শক্তি

Conversation, Dad & Daughter, Freedom, Friends, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, বাংলা

দীর্ঘ দু ঘন্টা হয়ে গেল পার্লারে বসে আছে পাখি। নামী-দামী পার্লার বলে কথা সেখানে যাওয়া মানেই আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তারপর যাওয়া,গিয়েও বসে আছে ঘন্টা দুই হয়ে গেল। সামনের আয়নাটা কেমন ঝাপসা লাগছে, নিজের মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছেনা একবারও পাখি। একবার বই পড়ছে একবার মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে, এতেই সময় যাচ্ছে।

 – কোকোনাট অয়েল, অলিভ অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল একসাথে মিশিয়ে গরম করে ভালো করে স্ক্যাল্পে আর চুলে লাগান,তারপর একটি হট টাওয়াল জড়িয়ে নিন তাহলে বাড়িতেই হয়ে যাবে হেয়ার স্পা,আজকের জন্য এই টুকুই আবার  পরে আসবো টিপস নিয়ে,আর আমার চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন আরও নতুন টিপসের জন্য।
থ্যাংক ইউ।
– হলো তোর??
– হ্যাঁ মা।
– এবার আয় আমি তেল মাখিয়ে দি তোকে।
– হ্যাঁ দাও,মা তোমার হাতের ম্যাসেজে জাদু আছে মা লাভ ইউ।
– হয়েছে হয়েছে আর অতো আদর করতে হবে না। হ্যাঁ রে মা এই কদিনে তোর চ্যানেল অনেক মানুষ দেখেন বল? আমি আর তোর বাবা দুজনেই খুব খুশি জানিস, কোনো দিন হারতে শিখিসনি তুই।
– এটাও তো তোমাদের দেওয়াই শিক্ষা মা। তোমরা দুজন পাশে না থাকলে বড় না করলে কি এই সব হতো।
– নারে মা তোর শেখার চেষ্টাটাই আসল। প্রফেসর, ভালো কলেজে পড়াস, ভালো আঁকা জানিস, কত ভালো আবৃতি করিস, গল্প লিখিস, আবার এই বিউটি টিপস দেওয়া এই সব দিক থেকেও কতো কিছু জানিস। আজ অবধি পার্লরেও যেতে হয়নি।
– মা পার্লারে যেতে হয়নি তোমার জন্য। সব তোমার টিপস। বাড়িতেই কি ভাবে নিজেকে সুন্দর করে তোলা যায়। আর আজকাল eye brow, waxing ওই সবও বাড়িতেই করা যায়, তাই আর যাওয়ার দরকারও পরেনি কোনোদিন।
– এবার বাবা একটা ভালো বিয়ে হলেই হলো,আমার আর তোর বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে।
– এখন নয় আর একবছর বাদে করবো বুঝলে। যাই হোক চলো আমায় আবার স্টুডেন্টদের খাতা গুলো দেখতে হবে।আজ সানডে ভালো রান্না করো খাবো।
– হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। বাবা বাজার থেকে এলেই রান্না বসাবো।কি খাবি বল?
– ওই তোমার হাতের ডাল,ভাত তরকারি,ভাজা এই সব ,বিরিয়ানি মাংস আর জানো ভালো লাগে না।
– আচ্ছা ঠিক আছে তাই বানাবো।……….
– ……….”

এইসব ভাবতে  ভাবতেই ডাক পড়লো পাখির।
– কি করাবেন ম্যাম?
– ফেসিয়াল আর হেয়ার কাট।
– ওকে।

ফোনটা বেজে উঠলো পাখীর।
– কিরে মা কোথায়? কখন আসবি? আমাদের বেরোতে হবে যে আবার।
– হ্যাঁ মা আসছি দু -আড়াই ঘন্টার মধ্যে।
– আচ্ছা।”

পার্লর থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি গেল পাখি। বেল করতেই দরজা খুলে দিলেন পাখির বাবা। পাখি কে দেখেই মা বাবা দুজনেই বাকরুদ্ধ। পায়ের তোলার মাটিটা যেন সরে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীটা যেন ভয়ঙ্কর লাগছে তাদের কাছে।

  – “পাখি মা…..” মায়ের মাথা ঘুরে যায় পাখিকে দেখে।
– মা ,মা নিজেকে সামলাও বাবা মাকে ধরো।
– ঘরে চলো সুমি।
– মা,বাবা আমায় কেমন লাগছে বলো তোমরা? নিউ লুকে। আজ অবধি পার্লরে যাইনি, আজ গিয়ে নতুন ফ্যাশন করে এলাম এবার স্কার্ফ বাঁধবো আমায় কেমন দেখাবে বলো তো মা?? হাহাহা কি গো বাবা কিছু বলো?

ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় পাখি। নিজের রূপকে সাদরে গ্রহণ করে সে, কারণ এই সময় যদি সে নিজে ভেঙে পরে তাহলে মা বাবা কে সামলাবে কে? তার কোনো দুঃখ নেই, সে হারতে শেখেনি কোনো দিন। আর পাখি জানে একমাত্র সে নিজেই যে নিজেকে ছেড়ে কোনো দিন যাবে না। সব মানুষ আমাদের ছাড়তে পারে কিন্তু, আমরা নিজেরা কোনো দিন নিজেদের ছেড়ে যাইনা।

  – সুমি দেখেছো আমাদের মেয়ে  মনের দিক থেকে কত শক্ত। আমাদের তো ওর পাশে থাকা উচিত গো আমরা ভেঙে পড়লে কে দাঁড়াবে ওর পাশে।
– কি করে মানব গো পিঠ ভর্তি চুল, মুখে চোখে কত গ্ল্যামার, আজ সেই মেয়ের মাথায় একটাও চুল…..না না মানতে পারছি না আমি।
– মানতে হবে, সুমি মানতে হবে আমাদের ভেঙে না পড়ে ওর শক্তি হতে হবে। ওঠো চোখের জল মুছে ওর নতুন রূপের আহ্বান জানাও, ওকে উৎসাহ দাও। আমাদের যে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আজ, পাখির প্রথম ‘কেমো।’ ওঠো সুমি ওঠো যাও মেয়ের কাছে যাও।

কোনো মতে বিছানা থেকে উঠে চোখের জল মুছে মেয়ের কাছে গেল মা।

  – “খুব সুন্দর লাগছে এই নিউ স্টাইলে জানিস পাখি। জিন্স, টপ,মাথায় স্কার্ফ আহা নজর না লাগে তোর।” বলে কাজলের টিপ দিলো মা।তারপর মেয়েকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো সে।
– “না মা কেঁদে নয় হাসি মুখে আমার আরোগ্য কামনা করো। যাতে খুব তাড়াতাড়ি আমি সুস্থ হয়ে নিজের আগের রূপে ফিরে যেতে পারি, আবার তোমাদের স্বাধীন পাখি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে পারি।”

পাখির চোখের কোনে জল। তবুও সে নিজের চোখের জল মুছে বাবা মায়ের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়, বাবা মাও নিজেদের চোখের জল গোপন করে তার শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। ক্যান্সারের সাথে লড়াইটা তো মুখের কথা নয়। সেই লড়াইয়ে জেতার জন্য পাখির মতো মনের জোরের দরকার,আর সেই মনের জোর তার আছে।

লেখিকা ~ পায়েল ব্যানার্জী

প্রচ্ছদ ~ cdn.skim.gs