পাঠকের চোখে – নটী নবনীতা

Anirban & Arijit, Book Review, Reviews, পাঠকের চোখে, বাংলা

||♦ #নটী_নবনীতা ♦||
লেখিকা ~ নবনীতা দেবসেন
প্রকাশক ~ আনন্দ পাবলিশার্স
মূল্য ~ ১২৫ টাকা

“গেল বছর এক ঝড়ের রাতে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল তার মাথায়৷ সকাল বেলা জানলা দিয়ে দেখতে পেলুম তার জ্বলে-পুড়ে যাওয়া মূর্তি। তারপর এল ভাড়াটে হাড়ি-ডোমেরা, শুইয়ে ফেলল আমার আজন্মের সঙ্গীকে। এখন আমার জানলা দিয়ে রাত্রিবেলা আর কেউ উঁকি দেয় না। কেবল বাড়ি। আকাশ। বাড়ি। ইঁট। পাথর। ইঁট। আমার বিশ্বাস জ্যোতিবাবুর মনেও দুঃখ রয়েছে বুড়ো নারকোলগাছটার জন্য। ওর ঝাঁকড়া মাথাটা উঁচিয়ে ছিল বলেই তো টিভির এরিয়েলটা ওঁরা সরিয়ে লাগিয়েছিলেন। সব ‘জনগণের মানুষ’-এর মধ্যেই একজন করে নির্জন মানুষ তো যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, সেই মানুষটার সঙ্গে নারকোল গাছটার অনেকদিনের চেনা ছিল।”

জীবনে নানারকম চাওয়া পাওয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকে বহু স্মৃতি, যা মনের মণিকোঠা থেকে একসময় সবাই মিলে উঁকি মারতে চায়৷ বয়সের গাছ পাথর না থাকলেও “গাছ-পাথরের বয়স” সেই হারিয়ে যাওয়া সময়কে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ উপলব্ধি হয় বিভিন্ন “ছন্নপ্রশ্ন” আর “ছিন্নচিন্তার”। আর আমরা, মানে বইপাগল পাঠকরা পেয়ে যাই এক “সোজা কথা সোজাভাবে বলতে পারা” মানুষকে, যাঁর লেখনী গর্জে উঠেছে কালের সাথে, মানুষের সাথে, যাঁর লেখনী স্নিগ্ধ করেছে আমাদের মন, আমাদের চিন্তাভাবনাকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত নানারঙের টুকরো লেখা একসঙ্গে বুনে দিয়ে আনন্দ পাবলিশার্স আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে আমাদের প্রিয় লেখিকা নবনীতা দেবসেনকে।

বইটির প্রথম প্রকাশ আগস্ট ১৯৮৩ তে। এর সাতাশ বছর পর জুলাই ২০১০ এ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ আসে। সর্বশেষ মুদ্রণ জুন ২০১৭ তে। কলেজ স্ট্রীটে হাতের কাছে দেখতে পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারিনি। বইটি আদ্যোপান্ত নন ফিকশন। তিনটি মূল অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে বিষয়বস্তু।

প্রথম অধ্যায়ে আছে লেখিকার বেড়ে ওঠার সাথে তাঁর বসতবাড়ি, পাড়া প্রতিবেশী, গাছ পাথরের বয়সেরও বেড়ে ওঠার গল্প। আছে লেখিকার প্রথম আলাপ কবিতার সাথে, ওনার অভিনেত্রী জীবনের কিছু “যেমন হতে পারত” মুহূর্ত। আর সবশেষে আছে সেই ফোন কল, যার অপরপ্রান্তের গলা বুঝতে না পেরে লেখিকার আচরণ এবং পরবর্তী বিস্ময়।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখিকা পেন রেখে হাতে তুলে নিয়েছেন তলোয়ার। সোজা সাপ্টা মাপা মাপা তীর আছড়ে ফেলেছেন লেখক ও পাঠকের মনে গেঁথে যাওয়া কিছু ভ্রান্ত ধারনার ওপর। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন “ভালো লেখকরা কেন খারাপ লেখেন।” বাতলে দিয়েছেন “রোগনির্ণয় ও রোগমুক্তির প্রস্তাব।” আর শেষে ফিরে গেছেন জয়ন্ত-মানিক, ব্যোমকেশ-অজিত, শার্লক-ওয়াটসনের ভিড়েও মাথা তুলে দাঁড়ানো ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতায়।

তৃতীয় অধ্যায় জুড়ে ফুটে উঠেছে কলকাতায় বাঙালিয়ানার আখ্যান। “মনে আর মুখে” আলাদা ভাবনা পোষণ করা বাঙালির পক্ষে হয়তো সুখকর নয় সেই পঠন, কারণ তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন আমাদের মানসিকতাকে। শেষে এসেছে “নাম-ডাক” ও ছুটির আহ্বান।

এই তিন অধ্যায়ের কথা খুব ওপর ওপর বললাম বলে বুঝতে আপনাদের অসুবিধা হল ঠিকই। কিন্তু, বইটি পড়তে গিয়ে আমি কতকিছু যে শিখলাম, তার হিসাব দিতে পারব না। ভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করে তৈরি এই সংকলন, কিন্তু সকলেই যেন একসূত্রে বাঁধা। আর সেই সূত্র হল আমাদের মনন৷ পড়তে পড়তে কখন যেন হারিয়ে গেলাম স্বীয় উপলব্ধির মায়াজালে। যখন পড়া শেষ হল, মনে হল আমার একটা ক্লাস নিয়ে গেলেন নবনীতা ম্যাডাম, আর শিখিয়ে দিলেন কিভাবে সাহিত্যরসকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, কিভাবে হয়ে উঠতে হয় একজন প্রকৃত কবি, সাহিত্যিক বা পাঠক। অদ্ভুত লাগলেও উনি যখন বলেন যে “ক্রেতা মানেই পাঠক নন, আবার পাঠক মানেই তিনি ক্রেতা নন, সংগ্রাহক হতে পারেন”, মনে হল সত্যিই তো। বই তো অনেকেই কেনেন, কিন্তু কতজন সত্যিকারের পড়েন বা বিষয়বস্তুকে আহরণ করেন! আবার প্রকৃত পাঠকরা কি বই কেনার জন্য অপেক্ষা করেন? কথায় আছে না “ধনীজনে কেনে বই, গুণীজনে পড়ে।”

“কম মানুষের জীবনেই এমন সুযোগ হয়। আজন্ম একই বাড়িতে বাস। কিন্তু বসতবাড়িটা থাকলেই কি বাড়িটা থাকে?” বড় হওয়ার সাথে বাড়ির মতই আমাদের আশপাশ পরিবর্তিত হতে থাকে। “এখন যেখানে গ্যারেজ, সেখানে ছিল মানকচুর বন, টগরফুলের ঝাড়, আর দুটো নিষ্ফলা পেঁপেগাছ। বদলে গেছে বাড়ির মানুষজনেরাও। বদলায়নি শুধু লেখিকার দৃষ্টিভঙ্গি। আজও তিনি খেয়াল করেন জানলা দিয়ে দেখা যাওয়া সেই বুড়ো নারকোলগাছটাকে। আজও তিনি শুনতে পান পাড়ায় আইসক্রিমওয়ালার ডাক, আজও সন্ধেবেলায় শাঁখ বেজে ওঠে। কিন্তু কেবলই ভয় করে, এমন দিন হয়তো আসবে যেদিন দূরের ওই গাছগুলোও আর থাকবে না, কোকিলরাও আর আসবে না এই পাড়ায়। “সেদিন থেকে আমার বয়সেরও আর গাছ-পাথর থাকবে না।”

“প্রথম প্রত্যয়” প্রবন্ধে লেখিকার কবিতাপ্রীতির কথা জানতে পারি। কবিতা ওনার জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সহজ। কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষিকা হয়েও উনি মনেপ্রাণে চান যেন ওনাকে কবিতা না পড়াতে হয় ছাত্রদের। কারণ “ও হচ্ছে জ্যান্ত প্রজাপতির পাখনা ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্রাণীবিজ্ঞান শেখানোর মত কঠিন কাজ।” কবিতাই ওনার প্রথম প্রত্যয়, কবিতাই ওনার দর্পণ। যেদিন “দেশ” পত্রিকা থেকে নীল খামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চিঠি এল যে নবনীতার “চলচ্চিত্ত” কবিতাটি মনোনীত হয়েছে, সেদিন “দেশ বন্দিত কবি” হওয়ার খুশি ভাগ করে নেওয়ার মতো বোধশক্তি ওনার ছিল না। কিন্তু কবিতার স্রোতে অবুঝের মতো গা ভাসিয়ে দেওয়ায় তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল, যে চিন্তাভাবনা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। “যখন কোনও ছোট পত্রিকার তরুণ সম্পাদক বলে ফেলেন – ‘তা, গদ্য যদি নাই দিতে পারেন তবে কবিতা-টবিতা যা হোক একটা কিছু দিয়ে দিন,’ তখন আমার সত্যি সত্যি কান্না পায়৷ ওরা কি জানে না ‘কবিতা-টবিতা যা হোক’ বলতে নেই? ওরকম বললে মা সরস্বতী বিরূপ হন? ওরা কি জানে না একটা কবিতা লিখতে কত কষ্ট?”

“নটী নবনীতা” প্রবন্ধটি হাস্যরসে ভরপুর৷ লেখিকা নিজের অভিনয় জীবনের বিভিন্ন ধাপ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে উৎফুল্ল হয়ে উঠবেন। হোক না সেটা নিউ এম্পায়ার স্টেজ বা কোনও রঙ্গমঞ্চ, বা ফিচার ফিল্মে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে তোলা হাই, সামান্য সুযোগের সদ্ব্যবহার যে উনি করেছিলেন, তার পরিচয় পাবেন এই গদ্যে৷

“আলাপ” পর্বটি শুরু হয় লেখিকার টেলিফোনে রোজ আসা একটা উড়ো কল নিয়ে। ওনার মেয়েরা ধরলেই অপরপ্রান্ত থেকে জলদগম্ভীর কৃত্রিম স্বরে আজেবাজে কথা বলতে শোনা যায় একজনকে। মেয়েদের নালিশে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাঠে নামেন লেখিকা। পরেরদিন ফোন আসতেই আগেই ধরে শুনিয়ে দেন বাছা বাছা কথা। কিন্তু তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকে বিস্ময় যখন সেদিন অপরপ্রান্তে উপস্থিত ভদ্রলোক একটা প্রশ্ন করে বসেন লেখিকাকে। বাকিটা বলব না, সারপ্রাইজ থাকুক।

আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে মনোগ্রাহী লেখেছে “ভালো লেখকরা কেন খারাপ লেখেন” প্রবন্ধটি। খারাপ লেখা পাঠকরা বেশিদিন সহ্য করেন না। দুদিন রেখে ছুঁড়ে ফেলে দেন প্রিয়তম লেখককেও, আবর্জনার ঝুড়িতে। সময়ের হাতে মেধা নষ্ট হয়। এর প্রতিকার হিসেবে লেখিকা প্রথমে রোগ নির্ণয় ও পরে রোগমুক্তির অনেকগুলি উপায় বলেছেন, যা বর্তমান যুগের লেখকদের কাছে সোনার খনির ন্যায়। যেহেতু অল্পবিস্তর লেখালিখির সাথে যুক্ত আমি, তাই আমার যেন চোখ খুলে দিলেন নবনীতা ম্যাডাম। এই সমাধান উনি বলেছেন দুরকম ক্যাটেগরির জন্যই। এক, লেখাই যাদের একমাত্র পেশা, আর দুই, লেখা যাদের শখ। কত সহজ সরলভাবে উদাহরণ দিয়ে উনি ব্যাখ্যা করেছেন লেখকের জীবনে কোন কাজগুলি তার লেখার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজীবন বুকের কাছে রেখে দেব এই অধ্যায়টা। নতুন লেখকদের কাছে এটা অবশ্যপাঠ্য।

“কলকাতা শহরের বাঙালির মহার্ঘ বাঙালিয়ানা, যা নাকি গেল-গেল, তা ঠিক কাকে যে বলে, এটা আর খুব স্পষ্ট নেই এই জগাখিচুড়ি শহরে।” আমাদের বাঙালিয়ানায় পশ্চিমের প্রভাব খুব স্পষ্ট। আর বিভিন্ন প্রাদেশিক খাদ্যাভ্যাস আর আচরণে সেই বাঙালিয়ানার ভিত টলতে শুরু করেছে। লেখিকার “আজ দখিন দুয়ার খোলা” প্রবন্ধে উনি আলোচনা করেছে ১৯৮৩ সালের বাঙালির জীবনযাপনে নানান আঞ্চলিক প্রভাব। পড়তে পড়তে মনে হতে পারে আজও “সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলে আসছে।”

“বালক, যুবক, প্রৌঢ় – তিন বয়সের, তিন রকম চরিত্রের, তিন জীবিকার তিনজন। মানুষের জীবনের প্রায় সবখানি সময় জুড়েই দলটা আছে।” এই কম্বিনেশন আপামর বাঙালির খুবই কাছের। রায়বাবুর অমর সৃষ্টিতে স্থান পাওয়া এই চরিত্র ত্রয়ের অমোঘ আকর্ষণ লেখিকার ছোটবেলার জয়ন্ত-মানিককেও হার মানিয়ে দিয়েছে। আর তাই সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন ফেলু তোপসে জটায়ুর চারিত্রিক বিশেষত্ব। খুব সঙ্গত কারণেই বইটিও তাই উৎসর্গ করেছেন শ্রী সত্যজিৎ রায় ও শ্রীমতী বিজয়া রায়কে।

আচ্ছা একটু ভাবুন তো। আপনি মনে মনে যেটা ভাবছেন, সেটা যদি আপনার বুকে লাগানো একটা কম্পিউটার স্ক্রিনে সবসময় ভেসে উঠত, তবে কেমন হত ব্যাপারটা! “ধরুন মিনিবাসে বাড়ি যাচ্ছেন, পাশের সিটের সহযাত্রিণীটি মৃদু হেসে একটু সরে বসলেন। তাঁর বুকের স্ক্রিনে ফুটে উঠল – ‘উঁঃ! এ লোকটার গায়ে কী বিটকেল গন্ধ রে বাবা!'” বুকের স্ক্রিনে মনের কথা ফুটে উঠলে দুনিয়াটা ঠিক কেমন হত, তার পরিচয় পাবেন লেখিকার কৌতুকাশ্রিত লেখা “মনে আর মুখে”-তে। আসলে তিনি যে অনেক সত্যি কথাই বলে দিলেন এই সূক্ষ্ম হিউমারের আড়ালে, সেটা বুঝতে পারলেই আপনার পাঠক হওয়া সার্থক!

সবমিলিয়ে “নটী নবনীতা” আমাকে ভাবিয়ে দিয়ে গেল। একজন ড্রাইভার হতে গেলে যেমন চোখ কান সবসময় খোলা রাখতে হয়, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়, ঠিক তেমনই সাহিত্যকে ভালোবাসতে গেলেও হতে হয় একটু সংবেদনশীল, আবার কখনও হতে হয় শকুনের মতো। ভালো জিনিস দেখলেই ছোঁ মেরে তুলে নিতে হবে। খারাপ সৃষ্টির মধ্যেও ধরা থাকে এক অদ্ভুত সুর, যার নির্যাস নিতে পারলেই কেল্লাফতে৷

ধন্যবাদ ও প্রণাম জানাই পদ্মশ্রী শ্রীমতী নবনীতা দেবসেন ও আনন্দ পাবলিশার্সকে এমন একটি রত্ন পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

~~~♠~~~

© অরিজিৎ_গাঙ্গুলি