আত্মার বিস্ময়

Humor, Nostalgia, Satire, Short Story, Story, Supernatural, বাংলা

বিশেষ দিনে আত্মারা প্রেতলোক ছেড়ে মনুষ্যলোক ঘুরতে আসে। এবছর সেরকমই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর জীবননান্দ দাস এসেছিলেন কলকাতা বেরাতে। এসেই তাঁরা ঝটপট মানুষের বেশ ধারণ করে ডেকার্স লেনে চিত্তদার দোকানে চিকেন স্ট্যু আর পাউরুটি খেয়ে এসপ্ল্যানেডে গিয়ে একটু লস্যি খেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করলেন। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু রসিকতাও চলছিল। এরই মাঝে একটা ট্রামকে দেখে জীবননানন্দ একটু আঁতকে উঠলেন।
তখন সত্যেন্দ্রনাথ বললেন – এই সামান্য ট্রাম দেখিয়াই চমকিয়া উঠিতেছ, আসল ভয়ের বস্তু তুমি পরখই কর নাই। করিলে তব ট্রামে ভীতি ফুৎকারে উড়িয়া যাইবে।
জীবনানন্দ : কহেন কি মশায়? মৃত্যুভয় অপেক্ষা ভয়ঙ্কর কিই বা হইতে পারে হে?
সত্যেন বললেন – শুনোহে আমরা চলিত ভাষায় কথা বলিব,এই ভাষায় কথা কহিলে পারিপার্শ্বিক জনগণ আমাদিগকে উন্মাদ কহিবে।
জীবন : ঠিক বলেছেন দাদা। এই চলিতটাই শ্রেয়,আচ্ছা কোন জিনিস আছে যা মৃত্যু ভয় অপেক্ষা ভয়ঙ্কর? হাজার বছর আমি পথ হাটিতেছি, এতো গোচর হয় নাই।
সত্যেন : লস্যিটা শেষ কর। চল একটু বালিগঞ্জ যেতে হবে।

বালিগঞ্জ পৌছে একটা বাড়িতে ঢুকে একজনের সাথে সাক্ষাৎ হল। পাগল পাগল বেশ,অমন সুপুরুষ মানুষটা গুটিয়ে পুরো কুঁকড়ে গেছেন।জবুথবু ভাব।

জীবন : আরে এতো যামিনী রায়, এর এই দশা কি করে হল? গতবার আমাদের মতই বেরাতে এসেছিল তো। তারপর আর প্রেতলোকে ফেরেননি।

সত্যেন : ভয়। আমরা আত্মা। আমাদের ভয় লাগে না। তাও কেমন ভয় পেয়েছে দেখ!

জীবন: আরে এতো পুরো পাগলা হয়ে গেছে।আমাদের চিনতেও পারছে না।
সত্যেন : তা ভয় পাওয়ার কারণ উদ্ঘাটন করবে না কি হে?
জীবন : চলুন দেখা যাক্।
সত্যেন : চলো ওলা ধরি, করুণাময়ী যেতে হবে।
জীবন: কলকাতায় এসে কি আওয়াজের চোটে আপনি সব বিস্মৃত হলেন? আমরা আত্মা।আমাদের এস্পেশাল ক্ষমতা আছে। আমরা গায়েব হতে পারি। শুধু জায়গা বলুন।

অতঃপর দুজনে সেন্ট্রাল পার্কে হাজির হলেন। প্রবল ভীড়। আমাদের মত ফেসবুক লেখকদের ভীড়ে কেউ জীবন আর সত্যেন কে চিনতেও পারছে না। আনন্দ, দেজ এ তো ঢোকাই যাচ্ছে না। রকবাদ্যি, খাওয়া দাওয়া আর সেলিব্রিটিদের চাপে নাজেহাল অবস্হা।একটা হ্যোৎকা মোটা মহিলা তার ছোটা বাঁটুলকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেল।যাওয়ার সময় সত্যেনকে একটা গুঁতো দিয়ে গেল।
একটি পীনোন্নত পয়োধরা তন্বী চেঁচিয়ে তার গেভারা টিশার্ট আর ওয়ারকার্গো পোশাক পরিহিত ঝুঁটি বাঁধা আঁতেল মর্দ সাথীকে বলল “চল্ চল্ ওদিকে সিঙ্গার পোটা এসেছে, একটা সেল্ফি তুলি”।

জীবন সত্যেনকে বলল – হ্যা দাদা, এটা কি বাঙালীর নতুন অবতার না কি? মাথায় ঝুঁটি,ভুরুতে পেরেক। লক্ষণ ঠিক সুবিধার ঠেকছে না। আপনি সিওর এটা পুস্তক মেলা।
আর পোটার সাথে সেলফি? পোটা তো যদ্দুর জানি নাকের ভেতরে থাকে, ঐ বলে মেয়েটি চেঁচাচ্ছে কেন? আর সেল্ফিটাই বা কি?

সত্যেন বলল – কি ভয় করছে?

জীবন – হ্যাঁ দাদা। বাংলার সংস্কৃতির মুখে নুঁড়ো জ্বালার উপক্রম হয়েছে দেখছি।

এরই মাঝে এক ছোঁকড়া তাদের হাতে “হতাশ জীবনে আশার আলো জাপানী পুট্টিনুয়া লিঙ্গবর্ধক যন্ত্র ও তৈল” এর একটি
প্যামফ্লেট ও আরেক ছোকড়া একটি “আধুনিক কবিতা by নিস্তেজ চৌধুরী”র বই গুজে দিয়ে দশ টাকা নিয়ে চলে গেল।

জীবন ভয়ে তটস্হ হয়ে সত্যেনের মুখ দেখতে লাগল। পাতা উল্টে প্রথম কবিতাটি পড়ল জীবন।

“রাজা রাজা, কলিজা মে সামাজা,
পুরীর মন্দিরে ফেমাস খাজা আর গজা”

ধপ করে বসে পরল জীবন।

আরে এতে ঘাবড়াচ্ছ। মেন এট্রাকসন তো এখনো বাকি। চল চল।

সত্যেন তটস্হ জীবনকে এক প্রকার টানতে টানতে “জাগো বাংলা” স্টলে নিয়ে গেল।

– ঐ টা দেখ, এক কোটি আশি লাখ টাকার ছবি,ঐটা দেখে যামিনী পাগল হয়ে গেছে,
আর এই নাও “আজব ছড়া”। দশটা কবিতা পড়ে দেখাও” বলল সত্যেন।

দশটা দূরে থাক, একটা কবিতা পড়েই জীবন ভয়ে কাঁপিতে লাগল।
“পালাও সত্যেন দা, পালাই চল, ফিরে যাই, চিত্তকে প্রেতলোকে খুঁজে বের করলেই স্টু এর সমস্যা মিটে যাবে।
জাগো বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, পশ্চিম বাংলার মুখ আমি দেখিতে চাইনা আর” বলতে বলতে হাওয়ায় মিশে গেল সে।

আর সত্যেন রাত্রে চক্রধরপুরে চড়ে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামের একটা তেঁতুল গাছে আস্তানা গাড়লো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

লেখক – দেবপ্রিয় মুখার্জী

ছবি – অনির্বাণ ঘোষ