সার্কাস

Friends, Short Story, Story, বাংলা

খিদিরপুরের নাজির লেনের মোড়টায় ইসমাইল মন্ডলের সংসার খুব চোখ টানে। দুটো বাঁদর বাঁদরী, বিবি লালি, মেয়ে রুকসানা আর ছেলে অমীরকে নিয়ে ইসমাইল মৌজসে থাকে। সকাল বিকেল ভোরে রাতে ইসমাইল পেরাকটিস করে, জমুরের ডায়লাগ বানায়, বাঁদর সলমন আর বাঁদরি ক্যাটরিনাকে ট্রেনিং দিলায়। অবশ্য খিদিরপুরের এ পাড়ায় ইসমাইল এসেছে গত মাসে, এ তল্লাটে তাও জমুরের খেলা দেখার লোক পায়। লাজপত হিন্দি হাই স্কুলের পাশের মাঠটায় ইসমাইল এক মাস ধরে খেলা দেখাচ্ছে, তার আগে দেখাত ট্যাংরায়, তার আগে পার্ক সার্কাসে, কখনও সাউথের ট্রেনে চলে যেত বারুইপুর, ক্যানিং।

ইসমাইলের জমুরের খেলা সাজায়, সলমন ক্যাটরিনার গলার দড়িতে টান পড়ে। সলমনের হাতের লম্বা খামটায় ক্যাটরিনার জন্য মানি অর্ডার থাকে.. ইসমাইল ডুগডুগি বাজায় আর বলতে থাকেঅবে সলমন, বিবি হোগেয়ি নারাজ, থোড়া জিয়াদা পয়সা ভেজ শালে।

অরে এ ক্যাটরিনা, তনিক মেরে কানমে আকে বোল যা তু যায়েগি সলমন কে সাথ?

হাতের রশির একটানে ক্যাটরিনা দুপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে ইসমাইলের কানে বলেডুগডুগি বেজে ওঠেটকাটক টকাটক টকাং। সলমন টান মারে ক্যাটরিনার লেজেইসমাইল চিৎকার করেআরে সব কোই তালি বজাও..সলমন ক্যাটরিনামে ঝগড়া হো গিয়াআরে কোই হ্যায় রণবীর কপুর?

তালি যে সেরকম পড়ে তা নয়,মাঠের পাশের বস্তিতে প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলোর সামনে ছোট ছোট ছেলেরা লাঠি দিয়ে টায়ার ঘোরাতে ঘোরাতে কখনও সখনও থমকে দাঁড়ায়। লাজপত জুনিয়র হাইস্কুলের টিফিনের সময় ছেলেরা আচারয়ালার কাছ থেকে কারেন্টের শিশি কিনে জিভে টকাস টকাস শব্দ করতে করতে সলমন ক্যাটরিনার খেলা দেখে।  লাইনের কলে জল নিতে আসা সলমা,মাধুরী, শিল্পারা নিজেদের সালোয়ার হাঁটু অবধি গুটিয়ে বন্ধুদের নতুন গড়া রূপোর মল দেখায়, কখনও কখনও ইসমাইলের ডুগডুগির শব্দে চোখ তুলে ওদিকে তাকিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যের গায়ে। সে হাসা অবশ্য খেলা দেখে নয়।

ইসমাইল মন্ডলের শরীরের খাঁচাটা লম্বাটে, খেলা দেখানোর সময়ে একটা খয়েরি ছেঁড়া সুতির সাফারি কোটের তলায় নীলসবুজ ডোরাকাটা লুঙ্গি পরে, মাথায় বাঁধা থাকে শতচ্ছিন্ন একটা ঘিয়ে মাফলার। তার শরীর মজবুত, সাফারি কোটের তলায় ঢাকা শরীরের গঠন সবল দৃঢ় । তার মুখের ঘন চাপদাঁড়ি মধ্যে জেগে থাকা ধারালো ঠোঁটে আর সুর্মা লাগানো চোখদুটোয় উঠতি বয়সের ছোড়ি দেখলে তাজা ঘোড়া ডেকে যায়। কলতলার সলমা, শিল্পা ,মাধুরীরা মাঝে মাঝে সেই তাজা ঘোড়াটাকে খেলা বন্ধ করে ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে। শিল্পার পায়ের গোছ দেখলে ইসমাইল গলায় ঝোলানো ছোট্ট সোনার পাত্তিটা ঠোঁটের কাছে তুলে চুমু খায়, ঠোঁট সরু করে অনেকক্ষণ ধরে। শিল্পার চোখে চোখ দিয়ে তাকায়। শিল্পা সলমারা মুখে ওড়না চেপে হাসতে হাসতে চলে যায়। জমুরের খেল দেখানো আশিক জমুরা। জমুরা ইসমাইলের মন রঙ্গীন কিন্তু পকেট ভরার মত খেল দেখানোর এখনও তৈরীর পর্যায়ে। রুকসানার ট্রেনিং চলছে, আর খুব বেশি হলেও এক সপ্তাহপাঁচ বছরের রুকসানা মাথায় চারটে ঘড়া বেঁধে দড়ির উপর হাঁটবে। হাওড়ার মঙ্গলার হাটে ইসমাইল দেখে এসেছে, জমুরেদের খেলা জমে পশুর বাচ্চা দিয়ে নয়, মানুষের বাচ্চা দিয়ে। শাড়ি কিনতে আসা কাস্টমার চটপট দাঁড়ায়, টকাটক হাততালি পড়ে, পটাপট খুচরো পয়সা পড়ে।

রাতের বেলা লালি কাঠে ফু্ঁক দিয়ে দিয়ে যখন ভাত বানায়, রুকসানা আর অমীর চারপাশে ঘোরাঘুরি করে।ইসমাইলের বিড়ির লাল আগুন অন্ধকারে জ্বলে ওঠে ধকধকিয়ে, রুকসানার শরীরটা ওর চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে। রোগাটে শরীর, সালমা চুমকির কামিজটা কাঁধ থেকে ঢলে ঢলে পড়ে যায়। পায়ের গোছে গোড়ালির উপর অনেকগুলো কালশিটের দাগ, দড়ির ব্যালান্স শিখতে গিয়ে যতবার পড়েছে রুকসানা, গরম লোহার শিঁক পায়ে  একবার ছ্যাঁক দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে দিয়েছে ইসমাইল। এ ব্যাপারে শালা পশুর বাচ্চা আর মানুষের বাচ্চার এক দবাই। মার মারকে শিখাওশালা দর্দকে মারে সব শিখ লেগা। অমীরের দিকে তাকিয়ে রাগ হয় ইসমাইলের, জমুরের খেলায় ছেলে বাচ্চার কোনো দাম নেই। মেয়ে বাচ্চা যত রস্সির উপর দুলবে, হাতে লাঠি নিয়ে যত আগুপিছু হবে, তত লোকে চ্যাঁচাবে, তত পয়সা পড়বে। একটু বড় হলে তো কোন ব্যাপারই নয়, ইসমাইল তখন বিশ্রাম নেবে, খেলা দেখাবে রুকসানা। চোলির উপর থেকে ওড়না একটু সরিয়ে লড়কির নরম সিনা দেখিয়ে বসে গেলেই হল। রুকসানা ডুগডুগি বাজাবে, খেলা দিখাবে কিন্তু পাব্লিক অন্য খেল দেখবে।

নতুন কেনা সাইকেলের  রিমটার দিকে তাকায় ইসমাইল। মঙ্গলহাটের জমুরার লড়কি রিমের উপর পা রাখে, রিম দড়ির উপর গড়ায়, আর মেয়েটাও রিমটার সাথে সাথে সামনের দিকে এগোয় ,কখনও পেছন দিকে পায়ের চাপ দিয়ে ঠেলে পেছনে হাঁটে। হাতের লাঠি বাঁয়ে নামে, ডানে ওঠে। কখনও ডানে নামে বাঁয়ে ওঠে। এতটা রুকসানা পারবে, ইসমাইলের তালিমের ধক আছে। কিন্তু বস্ একটাই খেল ওর শেখা বাকি, দড়ির উপর একপায়ে দাঁড়িয়ে ডুগডুগির সাথে সাথে বডিটাকে নাড়ানো, বডি নড়বে একদম পেন্ডুলাম কা মাফিক, দড়ি নড়বে এত জোরে যে মনে হবে বাঁশের স্ট্যান্ডসুদ্ধ খুলে পড়ে যাবে যে কোনো সময়। ডুগডুগি থামবে, লড়কিও থামবে, দড়িও খুলবে না, খেলা ভি জমে যাবে। রুকসানার এই খেলটা শেখা এখনও বাকি। বিড়িতে ফুঁক দিতে দিতে ইসমাইল নোটের স্বপ্ন দেখে, ধুলোতে বালিতে ছড়ানো রুপালি সোনালি সিক্কা, পাঁচ আর দশের কুড়ি পঁচিশটা নোট।

রাত হয়, রুকসানা অমীরের ঘুমন্ত শরীরটাকে পাশে ঠেলে ইসমাইল লালির বুকের উপর হাত রাখে। সাত বছর আগে শাদির সময় ডাগর ছিল বৌটা। ইসমাইল তখন সবে খেলা দেখানো শুরু করেছে, পার্ক সার্কাসের লাইন থেকে উঠে এসে লোকাল ট্রেনে চেপে বেরিয়ে যায় দূরে.. ডায়মন্ড, লক্ষ্মী বা ক্যানিংয়ের গ্রামে জমুরের খেল দেখানোতে ভিড় হয় ভালো। মোবাইলের ভিডিও  গ্রামের সবজায়গায় দেখা যায় না তখনও, লোকে তখন মেশিনের  খেলা দেখতে শেখেনি। সেই সময় লালির সঙ্গে ইসমাইলের দেখা। চাঁদ সুলেমান ওস্তাগরের পনরা সালকা জবান বিবি…  ওস্তাগরের চল্লিশ বছরের বেঢপ ভুঁড়ির চেহারাটার সাথে বিলকুল বেমানান। তখনও লালি এমনভাবেই ফুঁক মারত কয়লার উনুনে, ঝুঁকলে টাইট ফিট সালোয়ার কামিজের চৌকো গলার ভেতর দিয়ে আধামাইল ইলাকা পুরা মখ্খন। ইসমাইলকে দেখে ওড়না দিয়ে কখনও সখনও বুক ঢাকত লালি । ইসমাইলের চোখের ইশারায় ওস্তাগরের বাড়ির পেছনের জুতোর কারখানার পাঁচিলের কাছে দেখা করতেও এসেছে কতবার! ইসমাইলের হাতের মধ্যে গলে যেতেযেতে জাপটে ধরেছে ওকে।তখন লালির হাতছুলেও ইসমাইলওর শরীরে হাজার ঘোড়ার দাপাদাপি টের পেত। এখন শালি বাসিয়ামাল।কয়লার উনুন ফুঁকে ফুঁকে মাখন পুড়ে কয়লা হয়েছে। কোনো উত্তেজনাই টের পায়না ইসমাইল। বেদম হয়ে হাত সরিয়ে নেয় ও।

পাশে শুয়ে লালির চোখ ধক করে জ্বলে ওঠে।

ছয় বছর আগে ওস্তাগরের পিপের মত শরীরের তলায় পিষতে পিষতে যতটা বেইজ্জতি লাগত, ইসমাইলের হাত সরানোয় তার চেয়ে কম বেইজ্জতি নেই। তেলের অভাবে লাল রুক্ষ্ম চুলগুলোকে একটানে খুলে ইসমাইলের উপর উঠে বসে লালি। ইসমাইলের গেঞ্জি এক ঝটকায়  তুলে বুকে মুখ ঘষতে থাকে জোরে জোরে। ত্রিফলার আলোটা অনেকদূরে জ্বলছে, আলো আঁধারিতে ওর শরীরের উপর বসে থাকা মেয়েমানুষটাকে কোন ডাইনের চেয়ে কম মনে হয় না ইসমাইলের। মুখ দেখা যায় না, সরু শুকনো  বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করে। সপাটে চুলের মুঠি ধরে লালিকে বুক থেকে নামিয়ে ইসমাইল খিস্তি দেয়শালি রেন্ডি! দো বচ্চা কেয়া বিয়াই শালি পুরি শুখি পড় গয়িভাগ শালি ইহাসে।

বাঁহাত দিয়ে চুলটা ধরে মাথাটা হাত দিয়ে  ঘষতে থাকে লালি। ব্যথা লেগেছে ওর। তাও আরেকবার উঠে এসে ইসমাইলের সামনে দাঁড়ায় ও। ইসমাইলের হাত ধরে ঢিলা কামিজের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, – কিঁউ গরমি নেহি মিলতি তুঝে?

ইসমাইল ঘেন্নায় লালিকে ঠেলে দেয় দূরেলালির হাল্কা শরীরটা ছিটকে গিয়ে পড়ে ইসমাইলের খেলা দেখানোর সরঞ্জামের উপর। চামড়ার ডুগডুগি, রঙীন চশমা, কালো ক্যারেস্তানি ব্যাগ, বাঁশের খুটি , গোল্লা পাকানো দড়ি সব ছিতড়ে ছুতড়ে পড়ে এদিক ওদিক। সলমন ক্যাটরিনা কিচ মিচ করে ওঠে।

ইসমাইল লালিকে ঠেলে দিয়ে নিস্পৃহ ভাবে শুয়ে পড়ে আবার। লালি আবার উঠে এসে ইসমাইলের সামনে দাঁড়ায়, জিজ্ঞাসা করে

কা বে, নয়ি লৌন্ডি মিলি কেয়া কোয়ি?

ইসমাইল উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়,

লালি আবার ডাকেকিঁউ জবান হ্যায়? অনেক বড় বুক আছে ওর?

ইসমাইলের মাথায় আগুন জ্বলে, উঠে দাঁড়িয়ে লালির শরীরটাকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায় পাশের পেসাবখানার পাঁচিলের দিকটায়। মাথাটাকে পাঁচিলে একবার ঠুকে দিতে পারলেই শান্তি। তার আগেই লালির হাতের লোহার শিঁকটা বিঁধে যায় ওর বুকে॥ শিকটার অর্দ্ধেক বুকে বিঁধিয়ে টলতে টলতে মাটি নেয় ইসমাইল। শালা শিকটার কোনো জাত নেইএতদিন গরম করে রুকসানার শরীরে ছ্যাঁকা লাগানোর সময় মনেই হয়নি কোনোদিন বেইমানি করতে পারে। ইসমাইল চোখ চেয়ে হতভম্ব হয়ে দম ছাড়ে, রক্তের স্রোতটা দেখে লালি ভাবেনা, রক্তের জোর আছে মাদারির, কত জোরসে বইছে দেখ।

                       ****

ক্যানিংয়ের লস্করপাড়ায় ভিড় জমেছে খুব। এক জেনানা ডুগডুগি বাজাচ্ছে, টকাটক টকাটক টকাংমিঠে বোলে ডাকছে বান্দর বান্দরীদের

এ সলমন শাদি করেগা? অক্ষয়কুমার ওয়ালা চশমা পহনেগা?

জেনানা মাদারির হাতের টানে বান্দরের গলা উঠে নামে, বান্দর বলে হ্যাঁ।

কেরেস্তানি ব্যাগ থেকে জিনানা বার করে রঙীন চশমা। বান্দর চশমা পড়ে ঘাড় নাড়ায়। জিনানার হাতে ডুগডুগি আবার বাজে  অরে খেল দেকো মিঁয়া..মদারিকা খেলছারকাছ বাবুছারকাছ দিখোজেনানাবালি ছারকাছ। জেনানার পাশে ভিড় জমে। ভিড়ের মুখগুলো চোখ দিয়ে চাটে জেনানার শরীর। মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে লালি মাদারি বুকের কাপড় সরিয়ে নেয় আরও অনেকটাজোর সে হাঁকে, অরে এ রুকসানাতৈয়ার হ্যায়? অভি খেল দিখায়েগি তু

টকাটক টকাটক টকাং

~~~^^^~~~

লেখিকা ~ পিয়া সরকার