চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৩য় কীর্তি – চুরুট

Biography, Childhood, Friends, Humor, Journey, Nostalgia, Series, Story, বাংলা

শুনলাম রিসেন্ট একটা স্টাডি বলছে যে সিগারেট খেলে নাকি নেশাই হয় না“। দিপু প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিলো সিটুর উদ্দেশ্যে। সিটু বলল – “কি জানি! আমার তো দিব্যি হয়। কেন তোর হয়না?

আমারো হয়“- দিপুর স্বীকারক্তি। “কিন্তু মিতু বলল যে“।

ছার ছার”– আমি আর থাকতে না পেরে বলে উঠলাম। টিপিকাল মিতুর স্টাইল এ। আমাদের মধ্যে মিতুই একমাত্র কলকাত্তাইয়া টোনে ‘ড়’ কে ‘র’ বলে। “ছার পোকা “- অগা ব্যাপারটাকে বাক্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে।

মিতু বুঝবে স্মোকিং! তাহলেই হয়েছে। মনে আছে তো ওর চুরুট খাওয়াটা?” -আমি উস্কে দি মিতুকে। এতকক্ষন চুপ করে থাকার পর মিতু দার্শনিকের মতো শুধু বলল – “কোনো ভদ্রলোকের ছেলে এরকম করে না”

ঘটনা টা খুলেই বলি। ফার্স্ট এম.বি (ফার্স্ট ইয়ার অফ এম বি বি এস) শেষ হয়েছে এই আনন্দে সেদিন আমরা বিরিয়ানি পার্টি করে ফেরার পথে একখানা চুরুট কিনেছিলাম। সবাই টান দেয়ার পর পড়ে ছিলো শুধু পিছনের কাঠের অংশ টা। যথারীতি মজা করার জন্য সেটা মিতুকেই দেওয়া হল। আর মনের আনন্দে সেটাই টানতে লাগলো আর মাঝে মাঝে – “আহ! কি দারুণ” টাইপ শব্দ করতে লাগল। ব্যাপারটায় হাসি চেপে রাখা মুস্কিল হচ্ছিল। শেষে অগা আর থাকতে না পেরে মিতুকে জানিয়ে দিল।

আর যায় কোথায়! “কোনো ভদ্রলোকের ছেলে এরকম মজা করে না“। মিতু কাঠের (চুরুটের) শেষ অংশ টা ছুড়ে ফেলল। ‘ঠক ‘ – হোস্টেলের বারান্দায় চুরুটের আত্মা সদগতি লাভ করল।

সেইদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর কখনো চুরুট খাবো না“। ভদ্রলোকের ছেলের মতো মিতু সদম্ভে ঘোষনা করল।

কে রে! চুরুট ছাড়ার কথা কে যেন বলল শুনলাম“- মূর্তিমান প্রবেশ করলেন।

এই তো মিতু বলল“। দিপু বরাবরের মত চার্নকদার বাধ্য চেলা। “হুম! চুরুট“। এটুকু বলেই তিনি আবার কেমন যেন মিইয়ে যান। আমাদের আশার প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতেও নিভে যায়।

চার্নকদা আপনি কখনো চুরুট খেয়েছেন?” আমি শেষ চেষ্টা করি। “হ্যাঁ ; ওই জীবনে একটিবার।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। যেন আমাদের আশার শেষ শিখাটাকে নেভানোর জন্যই।

মাত্র একবার!” সিটু তাচ্ছিল্য করলো। ব্যস। জ্বলল। একদম দপ করে জ্বলে উঠলো। আমাদের আশার আলো আর সেই সঙ্গে দিপুর নতুন লাইটার। একটা সিগারেট মোক্ষম সময়মত ধরিয়ে চার্নকদার ঠোঁটে যোগান দিতে দিপুর ভুল হয়না। আর তিনিও বলে উঠলেন – “হ্যাঁ। ওই একটাই চুরুট। তবে সেটা যাতা চুরুট নয় হে ছোকরা।” চার্নকদা গুছিয়ে বসেন। আমরাও ততক্ষনে যেযার জায়গায়।

ওই একটি চুরুটের জন্যই পৃথিবীর ইতিহাসটা নতুন করে লেখা হল আর সমগ্রবিশ্ব রক্ষা পেল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে – এগুলো জানলে তাচ্ছিল্য টা করার আগে দশবার ভাবতে হে ছোকরা”।

সিটু মুখটা কাঁচুমাচু করার ভাব দেখায়। ভেতরে ভেতরে আমরা সবাই খুশি। চার্নকদা শুরু করেন।

 

সেবার হিমাচলে এক নতুন সাধুবাবার কাছে আস্তানা গেড়েছি। বাবাজীর নাম নৈশিক বাবা। দিবারাত্র বাবার সেবা করি। আর বাবার বিদ্যা আয়ত্ত করার চেষ্টা করি।

কি বিদ্যা?“- অগা আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনা।

সেটাই তো বলছিলাম। বাবাজীর ধূমপানের নেশা। হরেক কিসিমের জিনিস কে ধূম্র বানিয়ে পান করেন তিনি। তামাক,গাঁজা, হাভানা চুরুট এসব তো তার কাছে নস্যি।হিমালয়ের বিভিন্ন গাছগাছড়া আর ছোট ছোট জীবজন্তু ও তিনি স্মোক করেন। সেটাই তাঁর সাধনা। আমিও বাবার প্রসাদ পাই, আর সারাক্ষণ রিসার্চ চালিয়ে যাই।” দম নেওয়ার জন্য থামলেন তিনি।

এমন সময় ডাক এলো সুদুর ডয়েসল্যান্ড থেকে। ডয়েসল্যান্ড বুঝিস তো?” আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। “জার্মানি। বুঝলি? তোরা তো কিস্যু জানিসনা। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। 1943 সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। হিটলার প্রায় পুরো ইউরোপ দখল করে ফেলেছে। আমেরিকান দেখলেই কচুকাটা করছে। আর ইহূদি পেলেই ভরে দিচ্ছে গ্যাস চেম্বারে। এহেন দুর্ধর্ষ অ্যাডল্ফ হিটলার যিনি ফুয়েরার নামে বেশি বিখ্যাত, হঠাৎ একটা জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য ডেকে পাঠালেন আমাকে। তো আমিও জব চার্নক। কাউকে ডরাইনা। পৌঁছলাম রাইসট্যাগে। গিয়েই শুনলাম তাঁর আজব সমস্যা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই একখানা চুরুট না ধরালে ওনার মাথা পরিস্কার হয়না, আর উনি যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারেননা । দিনের শুরুই হয় সেই স্পেশাল ধূমপান দিয়ে।”

“কদিন হল তাঁর নেশা নাকি জমছেনা। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে ওনার স্পেশাল তামাকের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই বিপত্তি। জার্মানীও হারবে হারবে করছে। ওনার সবথেকে বিশ্বস্ত সেনাপতি গোয়েবল তাই আমাকে তলব দিয়েছেন।”

“আমি গিয়ে ব্যাপার টা বুঝে নিলাম। বললাম কোনো অসুবিধা নেই। এই সমস্যা আমি সমাধান করে দেব। তবে আমার একটা শর্ত আছে। শর্তটা হল আমাকে ফুয়েরারের সংগে চব্বিশ ঘন্টা থাকতে দিতে হবে। আর সেই সময় ওনার সঙ্গে ওনার দেহরক্ষীরাও থাকবেন না। তারা ওনার বাংকারের বাইরে অপেক্ষা করবে।”

আপনি বললেন আর ওরা সেটা মেনে নিলো?” – মিতুর অবিশ্বাসী প্রশ্ন।

এমনিতে কি আর মানে? বললাম তাহলে আমি চললাম আমার দেশ ভারতবর্ষ, তোমরা দেখি কি করে যুদ্ধ জিততে পারো! ব্যস এতেই কাজ হল। হিটলার রাজী হয়ে গেলেন। আমিও নৈশিক বাবাজির কাছে শেখা বিদ্যা সম্বল করে জয়গুরু বলে কাজে লেগে পড়লাম। পরদিন থেকেই আমি হিটলারের সঙ্গী। শেষরাত থেকেই দুখানা চার্নক মেড দিশী চুরুট রেডি। অপেক্ষায় আছি কখন হিটলার জাগবেন। তারপর সকাল হল। তিনি জাগলেন। আমিও একখানা নাৎসি স্যালুট ঠুকে দিলাম সুযোগমত। কোনো কথা না বলে উনি হাত বাড়ালেন। আমিও ওনার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা চুরুট টা এগিয়ে দিলাম।”

কিন্তু আমি যদি চার্নক হই উনিও হিটলার। চালাকিতে তিনিও কম যান না। নিজেরটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন আর আমারটা নিলেন নিজের জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি চুরুট টা নিলাম। তারপর শুরু হল দুজনের যুগলে ধূমপান। সে এক অভিজ্ঞতা। হিটলারের বাংকার ভরে গেল। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগলো গ্যাস চেম্বারে বসে আছি। ধূমপান শেষ হলে খুব প্রসন্ন মুখে তিনি আমার মাথা চাপড়ে দিলেন। বললেন – “আমি জীবনে এত ভালো চুরুট খাইনি। আমি নিশ্চিত এর মধ্যে বিশ্বের বিখ্যাত কিছু জড়িবুটি আছে। তোমরা ইন্ডিয়ানরা জিনিয়াস”।”

“সেই চিরন্তন সত্যি কথাটা ছিলো হিটলারের শেষ কথা – “তোমরা ইন্ডিয়ানরা জিনিয়াস”” -চার্নকদা থামলেন।

“শেষ কথা মানে? তারপরে কি উনি বোবা হয়ে গেলেন?” – অগা জানতে চায়।

বোবা হবে কেন? ওই কথাটা বলার পর উনি বাথরুমে ঢুকলেন আর আত্মহত্যা করলেন“। চার্নকদা ব্যাখ্যা দিলেন।

“মানে!” – সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম। “কেন?”

বাথরুমে আয়নায় চোখ পড়ে গিয়েছিলো যে” – তিনি তখনও নির্লিপ্ত।

“তাতে কি?” দিপুও চুপ থাকতে পারেনা আর।

“আরে ওতেই তো সব। গোঁফ ছাড়া হিটলারের আর কি বা গুরুত্ব আছে বল। গোঁফের শোকেই বেচারা নিজেকে শেষ করে দিল।”

“কেন গোঁফ কী হল? কোথায় গেল?” – সিটু জিজ্ঞেস করল।

তাহলে খুলেই বলি। হিটলারের জন্য স্পেশাল জড়িবুটি দেওয়া চুরুট বানিয়েছিলাম কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের জন্য যেটা বানিয়েছিলাম সেটা হিটলারের ওই স্পেশাল বাটারফ্লাই গোঁফ দিয়ে…আর তিনি চালাকি করে সেটাই টেনেছেন। অতবড় একজন ধুরন্ধর মাথার মানুষ একজন ভারতীয়র কাছে নিজের গোঁফ খোয়ানোর ধাক্কাটা নিতে পারলেননা।” চার্নকদা থামলেন । আমরাও চুপ । শুধু সিটু বরাবরের মত ফোড়ন কাটলো – “কিন্তু আপনি যে সময়ে হিটলার মরেছেন বলে বললেন তখন তো উনি মরেননি । উনি তো মরেছেন 1945 সালে”।

তুই ও ঠিক। শেষ দুবছর এটার পরে ওই জার্মানিতেই থেকে যেতে হল নাত্‍সী বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে” – এই বলে একটা ছ্যাকরা বকরা মাছি গোঁফ আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে চার্নকদা প্রস্থান করলেন।

 

৪র্থ কীর্তি – বাঘনখ ->

 

লেখক পরিচিতি ~ ডঃ স্বদেশ মান্না-র জন্ম 4 April 1986, কলকাতায়। এন আর এস মেডিকাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করে বর্তমানে হলদিয়া পোর্ট হসপিটাল এবং ডায়মন্ড হারবার জেলা হসপিটাল-এ কর্মরত। জীবসেবা-র পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও প্রশংসনীয়! অশেষ ধন্যবাদ স্বদেশ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ লেখা পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গুল্পগুচ্ছ।

 

প্রচ্ছদচিত্র ~ ডঃ স্বদেশ মান্না

One thought on “চার্ণক দার গুল্পগুচ্ছ – ৩য় কীর্তি – চুরুট

Comments are closed.