পিছুটান

Dad & Daughter, Friends, Love Story, Marriage, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, Story, বাংলা

” তোমার সাথে আর এক মুহূর্তও নয়…. এখনি আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি.. রইল তোমার সংসার…. তিন্নি চলে আয়! “….. তনয়ার সেই দিনের বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো আজও যেন বুকের মধ্যে বাজে সুদীপের! মায়ের হাত ধরে এক প্রকার বাধ্য হয়েই চলে যেতে হয়েছিল তিন্নি কে…যাওয়ার আগে ওর জলে ভরা চোখ দুটো একবার বলতে চেয়েছিল ‘ বাবা তুমি যাবেনা আমাদের সংগে!’.. একবার হয়ত বাবা বলে ডাকতে চেয়েছিল…
আজ প্রায় ১৩ বছর হতে চলেছে… ওরা নেই…মেয়েটার কি এর মধ্যে একবারও মনে পড়েনি ওর বাবার কথা! ভাবতে ভাবতে কখন যে তালতলা এসে গেছে খেয়াল ই করে নি সুদীপ| ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পরে ও… ‘এই গলিটাই তো মনে হচ্ছে’… বেলে হাত রাখতেই সেটা কর্কশ শব্দে চমকে দিল সুদীপকে|

  পুরোনো বাড়ি রিমডেল করা…. দেখলেই বোঝা যায় এক্কালে সরিখালি বাড়ি ছিল| কোলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো আজকাল এরমই নতুন সাজে সাজছে….এতে পুরোনো রূপটা হয়ত পাল্টাচ্ছে… কিন্তু স্মৃতিগুলো তো একই রূপে পুরো বাড়িতে জড়িয়ে আছে!

  “বসুন…দাদাবাবু আসতেসেন|”
বাড়ির বাইরেটা যতই ঝাঁ চকচকে হোক না কেন.. ভেতরটা সেই ৬০স  মডেল। তবে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন.. পরিপাটি করে সাজানো| সব থেকে নজর কাড়ে মাঝখানে রাখা সেন্টার টেবিল টা… এত সুন্দর কারুকার্য করা টেবিল এর আগে কখনও দেখেনি সুদীপ| আর তার চেয়েও সুন্দর একটা টেবিল ক্লথ… যেই বানিয়ে থাকুন না কেন তার হাতের কাজের প্রশংসা করতেই হয়|
ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা জানান দিল যে ১১ টা বাজে; সুদীপেরও খেয়াল হল … বেশ খানিক্ষণ হল ও ওয়েট করছে… তবে অরিন্দম বাবুর শুষ্ক কাশির শব্দেই  অপেক্ষার অবসান হল|
ভদ্র লোকের পাংচুয়ালিটিতো সাংঘাতিক! ১১ টা তো ১১ টাই… ভাগ্যিস ট্যাক্সি তে এসেছিল…
“আজ্ঞে , আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম…আমার নাম সুদীপ আচার্য”
-” হুম্… তা কি মনে করে?”
-“মানে!”
-“কি মনে করে চলে এলেন ?”
… কি অসম্ভব রুড রে বাবা…
-” আজ্ঞে… না মানে…আপনি খুব বড় মাপের ক্রিটিক …যদি একবার আমার লেখাতে চোখ বোলাতেন…. একবার যদি… “

-” কি ভাবেন বলুন তো মশাই …না মানে আপনারা এই যে সব নিজেদের লেখক বলে ভাবেন… কোনদিন এই আমাদের মতন ডিরেক্টার এর অ্যাঙ্গেল থেকে দেখেছেন… যে যেটা লিখলেন…সেটা আদৌ দর্শক নেবে কিনা… আদৌ মার্কেট খাবে কিনা!…না আমি মানছি…মানছি যে…বই পড়ে মনের সুখ নিশ্চই হবে…কিন্তু দেখে কি সুখ হবে ???…. হবে না ….হবে না মশায়. ..হবে না…. আর চোখের সুখ না হলে…বইও চলবেনা… আইটেম লাগবে বুঝলেন… আইটেম … শরীর গরম করা সিন লাগবে… এসব সাদা মাটা প্যাচপ্যাচে গল্প দিয়ে ইন্ডাস্ট্রী তে কিসসু করতে পারবেন না…তাই বলছি… বাড়ি যান বাড়ি গিয়ে এক দুই পেগ খান… তারপর লিখতে বসুন… দেখবেন গল্প চলছেনা… দৌড়চ্ছে!” কিরম একটা বিশ্রি নোংরা হাসি হাসতে লাগলো লোকটা|

এতদিন শুধু লেখার টানে লিখেছে সুদীপ… কিন্তু চাকরি টা চলে যাওয়ার পর থেকে পেটের টানে লিখতে হচ্ছে… দু একটা পাবলিসার্স থেকে রেস্পন্স ও পেয়েছে… ‘বাহ্…বেশ ভালই লেখেন !’….এইটুকুই| এর পরে আর তারা কোন যোগাযোগ করেননি| তাছাড়া লেখার খরচও তো আছে…তাই… অফিসের বন্ধু বিনায়ক রায় এর দেওয়া ফোন নম্বরে শেষমেস ডায়াল করেই ফেলে সুদীপ…কিন্তু এইরকম ব্যবহার একেবারেই প্রত্যাশিত ছিলনা! কথা না বাড়িয়ে উঠে পরে সুদীপ; কথায় বলেনা… মর্নিং শোজ দা ডে…ওই বিকট বেলটাই জানিয়েছিল কিরকম ওয়েলকাম হতে চলেছে ওর!

মুডটাই খারাপ হয়ে গেল সুদীপের! বাসেই ফিরবে ঠিক করল.. হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে তনয়ার কথা খুব মনে পরছিল… মেয়েটা খারাপ ছিল না… একটা সময়ে ওকে লেখাতেও খুব উৎসাহ দিত… তনয়াও খুব বলত বই লিখে কিছু হবেনা… নিজেকে ছড়িয়ে দাও… সিনেমা ইন্ডাস্ট্রী তে চেষ্টা কর… সুদীপ কখনও ইন্টারেস্ট দেখায়নি… ওর মনে হত…এসব ওর দ্বারা হবে না…কিন্তু তনয়ার খুব উৎসাহ ছিল.. আজ তনয়ার সেই বড়ো বড়ো চোখ দুটো খুব মনে পরছে সুদীপের… সেই সাপোর্টটা খুব মিস করছে … মেয়েটার অনেক গুণ ছিল… খুব ভাল গান গাইতে পারতো… আর ওর হাতের কাজও খুব সুন্দর ছিল… সুদীপকে দুটো সোয়েটার বুনে দিয়েছিল…. আজ ও দেখলে বন্ধুরা প্রশংসা করে… অর্থে না হোক…. ঐশ্বর্যে ওদের অভাবের সংসার ফুলে ফেঁপে উঠেছিল; কিন্তু ধরে রাখতে পারল না….. সুদীপ… তনয়ার উচ্চাকাক্ষা নাকি সুদীপের ওর প্রতি উদাসীনতা…কোনটা যে অনুঘটকের কাজ করল… এখন আর নতুন করে ভাবতে চায়না! আর ভেবেই বা কি হবে….তিন্নি কে তো আর কাছে পাবে না! তিন্নি এখন সেই ছোট্ট ৪ বছরের শিশুটি নেই… আজ সে তরুণী.. দীর্ঘ শ্বাস পরে সুদীপের… নিজ সন্তান কে কাছ থেকে বড় হয়ে উঠতে দেখাটাও ভাগ্যের ব্যাপার! সেদিন ও একটু বেশীই রুড হয়ে গিয়েছিল তনয়ার প্রতি…কিন্তু তার মানে এই নয় যে ও সত্যি সত্যি ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল… দীর্ঘ ৯ বছরে তনয়া কি এতটুকুও  চেনেনি ওকে! নাকি সহ্য করতে করতে সীমারেখাটা পার হয়ে গেছিল…সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় সুদীপ|

ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে… সূর্য যেন পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে … ছাতাটাও আনা হয়নি.. তনয়া বেরোবার আগে ঠিক মনে করিয়ে দিত… এখন একবার বেরিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে এসে ছাতা নিয়ে বেরনোর অভ্যেস হয়ে গেছে| কিন্তু আজ  পসিবেল ছিলনা…দেরী হয়ে যেত তাহলে|

  অনেকগুলো বাস ছেড়ে দিয়েও কোন লাভ হল না… শেষ পর্যন্ত একটা ভীড় বাসেই গাদাগাদি করে নিজেকে ম্যানেজ করতে হল সুদীপকে| এত বেলায় এত লোক কোথায় চলেছে কে জানে! হঠাৎ একটা ভীষণ ঝাঁকুনি….. চোখের চশমাটা কোথায় যে ছিটকে পরল কে জানে…. কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ভারী জিনিষ কপালে লেগে  গলগল করে রক্ত পরতে লাগল  সুদীপের;…

-” কাকু আপনার চশমাটা…আরে আপনার তো লেগেছে!”..
একটি ছিপছিপে গরনের সুন্দরী তরুণী| কোনরকমে চশমাটা পরে…উঠে দাঁড়াল সুদীপ… রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বাঁ চোখটা….তাই মুখটা ভাল করে দেখতে পায়নি ও…কিন্তু মেয়েটার চোখদুটো হুবহু তনয়ার মতন লাগল… কি জানি হয়ত আজ তনয়ার কথা বেশী ভাবছিল বলেই হয়ত…

–” রুপ্সা…. নেমে আয়….এই বাস আর যাবেনা…টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছে..”
বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে তড়িঘড়ি নেমে গেল মেয়েটি|
রুমাল দিয়ে রক্ত মুছে… আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগিয়ে যায় সুদীপ….

তিন্নিকেও হয়ত এরমই দেখতে!!

ঘটনার দু মাস পর অরিন্দম বাবুর একটা কল আসে…. বাড়ীতে ডেকেও পাঠান … কিন্তু ওনার হয়ে সিনেমার গল্প লেখার কাজটা নিতে পারেনি সুদীপ…. কারণ সেদিন  বাড়ির কাজের লোক নয়… বাড়ির মালকিন দরজা খুলেছিলেন…. ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা তনয়াকে দেখে… আর একটু দূরে দাঁড়ানো সেই মেয়েটিকে দেখে…নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সুদীপ… হৃদপিণ্ডটা অসম্ভব লাফাতে শুরু করেছিল… ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল…তনয়ার মতন! বুক ফাটলেও মুখ ফোটেনি সুদীপের সেদিন…. অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিল…’তিন্নি!’

তনয়াকে এতদিন পর সামনে দেখে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরতে ছেয়েছিল মন…. কিন্তু মস্তিষ্ক সায় দেয়নি….
-” ও তিন্নি নয়; রুপ্সা!”
-” তনয়া…”
-” তনয়া নয় মন্দিরা!”
…. কিছু বুঝে ওঠার আগেই অরিন্দম বাবুর অনুপ্রবেশ ঘটে যায়।
-” আরে আপনি এসে গেছেন…বাইরে কেন ভেতরে আসুন…. মন্দিরা ওনাকে অ্যাডভানসের টাকাটা দাও…”
… এসব অবশ্য সুদীপের কানে যাচ্ছিল না…একদৃষ্টিতে ও তিন্নিকে দেখে যাচ্ছিল.. তিন্নিও সুদীপকে চিনতে পেরেছিল…তবে বাবা হিসেবে নয়…নেহাতই বাসের কাকু হিসেবে! তাই ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা চেনা লাগেনি সুদীপের!
-“…আপনার এডভ্যান্সটা”
খামটা হাতে কোনরকমে ধরিয়ে দিয়েই মেয়েকে নিয়ে পর্দার আড়ালে মিলিয়ে গেল তনয়া|
খামের পিছনে তনয়ার হাতের লেখা….এ লেখা বহুদিনের পরিচিত সুদীপের…

‘..— এখন আর চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙে না…
এখন আর চাঁদ হাসে না ।’
আকাশে তখন মস্ত বড় চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে|

   “…চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে….”— গানটা একসময় বড়ই প্রিয় ছিল তনয়ার।

টাকাটা নিতে পারেনি সুদীপ….

তনয়া খামে এইরকম একটা কথা লিখল কেন?…ও কি বোঝাতে চাইল… ও কি তবে…..  রুপ্সাই কি ওদের তিন্নি?.. ওদের আবার কেন দেখা হল ?….কিসের টানে?…..কেন…কেন…কেন… কিসের একটা টান অনুভব করছে ও…একি তবে পিছুটান?….
একরাশ প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সুদীপ সেদিন।

লেখিকা পরিচিতি ~ উদিতি মজুমদার

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ Motionelements.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds