প্রেম এসেছিল, আবার

Freedom, Love Story, Marriage, Nostalgia, Short Story, Story, বাংলা

শান্তি নীড়,
কাঁঠাল তলা ময়দান,
নব বারাকপুর, (উঃ) ২৪ পরগনা

তমাল সেন আর সুতনুকার সংসার। শান্তি নীড় নামেও সার্থক। দু’জনের সংসারে ছন্দ পতন নেই কোথাও। উত্তর পঞ্চাশের, সরকারী কর্মচারী তমালবাবুকে ইদানিং কিঞ্চিৎ উদাসীন মনে হচ্ছে। বাজারে যাবার সময় প্রায়ই ব্যাগ নিতে ভুলে যাচ্ছেন। দু কেজি আলু আর পাঁচশো পেঁয়াজের জায়গায়, আধ কেজি আদা আর এক কেজি কুমড়ো নিয়ে এসেছেন আজ সকালেই। আর তাই নিয়ে সুতনুকার ঝামেলার এক শেষ। ফ্রিজে আর একটুও জায়গা নেই। এই এক ভুল করে তমালবাবু গতকাল একঝুড়ি শসা কিনে এনেছেন। তাইতেই ফ্রিজের অর্ধেক ভর্তি।
রান্না ঘর থেকে সুতনুকার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। খবরের কাগজের পাতা ওল্টালেও কান পেতে বোঝার চেষ্টা করছেন আসন্ন ঝড়ের প্রবলতা।

সাদামাটা কেটেছে দিনটা। সুতনুকা গুম মেরে আছেন। একটাও কথা বলেননি কাজের কথা ছাড়া। খাবার টেবিলে তরকারীর বাটি এগিয়ে দেওয়া, রাতের ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দেওয়া ছাড়া দু’জনের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। কর্মসূত্রে ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকার দরুণ রাতে শোবার আগে রোজ যেমন কথা হয়, আজও তেমনই হয়েছে।

তারপরেই হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন সুতনুকা। বিব্রত তমালবাবু কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন। কান্নার দমকে খাটের কোনায় বসে থাকা শরীরটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। তমালবাবুর এই ঘরে থাকতে খুব অস্বস্তি হলেও বেরিয়ে যেতে পারছেন না। আসলে এই কান্নার কারণটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। আর তাঁর স্ত্রীর নিয়মিত কান্নার কোনো রোগ নেই।
এভাবে কতক্ষন কেটে গেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। দাঁড়িয়ে থেকে বা’পাটায় খানিক অসুবিধাও হচ্ছে। পাশে গিয়ে বসাটা ঠিক কাজ হবে কিনা বুঝতে পারছেন না। এভাবে আরো কিছু সময় কাটার পর,কান্না থেমে এসেছে। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বালিশে মাথা রেখে স্ত্রীকে শুতে দেখে খানিক হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তমালবাবু। ঘরের আলো নিভিয়ে তিনিও বিছানায় পিঠ রাখলেন।
“তোমার মনে যদি অন্য কেউ এসে থাকে, তাহলে আমায় সোজাসুজি বলে দাও। আমি বাবানের কাছে চলে যাবো।”
হতচকিত তমালবাবু ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। “কি সব বলছো তুমি। এমন কথা এলো কোথা থেকে!”
“অফিস থেকে তুমি আর আজকাল ফোন করোনা দুপুরে। বাড়ি ফিরে কানে হেডফোন গুঁজে বসে থাকো। তিনবার ডেকেও সাড়া পাওয়া যায়না। একটা কিছু মনে করে আনতে পারো না।”
“আহা, আজকাল অফিসের একটু চাপ বেড়েছে। অনেক ফাইল জমে গেছে। সেগুলো শেষ করতেই আর সময় হয়ে ওঠেনা।”
“বাজে বোলো না। ভেবো না আমি কিছু বুঝিনা।”
“তুমি ভুল বুঝছো তনু। কিছুই হয়নি।”
“বুঝেছি, তুমি স্বীকার করবেনা। আচ্ছা, আমিও দেখবো কতদিন এরকম চালাতে পারো।”
স্ত্রীর পাশ ফিরে শোবার ধরণে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা এখানেই থামবেনা। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

প্রায় গোটা সপ্তাহটা এভাবেই কাটলো। প্রাত্যহিক কাজের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু ছাড়া, আর এর বর্ণও বেশী বলেননি সুতনুকা। এভাবে থাকায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তমালবাবুর। অফিসের কাজে মননিবেশ করতে পারছেন না। বাড়িতেও অস্বস্তিকর পরিবেশ। গেলো বুধবার ব্যাপারটার আরো অবনতি হয়েছে। বাবানের সঙ্গে কথা বলার সময় তার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য কারণ হিসেবে ছেলেকে অনেকদিন না দেখাকেই দায়ী করেছিলেন ফোনে।

শনিবারের ভোরবেলা। ঘড়িতে ছটা দশ। সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালেন তমালবাবু। তাঁর স্ত্রীর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। উল্টে সুতনুকাই তাঁর সব খামতি সয়ে গেছেন প্রতি নিয়ত। খানিক চুপচাপ বসে থাকার পর স্ত্রীকে ডাকলেন। ঘুমভাঙ্গা চোখে সুতনুকা অবাক হলেন। সারা রাত ধরে ভেবে রাখা কথাগুলোও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
“তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে, তনু।”
কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখ বড় হয়েগেলো সুতনুকার।
“তোমার সাথে সাথে আমার মনে আরো একজন বাসা বেঁধেছে। তোমায় আগেই বলা উচিত ছিল।”
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললেন তাঁর স্ত্রী।
“আহা, আগে তো শোনো সবটা। তুমিই আমার সব তনু। কিন্তু এ ভালোবাসা আলাদা। আমি রবিঠাকুরের গানের মোহে আটকে গেছি। আগেতো সেভাবে শুনিনি কখনো।”
“তুমি এইসব বুজরুকী দিয়ে এড়াতে চাইছো। তুমি এত জঘন্য হতে পারলে!”
“নারে বাবা, সত্যি বলছি। আগে খুব একটা রবীন্দ্র গানের কদর করিনি। কিন্তু ইদানিং কিছু গান শোনার পর যেন প্রেমে পড়ে গেছি।”
“একদম বাজে বকবে না। তুমি ঠকানোর চেষ্টা করো না আমায়।”
“কি জ্বালাতন, সত্যি বলছি। গানের ওপারে বলে একটা সিরিয়াল হতো। তার গানগুলো কিছুদিন আগে পেলাম অফিসের শ্রেয়সীর থেকে। তারপর ওই গানগুলো শুনেই যেন নতুন করে প্রেমে পড়ে গেলাম।”
“ও তাহলে এতক্ষনে নামটা বলেই ফেললে।”
“ধুস, কি যে বল! ও তো বাবানের থেকে অল্প একটু বড় হবে।”
“তাহলে কে শুনি?”
“আরে বলছি শোন না। এ যেন সেই নতুন করে প্রেমে পড়ার মতো। কত ফুরফুরে লাগে নিজেকে। যত শুনছি তত ভাল লাগছে।”
“তা আগে শুনতে কে মানা করেছিল? এই বুড়ো বয়সে এসে যত ভীমরতি।”
“তা নয় গো। আসলে বাড়িতে গান বাজনার চল তো ছিলো না কোনদিন। আর তুমিও তো সেভাবে গান নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখাওনি। বাবানের পেছনে ছুটতে ছুটতেই দিনগুলো কেটে গেছে। এবার একটু ফাঁকা পেয়ে নিজের মতো সময় কাটাচ্ছি এতদিনে।”
“মরণ, এবার একটা হারমোনিয়াম কিনে গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে যাও।”
“রেগে যাচ্ছ কেন। তুমিও শুনে দেখ। ভালো লাগবে। মনে হবে গানগুলো যেন তোমার মনের কথা ভেবেই লেখা।”
“ওসব আদিখ্যেতা করার জন্য এই ভোর বেলা ডেকে তুললে আমায়। তুমি থাকো তোমার গান নিয়ে। আর হ্যাঁ, সকালের বাজারে দু’আঁটি পালংশাক নিয়ে আসবে। মনে থাকে যেন।”

সুতনুকা বালিশে মাথা রেখে পাশ ফিরে শুলেন। খানিক পর তাঁর ভারী নিশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগলো।
তমালবাবু মনে মনে ভাবলেন “যাক ঝড়ের শেষে এবার শান্তি।”
খাটের পাশের টেবিলে রাখা মোবাইল আর হেডফোন তুলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। প্লেলিস্টটা চালাতেই খুব প্রিয় একটা গান বেজে উঠলো –
“তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ …”

লেখক: শান্তনু দাশ

ছবি: www.fanpop.com

অলংকরণ: আনাড়ি মাইন্ডস