বীথি
১
সন্তোষপুরের এই বাড়িটা খুব পছন্দ মিথিলেশের। চারপাশ টা বেশ নিঃঝুম, সকাল বিকেল নানা নাম না জানা পাখির ডাক আর তার সাথে সন্ধে গড়ালেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পরিবেশ টা কে মত্ত করে তোলে। শহরের দমবন্ধ গুমোট পরিবেশ থেকে এ যেন একঝলক মুক্ত হাওয়া। মিথিলেশের মায়ের সাধের লাউ ডগা দোতলা বাড়ি টার দেওয়ালের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে নেমে এসেছে নিচ অবধি। বাড়ির সামনের একচিলতে জমিতে তার মায়ের ভীষণ প্রিয় বাগানের রংবেরং এর ফুলের সারিও চোখে লাগার মতো। জনবহুল কলকাতা আর যানবাহনে মোড়া ঘিঞ্জি রাস্তা ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে সবুজ দিয়ে ঢাকা মিথিলেশ দের এই বাড়িটা এক কথায় অনবদ্য।
তার বাবা অর্থসূত্রে ধনী ব্যক্তি হওয়ায় কলকাতায় বাড়ির অভাব নেই ওদের। তবে শহরের কোলাহলের বাইরে এরূপ পরিবেশে মনঃসংযোগ বেশি হয়, তাই প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষার আগে বই খাতা সঙ্গে নিয়ে দু’সপ্তাহ কি একমাস এর জন্য তার ঠিকানা হয়ে ওঠে এই ১১ বি, সন্তোষপুর রোড এর তাদের একমাত্র শহরের বাইরের বাড়িটা। সঙ্গে থাকেন মিথিলেশের মা তমালি রায়চৌধুরী। তবে সবটাই তার বাবার আদেশ এবং এতে তাদের কোনো মতামত জানবার দরকার কোনোদিন তার বাবা কমলেশ্বর বাবুর হয়নি। ক্লাস ৮-এ ফাইনাল পরীক্ষার আগে মিথিলেশ এর প্রথম বার এই বাড়ি তে আসা। ফাঁকা জায়গায় গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা বাড়িটা কে প্রথম বার দেখে জংলি ভেবে নাক কুঁচকোলেও এই দুবছরে মতামত অনেকটা পালটেছে তার। এ বাড়ির একমাত্র চাকর হল দেবুদা, তাদের চলে যাওয়ার পর এই পুরো বাড়ির দায়িত্ব আর তার সাথে মালকিনের সাধের বাগানের যত্নআত্তি করার ভার থাকে তার উপর। পান থেকে চুন খসলেই মালকিনের এক ধমকে পিলে চমকে যায় ওই বুড়ো দেবুদার। তবে এ বাড়ির মালিক ও কিছু কম নন। অসম্ভব গাম্ভীর্য পূর্ণ অহংকারী এক ব্যক্তি। সারাটা জীবন যিনি নিজের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি টাকা দিয়ে কর্তব্য পালন করে এসেছেন।
২
মিথিলেশের এখন ক্লাস ১০। প্রিটেস্ট, টেস্ট পেরিয়ে সামনেই এবার মাধ্যমিক। হাতে আর মেরেকেটে দিন পনেরো। অতএব আবার তার গন্তব্য হয়ে উঠল সন্তোষপুর। যথাসময়মত একদিন বিকেলবেলা কমলেশ্বর বাবুর দামি ফোর্ড গাড়িটা মিথিলেশ ও তমালি দেবী কে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। দেবুদা তাদের দেখতে পেয়েই একগাল হাসি মুখে এগিয়ে এসে মাটিতে রাখা ব্যাগ গুলো নিয়ে তমালি দেবীর সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিল ভিতরের দিকে। মিথিলেশ ও তার পড়ার ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে চলল তাদের পেছন পেছন, তবে একটু ধীর গতিতে, চারপাশের এত সবুজ তার চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। বাড়িতে ঢুকেই সবকিছু জরিপ করতে লেগে গেল সে। দোতলা বাড়ির সদর দরজা ঠেলে ঢুকলে সামনেই বিরাট বড় বৈঠকখানা। ৪টে নরম গদিওয়ালা সোফা সেখানে কোনাকুনি করে রাখা রয়েছে, মাঝে একখানা গোল সেন্টার টেবিল। মাথার উপরে ঝুলছে মস্ত বড় একটা ঝাড়লন্ঠন। একতলায় রয়েছে রান্নাঘর বাথরুম মিলিয়ে মোট ছয়টি ঘর, যার মধ্যে দুটি ঘর বৈঠকখানার ঠিক পিছনেই যা ‘গেস্ট রুম’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যদিও ‘গেস্ট’ এ বাড়িতে কদাচিৎ আসে। ঘর দুটির দুপাশ দিয়ে দুটো সিঁড়ি উঠে গিয়ে দোতলায় মিশেছে। ঠিক সেখানেই ছাদে যাওয়ার দরজা। এছাড়াও দোতলায় রয়েছে আরও তিনটি ঘর, একটি বাথরুম ও একটি বারান্দা । পুরো বাড়িটা এক বার ঘুরে দেখে নিল মিথিলেশ। আগের বার যেমনটি দেখে গেছিল, সবকিছু ঠিক তেমনটি ই রয়েছে। এরজন্য দেবুদা কে মনে মনে তারিফ জানাল সে।
তমালি দেবী হাঁটুর ব্যথার কারণে একতলার একটি ঘর কেই তার নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন। মিথিলেশ দোতলায় তার নিজের ঘরে ঢুকে বই খাতাগুলো বের করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। তার ঘরটা ছাদের ঠিক পাশেই। পড়ার টেবিল এর সামনের জানলাটা খুলে দিতেই একটা নরম আলোয় ভরে গেল ঘরটা । ঘরের সবকটা জানলা খুলে দিয়ে ছাদে গেল সে। প্রায় পড়ন্ত বিকেল, দূরের সূর্য টা মেঘের গর্তে ঢুকে যাছে ধীরে ধীরে, চারিদিকে সোনালি আভার মতো ছড়িয়ে গেছে সূর্যের দুরন্ত রূপ, বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। মিথিলেশ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দূরের কাটা ঘুড়ি টার দিকে, তার মা নিচ থেকে কতক্ষণ ধরে যে তাকে ডেকে যাচ্ছেন তা সে খেয়াল ই করেনি। দেবুদা এসে তার পিঠে হাত রাখতে সম্বিৎ ফিরে পেল সে, দৌড়ে নেমে গেল এক তলায়।
৩
তমালি দেবীর অফিস সেই ডালহৌসি তে।সন্তোষপুর থেকে ডালহৌসি অনেকটা পথ। সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে বেরোন আর ফিরতে ফিরতে সেই রাত ৮টা। অগত্যা সারাটাদিন একাকী কেটে যায় মিথিলেশের। সে নিজের মতো পড়াশোনা করে, বিকেলে বাগানে ঘোরে, খেলে। মাঝে মধ্যে দেবুদা আসে, তার সাথে কথা বলে, মিথিলেশ কে তাদের গ্রামের গল্প শোনায়। সকালের জলখাবার, দুপুরের খাবার সব দেবুদাই পৌঁছে দেয় তার ঘরে।
পরীক্ষা তখন একদম সামনে আর ৩-৪ দিন বাকি, সকাল সকাল উঠে পড়তে বসে যেত সে। এমনি একদিন সকালবেলা দেবু দা এসে তাকে ডেকে দিয়ে চলে যাওয়ার পর টেবিল এর উপর রাখা চা টা হাতে নিয়ে ছাদে উঠল সে। পড়তে বসার আগে কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করা তার অভ্যাস। হঠাৎই কানে ভেসে এল একটা নরম সুর, কেউ যেন কাছেপিঠে কোথাও নিপুণ ভাবে খেলা করছে সুর নিয়ে। প্যাচ প্যাচে গরমের ভোরে এরকম মিষ্টি একটি আওয়াজ ভাল লাগল মিথিলেশের। পরেও অনেকবার গলা টা সকাল বিকেল কানে এসছে তার, মনের মধ্যে আগ্রহের মেঘ পুঞ্জে পুঞ্জে জমা হয়েছে, একবারটি তাকে দেখার জন্য, যার গলায় এরকম সুর রয়েছে।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল, এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ির গেট এর সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মিথিলেশ, তাদের গাড়ি তখনো আ্সেনি। এমন সময় আবার সেই গলা, সেই চেনা পরিচিত আওয়াজ, সেই চেনা সুর। এবার আর নিজেকে আটকাতে পারল না মিথিলেশ, খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পিছনের গাছ গাছালি পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল সে। সামনে টিনের ছাদওয়ালা একটা ছোট্ট বাড়ি, সুর টা এই বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে। পেছন ঘুরে সে দেখল একবার তাদের বাড়ির গেট টা দেখা যাচ্ছে। দেবুদা তিন খানা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার মা তাকে কিছু বলছে। সামনে ঘুরে দরজার কড়া দুটো একবার নাড়ল সে। হঠাৎ সব যেন থেমে গেল। কিন্তু দরজা খুলল না। কিছুক্ষণ পর আবার কড়া নাড়ল সে। এবার খানিকটা জোরে, ভেতর থেকে এবার কারোর গলার স্বর ভেসে এল,
– কে ?
– আমি মিথিলেশ, দরজা টা একটু খুলবে? ইতস্তত হয়ে জানতে চাইল সে।
কিছুক্ষণ পর ঘুনে ধরা দরজা টা বিশ্রী শব্দ করে খুলে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে, রুগ্ন- জীর্ণ চেহারা, মুখ চোখে রূপ এর কোনও ছোঁয়া নেই , চুল গুলো উস্কো খুস্কো। দরজা খুলে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মিথিলেশের দিকে।
– তোমার গানের গলা সত্যি খুব সুন্দর, আমি তোমাদের বাড়ির সামনেই থাকি, থাকি মানে মাঝে মাঝে থাকি আজ চলে যাচ্ছি তাই ভাবলাম, থেমে থেমে কথা গুলো বলল মিথিলেশ।
মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, চোখের পলক পরছে না ওর। প্রতিটা সেকেন্ড আরো অধৈর্য করে তুলছিল মিথিলেশ কে। বার বার সে পেছন ফিরে দেখছিল তাদের গাড়িটা এসেছে নাকি। কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করল সে,
– তোমার নাম টা ?
মেয়েটি উত্তর দিল না। ওদিকে গাড়ির আওয়াজ কানে আসে মিথিলেশের, গাড়ি এসে গেছে , এবার মা তাকে ডাকাডাকি শুরু করবেন, দেবু দা এক এক করে ব্যাগ গুলো তুলে দিচ্ছে গাড়িতে , আর সময় নেই এবার যেতে হবে।
– আজ আসি, আবার আসব ।
এই বলে মিথিলেশ উলটো দিকে হাঁটা লাগাল, এমন সময় পেছন দিয়ে সে বলে উঠল,
– বীথি ।
তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল মিথিলেশ, তারপর দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
ঘুনে ধরা দরজা টা আবার শব্দ করে বন্ধ হয় গেল।
৪
তখন ক্লাশ ১১। ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে, আবার ঠিকানা সন্তোষপুর। এই এক বছরে বীথির কথা প্রায় ভুলেই গেছিল মিথিলেশ। গাড়িটা গলির ভাঁজে বাঁক নিতেই গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে চোখে পড়লো বীথির বাড়িটা, আর সাথে সাথে পুরনো কথা মনে পড়ে গেল তার। পরের দিন মা অফিস বেরিয়ে যেতেই ছুটে গেল সে বীথির কাছে।
ঠক ঠক
– দরজা টা খুলবে?
কিছুক্ষণ পর ওপাশ দিয়ে ভেসে এল,
– কে?.. মিথিলেশ ?
বীথির মুখে নিজের নাম টা শোনামাত্র বিষম খাওয়ার জোগাড় হল মিথিলেশের। যার মুখ ও তার ঠিক ভাবে মনে নেই, সেই মেয়ে এতদিন পরেও তার গলার স্বর ঠিক চিনতে পেরেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে উত্তর দিল,
– তুমি কি করে বুঝলে ?
– আমি বুঝি !
কথার কোনও মানে বুঝতে না পেরে মিথিলেশ প্রশ্ন করল,
– আমি ভেতরে আসতে পারি?
বীথি জন্মান্ধ। তার দুই চোখের দুটো মণি সর্বদা স্থির থাকে। সে যখন তার সেই পলকহীন চোখ দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, বড্ড করুন লাগে তার সেই তাকানো। বীথির মা নেই। তার মা নাকি খুব ভাল গান গাইতে পারতেন। তাই তার মনে হয় এই সুর জ্ঞান যেটা তার জন্মগত সেটা সে তার মা এর কাছ থেকেই পেয়েছে। তার বাবা জরাব্রিজ ছাড়িয়ে একটি জুটমিলে কাজ করেন, সারাদিন বাড়িতে সে একাই থাকে। বীথি নিরক্ষর , শিক্ষার সাথে তার পরিচয় হয়ে ওঠেনি ।
-‘খুব ছোট ছিলাম তখন, বাবা আমায় এই এলাকার ই একটি ফ্রি ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। কিন্তু বেশীদিন সেখানে ঠাঁই হয়নি আমার জানো তো। আমি তো তোমাদের মত নই, আমার মত ছেলে মেয়েদের জন্য আলাদা ইস্কুলের দরকার হয়, সেরম ইস্কুল এই তল্লাটে কোথাও নেই। আর থাকলেও আমরা গরীব মানুষ, আমার বাবার অত টাকা নেই সেরম জায়গায় আমায় পড়ানোর জন্য। তাই আমি সারাজীবনের জন্য মুখ্যু ই রয়ে গেলাম’.. কথাগুলো বলতে বলতে বীথির গলা বুজে আসে।
ধনী পরিবারের ছেলে মিথিলেশ এর আগে কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে শুধুমাত্র কটা টাকার জন্য কেউ পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আজ বীথির কাছে এসে সে বুঝতে পারল যে কিছু কিছু মানুষের জন্য জীবন কতটা রূঢ়, বেঁচে থাকা কতটা কষ্টকর। বীথির জীবন মিথিলেশ কে এক অন্য দুনিয়া চিনতে শেখাল।
৫
এরপর প্রায় রোজ ই নিয়ম করে যায় সে বীথির কাছে, তবে পুরো ব্যাপারটা ই ঘটে তার মা এর চোখের আড়ালে। তমালি দেবী বিন্দুমাত্র আভাস পেলে মিথিলেশের রক্ষে নেই সেটা তার জানা আছে ভালমতো। প্রতিদিনের আড্ডার মধ্যে একটি গান বাঁধাধরা। প্রথম প্রথম মিথিলেশ জোর করলেও পরে অবশ্য বীথি সহজ হয়ে গেছিল তার কাছে। তবে মিথিলেশ সবচেয়ে বেশী বিব্রত হত যখন বীথি তাকে গানের সাথে গলা মেলানোর জন্য আবদার করত। তার সুর তাল জ্ঞান একেবারেই শূণ্য।তাই সে গান ধরার কিছুক্ষণ এর মধ্যেই তাকে থেমে যেতে হত বীথির দমফাটা হাসিতে। মিথিলেশ জানে তার দ্বারা গান হয়না তবু সে গান করত শুধুমাত্র বীথির এই প্রাণখোলা হাসি দেখার জন্য। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ছিল তাদের কাছে সব দুঃখ ভুলে গিয়ে সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা। তাদের সাক্ষাৎ এর বেশীর ভাগ সময় জুড়েই বীথি বলে চলত তার মা এর কথা, গানের কথা, অন্ধ হয়েও কিভাবে তার ঘরের সবকিছু তার নখদর্পণে সেকথা ।
আর মিথিলেশ ! সে শুধু চেয়ে থাকত বীথির খুশী তে ভরা মুখ টার দিকে, তার ঠোঁট দুটোর অবিরাম বিচরণে। বীথি ওর জীবনটা কে উগরে দিয়েছিল মিথিলেশের কাছে যেন বীথির কতদিন এর চেনা সে, আজ একান্তে পেয়ে সব না বলে ছাড়বে না। যারা সব নিয়ে জন্মেছে তারা এইসব কিছু না পাওয়া মানুষ গুলোর প্রতি কতটা উদাসীন, কতটা বিবেকহীন সেটা তারা বোঝেনা আর বীথি কিছু না পেয়েও যেন সব পেয়েছি-র এক জীবন্ত জীবাশ্ম। খুব কষ্ট হয় মিথিলেশের তার জন্য তবে গর্ব ও হয় বীথির মত কাউ কে সে তার বন্ধু হিসেবে পেয়েছে ভেবে । বিথির হাত দুটো নিজের দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে সে, ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে এই চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে বীথি কে নতুন করে পৃথিবী টা চেনাতে, কিন্তু কিছু একটা যেন পিছু হঠতে বাধ্য করে তাকে। সবার আড়ালে তাদের এই সম্পর্ক , একে যেনতেন প্রকারেণ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ই হয়ত তাকে থামিয়ে দেয়।
ভালবাসা, বন্ধন এসব এর কোনটারই সংস্পর্শে আসার সুযোগ কোনদিন হয়নি মিথিলেশের। ছোটবেলা থেকেই তার কাছে তার বাবা ছিলেন অর্থের পরিপূরক আর তার মা ছিলেন খুবই স্ট্রিক্ট। কঠোর হাতে তিনি তার ছেলে কে সামলেছেন, হয়তো ভয় ছিল বেশী বন্ধুর মত মিশতে গেলে ছেলে বিগড়ে যাবে। কিন্তু তিনি বোঝেননি শাসন করতে গেলে ভালবাসা টাও খুব জরুরি। ভালবাসলে তবেই শাসন করার অধিকার টা মেলে। তার এই অপ্রয়োজনীয় কঠোরতাই তাকে তার ছেলের থেকে কয়েক যোজন দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
বীথির দাবিহীন নিঃস্বার্থ সঙ্গ সময়ের সাথে সাথে আগলে ধরেছিল মিথিলেশ কে। মিথিলেশ বরাবরই চুপচাপ, বন্ধু বলতে সেরম কোনদিন ই কেউ ছিল না তার। আজ অবধি কাউকে কাছে আসতে দেয় নি সে, কিন্তু বীথির কাছে সে নিজেই ছুটে এসেছে, জায়গা করে নিয়েছে তার মনে। আর বীথি ও নির্দ্বিধায় আগলে ধরেছে তাকে, মিথিলেশের বুকে চেপে বসা সব পেয়েও কিছু না পাওয়ার দুঃখের বিশাল পাথর টা সরিয়ে দিতে চেয়েছে সে, মিথিলেশের অজান্তেই ভাগ করে নিয়েছে তার সব দুঃখ কষ্ট।
৬
ক্লাস ১২ পাশ করার পর, জয়েন্টে ভালো রয়াঙ্ক করার সুবাদে মিথিলেশ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হল আর সেই সুত্রে এই বাড়িটাই এখন তার পাকাপাকি আস্তানা হয়ে উঠল। তমালি দেবী আর আসেননি। ছেলে বড় হয়েছে আর তার সাথে ফুরিয়েছে কর্তব্য যেটার দায় থেকে মিথিলেশের বাবা অনেকদিন আগেই মুক্ত। এখন শুধু প্রতিমাসের শুরু তে কতগুলো টাকা মিথিলেশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে আসে। যতটা দরকার তার থেকে অনেক টাই বেশি।
মিথিলেশ আর বীথি একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল, দুজনে দুজন কে পূর্ণ করেছিলো আলাদা আলাদা অর্থে। ওরা মন খুলে হাসে, খেলা করে, গান গায়। দুটো নিষ্পাপ মন ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিল ভালোবাসার জালে, পৃথিবী তে আবার জন্ম নিয়েছিল এক নতুন সম্পর্কের কাহিনী। কিন্তু ওই যে মানুষের মন। তা বড়ই অদ্ভূত। মানুষের মন কে মানুষ কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারেনি। সেই মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক চোরা গোপ্তা খেলা, যার এক প্যাঁচে সব কিছু তছনছ হয়ে যায়, পড়ে থাকে শুধুই কটা জীবন্ত লাশ, হারিয়ে যায় বাঁচার সবকটা রাস্তা। সেই খেলা বাধ্য করে মানুষ কে জন্তু তে পরিণত হতে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ভালবাসার সব টান আর বন্ধন।
বৈশাখ মাস। গরমে ধুঁকতে থাকা মানুষ কে কিছুটা স্বস্তি দিতে সেদিন রাত হতে না হতেই নেমে এল বৃষ্টি। রাত তখন প্রায় ১১.৩০টা, বাইরে দাপিয়ে বেড়ানো ঝোড়ো হাওয়ার সাথে মুষলধারে বৃষ্টি নিয়ে আকাশ টা প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড়, বিকট শব্দ করে একের পর এক বাজ পড়ে চলেছে, ২-৪ টে গাছ ভাঙ্গার শব্দও কানে আসছে মাঝে মাঝে ।
মিথিলেশ নিচের ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করছিল, সেই সময়ে হঠাৎ দরজায় ঘন ঘন কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে চমকে গেল সে। কেউ যেন বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা ধাক্কাচ্ছে। তাড়াতাড়ি মিথিলেশ দরজার দিকে এগোল। যেতে যেতে সে শুনতে পেল শব্দ টা আরও জোরে হচ্ছে। দরজা খুলতেই সে দেখল সামনে দেবুদা দাঁড়িয়ে, সারা শরীর রক্তের দাগ।
– ‘ ছোট বাবু !! অন্ধ মেয়ে টার বাড়ির চাল ঝড়ে উড়ে গেছে, চাল এর বাটন টা ভেঙে গিয়ে বাপটার মাথায় পরেছে ঘরের বাইরে বাপ টাকে ধরে কাঁদছে, আপনার গাড়ি টা যদি বের করেন সামনের হাসপাতালে নিয়ে যেতাম, নয়তো এই ঝড় বৃষ্টি তে লোকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।’
কথা টা শোনা মাত্র ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত মিথিলেশের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। দিগ্বিদিক শূণ্য হয়ে সে ছুট দিল গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বের করে আনতে। গাড়ি নিয়ে বীথির বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল বাবার নিথর দেহ টা কোলে নিয়ে বীথি চুপ করে বসে আছে রাস্তায়, তার বাবার মাথার পিছন দিয়ে কতগুলো রক্তের স্রোত এঁকে বেঁকে গিয়ে মিশছে রাস্তার জমা জলে। বিথি তবু কাঁদছে না, পা দুটো অসহায় শিশুর মত সামনের দিকে ছড়িয়ে বসে আছে, ডান পা এর ঊরু র উপর ওর বাবার মাথা টা রাখা। বীথির চুলগুলো তার মুখের সামনে ঝুলে পড়ে যেন তার জমা দুঃখ কে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এতকিছুর পরেও আশেপাশে কারোর দেখা নেই, এ তল্লাটে শুধু কতগুলো মানুষ থাকে বটে কিন্তু তাদের যে প্রাণ নেই, বেঁচে থেকেও যে তারা মৃত সেটা আজ বোঝা গেল।
“ তোরা মানুষ বলিস নিজেকে, কখনো প্রমান দিয়েছিস ?
কাজের সময় আখের গুটিয়ে, বাদ বাকি সময় মুখ ঢাকিস
যত দায়িত্ব, দুঃখ, যন্ত্রণা সবই ওই মানুষ গুলোর, তোরা তো আসলে মেকি
তোরা মানুষ বলিস নিজেকে, কখনো প্রমান দিয়েছিস ? ”
মিথিলেশ কাছে যেতেই তাকে আঁকড়ে ধরল বীথি। লতানো গাছ যেমন বেড়ে ওঠে কিছু শক্ত জিনিস কে ভর করে তেমনি বীথি ও চেয়েছিল মিথিলেশ কে ভর করে বাঁচতে কারণ মিথিলেশ ই হয়ে উঠেছিল তখন তার একমাত্র অবলম্বন।
রাত তখন ৩ টে। বীথিকে একতলার ঘরে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে মিথিলেশ দেখে চিলেকোঠার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে সে, সামনে একটা বাজ পরা মড়া তাল গাছ এর দিকে শূণ্যদৃষ্টে তাকিয়ে। মিথিলেশের পায়ের আওয়াজ পেয়ে বীথি বলে উঠলো,
– আমরা তখন গঙ্গাপুরে থাকি, কাকা রা জেঠু রা মিলে খুব বড় পরিবার ছিল আমাদের। প্রতিদিন সকাল বেলা বাবা আমায় সাইকেল এর সামনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেত আর ছুটির পর মা যেত আনতে। কিন্তু সেদিন ছুটির পর মা এল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম ইস্কুলের গেট এর বাইরে। শেষে কাকা এসেছিল নিতে। বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলাম বাড়ি ভর্তি অনেক লোক, পাড়া প্রতিবেশী সবাই যেন ভিড় করে এসেছে, চারিদিকে শুধু কান্নার রোল । মা ছিল সবার মাঝে একটা সাদা খাটে একতোড়া ফুলের মাঝে শুয়ে। বাবা আমায় দেখতে পেয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে গেছিল মা এর কাছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না এত হাহাকার এত কান্নাকাটির মধ্যেও মা কিভাবে চুপচাপ নিশ্চিন্তে চোখ বুজে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরে মাথা টা মা এর বুকে গুঁজে দিয়েছিলাম। জানো তো সব মায়ের ই তাদের নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে। আমার মায়ের ও ছিল। কীরম যেন মনে হত কোন জংলি ফুলের গন্ধ। অদ্ভুত এক আবেশে মন ভরে থাকত। মা চলে গেল, কিন্তু মায়ের সেই গন্ধ টা আমি চোখ বুজলেই আজ ও পাই। কাকাদের মনে কি ছিল আমরা বুঝিনি, বাবা কে ঠকিয়ে জমিজমা সম্পত্তি সব নিজেদের নামে করে নিল আর নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পথে নেমে আসতে হল আমাদের। যে মানুষ টার হাত ধরে ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম, আজ প্রায় ১০ বছর ধরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব বলতে শুধু যে একজন মানুষটা কে চিনতাম আজ সে ও ছেড়ে চলে গেল আমায়। এতবড় পৃথিবী তে বড় একলা করে দিয়ে গেল আমায়।
আর পারল না বীথি চোখের জল ধরে রাখতে, দু চোখ বেয়ে তার অঝোরে নেমে এল নোনতা জলের স্রোত। তাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়ে দু হাত দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিল মিথিলেশ। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিল বীথি। তার কান্নার দমক সামলাতে আগুপিছু না ভেবে মিথিলেশের ঠোঁট নেমে এল বীথির ঠোঁটে । তার বুকে জমে থাকা সমস্ত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ওষ্ঠ দিয়ে পান করল মিথিলেশ। বীথি যেন আজ থেকে সম্পূর্ণ রুপে হয়ে উঠল তার জীবনের অংশীদার। পরম বিশ্বাস ও ভালবাসায় মাথা রাখল বীথি মিথিলেশের বুকে।
৭
সম্পর্ক টার কি নাম দেওয়া উচিত বুঝতে পারেনি মিথিলেশ। এতগুলো দিন পর এখন সম্পর্ক টার কথা ভাবলে খুব কষ্ট হয় তার। জীবনে চলার পথে একজন অন্ধ মেয়ে কে তার পাশে পেতে চায়নি সে। সব হারানো, নিঃস্ব, এতবড় পৃথিবী তে সম্পূর্ণ একা একজন গরীব অন্ধ মেয়ের দায়িত্ব নিতে অপারগ ছিল সে। আজ বোঝে যে তার এই পিছিয়ে আসা ছিল একধরনের কাপুরুষতা। বীথির সবকিছু জেনেই মিথিলেশ তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল, তবে এই পিছিয়ে আসা কেন? এই কাপুরুষতা কেন?- মিথিলেশের মন তাকে বারংবার প্রশ্ন টা করলেও নিজের কাছে নিজেই কোন জবাব খুঁজে পায়না সে।
অনেক চেষ্টা করেও বাবা মা এর কাছে নিজের মনের কথা টা বলতে পারেনি মিথিলেশ। সমাজের দোহাই, বাস্তবতার দোহাই, তাদের শ্রেণীগত বৈষম্যের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে এসেছিল প্রতিবার।
ভিতু ছিল সে, কাপুরুষ, মাথার সাথে মনের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়ে উঠেছিল তার। আর কারোর কথা না ভেবে শেষে স্বার্থপরের মত পালিয়ে গেছিল সে বিদেশে। মনে মনে জানত অন্ধ গরীব মেয়ের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তার চরিত্রে, মানসিকতায় ফুটে উঠেছিল অহংকারি বেইমান এর ছাপ, এই প্রথম তার নিজেকে মনে হয়েছিল পুরো ‘বাপ কা বেটা’ ।
৮
এখন বয়স বেশি নয় তার, সবে ৩০। ২২-এ বিদেশ পাড়ি তারপর দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ড্রাগ আসক্তি। মা বাবা জানতে পারায় কোনওরকমে প্রানে বেঁচে তাদের সাথে দেশে ফিরেছে মিথিলেশ। তবে পাপ পেছন ছাড়েনি তার, লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এখন সে প্রায় মৃত্যুশয্যায়। আর বেশি দিন নেই বলে দিয়েছে ডাক্তার, লাস্ট স্টেজ। তার দেশ ছাড়ার কিছুদিন পর বীথি নিখোঁজ হয়ে যায়। মিথিলেশের বিদেশ থেকে পাঠানো ১ লক্ষ টাকার চেক বীথি কে পৌঁছে দিতে গেছিলো দেবুদা কিন্তু তার দেখা পায়নি, দরজায় ঝুলতে দেখেছিল বড় একটা তালা। অনেক চেষ্টা তেও আর খোঁজ পাওয়া যায়নি বীথির। তারপর থেকে শুধু নষ্ট হয়েছে সময় আর বদলে গেছে দুটো জীবন।
বিকেল তখন ৪টে, মিথিলেশ জানে এই সময় তার মা নিজের ঘরে একটু শুয়ে থাকেন। তার ওপর নজরদারি টা কম থাকবে ভেবে সে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলল। এলগিন রোড এর বাড়িটা থেকে হাল্কা নীল রঙের BMW টা বেরিয়ে আসতে মিথিলেশ সামনের সিটে উঠে বসে সিট বেল্ট টা বাঁধল। চোখের তলায় বিস্তর কালি পড়ে চোখ দুটো প্রায় ঢেকে গেছে তার।
সন্তোষপুরের বাড়িটার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতে মিথিলেশ দেখল চারপাশ টা আর ফাঁকা নেই আগের মত, ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢেকে গেছে। সেই অপার্থিব শান্তি টা উধাও। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল মিথিলেশ। বাড়িটা একইরকম আছে, শুধু সামনের বাগান টা আর নেই, সব ফুলের গাছ নষ্ট হয়ে গিয়ে এখন জায়গা টা ঝোপঝাড় আর আগাছায় ভর্তি। কেউ থাকে না এখন এবাড়িতে আর, দেবুদা অনেকদিন আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেছে। চারিদিকে ভীষণ কোলাহল, অটো- রিকশা- ভ্যানে গিজ গিজ করছে রাস্তা, মাথা টা ঝিম ঝিম করছে তার। গাড়ি থেকে নামার সময়ই মাথা টা অল্প ঘুরে গেছিল, ড্রাইভার দা সামলেছে তাকে। এলগিন রোড থেকে সন্তোষপুর মোটে এইটুকু রাস্তা কিন্তু আসতে অনেকটা সময় লেগে গেল। যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে কলকাতায় আর তাছাড়া জ্যাম তো সর্বত্র লেগেই আছে। বাগান পেরিয়ে সদর দরজা অবধি আসতেই হাঁপিয়ে উঠেছে মিথিলেশ। আর শরীর দিচ্ছে না। ড্রাইভার দা আসতে চেয়েছিল তার সাথে, বাধা দিয়েছে মিথিলেশ। এ পাপ, এ যন্ত্রণা তার একার, একাই সেটা বয়ে নিয়ে যেতে চায় সে। বাড়ির পেছনের রাস্তাটা দিয়ে গিয়ে মিথিলেশ দেখল বীথির বাড়িটা আর নেই, ভেঙে বড় একটা ফ্ল্যাট হয়েছে সেখানে। একটা খারাপ লাগায় ছেয়ে গেল মিথিলেশের মন। কষ্ট এক অব্যক্ত কষ্ট তার গলা টা আঁকড়ে ধরছে। দুটো টলমল পা দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল সে। মাথার উপরের ঝাড়লন্ঠন টা মাকড়সার জালে ঢেকে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল সে, চাপ চাপ ধুলো জমে আছে সিঁড়ির হাতলে। দোতলায় তার নিজের ঘরে ঢুকল মিথিলেশ। ঘর টা একইরকম ভাবে সাজানো রয়েছে, ঠিক যেমনটা বিদেশ যাওয়ার আগে সে দেখে গেছিল। দেখাশোনার অভাবে, অযত্নে শুধু একটু অপরিষ্কার। ঘরের জানলা টা খুলে দিয়ে খাটের এক কোনায় বসল সে। সাইড টেবিলে তার গল্পের বই গুলো সুন্দর করে সাজানো। একটা বই হাতে তুলে নিয়ে নিজের অজান্তে পাতা উলটোচ্ছিল মিথিলেশ, হঠাৎ দুটো পাতার ভাঁজে সে খুঁজে পেল বীথি কে। হাসছে বীথি তার দিকে তাকিয়ে। তাদের আলাপের পর বীথির প্রথম জন্মদিনে এই ছবিটা তুলেছিল মিথিলেশ। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল তার, বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে নিঃশব্দ আর্তনাদ। ঘামছে মিথিলেশ, চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। খাট থেকে নেমে ডাকতে যাচ্ছিল ড্রাইভার দা কে, কিন্তু বেসামাল পা দুটো দিয়ে কিছুটা এগোতেই পুরো শরীর টা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। কিছুক্ষণ এর জন্য শরীর টা যেন অসাড় হয়ে গেল তার। একটু পর বাঁ হাতটা চোখের সামনে এনে মুঠো খুলল মিথিলেশ, বীথি এখনো হাসছে। চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এল তার।
ছোট্টবেলা থেকেই বড্ড ভিতু ছিল ছেলেটা, আর সেই বদভ্যাস টা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো ঘিরে ধরেছিল তাকে। বাবা-মা, সমাজ সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু পারেনি। জীবনে যেকোনও সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই লোকলজ্জার ভয় থামিয়ে দিয়েছে তাকে। মাথা কুটে মরেছে সে তবু নিজের ইচ্ছা টার হাজার চেষ্টা করেও মর্যাদা দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত জিতে গেছে তার ভয়, লজ্জা, কাপুরুষতা । মিথিলেশ ভালবেসেছিল কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার সময় পিঠ লুকিয়েছে, সাহস দেখিয়েছিল কিন্তু সাহস প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ কমে আসছে তার, ঘাড় ঘোরালো মিথিলেশ। ICU এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তমালি দেবি আর কমলেশ্বর বাবু, চোখে মুখে আতংকের ছাপ। মনে হল বীথিও যেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে। কাঁদছে বীথি, কিন্তু ওর তো কাঁদার কথা নয়, শয়তান টা তো শাস্তি পাছে আজ…
Author ~ Subhra Raha. Born on 27th April, 1992, at Kolkata, West Bengal. A B-Tech Graduate from St. Thomas College of Engineering & Technology, Kolkata, currently working at Cognizant as a Programmer Analyst. Besides reading and writing stories and poems, Subhra also loves to play Cricket. Cooking and Travelling are also there among his hobbies. Connect him at – [email protected] or follow him @subhra.raha.35
প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ indiatimes.com
প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds
11 comments
Thank you everyone 🙂
Beautiful love story and the message which you have tried to draw that is really admirable………..will wait eagerly for your next story.
ভাল লাগলো । পরেরটার অপেক্ষায় রইলাম ।
baah…..bhalo lekha!!…….onektai vivid descriptions……..well thought story line as well 🙂 !
bhison bhalo laglo pore!!!
Darun laglo pore…..evabei aro likhe ja
awesome bro….darun writing….carry on…
Thank you everyone 🙂
Khub bhalo likhechish @Subhra 🙂
Too good Subhra… Lekha r style ta khub Bhalo. Ei rom ato onek golpo likhte theko…
Bah…ekta flawless golpo saptamir din suru korar agey….
Comments are closed.