গানের গল্প সিনেমার গল্প – ১ – স্মোক অন দ্য ওয়াটার

Anirban & Arijit, Humor, গানের গল্প সিনেমার গল্প, বাংলা

অডিয়েন্সরা উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে এই বিধ্বংসী আগুন থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য। ক্লদ ভাবছেন তিনি কি করে বাঁচাবেন এতজনকে, কিন্তু তিনি এখনও জানেন না যে আজকের দিন টা ইতিহাসে ঠাঁই পেতে চলেছে আর সেইসঙ্গে তিনিও বিখ্যাত হওয়ার পথে।

||

১৯৭১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর। ক্লদ নব্স এর চিন্তার শেষ নেই সকাল থেকেই। একজন দক্ষ ইভেন্ট অর্গানাইজার হলেও আজকের শো নিয়ে সকাল থেকেই তার মন বড় কু গাইছে, এমন তো আগে কোনদিন হয়নি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা লেকের ধারে এই ছোট্ট সুন্দর শহর মন্ত্রো। আর ক্লদের দায়িত্ব এই লেকের গা ঘেঁষে থাকা ঝাঁ চকচকে মন্ত্রো ক্যাসিনো তে আজ সন্ধ্যাবেলা দুটো বড় মাপের রক কনসার্ট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। মন্ত্রো জ্যাজ ফেস্টিভালের কর্ণধার যে তিনি।

ফ্র‍্যান্ক জাপা ও তার মিউজিশিয়ান ব্যান্ড “মাদার্স অফ ইনভেনশন” রিহার্সাল করতে ব্যস্ত। এদিকে ক্যাসিনোর সাথে আর একটা ব্যান্ডের চুক্তি পাকা। আজকের শো এর পর ক্যাসিনো বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকবে শীতকালীন পরিচর্যার জন্য। তাই সেই সময়ে “ডিপ পার্পেল” বলে একটা উঠতি ব্যান্ড ক্যাসিনোর বিনোদন কমপ্লেক্সে রেকর্ড করবে তাদের নতুন অ্যালবাম “মেশিন হেড”। এই রেকর্ডিং হবে একটা চলমান স্টুডিও তে যেটা ধার নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে বিখ্যাত ব্যান্ড “রোলিং স্টোনস” এর থেকে। সব মিলিয়ে বেশ বড়সড় ব্যাপার সামাল দিতে হবে ক্লদ কে। “ডিপ পারপেল” এর পুরো দল ক্যাসিনোর কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে।

সন্ধ্যা হতেই কনসার্ট শুরু হয়ে এগিয়ে চলল ফ্যানেদের প্রবল উদ্দীপনায়। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু অঘটন টা ঘটল ৮০ মিনিটের মাথায়। ডন প্রেস্টন তখন সিন্থেসাইজারে বাজাচ্ছেন “কিং কং” গানের সোলো, আর ঠিক এইসময়ে অডিয়েন্সের মধ্যে থেকে ফ্র‍্যান্ক জাপা-র একজন ফ্যান উত্তেজনার বশে আকাশের দিকে তাক করে ফায়ার করল তার ফ্লেয়ার বন্দুক। ছিটকে আসা আগুনের গোলা গিয়ে লাগল কাঠের সিলিং-এ আর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দ্রুত গতিতে। দর্শকদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রাণ বাঁচানোর আকুল চেষ্টা। স্টেজের বাঁদিকের ছোট কাঠের দরজা খুলে বেরোবার চেষ্টা করতে লাগলেন হাজার হাজার লোক।

রকস্টার ফ্র‍্যান্ক জাপা নিজেই প্রাণের বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। স্টেজের মুখোমুখি একটা বিরাট কাঁচের জানলা। ফ্র‍্যান্ক এগিয়ে গেলেন ওনার ভারি গিটার তুলে, কাঁচের ওপর সজোরে মারতে লাগলেন। বেশ খানিকটা ক্র‍্যাক হলো। বাইরে থেকে একজন সুইস ফায়ারম্যান এসে কোদাল দিয়ে কাঁচের গায়ে বেশ কয়েকবার আঘাত করতে ভেঙে পড়ল বিশাল জানলা। লাফ দিয়ে নেমে বাইরে আসতে পারলেন অনেক দর্শক। ক্লদ বাইরে বার করে আনলেন একে একে অনেক বাচ্চাদের।

মোটামুটি সবাই বাইরে বেরিয়ে আসার পর আগুন গিয়ে পৌঁছল বিল্ডিং-এর হিটিং সিস্টেমের কাছে, যার ফলে ঘটল বিশাল এক বিস্ফোরণ, কিন্তু সৌভাগ্যবশত কারুর প্রাণহানি হল না।

এই বীভৎস ঘটনা পাশের হোটেলের জানলা দিয়ে দেখছিলেন “ডিপ পার্পেল” ব্যান্ডের সমস্ত সদস্য আর শিউরে উঠছিলেন। তাদের মনে হল ক্লড ও ক্যাসিনো আর নেই। রাতের দিকে আগুন নিভে আসার সাথে সাথে তারা দেখলেন লেকের জলের ওপর থেকেই যেন জমাট বাঁধা ধোঁয়া উঠে আকাশে মিশে যাচ্ছে। ব্যান্ডের ভোকালিস্ট ইয়ান গিলান একটা পাতায় খসখস করে লিখে ফেললেন কিছু লাইন।

পরের দিন ক্লদ নিজে “প্যাভিলিয়ন” নামের একটা লোকাল থিয়েটারে ব্যবস্থা করলেন “ডিপ পার্পেল”-এর রেকর্ডিং এর। কিন্তু সমস্ত সাউন্ড অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর বাধ সাধলেন প্রতিবেশীরা, তারা অভিযোগ জানালেন যে এই শব্দ তারা বরদাস্ত করতে পারছেন না। লোকাল পুলিশ এসে রেকর্ডিং থামিয়ে দিলো।

এরপর এক সপ্তাহের বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর মন্ত্রোর বেশ ফাঁকা গ্র‍্যান্ড হোটেল ভাড়া পাওয়া গেল। হোটেলের পুরো হল, করিডর আর সিঁড়ি কে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়ে গেল বেশ বড় একটা স্টুডিও। শুরু হল রেকর্ডিং। “মেশিন হেড” অ্যালবামের জন্য তৈরি সবকটা গান রেকর্ড হয়ে গেল, কিন্তু আর একটা গানের চাহিদা রইল। আগের প্যাভিলিয়ন স্টুডিও তে বেসিস্ট রজার গ্লোভার একটা গিটার রিফ রেকর্ড করেছিলেন, যেটা সবার বেশ মনে ধরেছিল। ইয়ান গিলান পকেট থেকে বার করলেন সেই কাগজ যেটা লিখেছিলেন মন্ত্রোর সেই ক্যাসিনো অগ্নিকান্ডের দিন। গিটারিস্ট রিচি ব্ল্যাকমোর এগিয়ে এলেন কম্পোজ করার জন্য। গিলানের গলায় সেই গ্র‍্যান্ড হোটেলেই রেকর্ড হয়ে গেল আর একটা গান।

পরের দিন ক্লদের বাড়িতে ডিনারে হাজির “ডিপ পার্পেল” ব্যান্ডের সবাই। ইয়ান গিলান করমর্দন করে বললেন, “ক্লদ, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ গান আছে, কিন্তু এটা অ্যালবামে থাকছে না। গানটার নাম হচ্ছে… স্মোক অন দ্য ওয়াটার!”

ক্লদ নব্স শুনলেন সেই গান আর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন! “তোমরা কি পাগল নাকি! এই গান সুপারহিট হবে।” গিলান হেসে বললেন, “তোমার যদি বিশ্বাস থাকে, তবে আমরা এই গান অ্যালবামে ঢুকিয়ে নিচ্ছি।”

বাকি টা ইতিহাস!

এবার যদি আপনি “স্মোক অন দ্য ওয়াটার” এর লিরিক্স টা খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন তাতে সেই অগ্নিকান্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া আছে। তাতে ফ্র‍্যান্ক জাপা আর ক্লদের নামও নেওয়া হয়েছে। লেকের জলের ওপর সেই ধোঁয়া দেখেই তৈরি হয়ে গেল বিশ্ববিখ্যাত এক রক নাম্বার। গানের শুরুর গিটার রিফ টা জানেন না এমন গিটারিস্ট আজ পৃথিবীতে নেই। মন্ত্রো শহরে একটা ভাস্কর্য আছে, যাতে “ডিপ পার্পেল” এর নাম আর “স্মোক অন দ্য ওয়াটার” গানের স্বরলিপি খোদাই করা আছে।

১৯৭২ সালে রিলিজ করে “মেশিন হেড” অ্যালবাম, যাতে স্থান পায় “স্মোক অন দ্য ওয়াটার”। ব্যান্ড মেম্বার রা প্রথমে ভেবেছিলেন এই গান ফ্লপ হবে, কিন্তু হয় ঠিক উল্টো। রিলিজের এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটিশ চার্টে সবার ওপরে চলে আসে এবং আমেরিকায় এই অ্যালবাম ৭ নম্বরে আসে আর চার্টে রয়ে যায় টানা দু বছর।

১লা মে ২০০৯ সালে পোল্যান্ডে ৬৩৪৬ জন গিটারিস্ট মিলে একসাথে “ডিপ পার্পেল” এর তখনকার গিটারিস্ট স্টিভ মর্স-এর সাথে এই গানটি পারফর্ম করেন, যা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

~~~♦~~~

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি

প্রচ্ছদ ~ liveformusic.com