একটা হঠাৎ পাওয়া বিকেলবেলা

Anirban & Arijit, Childhood, Humor, আদতে আনাড়ি, বাংলা

*#একটা_হঠাৎ_পাওয়া_বিকেলবেলা*
© #অরিজিৎ_গাঙ্গুলি

ঝুপড়ির চায়ের দোকানের সামনে ভাঁড়টা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ভেঙে আবার এগোলাম অফিসের দিকে। বিকেল চারটে বাজল। আর একঘন্টা বাদে জয়েন করতে হবে ক্লায়েন্ট কলে। ডেস্কে গিয়ে কম্পিউটারটা আনলক করে বাইরে তাকালাম৷ এই জানলার ধারে সিটটা বেশ ভাগ্য করে পাওয়া। সোমনাথ দা বসত এখানে, অনসাইট চলে যাবে শুনতেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল করি এটা। কারণ একটাই, মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যেতে মন করে। তখন এই জানলাটাই ভরসা।

আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই বিকেলগুলোর কথা। তখনও হাতে ফোন বা জয়স্টিক আসেনি। বিকেলবেলা বন্ধুরা দল বেঁধে ডাকতে আসত “পিকলুউউউউ, খেলতে যাবি!” ব্যাট উইকেট আর সাথে চাঁদা দিয়ে কেনা সাড়ে তিনটাকার রবার ডিউস বল নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে হাজির হতাম অবিনাশ ব্যানার্জি লেনের সেই লম্বা গলির মুখে। মাঠগুলোতে বড় দাদারা পিচ দখল করে নিত। বা সেগুলো খালি থাকলেও আমরা উইকেট পুঁততে না পুঁততেই কোথা থেকে ওরা চলে এসে যেন আমাদের অজান্তেই সেই পিচে খেলতে শুরু করে দিত, আর আমরা আবার মাঠের ধারের দর্শক হয়ে যেতাম। হাইট থাকলেও ল্যাকপ্যাকে চেহারা নিয়ে পেরে উঠতাম না ওদের সাথে। তাই গালি দিতে দিতে ফিরে আসতাম আমাদের বাইশ গজের গলিতে।

পা মেপে মেপে ঠিক কুড়ি পা দূরে পোঁতা হত উইকেট। বেল তো দিয়েছিল সেটের সাথে, কিন্তু সেটা হারিয়ে গেছে কোন জন্মে। তাই প্যাঁকাটির দুটো টুকরোই সম্বল। উইকেট পোঁতার তিনটে গর্তে বর্ষাকালে জল জমে থাকত। গলির শেষে, মানে ব্যাটিং উইকেটের ফুট দশেক পিছন দিকে ছিল আমাদের খেলার একমাত্র বিরোধীপক্ষ। বয়স্কা এক মহিলা শুধু সেই বিকেলগুলোতেই সবচেয়ে আনন্দে থাকতেন, যেদিন আমরা খেলতে যেতাম না। ওনার বারান্দায় বল লাগলে বা গ্রিলের ভেতর বল ঢুকলে শুরু হত সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। একবার শাসিয়েছিলেন যে এরপর বল ঢুকলে উনি কেটে ফেরত দেবেন। আমরা ভেবেছিলাম উনি আমাদের বাচ্চা পেয়ে ভয় দেখাচ্ছেন। কিন্তু পরের দিন সত্যিই যখন দু টুকরো অবস্থায় বলটা ফেরত পেলাম, তখনই আমাদের এক শুভাকাঙ্ক্ষী কাকু একটা বিশাল কালো কাপড়ের দুদিকে দড়ি লাগিয়ে আমাদের উপহার দিলেন। ক্রিকেটে সাইড স্ক্রিন থাকে সামনে, আর আমাদের লাগাতে হল উইকেটের পিছনে। আর চিন্তা রইল না। উইকেটকিপার বল মিস করলেই তা আছড়ে পড়তে লাগল কালো পর্দায়, সেই বাড়ি অবধি পৌঁছতই না। আমরা ভাবলুম এবার নিস্তার পাওয়া গেল সেই বুড়িমার হাত থেকে। কিন্তু ওনার আবদার এবার বদলে গেল। উনি বিকেলবেলায় ওনার বারান্দায় বসে নাকি রাস্তা দেখেন, আর কালো কাপড় থাকায় ওনার ভিউ আটকে যাচ্ছে। কাপড় গুটিয়ে নিলাম। কিন্তু এইভাবেই আমাদের খেলা চলতে লাগল। উনি বল আটকাতে বললে আমরা কাপড় টাঙিয়ে দিতাম, আর ভিউ আটকাচ্ছে বললে কাপড় সরিয়ে দিতাম। বল ভিউ বল ভিউ করতে করতে একদিন উনি বেলভিউতে ভর্তি হলেন, কিন্তু আর ফিরলেন না।

গলির শেষেই ছিল বোলিং প্রান্তের উইকেট, যাতে পাতা হত তিনটে ইঁট৷ আর এরপরই ছিল চওড়া রাস্তা। ফাস্ট বোলারের রান আপে তাই রাস্তা ক্রস করে দৌড়ে আসাই ছিল একমাত্র সম্বল। আমি নাকি অলরাউন্ডার ছিলাম, অন্তত আমি নিজে তাই মনে করতাম। গাঁয়ে না মানুক, আপনি মোড়ল। দ্রাবিড়ের ফ্যান ছিলাম, তাই টুকুস টুকুস করে সময় কাটানোয় আমার বেশ নাম ছিল। বোলাররা হাঁপিয়ে যেত, খিস্তি মারত, তারপরেও আউট না হয়ে রেলা মেরে ডিক্লেয়ার দিতাম। আগে ব্যাট করলে আগে বল করতে পারবে না। এইসব নিয়ম গলি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের বানানো ছিল। মোটামুটি সব গলিতেই একইরকম নিয়ম চলত। ওয়ান ড্রপ ওয়ান হ্যান্ডে আউট। হ্যান্ডটা অবশ্য লেফট হতে হবে। বল কোথাও ড্রপ না খেয়ে কারুর বাড়ি ঢুকে গেলে আউট। যে ফেলবে তাকে আনতে হবে। বাড়ির মালিক বিরক্ত হয়ে অনেকসময় কড়া নাড়লে বা বেল বাজালেও সাড়া দিত না। তখন আমাদের মিশন “পাঁচিল টপকাও” চালু হত৷ গ্রিল বেয়ে কার্নিশ ধরে পাঁচিল টপকে ধুপ করে বাড়ির কলতলায় নামত সদ্য আউট হওয়া বল্লেবাজ৷ তারপর “খুঁজে পাচ্ছি না, আর একজন আয়” এইসব বলে বেশ কিছুক্ষণ ভ্যানতারা কষতো। তারপর “পেয়েছিইইই” বলার আনন্দে তারস্বর চিৎকারে তাকে আর পাঁচিল টপকে ফেরত আসতে হত না। সদর দরজা দিয়েই বেরিয়ে আসত এসকর্ট সাথে নিয়ে, আর এই সময় তখনকার মতো স্ট্র‍্যাটেজিক টাইম আউট হত। আমরা তাকে গার্ড অফ অনার দিয়ে মন দিয়ে বাড়িওয়ালার বাণী শুনতাম। তারপর মাথা নেড়ে ঘাড় দুলিয়ে খেলা শুরু হতেই তারু ব্যাটসম্যানের আলতো ছোঁয়ায় বল গিয়ে ল্যান্ড করত সেই একই কলতলায়। চুপচাপ উইকেট গুছিয়ে বাড়ি গিয়ে পড়তে বসতাম।

শ্রীনাথ ছিল আমার ফেভারিট বোলার৷ তারপর দেখলাম ডোনাল্ডকে, তারপর এল ম্যাকগ্রা, তারপর শোয়েব, তারপর ক্লুজনার, কখনও রবিন সিং, কখনও কুরুভিল্লা, কখনও আকিব জাভেদ – এইভাবে দিনে দিনে চেঞ্জ হয়ে যেত আমার বোলিং অ্যাকশন। এতে আর কেউ মজা না পাক, রাস্তাচলতি লোকজন বেশ এনজয় করত। গাঁক করে মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে ফেললে অর্গাজম হত সেই বয়সেই। আর বেঁড়ে পাকা বন্ধু, যে ব্যাট নিয়ে আসত, তাকে অন্তত দু তিনবার আউট না করলে ক্রিজ ছাড়ত না, এমন ঢ্যামনা। ঢিপ করে উইকেট ছিটকে বাতাসে দুবার বাঁই বাঁই করে পাক খেয়ে গোঁত্তা খেয়ে পড়ল, আমরা সেলিব্রেট করছি, আম্পায়ার আঙুল তুলে নাড়াচ্ছে, পরেরজন রেডি হচ্ছে নামবে বলে, এদিকে সেই ব্যাটসম্যান হরু দেখি মাথা নেড়ে বলছে আউট নয়৷ আমরা কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল বোলারের পা নাকি দাগের বাইরে ছিল যেটা আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে ওর চোখে পড়েছে। তাই নো বল, নো আউট৷ আমরা ধর্ণায় বসতেই হরু ব্যাট বগলদাবা করে বাড়ি চলে গেল। আমরাও দু তিন রাউন্ড ক্যাচ ক্যাচ খেলে বাড়ি গিয়ে পড়তে বসলাম।

আর একটা কেস বেশ মজার হত৷ রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছি রান আপ নেব বলে। এদিকে রিক্সা আসছে, বাইক আসছে, সাইকেল চলে যাচ্ছে, গরু যাচ্ছে হেলতে দুলতে, ক্রস আর করতে পারছি না। ফাঁকা যখন হলো তখন রবারের বল প্যান্টে ঘষে কেত মেরে দৌড়তে যাব, দেখি টিং টিং করে আমার ক্রাশ আসছে বাঁদিক থেকে। গোলাপী সালোয়ার সাদা ওড়না। ব্যস ভেবলে গেলাম। শোয়েব থেকে পল অ্যাডামস হয়ে গিয়ে কোনরকমে বেঁকে বুঁকে অষ্টবক্র স্টাইলে একটা লেগস্পিন দিতেই সপাটে ছক্কা হাঁকালো ওদিক থেকে, আকাশ দিয়ে উড়তে উড়তে বল গিয়ে পড়ল সোজা প্যাভিলিয়ন এন্ডে বাড়ির বারান্দায় লাগানো মূল্যবান সাইড স্ক্রিনে, যার পুরোটাই কাঁচের তৈরি। স্ক্রিন ভেদ করে বল ঢুকে গেল ভেতরে। আমরা আবার বাণী শোনার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম।

দরজা খুলে কাকু বেরোলেন। কে মেরেছে বলতে হবে, নয়তো খেলা বন্ধ করে দেবে। আমরাও নতুন শিখেছি একতাই বল, তাই আগেই ব্যাটসম্যানের হাত থেকে ব্যাট কেড়ে নিয়ে মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে। কাকু আমাকে বললেন যে বোলিং তো আমিই করছিলাম উনি দেখেছেন বারান্দার ফাঁক দিয়ে, তাহলে আমিই জানব কে ব্যাট করছিল। মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলাম যে বোলারের পাখির চোখ স্থির থাকে ত্রিকাঠিতে, তাই খেয়ালই করিনি কে ছিল। কাকু এবার চাললেন মোক্ষম অস্ত্র। ওনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, যে কিনা আমাদের এই গ্যাং-এই সামিল। আর আয়রনি হলো ব্যাটটা সেই করছিল। নিষেধাজ্ঞা জারি হল, খেলা বন্ধ কাল থেকে। আমাদের জুনিয়র মোস্ট ফচকে ছেলে জিজ্ঞেস করল, “কাকু, আজকের টা তাহলে শেষ ক’রে নি? দু ওভার বাকি।”

খেলা তো বন্ধ হল। দুটো বিকেল ছাদে চেলা কাঠ আর পিংপং বল দিয়েই ক্রিকেট খেলে কাটালাম। মাঝে লাটাই কিনে ঘুড়িও ওড়াতে চাইলাম, কিন্তু ফেঁসে গেল প্রত্যেক বার। ওদিকে সেই গলি আর আশেপাশের বাড়ি আমাদের মিস করতে লাগল। শঙ্কুকাকার দোকানে দুদিন অন্তর সাড়ে তিনটাকার ইনভেস্টমেন্ট থেমে গেল৷ ফুলের মত বাচ্চারা, মানে আমরা, মাতিয়ে রাখতাম পাড়াকে, কিন্তু হঠাৎ সব থম মেরে যাওয়ায় চারদিনের মাথায় সেই সাইড স্ক্রিন বাড়ির কাকু নিজেই ডেকে পাঠালেন আমাদের। আমরা আবার ক্যালানি খাওয়ার ভয়ে গিয়ে হাজির হলাম। কাকু বললেন, “তোরা চার মেরে মেরে খেল না বাবু, ছয় মারার দরকার কী? যা খেলা শুরু কর।”

আবার হুল্লোড় শুরু হল। চার মারার চক্করে বল গিয়ে পড়ল হাই ড্রেনে। সে আবার সদা ফ্লোয়িং ড্রেন। ব্যাটসম্যান ছুটে আসতে আসতে বল ভেসে বেরিয়ে যেতে লাগল। যে ফেলেছে সে তুলবে রুল। রাস্তা বরাবর আমরা খানিক দূরে দূরে ছুটে গিয়ে ড্রেনের পাশে পাশে বসে পড়লাম মাথা ঝুঁকিয়ে। কমেন্ট্রি শুরু হলো বলের পোজিশন ট্র‍্যাক করে। ভেস্টিবিউল পেরিয়ে জগাদার দোকানের সামনে এখন, পিন্টু তুই পাবি। পিন্টু পাকড়ে ধরতে গিয়ে পাঁক লাগা বল পিছলে মিস করে গেল। সন্তকে অ্যালার্ট করা হল টিউবওয়েলের ধারে। এইভাবে অবশেষে উদ্ধার হল বল। ঘাসে মুছে নিয়ে হরু তৈরি হলো ওভারের শেষ বলের জন্য। ব্যাট করতে এয়েছেন ইমন। ইনি রোজ খেলতে আসেন না, মাঝে মাঝে চানটান করে পাটপাট করে চুল আঁচড়ে চলে আসেন মা ছাড়লে। ব্যাটটাকে হকিস্টিকের মত ধরে ইমন স্টান্স নিল। ছুটে এসে ঘাপ করে বল ছুঁড়ে দিল হরু, সত্যি ছুঁড়েই দিল বলা চলে, ও ছিল জাত “চাকার”। বলটাও সাঁই করে ঘোরানো হকিস্টিককে ড্রিবল করে লাগল মিডল স্ট্যাপে। আই মিন ইমনের মিডল স্ট্যাম্পে। আউউউউউ আওয়াজ করে পেট চেপে বসে পড়ল ইমন, তারপর তিড়িং বিড়িং করতে লাগল সারা গলি জুড়ে, সে কী চিৎকার। পাশের বাড়ির বৌদি জানলা দিয়ে দেখছিলেন এই কাণ্ড৷ ওনার দয়ার শরীর। ওপরের জানলা থেকেই বলে উঠলেন, “আহা রে, বড্ড লেগেছে, দাঁড়া দরজা খুলছি, ইমনকে পাঠিয়ে দে তো, বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি। নয়তো ফুলে যাবে।” এই কথা শুনে ইমন “মা, ও মা” বলে চিল্লাতে চিল্লাতে রাস্তা দিয়ে পালালো। আর আসেনি কোনদিন খেলতে।

আমরাও যাইনি অনেকদিন খেলতে। প্রায় পনেরো বছর। সেই গলি আজও একা মনমরা হয়ে বসে থাকে। বাঁধানোও হয়েছে এখন সেটা। বুঁজে গেছে উইকেটের সেই তিনটে গর্ত। বাড়িগুলোর নতুন রঙ হয়েছে। সাইড স্ক্রিনে কোথাও ক্র‍্যাক নেই। গলির সামনের রাস্তা দিয়ে আজ রিক্সার বদলে টোটো যায়, সাইকেলে করে হয়তো নতুন কারও ক্রাশ যায়। কিন্তু রান আপ নেওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করে না কেউ।

ঝাঁ চকচকে সেক্টর ফাইভে লম্বা বহুতলের সেভেন্থ ফ্লোর দিয়ে সামনে অনেকদূর অবধি দেখা যায়৷ বিকেলে আকাশ কালো করে বৃষ্টি এলে সেইদিকে তাকিয়ে থাকি হয়তো কখনও আনমনে, কিন্তু হাত থাকে কীবোর্ড আর মাউসে। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধে হলে একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠতে থাকে নলবনের গা ঘেঁষে। ঠিক যেমনটা দেখতাম বিকেলের খেলা সেরে ঘরে ফেরার সময়। টিভিতে জন্মভূমি শুরু হত। বাড়ি ফিরে দেখতাম ঠাম্মা চা নিয়ে বসে গেছে টিভির সামনে।

চমক ভাঙে মেইল আসার টুং শব্দে। মাথা নাড়িয়ে আক্ষেপ করে আবার ডুবে যাই কম্পিউটার স্ক্রিনে। অপেক্ষা করতে থাকি যদি কোনও বিকেলে আবার কেউ ডাকতে আসে “পিকলুউউউউ, খেলতে যাবি” বলে। মন ছুটে চলে যায় পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দূরের ওই মাঠের মাঝখানে, হাত বাড়িয়ে যেন বলতে থাকি,

“আর একবার, যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়…….”

~~~∆~~~

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি