একলা ঘর

Anirban & Arijit, আদতে আনাড়ি, বাংলা, ভূত আমার পূত

 

 

সন্ধের দিকে ধড়ফড়িয়ে ঘুমটা ভাঙতেই দীপের মনে হল কানের পর্দাগুলো এবার ফেটে যাবে। বালিশের মধ্যে শুয়েই দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে শব্দটা আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু এই গমগমে আওয়াজকে রোখা অসম্ভব। শব্দের তীক্ষ্ণতা যেন বুকে এসে ধাক্কা মারছে, মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।

কোনোরকমে খাটের লাগোয়া খোলা জানলাটার কাছে মুখ নিয়ে গেল দীপ। আওয়াজটা আসছে উল্টোদিকের বাড়ির আধখোলা জানলা দিয়ে। সাউন্ড সিস্টেমের ভলিউম ফুল করে দিয়ে কেউ ফসিলসের “অ্যাসিড” চালিয়ে দিয়েছে। দীপের একসময়ের ফেভারিট গান ছিল এটা, কতবার কলেজে পারফর্মও করেছে। কিন্তু এখন সব অতীত। জানলার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল দীপ,

“প্লিইইইইজ, সাউন্ডটা কম করুন! কেউ আছেন? শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন? গানটা বন্ধ করুন। সাউন্ডটা কমান….”

দীপের চিৎকার প্রবল আওয়াজের ভিড়ে মিলিয়ে গেল। নিজের জানলাটাকেই জোরে বন্ধ করে আবার বালিশে শুয়ে পড়ল দীপ। কিন্তু তাতে আওয়াজ কিছুই কমল না। গতবছর থেকেই দীপের ফ্ল্যাটের নিচে কলোনির পুজোটাও বন্ধ হয়ে গেছে, ঢাকের আওয়াজ তাই কানেই আসে না। আজ অষ্টমী বলে বোঝার উপায়ই নেই। কিন্তু, দীপের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে পাশের ফ্ল্যাটের ওই লাউড মিউজিক।

সোশাল মিডিয়া থেকে অনেকদিন হল নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে দীপ। ভালো লাগে না আর লোকজনের খাওয়ার ছবি দেখতে। হিংসে মারামারি খেয়ো খেয়ি এইসবই যেন বেশি চলে ওখানে। দীপ, ভিকি, বুবাই আর চিনা মিলে কলেজে পড়ার সময়েই একটা বাংলা ব্যান্ড বানিয়েছিল ওরা। স্বপ্ন ছিল ফসিলসের মতো ওরাও বাংলা গানে রক মিউজিককে একটা স্থায়ী জায়গা এনে দেবে। ব্যান্ডের নাম দিয়েছিল “বং রক”। দীপ নিজেই গান লিখত আর গাইত। ভিকি দুর্দান্ত ড্রামস বাজাতো। বুবাই ছোটবেলা থেকেই সিন্থেসাইজারে পোক্ত। চিনা ছাড়া আর কাউকে গীটারের জন্য ভাবাই যায়নি। এক কলেজ থেকে আরেক কলেজে দাপিয়ে বেড়াত “বং রক”। দর্শকদের চিৎকার আর মনিটরের কানফাটানো শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলত দীপ। একটা অন্যরকম উত্তেজনা আসত স্টেজের আলো আঁধারির মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। পরের পর শোয়ের ধকল নিতে না পেরে যখন গলা চিরে যেত, ক্লান্ত লাগত, তখন চিনাই প্রথম শিখিয়েছিল কীভাবে নিজেকে নেশার ঘোরে জড়িয়ে ফেলতে হয়। ছিলিমে দু টান দিলেই আবার কোথা থেকে যেন অজানা শক্তি এসে দীপকে চাগিয়ে তুলত। লাফিয়ে বেড়াত গোটা স্টেজ জুড়ে। ড্রামস আর গীটারের যে প্রচন্ড শব্দ আচ্ছন্ন করে রাখত দীপকে, সেই শব্দই আজ আর শান্তিতে থাকতে দেয় না ওকে।

ঘরের কোণে হেলান দিয়ে রাখা ইলেকট্রিক গীটারের কভারের দিকে তাকাতেই মাথার যন্ত্রণা যেন আরও বেড়ে গেল। রেগে গিয়ে আবার জানলা খুলে চেঁচালো দীপ,

“ওই শুয়োরের বাচ্চাগুলো! গোটা পাড়াকে গান শোনানোর ঠেকা নিয়েছিস নাকি? বন্ধ কর বলছি, নয়তো তোদের ঘরে ঢুকে ভেঙে আসব ঐ সাউন্ড সিস্টেম…”

দীপের চিৎকারে সাড়া দিল না কেউ। রেগেমেগে খাট থেকে নেমে পাশে পড়ে থাকা জামাটা গায়ে দিয়ে নিল। অন্ধকার ড্রয়িং রুমে এসে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে দীপ সদর দরজা খুলতে চেষ্টা করল। বেশ শক্ত হয়ে গেছে দরজাটা। কয়েকবার জোর দিয়ে টানতে তবেই খুলল। বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল দীপ। পাঁচতলার ফ্ল্যাটে লিফট থাকলেও সেইদিকে গেল না। আজ পাশের বাড়িতে গিয়ে ওদের উচিৎ শিক্ষা দিতেই হবে। পুজোর সময় বলে সবাইকে উত্যক্ত করার কোনও অধিকার ওদের নেই। বাকি সিঁড়ি নেমে এসে অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বাইরের গেট খুলে বেরলো দীপ।

রাস্তায় একটাও লোক আজ চোখে পড়ছে না। অবশ্য পুজোর ভিড়ে এদিকে লোক কমই থাকে। একটু হেঁটে গিয়ে পাশের আবাসনের মেন গেট দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। উঠতে হবে পাঁচতলা। এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে সেই বিকট আওয়াজ। উঠতে উঠতে শব্দটা আরও জোরালো হয়ে উঠছে। তিনতলার লবিতে এসে কানে হাত দিল দীপ। আরও উঠতে লাগল। অবশেষে পাঁচতলার সেই ফ্ল্যাটের কাছে এসে থামল। ফ্ল্যাট নাম্বার ফাইভ সি। এই ঘর থেকেই আসছে আওয়াজটা। গোটা ফ্ল্যাট যেন কাঁপছে। আশেপাশের লোকেরাই বা কিছু বলে না কেন এদের কে জানে! দীপ কানে হাত চাপা দিয়েই কোনোরকমে এক হাত দিয়ে দরজায় নক করল। কলিং বেলও বাজালো। কিন্তু কোনও সাড়া এল না ভিতর থেকে। রেগে গিয়ে বেশ জোরেই দরজায় ধাক্কা মারতে গিয়ে দরজাটা অল্প ফাঁক হয়ে গেল। তার মানে লক করা নেই এটা ভিতর থেকে। চোখ মুখ কুঁচকে সেই প্রচণ্ড আওয়াজের মোকাবিলা করতে করতে দরজাটা ঠেলে দীপ একটু ভিতরে ঢুকল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেউ আছেন?”

আশ্চর্য ব্যাপার! এবারেও কেউ উত্তর দিল না। দীপ কৌতুহলবশত আর একটু এগোতেই দেখতে পেল সামনে ফাঁকা ড্রয়িং রুমে একটা হাল্কা নীলাভ আলো জ্বলছে, আর সেই ঘরেরই শেষ প্রান্তে রাখা একটা বিশাল মিউজিক সিস্টেমে বাজছে সেই গান। সাহস করে ড্রয়িং রুমে ঢুকে দীপ লক্ষ্য করল যে ফ্ল্যাটের মালিক বোধহয় একটু আগেই বাইরে গেছেন। সোফার পাশে অ্যাশট্রেতে দুটো আধজ্বলা সিগারেট পড়ে আছে। সামনের টেবিলে বসানো দুটো বড় স্কচের বোতল আর চার পাঁচটা গ্লাস। তার মানে বেশ কয়েকজনই এখানে বসেছিল, আর তারাই চালিয়েছে এই গান। দীপ এগিয়ে গেল সাউন্ড সিস্টেমের কাছে। স্টপ বাটনটা প্রেস করতেই শান্ত হয়ে গেল চারিদিক। মনে হল এক চরম প্রশান্তি নেমে এল চারিদিকে। দীপ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাকিরা চলে আসার আগেই কেটে পড়তে হবে, নয়তো কেউ দেখতে পেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। ফ্ল্যাটের দরজাটা আবার বাইরে থেকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল দীপ। বিনা ঝগড়াঝাটিতেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি ও। এবার মুডটা ঠিক লাগছে। ঘরে গিয়ে শান্তিতে বসা যাবে। ভিকি চিনা বুবাইরা এখনও শো করে পুজোতে। একটা নতুন মেয়ে ভোকালিস্টও নাকি জুটেছে। ওদের শো খুব দেখতে যেতে ইচ্ছে করে দীপের, কিন্তু সে আর সম্ভব নয়। ওই আওয়াজ আর সহ্য হয় না। কোনও আওয়াজই দীপ আর নিতে পারে না। খুব রাগ হয় নিজের ওপরেই। রাগ থেকে ডিপ্রেশনও আসে, কিন্তু কলেজের সময় থেকেই বাবার এই ফ্ল্যাটে একা থাকার অভ্যেসটা আর ছাড়তে পারেনি। বাবা মা থাকে দেশের বাড়িতে। কতবার বলেছে ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে, কিন্তু লোকসমাজে মেশার ইচ্ছেটাই তো চলে গেছে দীপের।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে দোতলার কাছে নেমে এসেছে বুঝতেই পারেনি দীপ। কিন্তু, চমকে উঠতে হল ওপর থেকে আসা সেই একই আওয়াজে। আবার কেউ চালিয়ে দিয়েছে গানটা। আগের থেকেও জোরে!

দাঁতে দাঁত চিপে দীপ ফের ওপরে উঠতে শুরু করল। আজ একটা ফয়সালা হয়েই যাবে। নির্ঘাত অন্য কোনও ঘরে বা ছাদে গিয়েছিল ওরা। এসেই আবার মজলিশ বসিয়েছে। অপরকে কষ্ট দিয়ে নিজেরা আনন্দ করবে, আর দীপ সেটা সহ্য করবে, এমন হতেই পারে না। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে আবার ফাইভ সি ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দীপ কলিং বেলে চাপ দিল বেশ কয়েকবার৷ সাড়া না পেয়ে দরজায় টোকা দিতেই দেখল এখনও সেটা খোলা অবস্থায় আছে, আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের গমগমে আওয়াজ। দীপ চেঁচিয়ে উঠল জোরে,

“শুনছেন! কেউ আছেন? একটু বাইরে আসবেন?”

এবারেও কোনও উত্তর এল না। দীপ এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ড্রয়িং রুমে। অবাক হয়ে গেল দেখে যে একইরকম ভাবে ফাঁকা ড্রয়িং রুমে সেই বোতল আর গ্লাস রাখা। সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। এবার বেশ ভয়ই লাগল দীপের। আজব ব্যাপার তো। নিজের হাতেই তো বন্ধ করে গেছিল গানটা। কেউ কি মজা করছে ওর সাথে! দীপ পাশের ঘরের দিকে চোখ বোলালো। সেটাও খালি। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ করল গানটা। তারপর, মিউজিক সিস্টেমের পিছনেই আধখোলা জানলাটাও বন্ধ করে দিল দীপ। এই জানলা দিয়েই আওয়াজটা বাইরে যাচ্ছিল। ঘরের মধ্যে বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আর বেশি সময় নষ্ট না করে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে আবাসনের বাইরে চলে এল। একটা লোকও এদিকে নেই, অথচ ওপরে ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটে চলেছে। দীপ এসে নিজের আবাসনের দরজা দিয়ে ঢুকে ওপরে উঠতে শুরু করল। ঘরে গিয়ে এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া যাবে।

||

– শঙ্কুদা, ফিল্টার উইলস দিও এক প্যাকেট।

– আর কত সিগ্রেট খাবি তোরা, দুপুর থেকে তো সাত প্যাকেট হাওয়া করে দিলি।

– তোমার তো ব্যবসা হচ্ছে নাকি!

– এমন ব্যবসা করে কী লাভ বলতো। তোদের কিছু হয়ে গেলে নিজেকেই দোষ দিতে হবে তো।

– চাপ নিও না, বন্ধুরা মিলে একটু অষ্টমীতে ফূর্তি করছি। বছরের এই সময়েই তো সবাইকে একসাথে পাওয়া যায়। তাছাড়া আমি কিন্তু খাই না।

সিগারেটের দাম মিটিয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগল আনন্দ আর তিস্তা। লাইটার নিয়ে আড়াল করে তিস্তা মুখের সিগারেটটা ধরালো।

– কটা হল রে তিস্তা? বাকি ছেলেদের ফ্রাস্টু দিবি মনে হচ্ছে এবার।

– মেলা বকিস না। মেয়েদের স্মোক করা বারণ আছে কোথাও? তুই না আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস আনন্দ! সবসময় নীতি আওড়াস, এটা করিস না, ওটা করিস না। কাম অন ডুড, এটা তোর নিজের লাইফ, এনজয় কর।

– এনজয় তো করছে ওরা এখন। আমার ফ্ল্যাটটার যা হাল করবে, সেটা ভেবেই আঁতকে উঠছি। ভাগ্যিস মম ড্যাড পুজোয় থাকে না এখানে। নিজে মালও খাই না, স্মোকও করি না, কিন্তু ঘন্টায় ঘন্টায় ওদের অর্ডারের যোগান দিচ্ছি।

– সাচ্চা দোস্ত তুই আমাদের জানিস তো! সেইজন্যই তোকে সঙ্গ দিলাম এখন। চল ঢোক। সন্ধে হচ্ছে, অন্ধকার হলেই স্যান্ডিকে সামলানো মুশকিল হবে।

আবাসনের গেট খুলে ভিতরে ঢুকল আনন্দ আর তিস্তা। লিফট লবির কাছে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। কিছুক্ষণ বাদেই টিং করে আওয়াজ হয়ে লিফট এসে দাঁড়াল সামনে। ভেতরে ঢুকে বাটন প্যানেলে ফাইভ প্রেস করল আনন্দ।

ফাইভ সি-এর দরজা খুলে ঢুকতেই ভিতরের ড্রয়িং রুম থেকে চেঁচিয়ে উঠল স্যান্ডি,

– তিস্তা! কোথায় গেছিলিস তিস্তা আমাকে ছেড়ে? এই পুরানি হাভেলিতে আমার বুঝি ভয় করে না ডার্লিং! কাম তিস্তা, আমাকে জড়িয়ে ধর।

তিস্তা ড্রয়িং রুমে ঢুকেই স্যান্ডির মাথায় একটা চাঁটি মেরে সোফায় বসে পড়ল। আনন্দ ঘরে ঢুকতেই বাকিরা বলল,

– এই তো এসে গেছে মালিক। স্যারজি, আসুন এদিকে একবার। আপনি যে এই ব্যাপারটা চেপে গেছিলেন, তা তো জানতাম না।

আনন্দ অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে তারপর স্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

– বোস বোস। তোর বাড়িতে যে একটা ভূতুড়ে মিউজিক প্লেয়ার আছে সেটা আগে বলিসনি তো!

আনন্দ সোজা হয়ে বসল সোফায়, “কী যাতা বকছিস! কী হয়েছে সেটা বলবি তো!”

– আরে, যতবার এতে গান চালাচ্ছি, ততবার কিছুক্ষণ চলার পরেই ফট করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্টপ বাটনটাও ওপরে উঠে যাচ্ছে।

আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

– তোরা কি খুব জোরে গান চালিয়েছিলিস?

– হ্যাঁ তো! আমাদের বন্ধুর ফ্ল্যাট, আমাদের গান, ফুল ভলিউমে ফসিলস চলছিল। এই দেখ এইভাবে..

বলেই স্যান্ডি উঠে গিয়ে প্লে বাটন প্রেস করে দিল। আর প্রকান্ড শব্দে কাঁপতে লাগল ঘরখানা। বাকিরাও গলা মেলাতে লাগল, “সে চক্রব্যুহে আজও…..”

আনন্দ ছুটে গিয়ে স্টপ করল সাউন্ড সিস্টেম। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

– আমাকে না জিজ্ঞেস করে এত জোরে গান চালাতে তোদের কে পারমিশন দিয়েছিল?

“মানে? গান চালাবার পারমিশন লাগে নাকি? তুই পারিসও বটে আনন্দ,” তিস্তা বলল সোফা থেকে।

– শাট আপ তিস্তা! আমি ওদের জিজ্ঞেস করছি। বল কে চালিয়েছিলি গান?

স্যান্ডি এবার উঠে দাঁড়াল মেঝে থেকে। চোয়াল শক্ত করে জবাব দিল,

– আমি চালিয়েছি। এবার বল কী করবি?

– আর এই পিছনের জানলাটাও কি তুই খুলেছিস?

– অফকোর্স! সিগারেটের ধোঁয়া বেরোবে কোথা দিয়ে চাঁদু? আর তাছাড়া তোর জানলাটাও তো নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায় দেখলাম। ম্যাজিক নাকি বে?

সজোরে স্যান্ডির গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল আনন্দ। স্যান্ডি গালে হাত দিয়ে সোফায় গিয়ে পড়ল। তিস্তা চেঁচিয়ে উঠল সোফা থেকে, “আর ইউ ম্যাড আনন্দ? তোর হয়েছে টা কী?”

তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করে আনন্দ সোফায় এসে বসে পড়ল দুহাতে মাথা গুঁজে। তিস্তা এসে বসল পাশে। পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,

– কিছু প্রবলেম নাকি? আমাকে বলতে পারিস।

আনন্দ দুমিনিট পর মাথা তুলে চাইল। সামনে বসে থাকা সবাই অবাক ঘটনার আকস্মিকতায়৷ স্যান্ডির চোখে রাগ। আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– আই অ্যাম ভেরি সরি। ক্ষমা চাইছি এইভাবে রিয়্যাক্ট করে ফেললাম বলে। প্লিজ কিছু মাইন্ড করিস না। তোরা আবার মজা কর। কিন্তু গান চালাস না আর জোরে। আমি একটু আসছি বাইরে থেকে।

তিস্তাও উঠে দাঁড়াল, “চল আমিও যাব তোর সাথে।”

||

– কেন কিনলি এইগুলো আনন্দ? কোথায় যাবি?

– আয় না আমার সাথে। আর কাউকে বলবি না। তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব এখন।

– আনন্দ, তোকে না আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। তুই আমাকে ভালোবাসিস না তো? প্লিজ, এইসব ন্যাকামো আমার সহ্য হয় না কিন্তু।

– ভুল ভাবছিস। সেসব কিছু নয়। জানিস তিস্তা, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের নিচেও একটা দুর্গাপুজা হত।

– কই এবারে তো দেখছি না।

– বন্ধ হয়ে গেল রে! আগের বছর একটা ঘটনা ঘটে গেল। তারপর থেকেই আর পুজো হয় না। আগে সারাদিন ঢাক বাজত, কাঁসর শাঁখের আওয়াজে পাড়া গমগম করত। গানের অনুষ্ঠান হত কতরকমের। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল আগের বারে। এই অষ্টমীর দিনেই।

তিস্তা হাতের সিগারেটটা ফেলে দিল রাস্তায়।

– কেন বন্ধ হল পুজো?

– পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন দেবাঞ্জন কাকু। বেশ রাশভারি চেহারার লোক, কিন্তু খুব হাসিখুশি আর মিশুকে। ওঁর ফ্ল্যাট ছিল আমাদের পাশের আবাসনেই। পুজোর সময় গোটা কলোনিকে একত্র করতেন। সবাই এসে পাঁচটা দিন মাতিয়ে রাখত এই পাড়া। গত বছরও সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু…

আনন্দ নিজেদের আবাসনটা পেরোতেই তিস্তা বলে উঠল, “কী রে, ঢুকবি না?”

– না, আমার সাথে আয়। বললাম না একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি তোকে।

তিস্তা আবার হাঁটতে লাগল পাশে পাশেই। কিন্তু পরের গেট দিয়েই আনন্দকে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।

– পাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবি? কেউ থাকে এখানে তোদের চেনা?

– তুই মুখ বন্ধ রেখে আসবি?

তিস্তাও ঢুকল ভেতরে। ফাঁকা অন্ধকার গ্যারেজের ভেতর দিয়ে দুজনে হেঁটে পোঁছলো লিফট লবির কাছে।

– লিফট কিন্তু চলে না তিস্তা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবি তো?

– আলো নেই একটাও এদিকে। লিফটও চলে না। কী যে করতে চলেছিস কে জানে। চল, তোর হাতেই আমার ভাগ্য। কন্টিনিউ কর যেটা বলছিলিস।

দুজনে মিলে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি দিয়ে।

– দেবাঞ্জন কাকুর পলিটিকাল সোর্স ছিল বিশাল৷ পুজোর জাঁকজমক দেখলেই টের পাওয়া যেত। নেতা মন্ত্রীরা আসত উদ্বোধন করতে। পুজোর প্রত্যেকদিনই জলসা হত কিছু না কিছুর। আবাসনের সবাই অংশ নিত সেই হইহুল্লোড়ে। তবে তাতে থাকত না শুধু একজন। পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটের সেই ছেলেটা কারুর সাথে মিশত না। কোনও সোশ্যাল গেট টুগেদারেও আসত না। এমনকি পুজোর মণ্ডপেও নয়।

– কেন রে?

– কারণটা ছিল অদ্ভুত। ছেলেটা এমন ছিল না আগে। ওর বাবা মা থাকত মালদায় ওদের নিজেদের বাড়িতে। আর ছেলেটা পড়াশুনার জন্য থাকত বাবার এখানকার ফ্ল্যাটে। কলেজে পড়ার সময় একটা রক ব্যান্ডে গান গাইত। দিলখোলা ছেলে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিল। কোনোরকম জোরালো শব্দ শুনলেই ও আর থাকতে পারত না, ছটফট করত অস্বস্তিতে। সামান্য জোরে আওয়াজেও ও পাগলের মতো রিয়্যাক্ট করত। কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকত। এটা একধরনের ফোবিয়া। নাম ফোনোফোবিয়া।

– নাম শুনলাম প্রথমবার।

– হ্যাঁ, আমরাও জানতাম না। সাবধানে আয় তিস্তা, এখানকার আলোগুলো কিন্তু খারাপ।

তিস্তা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সিঁড়ির দিকে খেয়াল রেখে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল,

– এই রোগের ট্রিটমেন্ট কিছুই ছিল না?

– ছিল, ওর বাবা একটা বড় ডাক্তারের সন্ধান পেয়েছিলেন। পুজোর পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছিল তাঁর। ঠিক ছিল পুজোর পরেই উনি এসে ছেলেকে দেখাতে নিয়ে যাবেন। ছেলেও জেদ করে ফ্ল্যাটেই রইল পুজোর সময়, দেশের বাড়িতে গেল না। পুজো শুরু হল ধুমধাম করে৷ সকাল থেকেই ঢাক কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে পাড়া মেতে উঠল। রোজই দুপুরে দেবাঞ্জনকাকু ফ্রিতে ভোগ খাওয়াতে লাগলেন কলোনির সবাইকে। কিন্তু সবাই ভুলে গেল পাঁচতলার ফ্ল্যাটের সেই ছেলেটাকে। পুজোর কানফাটা মাইকের আওয়াজে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখে দিল সে নিজেকে।

– তুই চিনতিস ওকে আনন্দ?

– হ্যাঁ, পাশের ফ্ল্যাট তো, চিনব না! কিন্তু ও তো মিশত না আর কারুর সাথে। তাই একতরফা কতটা আর আলাপ থাকে। ওর গোটা দুনিয়াই ছিল এই একলা ঘর, ঠিক তোর পিছনেই।

চমকে পিছনে ঘুরে তাকালো তিস্তা৷ ফ্ল্যাট নাম্বার ফাইভ এ লেখা দরজাটা বেশ অনেকদিন হল খোলা হয়নি মনে হচ্ছে। মোবাইলের টর্চের আলোতেও বেশ বোঝা যাচ্ছে দরজার গায়ে আর তার আশেপাশে ধুলো আর ঝুল জমে আছে। তিস্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আনন্দকে,

– এখানে কি ও থাকে এখনও? দেখে তো মনে হচ্ছে না। পুরো কমপ্লেক্সেই তো কাউকে দেখতে পেলাম না। কারুর ঘরের আলোও জ্বলতে দেখলাম না।

আনন্দ কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে তিস্তার সামনেই ফ্ল্যাট ফাইভ এ-র দরজা ধরে চাপ দিল। বেশ একটু জোরেই চাপ দিতে হল। ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়ে দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ধুলোমাখা বোঁটকা গন্ধ এসে লাগল নাকে। তিস্তা নাকে হাত দিয়ে আনন্দর জামাটা টেনে ধরল পিছন থেকে।

– আনন্দ! তুই কী করতে চাইছিস? আমাকে বলবি প্লিজ! সেই ছেলেটা কি থাকে এখানে?

– আমার সাথে ভেতরে আয় তিস্তা। দাঁড়া মোবাইলের আলোটা আমিও জ্বালিয়ে নি।

তিস্তা আনন্দর পিছন পিছন অন্ধকার হাতড়ে ঢুকে দাঁড়াল ঘরের ভেতর। মোবাইলের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই ফ্ল্যাটে এখন আর কেউ থাকে না। বলা ভালো কেউ থাকবার মতো অবস্থায় নেই আর। মেঝেতে চাপ চাপ ধুলো, দেওয়ালে সিলিঙে মাকড়সার জাল। আসবাব বলতে ডাইনিং রুমে রাখা একটা শোকেস, একটা খাওয়ার টেবিল, দু তিনটে চেয়ার। সামনের দিকে দুখানা ঘর। সেই ঘরের কাঁচের জানলা দিয়ে আসা আশেপাশের ফ্ল্যাটের মৃদু আলো যেন পরিবেশটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।

আনন্দ এগিয়ে গেল বাঁদিকের ঘরের দিকে। তিস্তাও গিয়ে দাঁড়াল ঘরে ঢোকার দরজার সামনে। ঘরের ভেতর আর একটা দরজা, ব্যালকনিতে যাওয়ার। জানলার পাশেই রাখা একটা ধুলোভর্তি খাট। খাটের চাদরটা মনে হয় কত মাস ধরে পালটানো হয়নি। তিস্তা জিজ্ঞেস করল,

– ওগুলো খাটে রাখলি কেন আনন্দ?

– কারণ, এটাই ছিল ওর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা৷ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল এই ছোট্ট জায়গাতে৷ বাইরের জগতের শব্দ যখন ওকে আর তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না, তখন ডিপ্রেশনে চিৎকার করে উঠত মাঝে মাঝে৷ আর সেই চিৎকারে নিজেই আরও ভয় পেয়ে যেত৷ কিন্তু অষ্টমীর সন্ধিপুজোর ঢাক আর কাঁসরের প্রবল আওয়াজে আমরা শুনতে পাইনি ওর চিৎকার। হয়তো আমাদের জানাতে চেয়েছিল যে ওর অস্বস্তি চরম সীমায় পৌঁছেছে। তাই মন্ডপের দালানে আমাদের চোখের সামনে আছড়ে পড়েছিল দীপের শরীর, এই ঘরের লাগোয়া ব্যালকনি থেকেই।

তিস্তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল এটা শুনেই। চমকে দু পা পিছোতেই ধাক্কা লাগল দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা গীটারে। কোনোরকমে বুকে হাত চেপে ছুটে বেরোতে লাগল ঘর থেকে। আনন্দ পিছু নিল ওর,

– তিস্তা, আস্তে যা, অন্ধকার আছে কিন্তু, পড়ে যাবি!

তিস্তা দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামতে শুরু করল। আনন্দও ফ্ল্যাটের দরজাটা বাইরে থেকে সজোরে বন্ধ করে নামতে লাগল তিস্তার পিছনে।

||

হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজে চমকে উঠল দীপ। বিছানায় বসেই পাশে রাখা ফুলের তোড়ার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ এটা এল কোথা থেকে! হাতে নিয়ে দেখল প্লাস্টিক কাগজে মোড়া সেই ফুলের বোকের ওপর একটা ছোট্ট চিরকুটে পেন দিয়ে কিছু লেখা৷ জানলা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় কাগজটা চোখের সামনে এনে দেখল তাতে লেখা দুটো শব্দ।

“ভেরি সরি!”

দীপ বুঝল না এর মানে। শুধু এটাই ভেবে শান্তি পেল যে পাশের ফ্ল্যাটের সেই গানটা এখন বন্ধ হয়েছে!

 

~ সমাপ্ত ~

  লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি

2 comments

Comments are closed.