ভূত আমার পূত – গল্প ৪ ~ কার্নিশ

Anirban & Arijit, Humor, Series, Short Story, Supernatural, বাংলা, ভূত আমার পূত

(আমার সত্যিকারের ভয় পাওয়া অবলম্বনে)

সেদিন লন্ডন থেকে একটু দূরে একজন বন্ধুর বাড়িতে পাত পেড়ে খেতে গেছিলাম, নিজেকেই নেমন্তন্ন করিয়ে নিয়েছিলাম আর কি, বন্ধুর বউয়ের ফেসবুকে পোস্টানো লোভনীয় রান্নার ছবি দেখে। তা বেশ ভালোই একটা গেট টুগেদার হল, আরও অনেকে এসেছিল। তবে যে কারণে বলা এইসব, সেটা হল, আড্ডার মাঝে একজন বলে উঠল, “তোর এই ঢপবাজি মার্কা ভুতের সিরিজ টা কবে বন্ধ করবি বল তো, লোকজন কে তো খালি মুরগি বানাচ্ছিস। বলছিস নিজের ভয় পাওয়ার গল্প, আর শোনাচ্ছিস চরণের বিয়ের কথা।”

কথা কাটাকাটি তে আর যাইনি সেদিন, ওকে “বোকা” বললে হাফ বলা হত। অবশ্য সত্যিই তো, আমার নিজের অভিজ্ঞতা তো শুধু প্রথম দুটো পর্ব তেই ছিল। তার পরেরটা তো শুধুই শোনা। কিন্তু, শুনে ভয় পেলে সেটাও তো আমার সত্যিকারের ভয় পাওয়াই হল নাকি, আর সিরিজটাও তো সেই টপিক নিয়েই। প্রথমে ঠিক করেছিলাম চরণের গল্পই হবে এই সিরিজের শেষ গল্প, কিন্তু ফেসবুক চ্যাটে অনিশার ঘটনা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল বিশ্বাস করো!

ওর থেকে তাই পারমিশানও নিয়ে ফেললাম সবার কাছে ওর অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমার কাছে এই পর্বই এই সিরিজের বেস্ট, কারণ লিখতে লিখতেই হাত পা কাঁপছিল ভয়ে। তবে এর সত্যতার দায়িত্ব অনিশা মুন্সির, যাকে নিয়েও দুকথা বলতেই হয়। তবে তার আগে বলে রাখি এই সিরিজ আজই শেষ হচ্ছে, এটাই শেষ গল্প, জোর করে টেনে বাড়ানোর পক্ষপাতী আমি নই, কারণ তাতে তোমাদের ভালোবাসা কমে যেতে পারে, যা আমি ভুলেও চাই না।

একটা ব্যাপার বলে রাখি, ঘটনা গুলো শেষ থেকে শুরু এইভাবে সাজানো। রিকোয়েস্ট করছি খুব বুকের পাটা না থাকলে এই গল্প টা আর রাত জেগে আলো নিভিয়ে না পড়াই ভালো। এই প্রথমবার আমি তোমাদের আগেই সাবধান করতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ কারোর হিতে বিপরীত কিছু হয়ে গেলে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারব না।

শুরু করছি আজকের গল্প।

||

অনিশা থাকে বেহালার সরশুনায় বাবা মার সাথে। দোতলার ফ্ল্যাট। গ্রাজুয়েশন শেষ করে নিজের স্বপ্নের দিকে হাত বাড়াতে ব্যস্ত সে। তবে অনিশার আসল স্ট্রেন্থ হচ্ছে ওর অতুলনীয় সাহস। ওর মা মাঝে মাঝেই বলে ওঠে যে মেয়েদের এতো সাহস ভালো নয়, তবে কে শোনে কার কথা। ছোটবেলায় স্কুলে দুষ্টুমি করায় যখন ওকে ভুতের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছিল, তখন সারাদিন ধরে এই মেয়ে স্কুলের পরিক্রমা চালিয়েছিল ভুতের সেই ঘর খানা খুঁজে বের করার জন্য। এহেন সাহসী মেয়ে না হলে অনিশার এই অভিজ্ঞতা আর শোনা হত না।

এবার আসি বাস্তু বর্ণনায়। ভুতের গল্প লিখতে গেলে পরিবেশ তৈরি করা একান্ত কর্তব্য, না হলে কখন কোথায় আবার সোফা খুলে খাট হয়ে যাবে কে জানে। দুখানা ঘর অনিশাদের ফ্ল্যাটে, একটাতে অনিশা থাকে, অন্যটাতে ওর বাবা মা। অনিশার ঘরের খাটের মাথার দিক করে একটা জানলা। এই জানলার পাশেই পরের জানলাটা লাগোয়া ঘরের। দুটো জানলার ওপরেই একখানা করে লম্বা কার্নিশ বা সানসেট।

ব্যাস, ঘরের এইটুকু বর্ণনাই যথেষ্ট। অনিশা পরে আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালে এমনিতেই সবাই ওদের রান্নাঘর আর ডাইনিং রুম দেখে নিতে পারব।

এবার আসল কথা বলি ওদের ফ্ল্যাটের তিন তলা নিয়ে, ভয়ের উৎস যে ওখানেই। তবে গতানুগতিক ভুতের গল্পের মতো শোনাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে, ন্যাকা ন্যাকাও বলতে পারো। তার চেয়ে চলো অনিশার লেটেস্ট অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক, তার সূত্র ধরেই না হয় তিন তলায় ওঠা যাবে।

||

রাতে ঘুম আসে না অনিশার। মোটামুটি ভোর ৫ টা নাগাদ নিদ্রাচ্ছন্ন হয় সে। এই রাতজাগার কারণ কিন্তু আমাকে বলেনি, যদিও ওর বয়সে আমাকেও রাত জাগতে হত পূর্বরাগের কারণে, তবে অনিশার কারণ টা সত্যিই আমি জানি না। রাত জেগে মাঝে মাঝেই ভুতের বই পড়া বা হরর সিনেমা দেখার অভ্যাস ওর আছে। তা আজ থেকে দু সপ্তাহ আগে এমনই এক রাতের ঘটনা।

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে একটা শর্টফিল্ম দেখতে ব্যস্ত তখন অনিশা। জানলার ধারে মাথা, বালিশে হেলান দেওয়ানো মোবাইল, কানে ইয়ারফোন। জানলা খুলে ঘর অন্ধকার করেই শোয় ও। হঠাৎ মনে হল পিঠের ওপর যেন একটা কনকনে ঠান্ডা ভারি জিনিস চেপে বসল। এমনভাবে সেটা বসল যে আর চেষ্টা করেও সোজা হওয়া যাচ্ছে না! এই অবস্থাতেই একটা হিমশীতল ঠান্ডা হাওয়া মাথা থেকে পা অবধি ক্রমাগত আসা যাওয়া করছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল যে খাটের সামনে মনে হচ্ছে একটা বাচ্ছা ছুটোছুটি করছে!

এই ব্যাপারটা ১৫ থেকে ২০ মিনিট মতো চলার পর হঠাৎ মনে হল পিঠ থেকে সেই ভারী বস্তু টা উঠে গেল। সোজা হয়ে বসতে পেরেই ঘুমে ঢুলে পড়ল অনিশা।

পরের গোটা দিন কিন্তু পিঠে বেশ ভালোই টনটনে ব্যথা ছিল, ভারি ব্যাগ পিঠে নিলে যেমন ব্যথা হয় আর কি।

||

অনিশার লাইফের মোটো হচ্ছে মরতে তো একদিন হবেই, তবে সেটা ভয় পেয়ে কখনোই নয়। কাশ, ওর এই অ্যাটিটিউড টা আমার থাকত।

এবার আসা যাক ওদের বাড়ির তিন তলায়। এই ফ্ল্যাট টা এখন ফাঁকা। তবে দু বছর আগে এখানেই থাকতেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। মেয়ে আত্মহত্যা করার পর থেকে একাই ছিলেন। এমনিতে কারোর সাতে পাঁচে না থাকলেও সারাদিন মোটামুটি মদ্যপান আর একে ওকে খিস্তি খেউরের ওপর দিয়েই কাটাতেন। রাত বাড়লে নিজের মেয়েকে ডাকতেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আর ওর সাথে গল্প করতেন। ফ্ল্যাটের কেউ অবশ্য কোনওদিন তিন তলায় গিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি যে উনি আসলে কার সাথে গল্প করেন। মাঝে দু একবার সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তবে ফিরে এসে আবার যে কে সেই।

যেদিন উনি মারা গেলেন, সেদিন ফ্ল্যাটের মোটামুটি সবাই শ্মশানে গেলেও অনিশা আর ওর মা বাড়িতেই রইলেন। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিশা ওদের ফ্ল্যাটের দরজাও ছিটকিনি দিয়ে দিল। কিন্তু একটু বাদেই শুরু হল দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা। অনিশা উঠে গিয়ে দরজা খুলল, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। এইরকম দু তিন বার হওয়ার পর দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল সে। আবার দরজায় টোকা পড়তেই এক ঝটকায় দরজা খুলে দিল, কিন্তু এবারেও কাউকে দেখা গেল না করিডরে বা সিঁড়িতে! অনিশার মা বললেন দরজা টা আজ খোলাই রেখে দিতে, কারণ যিনি আজ সব মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, তিনি মনে হয় আজ এই দরজা আর বন্ধ করতে দেবেন না।

এরপর বিকেলে সবাই ফিরে আসার পর আর কোনও উৎপাত হয়নি।

||

তিনতলার কাকু মারা যাওয়ার ২ দিন পরের ঘটনায় আসা যাক। আলো বন্ধ করে অনিশা যখন শুতে গেল, তখন রাত ৩:৩০। জানলার দিকে মাথা করেই শুয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ মনে হল জানলা দিয়ে সেই কাকু তিনবার ডাকলেন নিজের মেয়ে হিয়া কে। অনিশা উঠে বসে জানলার দিকে তাকালো, বাইরে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলো, চারিদিক নিস্তব্ধ, মনের ভুলও হতে পারে। ঠিক এইসময় জানলা দিয়ে আবার তিনবার কাকুর গলা স্পষ্ট শোনা গেল,

“হিয়া, অ্যাই হিয়া, হিয়া”।

হিয়া ওনার ৫ বছর আগে মারা যাওয়া মেয়ের নাম। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল অনিশার! হঠাৎ এই সময় পাড়ার সমস্ত কুকুর বেড়াল একসাথে খুব বিশ্রীভাবে কেঁদে উঠল।
পাড়ার অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল, পাশের ঘরে অনিশার মা-ও উঠে পড়লেন।

এই ঘটনার পর থেকেই অ্যাপার্টমেন্ট জুড়ে আর এক কাণ্ড শুরু হল। রোজ রাত ৩ টে থেকে ৩:১০ এর মধ্যে সবার ফ্ল্যাটের বাইরের গ্রিলের তালা বেশ ঝনঝন করে নড়ে উঠতে থাকল। প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন যে মাঝরাতে কারুর কোনও এমার্জেন্সি হয়েছে হয়তো। কিন্তু পরে সোসাইটির মিটিং-এ জানা গেল ওইসময় কেউই বাইরে বেরোয় না, সবার সাথে এই জিনিস হয়, আর টপ ফ্লোরের লোকেরা তখন ছাদে কারুর পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ছাদ আর মেন সদর দরজায় তালা দেওয়া থাকায় কোনও ছিঁচকে চোরের পক্ষে ভেতরের সিঁড়ি তে আসাও সম্ভব নয়।

সকলের সমবেত সিদ্ধান্তে এর পরের ২ সপ্তাহ রাতে সিঁড়ির সমস্ত আলো জ্বালিয়ে রাখা হল। যদিও সেই তাণ্ডব কমলো পরে বেশ কিছু হোমযজ্ঞ করার পর।

||

৫ বছর আগে যেদিন হিয়া মারা গেল, সেদিন ছিল পয়লা মে। ওর আত্মহত্যার কারণ আর এখানে বললাম না। গল্পের খাতিরে ওর নামটাও বদলে রাখলাম। পুলিশ এসে ওর ঝুলন্ত দেহ নামিয়ে নিয়ে যখন চলে গেল তখনও ফ্ল্যাটের কারুর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে হিয়া এমন একটা কিছু করতে পারে। মাত্র ১৯ বছর বয়স ছিল ওর।

রাতে অনিশার বাবা জেদ ধরলেন যে মেয়েকে একা ঘরে শুতে হবে না এখন, ওদের সাথেই যেন শোয়। ওনার কোথাও কিছু একটা নিয়ে খটকা লাগছিল। তবে দুদিন সেইভাবে শোওয়ার পর সাহসী মেয়ের বায়না শুরু হল যে তাকে তার নিজের ঘরেই শুতে দিতে হবে।

৩রা মে ২০১২। হিয়া মারা যাওয়ার ঠিক দুদিন পর। আজ অনিশা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে একা নিজের ঘরেই থাকার। লাইট অন করে শুলে ওর ঘুম আসে না, তাই ঘর অন্ধকার করেই শুয়েছে। সন্ধ্যে থেকেই বাইরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি, থামার নামগন্ধ নেই, সাথে অবিরাম বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর বাজ পড়ার আওয়াজ। বৃষ্টির ছাঁট উলটো দিকে বলে অনিশার ঘরের জানলা খোলা। পাশেই বাবা মায়ের ঘরের জানলা, আর দুটো জানলার ওপরেই কার্নিশ।

রাত তখন দেড়টা কি দুটো হবে। একনাগাড়ে বৃষ্টি চলছে। জানলার দিকেই তাকিয়ে শুয়ে অনিশা। হঠাৎ একটা বেশ জোরালো বিদ্যুৎের ঝলকানি তে যা চোখে পড়ল, তা আমি দেখলে কি হত সে তো পরের কথা, ভাবলেই শিউরে উঠছি এখন। দুটো ছাই রঙ এর পা অনিশার ঘরের জানলার কার্নিশ থেকে ঝুলে আছে! পা দুটো এতটাই লম্বা যে হাঁটু কার্নিশের কাছে কিন্তু পায়ের পাতা দুটো জানলার নিচের গ্রীলে রাখা! পরপর দুবার বিদ্যুৎ চমকালো আর একই জিনিস চোখে পড়ল। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলো অনিশা, এগিয়ে গেল জানলার কাছে ভালো করে দেখবে বলে। কিন্তু হঠাৎ এক ধাক্কায় ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন অনিশার মা আর ঘরের লাইট অন করে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন,

“রিমি!”

||

রিমি অনিশার ডাকনাম। সেই রাতে তো বটেই, আগামী এক সপ্তাহ আর নিজের ঘরে শোওয়ার পারমিশান পায়নি অনিশা। মেয়ে অনেক জোরাজুরি করাতে পরেরদিন সকালে উনি বলতে বাধ্য হলেন যে কেন ওইসময় ঘরে ঢুকেছিলেন অনিশার মা। ওদের ঘরেও ঠিক খাটের সামনেই জানলা। বাজের শব্দে ঘুম হঠাৎ ভেঙে যায় মায়ের আর জানলা দিয়ে বিদ্যুৎ এর আলোয় দেখতে পান দুটো ছাই রঙ এর পা ওদের কার্নিশ দিয়ে ঝুলছে, আর সেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে অনিশার ঘরের জানলার দিকে।

~ ফুল সিরিজ ~

ভূত আমার পূত – গল্প ১ ~ আমার জানলা দিয়ে

ভূত আমার পূত – গল্প ২ ~ ফরাসী হোটেল

ভূত আমার পূত – গল্প ৩ ~ কড়ে আঙুল

ভূত আমার পূত – শেষ গল্প ~ কার্নিশ

~ আমার স্টক টি ফুরোল, নিমগাছটি মুড়োল ~

আর হ্যাঁ, এবারে প্রচ্ছদ টিও এই অধমের কীর্তি!

তবে অফার এখানেই শেষ নয়, সাথে পেয়ে যাচ্ছ আরও একটা বোনাস ট্র‍্যাক! ভূত নিয়ে এত বড় একটা সিরিজ হল, আর ভূতের রাজা কে পেন্নাম ঠুকতে হবে না! শুনেই দেখো না নিচের লিঙ্কে কেমন বাঁশি বাজায় মাঠে তে রাখাল।

https://m.starmakerstudios.com/share?recording_id=548756462&share_type=copyLink

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি

প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি