আবর্ত

Anirban & Arijit, Childhood, Red, Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

আজ শনিবার, টুনাইরা আসছে, টুনাইয়ের মা আজকে খুব ব্যস্ত তাই, বাজার থেকে ইলিশ আর পুঁইশাক নিয়ে এসেছেন, পুঁইডাটা দিয়ে ইলিশ খেতে টুনাই খুব ভালবাসে, সামনের একটা সপ্তাহ ফাঁকা দু কামরার ফ্ল্যাটটা মা মেয়ে আর নাতির ওমে উষ্ণ হয়ে থাকবে।

দুপুরে খাওয়ার পরে মা আর মেয়েতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে গল্প করছিল,

– “টুনাই”

– “বল”

– “বলছি বিয়ে কি আর সত্যি করবি না?”

– “বিয়ের কথা আবার কেন মা, আমি তো সুহানকে নিয়ে ভাল আছি, চাকরিটাও করছি, এই কোলকাতার অফিসের কাজটা এক সপ্তাহের মধ্যে গুটিয়ে ফিরতে হবে”।

“হ্যা জানি, সেই কাজ পরল বলেই তো দেখার করার কথা মনে হল।” অভিমানটা মায়ের গলায় স্পষ্ট।

“ও মা রাগ করছ কেন? তোমার জন্য একটা গিফট আছে! দাঁড়াও আনছি।” বলে টুনাই দৌড়ে শোয়ার ঘরে গেল, ফিরে এল একটা ছোট বাক্স হাতে।

– “খোল দেখি এটা।”

– “কি আনলি আবার?”

– “আরে খুলেই দেখ না”

বাক্স খুলতে বেরল একটা মোবাইল ফোন, স্পর্শে সাড়া দেয়, কয়েকটা ঘন্টা গেল মা কে শেখানোর কাজে, কি করে লক খুলতে হয়, কি ভাবে টাইপ করতে হয়, কেন এতে কোন বোতাম নেই, কি ভাবে হোয়াটস্যাপে কল করতে হয়, কিভাবে ফেসবুকে ছবি লাইক করতে হয়, আরো কত কি, মাঝে মাঝে টুনাই নিজেই ভাবছিল যে কি আক্কেলে মাকে মোবাইলটা কিনে দেওয়ার কথা ভাবল।

তবে মায়ের নিজের যেটা সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে সেটা হল ভয়েস রেকর্ডিং ।

– “এই লাল ডট টা টিপলেই রেকর্ডিং শুরু হবে, তারপরে যা খুশি বল, বলা শেষ হলে আবার লাল ডট টা টিপো, তালেই সেভ হয়ে যাবে ওটা।”

– “বাহ! এতো বেশ মজার জিনিস! গান গেয়ে রেকর্ড করতে পারব?”

– “পারবে মা, এখনি কর না।”

বেশ কয়েকটা গান গেয়ে মা থামলেন, চোখ মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত।

“টুনাই তোর মনে আছে, তুই যখন সুহানের বয়সী ছিলি তোর বাবা একটা টেপ রেকর্ডার কিনে এনেছিল, তাতেও এমন লাল বোতাম টিপে রেকর্ড করা যেত, তুই আর আমি মিলে একটা গান রেকর্ড করেছিলাম, যেই বাড়িতে আসত তুই তাকেই ডেকে ডেকে গানটা শোনাতিস।”

এক মুহূর্তের জন্য টুনাই ফিরে গেল সেই সময়টায়, একটা ফ্রক পরে ও মায়ের সাথে গাইছে-

“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি…”

কিন্তু আনন্দটা কয়েক পলের বেশি স্থায়ী হল না, সুহান এখন সেই ছোট্ট টুনাইয়েরই বয়সী, কিন্তু ছেলেটা এখনো সেরকম ভাবে কথা বলল না, শুধু মা, খিদে, জল, এরকম ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দ ছাড়া আর কিছু বলে না ও, সারাদিন নিজের মতই থাকে বেবিসিটারের কাছে, বিকেলে মা ফিরলে একগাল হেসে দৌড়ে এসে কোলে উঠে পরে, ব্যস ওইটুকুই, কথা এখনো সড়গড় নয়, মাঝেমাঝে এমনটা শুনতে ওকে।

বাকি কয়েকটা দিন হুস করে কেটে গেল, রোজই টুনাইয়ের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত, ঘরে ঢুকে দেখত ছেলে দিদিমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।

মুম্বই ফেরত যাওয়ার দিনটায় মায়ের মুখটা ছোট হয়ে এসেছিল, সারাদিন কাজ ফেলে নাতিকে নিয়ে বসে রইল।

ফ্লাইটটা ১ ঘন্টা লেট ছিল, তার ওপর আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি , বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা বাজল, ছেলে কে জলদি খাইয়ে ঘুম পাড়াতে নিয়ে এল টুনাই, তখনি হোয়াটস্যাপে মেসেজটা এল। মা পাঠিয়েছে, একটা অডিও, তার তলায় লেখা-

“তোর জন্য আমার গিফট।”

আবার কোন গান রেকর্ড করেছে নিশ্চয়,

আঙুলের আলতো চাপে চলতে শুরু করল গানটা-

“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদিল গেছে টুটি…”

মা গাইছে।

পরের লাইনটাও একই, কিন্তু এই গলাটা কার? ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ , মায়ের সাথেই গাইছে।

“আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি…”

এবারে স্বরটা এল টুনাইয়ের পাশ থেকে,

সুহান গাইছে,

গলা মেলাচ্ছে দিদিমার সাথে।

মিলে যাচ্ছে সুর, তাল , কন্ঠ, স্মৃতি ।

টুনাইয়ের চোখের কোলটা ভারী হয়ে এল।

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ pinterest.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

3 comments

Comments are closed.