দরিন্দা

Freedom, Protest, Rebel, Short Story, Story, Thriller, বাংলা

(বিধিবদ্ধ চেতাওনি : গল্প পড়ে কারো কারো কষ্ট হতে পারে, নরম মনের মানুষের না পড়াই ভাল|)

( ১ )

হাল্কা ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা বেরিয়ে এল গাড়িটা থেকে| পরনে একটা পালাজো আর পাতলা টপ| ভেজা বৃষ্টিতে শরীরের সব মাংসপিন্ড অত্যন্ত স্পষ্ট| নেশা নেশা পায় এগিয়ে গেল ড্রাইভারের দরজার দিকে| ড্রাইভারের ডান পাশের জানলার কাঁচটা নেমে গেল ধীরে| মেয়েটি জানলায় হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকলো একটু| কয়েক মুহূর্ত| তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল| গাড়ীটা বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল হুস করে|

মেয়েটাকে খুঁজে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে| সময় লেগেছে প্রায় একমাস| মাত্র সাতদিন আগেই মেয়েটাকে খুঁজে পয়েছে সে|… মানসিক প্রস্তুতি নিতে সময় লেগছে তিনদিন| তারপরের তিনদিন সে একনাগাড়ে রেকি করেছে| প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই| রাতের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণই সে মেয়েটার পিছনে আঠার মত লেগে ছিল| এই তিনদিনে মেয়েটার নাড়ী নক্ষত্র জানা হয়ে গেছে| কোথায় থাকে, কখন কোথায় যায়, কোথায় কাজ করে, কখন বাড়ী ফেরে, সব|

গাড়ীটা বেরিয়ে যেতে মেয়েটা পিছন ঘুরে টলতে টলতে এগিয়ে গেল গেটের দিকে| … অপলক তাকিয়ে আছে সে মেয়টার দিকে| ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে পড়ছে তার বর্ষাতি থেকে, কানের লতি থেকে, চোখের পাতা থেকে|

-আর ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে থাকা লোহার রডটা থেকে|

…আজ বিকেল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে| কখনও জোরে কখনও আস্তে| মেয়েটা সন্ধ্যেবেলায় যখন অফিস থেকে বেরলো তখন বৃষ্টিটা একটু কমেছিলো| এই গাড়ীটাই মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিল পার্কস্ট্রিটের একটা বারে| পাঁচজন মিলে দশহাজার টাকার মদ শেষ করল তিন ঘন্টায়| …বারে একেবারে তাদের পাশের টেবিলটায় বসেছিলো সে| আধঘন্টা অন্তর একটা করে স্মল পেগ হুইস্কির অর্ডার দিচ্ছিল| কিন্তু খাচ্ছিল না| অপারেশনের দিন সে কোন নেশা করে না| … শুধু পাশে বসে মেয়েটাকে দেখে নিচ্ছিল খুঁটিয়ে, শেষবারের মতো| মেয়েটার গঠন একটু পুরুষালি, গোঁফের রেখা আছে হাল্কা| মঙ্গোলিয়ান ধরনের মুখ, ছোট কুতকুতে চোখ| একটু বসা নাক| আর পুরু ঠোঁট| আলগা চটকটা বাদ দিলে সুন্দরী বলা যায় না কোনমতেই| কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না| সে যে ধরনের শিকার খুঁজছিল তার সাথে প্রায় হুবহু মিলে গেছে মেয়েটা| সব সময় মেলে না| কারণ তার শিকার খোঁজার পদ্ধতিটা একটু জটিল|

…একবার একটা অপারেশান হয়ে গেলে সে বেশ কিছুদিন নর্মাল থাকে| দুমাস তিনমাস| তারপর আবার তার শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটতে থাকে| চঞ্চল হয়ে পড়ে সে| কাজে মন বসাতে পারে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়| আরও দুদিন পরে মাথাটা পাগল পাগল করে| অবসন্ন হয়ে পড়ে সমস্ত স্নায়ু| চিন্তা ভাবনা যায় দলা পাকিয়ে| শিরাগুলো ফুলে ওঠে, ফেটে পড়তে চায় যন্ত্রণায়| লক্ষণগুলো তার চেনা| এরপর দুদিন আর সে ঘর থেকে বের হয় না| খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়| দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে নিজেকে| তারপর একদিন দড়ি ছিঁড়ে বের হয় শিকারের সন্ধানে| তার শিকার খোঁজারও একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে| একটা নির্দিষ্ট ধরনের মঙ্গোলিয়ান মুখ, ছোট ছোট চোখ, চাপা নাক, একটু পুরু ঠোঁট| এই সমস্ত লক্ষণগুলো না মেলা পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে থাকে| সব চাহিদা সব সময় মেলে না| তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়| কখনও এক দু সপ্তাহ, কখনও একমাস, কখনও বা আরও বেশী| এ লাইনে তাড়াহুড়ো চলে না| … একবার শিকার খুঁজে পেয়ে গেলে সে নিজেকে দুই তিন দিন সময় দেয়| … মন স্থির করতে| যদিও এই সময় মন আপনা থেকেই স্থির হয়ে যায়| মাথাটা পুরোপুরি স্বচ্ছ হয়ে যায় ক্রমশ| দৃষ্টি বুদ্ধি পরিষ্কার হয়ে যায় জলের মত| একাগ্রতা বেড়ে যায় বহুগুণ| একটা সময় এমন আসে যখন একটা মাছি উড়লেও মনে হয় তার ডানাগুলো গুনতে পারবে সে| … তখন সে রেকি করতে বের হয়|

… ওরা বার থেকে যখন বের হলো, তখন জোর বৃষ্টি হচ্ছে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া| দলটা গাড়ীতে করে চলে এল গঙ্গার ঘাটে| ভরা বৃষ্টিতে পাঁচজনই নেমে পড়ল গাড়ী থেকে| ঝম ঝম ভিজতে লাগলো দামাল বৃষ্টিতে| ঝড় আর হাওয়ার সমানুপাতে বাড়তে লাগল নেশা| সেও প্রায় একঘন্টা আগের কথা|

… এই মুহূর্তে মেয়েটা ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে খুঁজে চলেছে চাবিটা| নেশার কারণে খুঁজে পাচ্ছে না বোধ হয়| আর দেরী করে লাভ নেই| এই হলো সঠিক সময়| সে একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল চারপাশটা| তারপর দ্রুত, নির্দিষ্ট, দ্বিধাহীন পদক্ষেপে জল আর রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে|

***

( ২ )

ডেপুটি কমিশনার অরুন আইচ আর একবার রিভলভারটা চেক করে নিলেন| অ্যাকশানের সময় হয়ে গেছে| গাড়ী তৈরী| মোট দশজনের টিম| এই অপারেশনে তাঁর না থাকলেও চলত| কিন্তু কোন রিস্ক তিনি নিতে চাননি| প্রতিপক্ষ খুবই ধূর্ত, আজ দেড় বছর সে চোখে ধূলো দিয়ে চলেছে| তাই তিনি নিজেই লিড করবেন টিমকে| তিনি ছাড়াও থাকবেন দুইজন ইন্সপেক্টর, দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর আর পাঁচজন কনস্টেবল|

… আজ দেড় বছর হয়ে গেল শহরের বুকে একের পর এক খুন হয়ে চলেছে| এযাবৎ মোট পাঁচটা| দুইজন পুরুষ, তিনজন নারী| হত্যার ধরণ দেখে কোন সন্দেহ থাকে না যে এগুলো কোন একজন নর পশুরই কীর্তি| …হত্যার ধরণটা খুবই ভয়ানক| … প্রত্যেক ক্ষত্রেই একটা লম্বা লোহার রড ভিক্টিমের পশ্চাদ্দেশ দিয়ে আমূল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে শরীরে| …অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভয়ে যন্ত্রণায় হার্টফেল করে মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ| তার পরেও যে ক্ষেত্রে মৃত্যু হয় নি, তাকে হত্যা করা হয়েছে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে অথবা শ্বাসরোধ করে| …তবে আশ্চর্যজনক ভাবে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো মেয়ের উপর কোনো রকম যৌন অত্যাচার করা হয় নি| …আর আজ রাতেও সম্ভবত আর একটা খুন হতে চলেছে| খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে শেষ হবে দেড় বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার|

…আজ বিকেলে হঠাৎ একটা ফোন এল| একজন নিজেকে গোপন ইনফর্মার পরিচয় দিয়ে কিছু খবর দিল আততায়ীর| আজ নাকি সেই শয়তান ষষ্ঠ খুনটা করতে চলেছে| … এরকম উড়ো খবর কতো আসে| প্রথমে পাত্তা দেননি তিনি| কিন্তু তারপর ইনফর্মার এমন কিছু কথা বলল, যেগুল হুবহু মিলে গেল এই তদন্তে পাওয়া গোপন কিছু তথ্যের সাথে| তারপরই নড়ে বসেছেন অরুনবাবু| ইনফর্মারই বলে দিয়েছে অাততায়ীর আস্তানা| ঘড়ি দেখলেন তিনি| সময় হয়ে গেছে| বাইরে বেরিয়ে এলেন| সবাই তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিল| তিনি উঠে বসতেই দুটো গাড়ী ছেড়ে দিল পরপর|

… তাঁরা যখন নির্দিষ্ট বাড়ীটার সামনে এসে দাঁড়ালেন ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে আবার| সবাইকে সবকিছু বোঝানই আছে| সবাই চুপচাপ যে যার জায়গা নিয়ে নিল| এখন শুধু রুদ্ধশ্বাস প্রতিক্ষা| যদিও বেশিক্ষন লাগল না| কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গাড়ী এসে থামল বাড়ীটার সামনে| একটা লোক বেরিয়ে এল গাড়ীটা থেকে| ডিকিটা খুলে কাঁধে তুলে নিল প্লাস্টিকে মোড়া একটা ভারী কিছু| দূর থেকে মনে হলো একটা বডি| ইনফর্মেশন তাহলে ঠিকই ছিল| কেউ আটকালো না আততায়ীকে| সে ধীরে ধীরে নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল বাড়ীটার মধ্যে| পুর্বপরকল্পনা অনুযায়ী দশজনের টিমটা ঘিরে ফেললো পুরো বাড়ীটাকে|

… চেষ্টা করেছিলো| কিন্তু পালাতে পারল না| ডিসিপি অরুন আইচের হাত থেকে কেউ কখনো পালাতে পারে না কোন দিন| পারে নি| আর এ তো নেহাতই বাচ্চা ছেলে| চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছোকরা ছেলে একটা| এই বাচ্চা ছেলেটা এতদিন পুরো ডিপার্টমেন্টকে ঘোল খাইয়েছে ভেবে বিস্মিত হলেন তিনি| এখন যদিও তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে শুইয়ে রাখা হয়েছে| …মুখটা একটু চেনা চেনা লাগছে| ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা দেখতে হবে| আগের পাঁচটা খুনই যে এই করেছে তাতে কোন সন্দেহই নেই| প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারিপাশে| এমনকি মার্ডার উইপেন টাও| সব নমুনা সংগ্রহ করে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে| কেস সাজাতে কোন অসুবিধাই নেই| ফাঁসি নিশ্চিত| কিন্তু তিনি অবাক হয়েছেন অন্য একটা কারণে| প্লাস্টিকে মোড়া যে জিনিসটা নিয়ে ছেলেটা ঘরে ঢুকেছিল সেটায় কোন বডি নেই| জলে ভেজা একটা মোটা লেপ এমনভাবে বাঁধা হয়েছে যেন একটা মনুষের দেহ| কিন্তু কেন! …আপাতত এটা নিয়ে ভাবার সময় নেই…হাতে অনেক কাজ| এটা নিয়ে পরে ভাবতে হবে|

…ছেলেটাকে নিয়ে যখন ফিরলেন তখন অনেক রাত| বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে| সেই সঙ্গে প্রচন্ড ঝড় আর বজ্রপাত| শহর যেন ছারখার হয়ে যাচ্ছে| এরকম একটা নরকের কীটকে ধরবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত পরিবেশ| উত্তেজনায় মাথাটা গরম হয়ে আছে| হুইস্কির গ্লাসে লম্বা চুমুক দিyলেন একটা| তিতকুটে স্বাদে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল|

…শালাআহ্, এই খানকির বাচ্চাটার জন্য জীবনে অনেক,অনেক বেইজ্জত হতে হয়েছে| প্রমোশানটাও আঁটকে আছে অনেকদিন| যত দোষ যেন তাঁরই| আবাল পাবলিক বোঝেও না পুলিশেরও একটা লিমিটেশান আছে| পুলিশ ভগবান নয়| আর উদ্গান্ডু মিডিয়াগুলো এই জনতার মোটা ব্রেনগুলো নিয়ে জাগলিং খেলছে| এক সে বড়কর এক জোচ্চোর সব| অসহ্য রাগ নেশার সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ল স্নায়ুতন্ত্রীতে| বিকৃত মুখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি| ঢক করে খানিকটা র’ হুইস্কি ঢেলে দিলেন গলায়| তারপর একটা লোহার রড আর হুইস্কির বোতল নিয়ে এগিয়ে গেলেন পাশের ঘরে|

…ছেলেটাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাত বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ঘরের মাঝখানে| হাত দুটো সিলিং থেকে ঝোলানো একটা দড়ির সাথে টান করে বেঁধে| একটু আগে একপ্রস্থ ট্রিটমেন্ট করে গেছে অন্য অফিসার , কিন্তু মুখ খোলানো যায় নি| … মোটিভ না জানতে পারলে কেস সাজাতে অসুবিধা হবে| মুখ তো ওকে খুলতেই হবে| তিনি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন ছেলেটার সামনে| মুখটা ঝুলে পড়েছে বুকের উপর| মাথার উপর টিমটিম করছে একটা বাল্ব| মুখটা তাই ভাল বোঝা যাচ্ছে না|

-কি নাম তোর ?

ছেলেটা কোন উত্তর দিল না| মাথা তুলে তাকালো শুধু| অরুনবাবু হাতের লোহার রডটা আড়াআড়ি সজোরে বসিয়ে দিলেন কোমরে| কোঁকিয়ে উঠল ছেলেটা|

-অনেক লাশের ঢের বিছিয়ে আমাকে এখানে উঠে আসতে হয়েছে, বুঝেছিস বানচোদ| চাপা গলায় গর্জন করে উঠলেন অরুনবাবু| তোর মতো হারামির পেট থেকে কি করে কথা বের করতে হয় আমার থেকে ভাল কেউ জানে না|

ডিসিপি অরুন আইচকে যারা চেনে তারা জানে এটা কোনো ফাঁকা আওয়াজ নয়| কোমর থেকে বেল্টটা খুলে নিলেন তিনি| প্রায় হাফ বোতল র’ হুইস্কি গলায় ঢেলে দিলেন| গলা দিয়ে নেমে যাওয়া জ্বলন্ত আগুনে মুখটা বেঁকে চুরে গেল| বাছবিচার করলেন না তিনি| এলোপাথাড়ী বেল্টটা বসিয়ে দিতে লাগলেন সারা শরীরে| একনাগাড়ে, বিরামহীন| প্রায় দশ মিনিট পর থামলেন| বড়ো বড়ো নিশ্বাস পড়তে লাগল| ছেলেটার মুখ থেকে তখন গ্যাঁজলা বের হচ্ছে| সেদিকে তাকিয়ে শালাহ্ দরিন্দা বলে থু করে একরাশ থুতু ফেললেন রংচটা নোংরা মেঝেটাতে| বড্ড হাঁপিয়ে গেছেন তিনি| শরীরটা ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে| বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে নিতে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ছেলেটাকে| আর একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে মিডিয়ার অত্যাচার| সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে যা হোক একটা স্টেটমেন্ট দিতেই হবে| তার আগেই একটা থিয়োরি দাঁড় করানো খুব দরকার| একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি|

…অন্যমনস্কতা আর নেশা দুটোই ছুটে গেল একসাথে| মুহূর্তে তিনি শিকারী হায়না| শিড়দাঁড়া টানটান করে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন ছেলেটার দিকে| দেহের প্রতিটা নার্ভ টানটান সজাগ| … ওটা কি ? একটা জুড়ুল না! কোমরের একটু নীচে পাছার উপর| …হ্যাঁ, এই ঘোলাটে হলুদ আলোতেও প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা দুই ইঞ্চি চওড়া লাল জুড়ুলটা জ্বলজ্বল করছে পরিষ্কার| ছেলেটাও একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে তাঁকে| লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন তিনি| দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে জুড়ুলটাকে ভাল করে দেখলেন কাছ থেকে| তারপর ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়ালেন| মুখটা তুলে ধরলেন আলোয়| চমকে উঠলেন তিনি| দুপা পিছিয়ে গেলেন, অজান্তেই হাত থেকে খসে পড়ল বেল্টটা| ছুটে বেরিয়ে এলেন বাইরে, টেনে বের করলেন কেস ফাইলটা| ভিক্টিমদের ছবিগুলো পরপর সাজালেন টেবিলে| ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন মন দিয়ে| সত্যিই তো এতবড় ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়িয়ে গেল| ওফ্ এত বড় একটা মিসটেক| … প্রত্যেকের মুখের একটা নির্দিষ্ট আদল অাছে,… ছোট ছোট চোখ, চাপা নাক, পুরু ঠোঁট, দেখতেও অনেকটা একরকম| আর এদের সকলের মুখের সাথে একজনের মুখের আশ্চর্য মিল| …আর সেটা হল তাঁর নিজের মুখ| …তিনি আবার ছুটে গিয়ে ঢুকলেন ঘরের ভিতরে|

***

( ৩ )

আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে কলকাতার বাইরে পোস্টেড ছিলেন ইন্সপেক্টর অরুন আইচ| স্ত্রী চপলা এক দুরারোগ্য রোগে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী| নড়াচড়াও করতে পারেন না ভাল| চপলা দেবীর বাপের বাড়ীর মতে ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট করলে রোগটা সারতো| কিন্তু ঠিকমতো ট্রিটমেন্টটাই হয় নি| চপলাদেবীর মৃত্যুর পর খুনের মামলা করেছিলেন তাঁর বড় ভাই| কিন্তু আচমকা একদিন অফিস থেকে বাড়ী ফেরার সময় তিনি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ায় ব্যাপারটা ওখানেই ধামা চাপা পড়ে যায়| … যাই হোক, সেই সময় চপলা দেবীর দেখাশোনার জন্য একটা থাকা খাওয়ার কজের লোক দরকার হয়ে পড়ে খুব| তাই কলকাতা থেকে দূর সম্পর্কের এক বিধবা বোনকে অরুনবাবু নিয়ে এলেন নিজের কাছে| তাঁর নিজের সমস্যাও মিটবে আর সহায় সম্বলহীন মেয়েটারও একটা গতি হবে| মেয়টা তার এগারো বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে এসে উঠল তাঁর বাড়ীতে|

মহিলা দুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন দেবতুল্য দাদার উদ্দেশ্য এবং চরিত্র| মেয়েদের ব্যাপারে অরুনবাবুর বাছবিচার ছিল না কোনদিনই| অসুস্থ স্ত্রী সেটা ভাল করেই জানতেন| স্ত্রীর জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে তিনি নিয়মিত মিলিত হলেন সেই দূর-সম্পর্কের বোনের সাথে| কিন্তু ব্যাপারটা একসময় একঘেঁয়ে হয়ে গেল| নতুনত্ব চাই তাঁর| …এইবার তিনি হাত বড়ালেন বোনের ছেলের দিকে| …প্রথমবার ছেলেটা অবাক হয়েছিল খুব| … কিছুদিন পর অবাক হোতো না আর| প্রথম প্রথম ওর মা খুব কান্নাকাটি করত| তিনি পাত্তা দিতেন না| অতকিছু পাত্তা দিলে চলে না| … কিন্তু একসময় ধীরে ধীরে ছেলেটার চোখের দৃষ্টি হয়ে গেল নিষ্প্রাণ| বসে আছে এক জায়গায় স্থির হয়ে , তো বসেই আছে| কিন্তু তার অস্তিত্ব যেন এখানে নেই| … চোখের উপর বদলে যাচ্ছিল ছেলেটা| শেষের দিকে চোখের দিকে তাকাতে ভয় করতো| এমন ভাবলেশহীন চোখ সাধারণত হয় খুনিদের| আর সহ্য হচ্ছিল না তাঁর| ভাবছিলেন কিছু টাকা পয়সা দিয়ে ওদের কলকাতা পাঠিয়ে দেবেন| তার আগেই একদিন ময়েটা ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেল কোথায়| এ যেন শাপে বর হোলো| হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন অরুনবাবু|

***

( ৪ )

ঘরে ঢুকে ছেলেটার মুখটা আবার উঁচু করে দেখলেন অরুনবাবু| ভাল করে দেখলেন জুড়ুলটাকে| একটা বমির বেগ সারা শরীর গুলিয়ে উঠে আসতে চাইছে| … তিনি ছুটে গেলেন বাথরুমের দিকে| দোর্দন্ডপ্রতাপ ডিসিপি অরুনবাবু, যার ভয়ে চোর ডাকাত ক্রিমিনাল প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলে, সেই তিনি একরাশ ক্লেদাক্ত, দুর্গন্ধময়, পিত্তবমি হড়্ হড়্ করে ঢেলে দিলেন কমোডের মধ্যে| শরীর এলিয়ে পড়ল বাথরুমের মেঝেতে|

…একটা নগ্ন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ এসে দাঁড়াল বাথরুমের দরজায়| মেঝেতে তার ছয় নম্বর শিকার| বাথরুমের ভিতরে তার লম্বা ছায়া| হাতে লোহার রড|

…অরুনবাবু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন উঠে দাঁড়াতে| ছুটে পলাতে চাইছেন প্রাণপণ| কিন্তু তিনি নড়তেই পারছেন না| তাঁর সমস্ত শরীর অবশ, শুধু নিশিগ্রস্থের মত তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে| … উল্টে গেছে পাশার দান, থমকে গেছে সময়………..

~~~☀️ সমাপ্ত ☀️~~~

লেখক ~ দিব্যেন্দু বিজলী

প্রচ্ছদ ~ various sites

www.facebook.com/anariminds

#AnariMinds #ThinkRoastEat