিয়ে উঠে দরজা অবধি ছুটে গিয়ে ওর কাঁধে একটা হাত রাখতেই মাটিতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল বউ।

অকস্মাৎ এইসব আওয়াজে বাইরে যারা শুয়েছিলেন তাদের ঘুম গেল চটকে। চরণের ঘরের ভেতর থেকে ফুলশয্যার রাতে “আউট অফ দা সিলেবাস” আওয়াজ আসতে শুরু করেছে দেখেই তারাও গেলেন চমকে, আর দরজায় এসে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন যে সব ঠিকঠাক আছে কিনা।

চরণ দরজা খুলে দিল, আর ঘটনার কথা বলল সবাইকে। চরণের বোন আর মা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কিছু বলে ওদের বাবা কে কানে কানে কিছু বলল। বাবার মুখ টা গেল গম্ভীর হয়ে, উনি বাড়ির সব মেয়ে দের বললেন যে বউমা কে আলাদা ঘরে নিয়ে যেতে। কিন্তু এইসব কথাবার্তার মাঝে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল।

||

“স্যার, আপনারা আর কিছু নেবেন?”

আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে দিলাম সবার জন্য, আর ওয়েটার কে রিকোয়েস্ট করলাম, “চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না সরায়ে।” আজ ব্যাটা ছাড়া যাবে না, গল্প উঠেছে জমে, তাই ভোজন চলতে থাকুক।

যাজ্ঞে, যেখানে ছিলাম। বাড়ির বড়রা যখন সবাই কথাবার্তায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই চোখ খুলল নতুন বউ, টকটকে লাল চোখে যেন একটা রাগ দানা বাঁধছে। তবে সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার ক্ষিপ্র গতিতে উঠে লম্বা করিডর দিয়ে ছুটতে শুরু করল সে। সারাদিনের উপোষের পর নতুন বউয়ের এতো এনার্জি দেখেই তো আমি চমকে যেতাম স্পটে থাকলে। অদ্ভুত রকমের স্পিড ছিল সেটা চরণের ভাষায়, ছুটছিল না উড়ছিল বোঝা যায়নি।

চরণ আর বাড়ির সবাইও ছুটতে থাকল তার পেছনে। করিডর পেরিয়ে বাঁদিকের বাথরুমের ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করছিল সে। চরণ গিয়ে পেছন থেকে ওকে ধরতেই আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ফুট কাটা আমার জাত স্বভাব। আমার খালি মনে হচ্ছিল ওনার বড়ো বাইরে টা বেশ জোরেই পেয়েছে, তাই এতো নাচন কোদন করছেন, কিন্তু এটা বলতেই ঘাড়ে পিঠে চারখানা চপেটাঘাত খেয়ে গেলাম পাশ থেকে, “মুখ বন্ধ রাখ শুয়ার”।

চরণের মা আর বোন নতুন বউ কে অচৈতন্য অবস্থায় নিয়ে গিয়ে বসাল ওদের ঘরে। বাবা কাকা রা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন।

– ঠিক আবার এসে গেছে, পরশু দিন পাশের গ্রামে একটা বিয়ে ছিল না, সেখানেও গেছিল?
– নাহ্, সেখানে কিছু তো শুনিনি।
– সব ওই পান্ডের কীর্তি, আবার ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।
– ওকে দোষ দিয়ে কি লাভ, কাল সকাল অবধি নতুন বউ সুস্থ নাহলে তো সেই পান্ডে কেই ডাকতে হবে আবার।
– হুমম, তবে এবার ওকে ওয়ার্ন করে দিতে হবে।

||

রাত তখন ৩ টে। ধীরে ধীরে চোখ খুলল বউ। সোফায় বসে সে, চারিদিকে ঘিরে বসে চরণ, ওর বোন, মা, মাসি। চোখ খুলেই সে সবাইকে একবার দেখে নিল। ওই লাল চোখ দেখলেই যে কারুর হাড় হিম হয়ে যেতে বাধ্য। হনুমান চালিশা পাঠ করতে শুরু করলে নাকি ভুতেদের পিলে চমকে যায়। হলোও তাই, চরণ ধীরে ধীরে চালিশার মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করতেই নতুন বউয়ের প্রকান্ড এক চিৎকারে কেঁপে উঠল ঘর খানা। বোন কোনরকমে ওর হাত চেপে ধরে ওকে শান্ত করল, আর জিজ্ঞেস করল, “কে তুই? কেন আমাদের নতুন বউ কে ধরেছিস?”

প্রথমবার মাথা নিচু করেই রইল বউ, আবার জিজ্ঞেস করাতে মাথা তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে আড়চোখে তাকালো বোন এর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে, কিন্তু কোন জবাব দিল না।

– কিরে বললি না কেন ধরেছিস নতুন বউ কে? এক্ষুনি ছেড়ে পালা, ও আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য, ওকে ছেড়ে দে, ওর শরীর খারাপ।

সম্পূর্ণ অন্য এক ধরা ধরা বিকট গলায় উত্তর দিল নতুন বউ, “ওকে আমি ছাড়ব না, আমাকে তোরা খেতে দিসনি।”

– কি খেতে চাস তুই?
– মিষ্টি।
– এক্ষুনি তোকে মিষ্টি দেবো, তাহলে ছেড়ে দিবি নতুন বউ কে?

মাথা নিচু করে রইল সে।

জোগাড় হল একটা স্টিলের বাটি করে দুখানা রসগোল্লা। এনে নতুন বউয়ের সামনে রাখা হল। কিন্তু বাটি দেখেও মুখ তুলল না সে।

চরণের বাবা ঘরে ঢুকলেন আর বললেন, “কাল পান্ডে কে ডাকছি সকালে, তার আগে আমরা একবার মন্দিরে নিয়ে যাব বৌমা কে। মনে হচ্ছে না আজ ছাড়বে ওকে।”

চরণের বোন উঠে নতুন বউ এর সামনে বসল পা গুটিয়ে। হাত বাড়িয়ে বৌদির বাঁ হাত টা টেনে নিল নিজের হাতে আর দু আঙুল দিয়ে চেপে ধরল বৌদির কড়ে আঙুল।

আমি ফুট কাটলাম, “এটা ঠিক না, ভুতে ধরেছে বলে আড়ি করে দিল?” কথা টা কেউ পাত্তাই দিল না।

যখন কেউ পজেস্ড হয়, মানে কাউকে ভুতে ধরে, তখন তার কড়ে আঙুলের ডগা চেপে ধরে থাকলে আত্মা সেই দেহে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, বেরিয়ে চলে যায়। এই বিশ্বাস চরণের বাড়ির লোকেদের, আগেও এটা নাকি অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। বোন এই জিনিসটা করার সাথে সাথে নতুন বৌয়ের কেমন একটা অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেল। বেশ কিছুবার জোর করে আঙুল টা ছাড়াবার চেষ্টাও করল, কিন্তু না পেরে আবার একটা গগণভেদী হাড়কাঁপানো চিৎকার করে বাঁদিকে অজ্ঞান হয়ে হেলে পড়ল।

চরণ উঠে ধরল ওকে, তারপর ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দিল। মনে হচ্ছে এইযাত্রা বেঁচে গেল। বোনের “কড়ে আঙুল” টোটকা কাজে লেগে গেল। ঘুরে বোনকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে গিয়ে দেখে ঘরে নেই বোন। আরে ও আবার কোথায় চলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে চরণ দেখে এই মাঝরাতে উঠোনে সবাই দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে ছাদের দিকে তাকিয়ে। হকচকিয়ে ছুটে উঠোনে এসে ছাদের দিকে তাকিয়ে চরণ যা দেখল, সেটা শুনে আমার চার রাতের ঘুম ওখানেই ক্যান্সেল হয়ে গেল।

তিন তলার ছাদ। পুরনো দিনের বাড়ি হওয়ায় বেশ উঁচু। ছাদের রেলিং বা পাঁচিলও কোমরসমান। সেই
পাঁচিলে কেউ যদি ছাদের দিকে মুখ করে পা ঝুলিয়ে বসে শরীর টা কে বাইরের দিকে পুরো ঝুলিয়ে দেয়, ঠিক সেইরকম ভাবেই চরণের বোনের শরীর টা উলটো হয়ে ঝুলছে বাইরের দিকে, পা দুটো হাঁটু থেকে ভাঁজ করে পাঁচিলের ভেতরের দিকে আঙটার মতো করে রাখা, হাত দুটো নিচে দুদিকে ছড়ানো, খোলা চুলও এলোমেলো ভাবে নিচে ঝোলা, আর সেই অবস্থায় বোনের মুখে মুচকি হাসি।

||

ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই নতুন বউ চোখ খুলে অবাক হয়ে তাকালো।

– আমার কি হয়েছিল কাল রাতে? কিছুই মনে পড়ছে না কেন আমার!

নর্মালি ফুলশয্যার রাতটা সকলের সামনে মনে পড়ার কথাও না, আমারই পড়েনি। কিন্তু এই মেয়ে টা তো জানেও না যে বিয়ের প্রথম রাতেই নিজের বর ছাড়াও গোটা শ্বশুরবাড়ি কে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। পরে ভুত না চাপলেও এই ট্রিক টা মাঝে মাঝে নিতেই পারে, খিক খিক!

বেলাইন হয়ে যাচ্ছি আবার দেখুন, ফিরে আসা যাক। বাড়ির উঠোনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ৫ খানা গাড়ি, মাঝের গাড়ির মাঝের সিটে বসে চরণের বোন, উস্কোখুস্কো চুল, মাথা নিচু, পরণের সালোয়ার কামিজটাও অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে ছাদ থেকে নামানোর সময়, তবে কথাবার্তা কিছুই নেই মুখে। মাথা নিচু করে বসে শরীর টা বাঁদিক আর ডানদিকে দুলিয়ে যাচ্ছে।

বাবা গাড়ি তে উঠলেন, আর মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সবাই মিলে।

||

বাড়ি থেকে একটু দূরে এই মন্দির। গাড়ি তে আধঘন্টার রাস্তা। মন্দির প্রাঙ্গন টা বিশাল জায়গা নিয়ে, কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা প্রকাণ্ড মাঠের মাঝখানে কালী মন্দির। বেড়া দিয়ে ঢোকার মুখে দুদিকে বিশাল বড় বড় দুটো বটগাছ। গাড়ি গুলো বেড়া পেরিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে মন্দিরের দিকে এগোতেই চরণের বোনের মধ্যে অদ্ভুত আচরণ দেখা গেল। মুখ তুলে বাবা কে জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা? বৌদি কেমন আছে?”

মন্দিরে আসা সার্থক হল। খুব যত্ন সহকারে পূজা দেওয়া হল। বোন এখন স্বাভাবিক, শুধু শরীর টা বেশ দুর্বল, প্রসাদ খাইয়ে চাঙ্গা করা হল। মন্দিরে ঢোকার মুখেই মনে হয় ভর করে থাকা অশুভ শক্তি পালিয়েছে। বাড়ি ফিরে অনেক কাজ, সবাই গাড়ি তে উঠে পড়ল। মাঠ পেরিয়ে গাড়িগুলো আবার বেড়া দিয়ে তৈরি গেটের মুখে এসে গেল। কিন্তু সেই দুদিকে বটগাছ ওয়ালা গেট পেরিয়ে গাড়ি এসে বড় রাস্তায় এসে নামতেই পেছনের সিট থেকে বোন একটা অদ্ভুত রাগি গলায় বলে উঠল, “ভেবেছিলিস মন্দিরে এনে আমার থেকে মুক্তি পাবি! আজ তোদের কাউকে ছাড়বো না।” সবাই চমকে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল বোনের চোখদুটো টকটকে লাল, আর একদৃষ্টে গাড়ির সিলিঙের দিকে তাকিয়ে।

||

পান্ডে এলো সকাল সাড়ে ১০ টা নাগাদ। গ্রামের একমাত্র ওঝা। গেরুয়া কাপড়ে শরীর ঢাকা, মাথায় ছোট জটা পাকানো চুল, আর চোখে একটা আদ্যিকালের চশমা, বয়স ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে হবে, ঠিক আন্দাজ করা যায় না।

বড় উঠোনের মাঝখানে বসে নিজের জিনিসপত্র বার করে সাজাতে শুরু করল। অদ্ভুত অদ্ভুত রকমের কালেকশান লোকটার। দুটো খরগোশের হাড় দড়ি দিয়ে মাঝখানে বাঁধা ক্রুশের মতো করে, একটা মানুষের মাথার খুলির ওপরের অংশ যেটা কে উলটো করে মাটি তে রেখে বাটির মতো ব্যবহার করা যায়, ৩ খানা আলাদা রকমের ঝাঁটা, বাঁশপাতা দিয়ে তৈরি আসন, আর বিভিন্ন সাইজের ৭-৮ খানা অদ্ভুত দেখতে ছিপি আটকানো কাঁচের বোতল।

সব গুছিয়ে নিয়ে পান্ডে সাব মিহি গলায় হঙ্কার ছাড়লেন, “নিয়ে আয় তেনাকে”। দুজন দুদিক থেকে জাপটে ধরে নিয়ে এল চরণের বোনকে, এনে বাঁশপাতার সেই আসনে বসিয়ে দিল। তখনও ভুলভুলাইয়া সিনেমা টা রিলিজ করেনি, করলে হয়তো বলেই দিতাম যে চোথা মারছে, কিন্তু চাঁটা খাওয়ার ভয়ে জাস্ট মুখ বন্ধ রেখে সব হজম করে যাচ্ছি, আর ভাবছি সামনের কতগুলো রাত এই গল্প টা আমার মাথায় ঘুরপাক খাবে।

পান্ডে জি শুরু করলেন কিম্ভুত কিমাকার সব মন্ত্রোচ্চারণ। চরণের বাড়ির সবাই চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। নতুন বউ এখন অনেকটাই সুস্থ। বাবার নির্দেশে সবাই যে যার নিজের কড়ে আঙুল নিজের অন্যহাতের আঙুল দিয়ে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে, যাতে আগের রাতের ভুল আর না হয়। হ্যাঁ, এখানে আমার মনেও প্রশ্ন টা এসেছিল যে কড়ে আঙুল কনসেপ্ট টা বোনের ক্ষেত্রে খাটালো না কেন। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। চরণ বলল বোন এতটাই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছিল যে ওকে বসিয়ে কড়ে আঙুল ধরাই যাচ্ছিল না, আর ধরলেই বিশাল শক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছিল।

পান্ডে জি চিৎকার করে বলে উঠলেন, “শালা, ছিপি আলগা ছিল বলে খুলে বেরিয়ে গেলি হতভাগী! আগের সপ্তাহেই তোকে পুরেছিলাম না। দাঁড়া তোর হচ্ছে।” বলে সামনে রাখা বোতল গুলোর সবকটার ছিপি খুলে দিয়ে মাটিতে শুইয়ে রাখলেন।

বোতল গুলো দেখেই চরণের বোন বিশাল জোরে হাসতে শুরু করল, দেখলেই পিলে চমকে যেত। ঠিক খানিক বাদেই গম্ভীর মুখে বিকট শব্দে জবাব দিল, “তুই আমাকে খেতে দিস না, তোর ঘরে আর যাব না, এখানেই থাকব।”

পান্ডে জি উঠে দাঁড়ালেন। ঝোলা থেকে বের করলেন একখানা হনুমানের লেজের মতো দেখতে জিনিস যার ডগায় অনেক লোম। মাটি থেকে একখানা বোতল তুলে তার মধ্যে গুটিয়ে পুরে দিলেন সেটা, আর বোতলের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে মাটি তে রেখে বললেন, “তুই থাকবি না তো একেই রাখব এবার থেকে।”

এই কথা টা বলা মাত্রই সবার চোখের সামনে দিয়ে চরণের বোন বেশ জোরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল সেই বোতলের দিকে। বোতল থেকে একহাত দূরে এসে হঠাৎ মাটি তে এলিয়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই অদ্ভুত ভাবে বোতলের ছিপি টা পক করে খুলে গিয়ে ভেতর থেকে হনুমানের লেজের মতো জিনিসটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে, আর তারপরেই খালি বোতল টা নিজেই মাটি তে ঘষে সরে এল কাছেই পড়ে থাকা ছিপিটার দিকে। সামনে আসতেই ছিপি টা নিজেই আটকে গেল বোতলে।

পান্ডে জি দৌড়ে গিয়ে বোতলটার মুখ একটা লাল কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ব্যাগে পুরলেন। আর মাটিতে শুয়ে থাকা বোনকে দেখিয়ে বললেন, “ওনাকে একটু দুধ জাতীয় কিছু খাইয়ে দিন, সুস্থ হয়ে যাবে। আমারই ভুল, ক্ষমা চাইছি, আপনাদের থেকে কোন পয়সাকড়ি নেব না, শুধু এইবেলা একটু খেতে পেলে ভালো লাগত।”

চরণের বাবা বলে উঠলেন, “আর যেন এই সীমানায় কেউ না আসে বলে দিলাম। আর তুই খেয়ে যাবি অবশ্যই। ওরে কে আছিস, পান্ডের জন্য থালা লাগা।”

দুপুরটা টানা ঘুমানোর পর সন্ধেবেলা বোন আবার সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু আশ্চর্যভাবে সারাদিনের ঘটনার কিছুই ওর মাথায় ছিল না আর।

||

গল্প শেষ করে চরণ একটা বেশ বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভাই, এখনো রাতে বউয়ের সাথে শুতে গেলে ভয় লাগছে! তবে আর যাতে আমাদের বাড়িতে এই জিনিস না হয়, সেই ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি সেদিন থেকেই।”

আমরা সবাই বলে উঠলাম, “সেটা কিভাবে?”

চরণ বলল, “ওই পান্ডে ধুরন্ধর লোক, ব্যাটা বোতল খুলে ভুত ছেড়ে দেয়, আর তারপর লোকে ওকেই ডাকে ভুত ছাড়াতে, এইভাবেই রোজগার করে মাল টা। ভুত গুলোরও আবার এরিয়া স্পেসিফাই করা আছে, এক একটা জোনে কাজ করে।”

– বলিস কি! তা তুই কি ব্যবস্থা করলি?

– সেদিন যখন পান্ডে গুছিয়ে বসে খাচ্ছিল, তখনই মাথায় আইডিয়া টা খেলে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে কাজটা করেও ফেলি। দাঁড়া…

বলেই পাশে রাখা ব্যাগের ভেতর থেকে বার করে চরণ আমাদের সামনে টেবিলের ওপর রাখল একটা আদ্যিকালের কাঁচের বোতল। সেটার মুখে একটা কর্কের ছিপি আর একখানা লাল কাপড় শক্ত করে পেঁচিয়ে বাঁধা।

 

 

গল্প ৪ ~ “কার্ণিশ”

নাহ্, আজ আর চতুর্থ গল্প শুরু করে থেমে যাব না, একই ট্রিক বারবার চলে না, তাছাড়া প্রচুর খিস্তি খেয়েছি লাস্ট দুবার এই অপকম্মো করে। তবে এইটুকু বলে রাখি যে মেসেঞ্জারে অনেকে আমার সাথে তাদের সত্যি ভুতের গল্প শেয়ার করেছেন। ভয়ানক সেইসব অভিজ্ঞতা! তবে আমার সবচেয়ে বেশি ভয় লেগেছে অনিশা মুন্সীর বেশ কয়েকটা হাড় হিম করা ঘটনা শুনে, পারমিশানও পেয়ে গেছি অনিশার থেকে। তাই “কার্ণিশ” গল্প টা সামনের বুধবার রাত ১০ টায় থাকবে সবার জন্য। অনিশাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে ওর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লেখার যোগ্য মনে করার জন্য।

আরও অনেকের সত্যি ভুতের ঘটনা পড়ছি রোজ, দারুণ লাগছে। ভৌতিক কাজকর্ম আমরা কেউই প্রোমোট করি না কখনোই, কারণ জানিই তো না এগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণ গুলো। কিন্তু সবাই যে তোমাদের লেখা এখানে শেয়ার করছ, এটাই আমাদের বিশাল পাওনা।

একটা কথা কিন্তু ঠিক। ভুতের থেকে আজকাল মানুষই বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, হয়তো ভুতেরা আজ আমাদের ভয় পায়, আমাদের নিয়ে গল্প লেখে। খুব ভালো একটা কমেন্ট পড়লাম আমার লেখায় সেদিন, মাফ করবেন নামটা ভুলে গেছি। এই ভুতেদের দেখেই আমাদের মনে আশা জাগে, যে মরে গিয়েও এই পৃথিবীর মাটিতে থেকে যেতে পারবো অ্যাটলিস্ট। ভুত চতুর্দশীর দিন যদি দেখা দিতে পারি, তাহলে সবাইকে জানিয়ে যাব “শুভ দীপাবলি!”

~~~@~~~

বিঃ দ্রঃ ~ বন্ধু বোতল সরিয়েছিল ঠিকই, তবে ওই বোতল বের করে টেবিলে রাখার পার্ট টা আমার আইডিয়া, সত্যি সেদিন ও এমন করলে ওর মাথায় ভাঙতাম সেই অলক্ষুণে বোতল।

 

~ ফুল সিরিজ ~

ভূত আমার পূত – গল্প ১ ~ আমার জানলা দিয়ে

ভূত আমার পূত – গল্প ২ ~ ফরাসী হোটেল

ভূত আমার পূত – গল্প ৩ ~ কড়ে আঙুল

ভূত আমার পূত – শেষ গল্প ~ কার্নিশ

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি

প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ~ Anari Minds

2 comments

Comments are closed.