প্যান্টুলুন

Anirban & Arijit, Humor, আদতে আনাড়ি, বাংলা

টিশার্টটা ভাঙব না ভাঙব না করেও শেষ পর্যন্ত পরতে বাধ্য হলুম গিন্নির ধ্যাতানিতে। পুজোর আগে নতুন জামা বের করতে খুব বাজে লাগে৷ “কটা জামা হল” প্রশ্নের উত্তর থেকে এক মাইনাস হয়ে যায়। মনে হয় জমানো থাকুক না আর কয়েকদিন। কড়কড়ে অবস্থায় ষষ্ঠীতে ভাঙব। কিন্তু নাহ্, সে সুযোগ নেই। পাশের জন সাজুগুজু করে চললে আমারও তো তার সাথে পাল্লা দেওয়া উচিৎ। নয়তো আমার তো মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ বেশ পছন্দ। মানে, বউ শাড়ি পরলে আমার ফর্ম্যাল, আমি পাঞ্জাবি পরলে বউ জিন্স, বউ সালোয়ার কামিজ পরলে আমি হাফপ্যান্ট। স্টাইল স্টেটমেন্ট একটা মেন্টেইন করার চেষ্টা করি সবসময়, কিন্তু সবসময় কম্বিনেশন যে কিভাবে উলটে পালটে যায় বুঝি না।

যাই হোক, বিকেলবেলা ফুলবাবু সেজে চললাম বিশ্বের সেকেন্ড লার্জেস্ট শপিং মলে। হাওড়ার ভাঁড়ে মা ভবানী। “অবনী”। সেল চলছে হেব্বি, সব জায়গায় আপ টু ১০০%। যেগুলো পছন্দ হবে সব ২% বা ৩%। আমার অফিসে বাৎসরিক মাইনে বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রাখে আর কি। ৮০% এর ওপরের গুলো কোথায় রাখা আছে জানতে চাইলে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে চতুর্থজন দূর থেকে হাত নেড়ে উত্তর দেয় “সোল্ড আউট”। নিউ অ্যারাইভাল গুলো দেখে মায়া লাগে। এগুলোকে এক বছর পড়ে থাকতে হবে এইভাবে। পরের বছরের সেলের আগে কেউ ছোঁবে না। তবে দেখে রাখতে পারবেন পরের বছরে আপনি কী কিনতে চলেছেন, ট্রেলার টাইপের।

এইবার আসল ঘটনাটা বলি। বউ মেয়ে নিয়ে মলে ঢুকেছি। প্রথমেই বাঁহাতে পড়ে প্যান্টালুন্সের শোরুম। কাঁচের পিছনের মূর্তিগুলোর বুকে পেটে সাঁটা ঘ্যামা ঘ্যামা সেলের পোস্টার। এদিকে আগের সপ্তাহে বেশ কয়েকটা জামা প্যান্ট কেনা হয়ে গেছে রিলায়েন্স থেকে, তাই আজ যে কিনতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। গিন্নি যথারীতি দাঁড়িয়ে চোখ বোলাতে লাগল বাইরে থেকে৷ ঢুকতে গেলেই সাথের ব্যাগ, ছাতা, জলের বোতল জমা রাখার হ্যাপা থেকে মুক্তি পেতে বাইরে থেকেই যতটা স্ক্যান করে নেওয়া যায়৷ দুতিনবার ঘাড় বেঁকিয়ে স্পেশাল একটা কুর্তিতে অফার আছে কিনা ঠাহর করতে না পেরে আমাকে বলল, “একবার চট করে ভেতরে ঢুকে দেখে আসো তো ওই শ্যাওলা রঙের কুর্তিতে কত অফ দিচ্ছে। আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি ব্যাগ নিয়ে।”

আমিও “যথা আজ্ঞা” বলে হনহন করে হেঁটে গেলুম দরজায় রাখা লম্বা লম্বা স্ক্যানারের মাঝখান দিয়ে। কুর্তিটা হাতে ধরে দেখি “নিউ অ্যারাইভাল”। মুচকি হেসে বেরিয়ে আসতে লাগলাম। প্যান্টালুন্সের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বউকে সুখবরটা দিতে যাব, এমন সময় দেখি আমার দু কাঁধে দুটো ভারি হাত এসে পড়ল, খাবলে ধরা যাকে বলে। বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ চমকে উঠেছে। ঘাড় ঘোরাতেই দেখলাম প্যান্টালুন্সের দুজন গার্ড আমাকে ধরেছে। পিছনে সেন্সর ওয়ালা লম্বা লম্বা দুটো স্তম্ভে পিঁ পিঁ করে সাইরেন বাজছে। দোকানের ভেতরের আর বাইরের লোকেরাও গেছে চমকে। আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে ওরা নিয়ে এল সেই সেন্সরের কাছে আবার, পারলে মনে হচ্ছে কোমরে দড়ি বেঁধে দেয়। দুজনেই বেশ চিন্তিত। “স্যার, কিছু মনে করবেন না। একটু আসুন। এখানটা দাঁড়ান। অ্যাই, দেখ তো বাজছে?”

পাশের জন বলল, “না তো। স্যার, আপনি একবার ভেতর থেকে বাইরে আসুন আবার।”

আমি কথামতো আবার ঢুকে বেরোতে গেলাম। আবার বেজে উঠল সাইরেন।

– স্যার, আপনি কি কিছু কিনেছেন?

– না তো! দেখতে ঢুকেছিলাম কত অফ আছে। দাম দেখে মুডই অফ হয়ে গেল। আপনাদের ব্যাপারটা কী বলুন তো। আমার পিছনে লেগেছেন কেন?

– স্যার, এই সেন্সরে বলছে যে আপনি একটা জিনিস পেমেন্ট না করে নিয়ে যাচ্ছেন।

এটাই শোনা বাকি ছিল। একটা ছোট্ট ভিড় জড়ো হয়ে গেল দোকানের ভেতরে আর বাইরে। চোর ধরা পড়েছে হাতেনাতে। ক্যালাতে ডাকলেই সবাই রেডি। বউ আর মেয়ে এমন করছে যেন ব্রিটিশ পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য।

– স্যার, একটু সার্চ করব?

– গুগুলে?

– না স্যার, আপনাকে।

– ওহ্, করুন না।

বলেই আমি টাইটানিকের পোজে দুহাত দুদিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দুটো গার্ড মিলে আমার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাবড়ে থুবড়ে কুতুকুতু দিয়ে সার্চ করতে লাগল। কিছু না পেয়ে দুজনেই উঠে দাঁড়াল। ওদিকে কাউন্টারে পেমেন্ট থামিয়েও লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে। ভাবছি এর মধ্যে আনাড়ি মাইন্ডসের লেখা পড়ে, এমন কেউ থাকলেই কেস। ভাববে আমি লিখিও চুরি করে।

পিছন থেকে একজন স্টাফ বলে উঠল, “স্যারের জামার ভেতরে দেখ।”

বলে কী শালা! টাইগার স্রফ পেয়েছে নাকি আমাকে, যে বললেই ফড়াত করে শার্টটা ছিঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়ব, আর ভিড়ের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠবে হুউউউউউউ! আমি কিছু বলার আগেই দেখি সামনের গার্ডটা আমাকে বলছে,

– স্যার, একটু জামাটা তুলে দেখব?

– আমি কি জামার ভেতরে জিনিস লুকিয়ে রেখেছি বলে আপনার মনে হয়?

– ছি ছি, না স্যার, একবার দেখতে দিন। সেন্সরে কিছু গণ্ডগোল মনে হয়৷

এই বলেই সে আমার জামা তুলে তাতে হাত দিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। এক মিনিট বাদেই উল্লাসে বলে উঠল, “পেয়েছি শালাকে!”

মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে এটা বলেনি! আমি মুখ কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞেস করলাম,

– ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন না? প্র‍্যাঙ্ক হচ্ছে? আমার বগলের তলা দিয়ে পায়রা বের করবেন?

– না স্যার, এই দেখুন। আপনার জামার সাথে একটা ট্যাগ লাগানো আছে। এটা জামা কেনার পর কেটে নিতে হয়। সেটা কাটেননি বলেই এই বিপত্তি।

আহা, টেকনিকাল গোলোযোগ। আগে বলবে তো। আমি আরও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– কিন্তু জামাটা আগের দিন তো পেমেন্ট করেই কিনেছিলাম। তাহলে তো ভেঁপু বাজার কথা নয়।

– আমাদের দোকান থেকে কেনেননি মনে হয়। অন্য দোকানের ট্যাগ এটা। আসুন আমাদের সাথে। এটা কাটতে হবে।

দুজনে মিলে আমার হাত ধরে নিয়ে চলল একটা কাউন্টারের দিকে। সামনের লোকটা এগিয়ে বলল,

– একটা কাঁচি দে। কাটতে হবে।

আশেপাশের লোকেরা কী যে বুঝছে ভগবান জানে। তামাশা দেখছে সবাই। সবার মুখেই হাসি। প্রেস্টিজের “নেইমার” বানিয়ে দিল শালা। সবকটাকে দেখে নেব। এদিকে কাঁচি নিয়ে আমার ট্যাগ কাটার চেষ্টা চলছে। আমি ভাবছি এই অবস্থায় কেউ আমার ছবি তুলে ফেবুতে না ট্যাগ করে দেয়।

সব শেষে আবার ইউনিট টেস্টিং এর ডাক এল।

– স্যার, আবার চলুন গেটে। একবার ভেতর থেকে বাইরে যাবেন, আবার আসবেন, তারপর বেরিয়ে যাবেন।

– আবার সাইরেন বাজলে?

– তাহলে স্যার অন্যকিছু দেখতে হবে।

শুনেই আমি তৈরি হয়ে নিলাম মহড়ার জন্য। ভেতর থেকে বাইরে গেলাম সেন্সরের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে। টুঁ শব্দ করল না এবার। বাইরে থেকে ভেতরে এলাম। সেন্সর চুপ। এবার আজকের শেষ খেলা। ভেতর থেকে বাইরে এলাম।

সেন্সর চুপ। কিন্তু তালি বেজে উঠল প্রায় একশ হাতের।

কী যে আনন্দ হল বলে বোঝাতে পারব না। মেয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বউ এসে পাশে দাঁড়াল, ফিরে পেয়েছে ওর সাধের বরকে। শ্যাওলা কুর্তি আজ ওর বরকে কেড়ে নেবে ভেবেছিল।

দুটো গার্ড এগিয়ে এসে বলল,

– স্যার, প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আসলে আমাদেরই তো দেখতে হয় এগুলো। এবার থেকে জামা কিনেই আগে বাড়ি গিয়ে ওই ট্যাগ গুলো কেটে নেবেন।

আমিও ওদের সাথে হ্যান্ডশেক করে এগিয়ে চললাম মলের ভেতরের দিকে।

একটাই কথা শুধু মাথায় আসছিল তখন।

আজ প্যান্টালুনে এসে নিজের প্যান্টুলুনটা যে খুলতে হয়নি, এটাই বাবার ভাগ্যি।

~~~♠~~~

© অরিজিৎ গাঙ্গুলি