অন্য এক দোলগাথা

Friends, আদতে আনাড়ি, বাংলা

শ্রীবৃন্দাবনের গোপীনাথ জিউর মন্দিরের বাইরের চাতালে পা ছড়িয়ে বসে আকাশপাতাল ভাবছিলেন চারুবালা। বয়স সে তো প্রায় অনেকদিন হল চারকুড়ি পেরিয়ে গেছে, কম তো নয়। সে কতবচ্ছর আগে কপাল পুড়িয়ে, শাঁখা-সিঁদুর-নোয়ার পাট চুকিয়ে কেষ্টর শ্রীচরণে ঠাঁই হয়েছিল…. মনেই পড়েনা ছাই। কতকি দেখলেন নিজের চোখে। ইংরেজ গেল, দেশ স্বাধীন হল, গান্ধীবুড়োকে কে যেন গুলি করে মারল। আহা, সেই সুভাষ ফিরে এলো না আর। কোন ছোটবেলায় বাপের কোলে চড়ে গ্রাম থেকে একবার দক্ষিণেশ্বর দর্শনে গিয়ে, বেলুড়মঠ থেকে বিবেকানন্দের একখান ছবি এনেছিল কিনে। দুচোক জুড়িয়ে যেত দেকে দেকে। বিয়ের ছমাস যেতে না যেতেই বাপের দেশ থেকে খপর এলো, ওলাউঠোয় মরেচে বাড়িশুদ্ধু। আছাড়িপিছাড়ি করে কেঁদেছিল চারু। বাপ মা আর কোলের ভাইটিকে সারাজীবনের জন্য আর দেকতে না পাওয়ার দুক্কে। ঘরের মানুষটা তকন ষোল বচরের কিশোর, অনেক গায়ে মাতায় হাত বুলিয়ে কান্না থামিয়েছিল চারুর। শউর-শাউড়ি লোক ভাল ছেল, মিত্যে বললে পাপ অবে। তাপ্পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, ঘোর বর্ষার একদিনে ইস্কুল থেকে ফেরার সময়,আলপথে কামড়ালো তাকে। জলে ডোবা ধানগাছের গোড়ার থেকে ছোবল দিল সাক্ষাৎ মৃত্যু। ঘরে এসে তোলার সময় মুক দিয়ে গ্যাঁজলা বেরিয়ে, সারা শরীল বিষে নীল। শাউড়ি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল উঠোনে। শউড়ঠাকুর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুদু। মানুষকে নিয়ে চলে যাওনের পর, বাড়ির আশপাশের বেধবারা পুকুর ঘাটে তাকে নে গিয়্যে, পাতর ঠুকে ঠুকে ভেঙে দেল সাদা শাঁখা, লাল পলা। ঘষে তুলে দেল মাথার লাল চেহ্ন। কোরা থান জড়িয়ে দেল গায়ে৷ তারপর একদিন জ্ঞাতি ভাসুর দেওরের পরিবার তেথ্যর নাম করে নিয়ে এসে ফেলে রেখে গেল একানে। সোমত্ত বেধবা মাগী, ঘরে ঠাঁই দিলে কোতায় ককন কেলেঙ্কারি করে বসে কেজানে। বেদ্যাসাগরের আলো শুধু কলকেতার জন্যি, নদীয়ার গন্ডগ্রামে ওসব শোনাও পাপ।

বেন্দাবনে এসে খুব একটা কষ্ট পেতে হয়নি চারুর। আশ্রয় জুটে গিয়েছিল আনন্দধামে। তার মত আরো প্রায় শচারেক কপালপুড়ীর সাথে। একসাথে ঘুম থেকে ওঠা, কাপড় ছেড়ে স্নান সেরে মন্দিরে গিয়ে নামগান, দুপুরে আলু কাঁচকলা সেদ্দ ভাত, কদাচিৎ ডাল বা কেউ দান করে গেলে সব্জীর তরকারির ছোঁয়া একটু। নিয়ম করে বেলপাতা চিবোনো, শরীল-মন ঠান্ডা রাকার জন্যি। মাসে মাসে মাতার চুল মুড়িয়ে কেটে দে যায় নাপতিনী। বিকেলে আরতির সময় আবার মন্দিরে গিয়ে বসা, অষ্টোত্তর শতনাম জপ করা। আর একাদশী পুন্নিমা আমাবস্যা অম্মুবাচীর উপোস। আগে খুব কষ্ট হত, একন সয়ে গেছে একেবারে। বরং নিয়ম না মানা হলে, দেরি হলেই রাগ হয়ে যায় নিজের ওপর আর দুনিয়াশুদ্ধ সবার ওপর।

ওই দেকো, ওদিকপানে একবার চেয়ে। মুখে বাঁশি, মাথায় পালক, হলুদ ধুতি পরনে কেমন মিটিমিটি হাসে আমার পানে চেয়ে। রাধারাণী কি বলচে যেন কানের কাছে মাতা ন্যে এসে। মনটা অস্থির হয়ে আছে কদিন থেয়ে।

হপ্তাখানেক আগে বেহারের পূর্ণিয়া না কোত্থেকের এক গেরাম থেয়ে কেউ এসে আশ্রমে রেকে গেছে বছর কুড়ি একুশের লছমী কে। বেধবা, বর নাকি লরির খালাসী ছেল, নিজেই মাসচারেক আগে আরেকটা লরির সাথে ধাক্কায় খালাস হয়ে গেচে। তা সে মাগী শুধুই কাঁদে পড়ে পড়ে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, দুইবেলা মন্দির যাওয়া নেই। মুকটা খুব সুন্দর, রঙ পরিস্কার, গায়েগতরে বেশ যৈবন ভরভরন্ত, এইসময়েই তো যত ভয়। আশ্রমের সবাই একবার করে এসে বুজিয়ে বলার চেষ্টা চরিত্তির করে যখন হার মেনেচে, গতকাল রাতে তার কাচে গিয়ে বসেচিলেন সবচেয়ে বুড়ি ঠাকরুন চারুবালা। তারপর মাতাটি তার কোলে নিয়ে, অনেক আদর করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর, যা শুনলেন তাতে প্রায় দমটা আটকে এলো গলার কাচটিতে।

মাগীর দেড়মাস পোয়াতি। ইসকনের সেই ধলা ছোঁড়াটা কদিন ঘোরাঘুরি করছে আশ্রমের চারপাশে, সেই নাকি দায়ী। ওই বড় মন্দিরেই নাকি ছেল কদিন বেন্দাবনে এসে, তখনকারই কেচ্ছা। সে নাকি লছমিকে ছাড়া বাঁচবেনা বলেছে।

এইসবই, সাথে নিজের কথাও ভাবছিলেন বসে চাতালে। সবাই স্নানে চলে গেচে। শরীর মাথা ঝাঁঝাঁ করছিল বলে একটু পরে যাবেন বলেছেন তাদের।

তিনি থাকতে এই অনাচার, পাপ আর একটিবারের জন্যেও আনন্দধামে ঘটা চলবেনা। যা হওয়ার, তাই হবে। হাতুড়ে ডেকে, হামানদিস্তে তে বাটা শিকড়বাকড় খাইয়ে, আগত প্রাণের হানি আর তিনি করতে পারবেন না।

ছোঁড়াটাকে আরতির পর মন্দিরের পিছনে ডেকে পাঠালেন হরিমতি কে দিয়ে। আহা, মুকটা যেন সাক্ষাৎ মুরারিমোহনের মত। রঙটাই যা শুদু দুধসাদা। ধুতিচাদর, কপালে তেলক, টুকটুকে লাল ঠোঁট। চওড়া কাঁধ, পিঠের বাঁধুনি।… তা বাচা, লছমীকে ন্যে কি করবে ভেবেচো বলোদিকিনি? কোতায় বেচবে ন্যে গিয়ে? এদেশের কোতাও, নাকি আরবদেশে?

মাদার, আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু ম্যারি হার। কান্ট লিভ হার অ্যালোন লাইক অ্যাট দিস স্টেজ। আই উইল কুইট মাই রিলেশনসিপ উইথ ইসকন সিন্স দ্যে আর নট উইলিং টু গেট আস ম্যারেড। দ্য মাহাপ্রাভু অফ দ্য টেম্পল ড্রোভ হার অ্যাওয়ে। আই উইল গো ব্যাক টু মাই ওন কান্ট্রি নরওয়ে উইথ হার ওয়ান্স উই ক্যান গেট ম্যারেড লিগ্যালি…

দোলপূর্ণিমার রাতে, চাঁদের আলোয় যখন ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর, আর সাক্ষী হিসেবে বয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস…
তখন গোপীনাথ জিউর মন্দির ভীড়ে ভীড়াক্কার। ফুলের মালায়, আলোতে সাজানো চারদিক। মরিস ওসওয়ার্ল্ডের সাথে লছমীরাণী পাঠকের বিয়ে। হিন্দুমতে। রেজিস্ট্রার এসে গেছেন, সইসাবুদ হয়ে গেছে, স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে গডস ওন চিল্ড্রেন নামক এনজিও’ র সেই পাগলী মেয়েটা, সীমন্তিনী। মাসখানেক আগেই গঙ্গার ঘাটে তার সাথে নাতনী পাতিয়েছিলেন চারুবালা। গতকাল রাতে আশ্রম থেকে তার মোবাইলে ফোন করেছিলেন তিনি। পাগলী নাকি ঠাকুরদেওতা মানে না, মন্দিরে যায় না। অথচ দেকো, আজ সক্কালবেলাতেই একপাল ছেলেমেয়ের সাথে এসে, গোলাপি আবির মাখিয়ে, চকাস করে ফোকলা গালে চুমু খেয়ে বলে কিনা, উফ, চারুঠাম্মি, তুমি একটা জিনিয়াস গো। একন দেকো কেমন দৌড়ে বেড়াচ্চে খাবার জায়গায়, সবাই মিষ্টি পেলো কিনা তদারকিতে ব্যাস্ত।

গোপীনাথের মুখে যেন আজ মিষ্টি হাসি। শ্রীরাধিকারও। গোলাপি আভা ফর্সা গালে। প্রদীপের আলো, ধুপের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। একমনে মন্ত্র পড়ছেন পুরোহিত। লছমীর কপালে সিঁদুর। লাল শাড়ি। যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম… হোমের শিখা লকলকিয়ে উঠছে যজ্ঞের। কখন যেন পাশে এসে বসে, গান গেয়ে উঠেছে সীমন্তিনী.. …… “যখন পূজার হোমানলে, একে একে উঠবে জ্বলে তারা, আকাশপানে ছুটবে বাঁধনহারা…তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন…আমার ব্যাথার পুজা হবে সমাপন…”

চারুবালার দুচোখে জল। আজীবনের কঠিন সাদা রঙ স্বচ্ছতোয়া মনের ভিতর দিয়ে বয়ে যেতে গিয়ে সাতরঙা রামধনুতে গেছে ভেঙে। বাৎসল্য, ভালোবাসা, আনন্দ, প্রেমের অদ্ভুত সেসব রঙ। বুড়ির আজ বড় আনন্দের দোলখেলা..।

?

✍ পার্থ ঘোষ