বেবি অন বোর্ড

Anirban & Arijit, বাংলা

দেরি হয়ে গেছিল সেদিন। কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে ছুটে ছুটে গিয়ে টিউব স্টেশনে ঢুকলাম সাড়ে আটটা নাগাদ। জুবিলি লাইনের ভিড় অপেক্ষাকৃত কম থাকে অন্য লাইনের থেকে। মোটামুটি ৩-৪ মিনিট অন্তর মেট্রো আসে অফিস টাইমে। স্ট্র‍্যাটফোর্ড স্টেশন থেকেই জুবিলি শুরু হয়, তাই জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না। যদিও বসবার চেষ্টা আমি করি না, কারণ চারটে স্টেশন পরেই নামতে হয়, আর সেখানে ভালোই ভিড় থাকে। তা সেদিন ট্রেন আসতেই উঠে দরজার সামনে একটা কোণে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মোটামুটি ভালোই লোক হল মেট্রো ছাড়বার আগে। দুলকি চালে ট্রেন চলতে শুরু করে পরের স্টেশন ওয়েস্ট-হ্যাম আসতেই আরও কিছু যাত্রী প্রবেশ করল সেই ভিড়ে। আর তখনই চোখে পড়ল আমার ঠিক সামনেই দাঁড়ানো বছর পঁচিশের সোনালী চুলের ব্রিটিশ ভদ্রমহিলার লং ওভারকোটের বুকের কাছে লাগানো ব্যাজটায়। সাদা ব্যাজের মধ্যে লেখা,

“বেবি অন বোর্ড”।

কলকাতায় তো এই লেখাওয়ালা বোর্ড হামেশাই দেখেছি গাড়ির পিছনে ঝুলতে। গাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকলে এই বোর্ড ঝুলিয়ে রাখলে পিছনের গাড়ি সাবধান হয়ে যায়, অযথা হর্ন দেয় না, যদিও পিছনের গাড়িগুলো কতটা মেনে চলে সেটাও দেখেছি। লন্ডনের গাড়িতেও এই রীতি আছে। কিন্তু এই মহিলার বুকে হঠাৎ এই ব্যাজ কেন! এক মুহূর্তের জন্য মনে হল এটা কোনও ব্র‍্যান্ড বা পথ নিরাপত্তা সপ্তাহের প্রচার নয় তো! কিন্তু তারপরেই টনক নড়ল যখন ওই ভিড়ের মধ্যেই সামনের সিটে বসে থাকা আরেক ব্রিটিশ ভদ্রমহিলা নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার সামনে দাঁড়ানো ব্যাজ পরিহিতাকে হাত নেড়ে বসার জন্য ডাকলেন। ইনিও থ্যাঙ্ক ইউ বলে আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে গিয়ে বসলেন সেই সিটে।

ভদ্রমহিলা অন্তঃসত্ত্বা। তবে দেখে বোঝা সত্যিই কঠিন। প্রথম কয়েক মাসে উদরদেশের স্থূলতা অনুধাবন করা কারুর পক্ষেই সম্ভব হয় না। তাই ভিড় বাসে বা ট্রেনে বোঝাও যায় না সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার শারীরিক অবস্থা। তবে এই ব্যাজের কনসেপ্ট দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। বাড়ি ফিরে সেদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম যে ২০০৫ সালে ” ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন” (টি এফ এল) এই ব্যাজের প্রচলন করে। ভিড় ট্রেন বা বাসে অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা অনেক সময়েই বসার জায়গা পান না, বা বলতেও লজ্জা পান। ধাক্কাধাক্কিতে আঘাতও পেতে পারেন। তাই এই ব্যাজ দেখলেই সামনের সহযাত্রীরা দেখে বুঝে যেতে পারবেন যে সিট ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। এই ব্যাজ কিন্তু টাকা দিয়ে কিনতেও হয় না। টি এফ এল-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা অনলাইন ফর্ম ভরলেই তিনদিনের মধ্যে বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই ব্যাজ।

আমি ভাবলাম এটা কি শুধু আমিই আজ প্রথম দেখলাম, নাকি আমার বন্ধুরা ইতিমধ্যেই জানে খুব সাধারণ ব্যাপার হিসেবে। যথারীতি ফোন করলাম অনির্বাণকে। ফোন ধরতেই জিজ্ঞেস করলাম,

– তুই “বেবি অন বোর্ড” ব্যাজের কথা শুনেছিস? প্রেগনেন্ট মহিলারা পরে ঘোরে লন্ডনে।

– আরিব্বাস! মিঠির ভাই আসছে নাকি? মুনমুন প্রেগনেন্ট? জয়ি শুনছ….

– বোকা****, ল্যা**, গা*, অভিশাপ দিস না এই বয়সে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই শালা সিদ্ধান্তে চলে গেলি! শুনেছিস কিনা বল এমন কেস?

– না তো, দেখিনি তো তেমন কিছু। বা দেখলেও হয়তো খেয়াল করিনি।

– ওকে, তাহলে ঠিক আছে। আমি দেখলাম আজ ট্রেনে, তাই মনে হল।

– অ! তা সত্যিই কোনও খবর নেই তো?

– **#@৳* $℅£°#@*** !!!

ফোন কাটলাম। তার মানে ব্যাপারটা লন্ডনের বাইরে খুব একটা লোকে জানে না। তবে পরিসংখ্যান বলছে প্রতি বছর লন্ডনে প্রায় তিন লাখ অ্যাপ্লিকেশন আসে এই ব্যাজের। ২০১৩ সালে প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী “ডাচেস অফ কেমব্রিজ” কেট মিডলটন বেকার স্ট্রীট আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে এসেছিলেন লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ১৫০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। ওনাকেও একটা “বেবি অন বোর্ড” ব্যাজ সেদিন উপহার দেওয়া হয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। প্রথম সন্তান প্রিন্স জর্জের জন্ম হতে তখনও চার মাস বাকি। উনি সেই ব্যাজ বুকে পরে বলেছিলেন “এটা আমি বাড়িতে পরে থাকব”।

এই ব্যাজের জনপ্রিয়তা দেখে ২০১৬ সালে লন্ডনের মেয়র আরেকটি ব্যাজ চালু করেন।

“প্লিজ অফার মি আ সিট”।

অনেক মানুষই থাকেন যাদের দেখে বোঝা যায় না তাদের শারীরিক অসুস্থতা। তাই অনুরোধ বিনয় এসবের পরোয়া না করে শুধু ব্যাজ দেখলেই যাত্রীরা সিট ছেড়ে দেন। অসৎ উপায়ে কিন্তু এই ব্যাজের ব্যবহারের কথা তেমন শোনা যায়নি এখনও লন্ডনে।

এবার আসি মোদ্দা কথায়। এমন একটা ব্যাজ আমাদের কলকাতায় চালু হলে কেমন হয়? “আমাদের দেশে” বললাম না তার কারণ লন্ডনের কনসেপ্ট তো, তাই আগে কলকাতাতেই হওয়া উচিৎ তো! বাসে ট্রামে প্রেগনেন্ট মহিলাদের বসার সিট তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সৌজন্যও অনেকসময় দেখান না অনেকেই। যদিও এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু তা হাতেগোনা এইটুকু বিশ্বাস আছে। কন্ডাকটররা তবু ” আস্তে লেডিস কোলে বাচ্চা” হাঁকটা দিয়ে দেন, কিন্তু এমন একটা ব্যাজ থাকলে কি সহযাত্রীদেরও সুবিধা হতে পারে?

এর একটা অন্য দিকও অবশ্য আছে। আমাদের সমাজে প্রেগনেন্সির খবর শেষ অবধি লুকিয়ে রাখার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এর পিছনে শুধুই যে অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার দায়ী তা বলব না, অনেক কারণেই মহিলারা চেপে যেতে চান সেই খবর। এর পরিবর্তন সম্ভব নয় মেনে নিলাম। কিন্তু আধুনিক দুনিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে এমন একটা পরিকল্পনা কি আমাদের আরেকটু এগিয়ে দিতে পারে অন্যকে সাহায্য করতে? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে এক জায়গায় বলা হয়েছে দেখলাম যে এই “বেবি অন বোর্ড” ব্যাজ পুরুষদের একটু স্বস্তি দিয়েছে। তাদের আর মহিলাদের পেটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে হয় না তারা প্রেগনেন্ট কিনা। কিন্তু, উল্টোদিকে কলকাতার রাস্তায় কোনও মহিলার বুকে এই ব্যাজ দেখে কি পুরুষের দৃষ্টি সেই মহিলার পেটের দিকেই যেতে বাধ্য?

আসুন না আলোচনা হোক। একটা কোনও সিদ্ধান্তে তো আশা করি আমরা পৌঁছতে পারবই। 🙂

~~~♦~~~

© অরিজিৎ গাঙ্গুলি