খারাপ ছবির অ্যালবাম

Anirban & Arijit, Love Story, Nostalgia, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

অমিয়র দিনকাল একদম ভাল যাচ্ছে না।সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হয় কি করব আজকে,সত্যিই করার মতো কোন কাজ নেই, অনেকদিনই নেই, আজ প্রায় কয়েক বছর হল নেই। কাজ যে এক সময় ছিল না তা কিন্তু নয়, ঢের কাজ ছিল। বাবার ছিল ফোটগ্রাফির দোকান, সেটাই বড় করে নিয়েছিল অমিয়, মিনোল্টার ক্যামেরাটা তে নিজের প্রান ঢেলে দিয়েছিল।বাড়িরই চিলেকোটার ঘরটা দেওয়ালময় কালি মেখে হয়ে গেছিল ডার্করুম।বিয়েবাড়ি, মুখেভাত,বিবাহবার্ষিকী এসবের ছবি তোলার অর্ডার লেগেই থাকত, অর্থ উপার্জন মন্দ হত না, ছেলে বউকে নিয়ে সংসারটাও এগিয়ে চলেছিল তরতর করে।

কিন্ত সব গোলমাল হয়ে গেল বছর পাঁচেক আগে। বাবাইটা হটাৎ ক্যান্সারে পড়ল। মধ্যবিত্তের ঘরে এসব রোগবালাই ঢুকলে সুখ, সমৃদ্ধি পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়, একথা আগে শুনেছিল অমিয়, তবে এবারে হাড়ে হাড়ে টের পেল। অনেক চেষ্টা করে ছিল ও আর সঞ্চারী মিলে, কিন্তুপারল আর কই? প্রথমে জমানো টাকাগুলো ফুড়ুৎ করে হাওয়া হয়ে গেল। তারপর গয়নাগাটি,দেশের বাড়ির জমি ইত্যাদি ইত্যাদি আর যা যা যায় আরকি, শেষে বাবাইটাও ফাঁকি দিল।

মাস চারেক ঘরে গুম হয়ে বসে থাকার পরে আবার কাজ শুরু করে অমিয়, তবে আর মন বসত না। আরও কয়েক বছর পরে কাজ আসাও বন্ধ হয়ে গেল, ক্যামেরার রিলে আর ভরসা নেইকারোর, বিয়েবাড়িতে সবাই ডিজিটাল এস এল আর চায়। হাজারটা ছবি তোল, পরে যেমন চাও বেছে নাও, বদলে নাও ছবি, অনেক সুবিধা।ধীরে ধীরে দোকানটা বন্ধ করে দিতে হল,তারপরেএকদিন বিক্রি করে দিল ওটাকে। বাবাইয়ের জন্য হওয়া দেনা গুলো অন্তত মেটানো গেল তাতে।

অমিয় এখন বিয়েবাড়িতে পল্টুর সাগরেদ হয়ে যায়, আলো ধরার কাজ, ছোকরা অনেকবার বলেছে, গুরু এবারে একটা ক্যামেরা তুমিও নামিয়ে ফেল, বাজার তো বেশ গরম,ভাল ইনকাম হবে। নিজের কৌতুহলেই অমিয় বার চারেক পল্টুর ক্যামেরাটা নেড়েচেড়ে দেখেছে। এতে ছবি তোলাটা খুবএকটা জটিল কিছু নয়, সেই অ্যাপারচার,সেই শাটারস্পিড, শুধু কয়েকটা এক্সট্রা বোতাম, কিন্ত হাজার পঞ্চাশেক টাকা লাগবে, সেটাতো নেই, তার চেয়ে যেমন চলছে তেমনি ভাল।

দুবেলার খাওয়া, বছরের একটা জামা, আর বিয়েবাড়িতে পাঁঠার মাংস, অমিয়র ভেতরে যে আরেকটা অমিয় আছে সে কিন্তু এই নিয়েই দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছে। ওর একমাত্র শখের কথা তো বলাই হয়েনি আপনাদের। খুব,খুব গোপন শখ, সঞ্চারীও জানে না। সেটা হল খারাপ ছবি তোলার।সে কিরকম? আরে বলছি বলছি, আপনি কতো রকমের ছবি দেখেছেন মানুষের? প্রেমিকের সাথেপ্রেমিকা, সদ্যজাত সন্তান কোলে মা, পিকনিকে বন্ধুরা, বিয়ের রাতের কনে, এদের সবার ছবিতেএকটা মিল আছে সেটা খেয়াল করেছেন কি? না করে থাকলে আবার দেখুন, এরা সবাই হাসছে।তার মানে কি সারাদিনই এরা হাসে? তা তো নয়, প্রেমিকার ব্রেক আপ হলে, কনের স্বপ্ন ভাঙলে এরাই আবার কাঁদে, সেই ছবি তো কেউ তোলে না, কেউ তোলে না বললে একেবারে মিথ্যে বলা হবে যদিও, অমিয় তোলে।

যখন সবে ২৫শে পা দিয়েছে, তখন একদিন প্রেমিকা ল্যাং মারলো, বাড়ি এসে নিজের ঘরে খুবকাঁদল অমিয়, তারপরে আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হল আরে এতো একটা অন্য মানুষ!অবিন্যস্ত চুল, দিশেহারা চোখ, গালের পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট জলের বিন্দু গড়িয়ে নামছে।, চটকরে ক্যামেরাতে একটা ছবি তুলে ফেলল, গোপনে ডেভেলপ করল চিলেকোঠার ঘরে। সেই শুরু।শোকে মানুষের অবয়ব বদলে যায়, সেটা আর কেউ দেখুক না দেখুক অমিয় লক্ষ করেছিল ঠিক, একদিন একটা বিয়ে বাড়ির কাজ শেষ করে ফিরছে, খবর পেল পাড়ার মস্তান ছোটকার ভাইকে নাকি কে গুলি করেছে, অবস্থা ভাল না। হাসপাতালে গিয়ে দেখল ওই বিশাল চেহারার ছোটকা একটা সরু বেঞ্চে কেন্নোর মতো গুটিয়ে শুয়ে আছে, টুক করে একটা ছবি তুলে নিয়েছিল। কেউ মারা গেলে যখন শেষ ছবি তোলার ডাক পরত তখন মরা মানুষটার সাথে সাথে আড়ালে কাঁদতে থাকা প্রিয়জনদেরও গোটা কয়েক ছবি তুলে রাখতো। শ্মশানের দিকেও গেছিল দু একবার, কিন্তুআশাহত হয়েছিল। ওখানে শোক চার আনা, আর বাড়ি ফেরার তাড়া বারো আনা।

এমন করতে করতে বেশ কিছু ছবি জমেছিল, নিজের মনের মতো একটা অ্যালবাম তৈরি করেছিল অমিয়, আজও আছে ওটা ওই ডার্করুমে সিলভার হ্যালাইডের ফাঁকা বাক্সটার মধ্যে। এই ঘরে সঞ্চারী ২০ বছরের সংসার জীবনে একবারও ঢুকেছে বলে মনে পরে না, মাঝে মাঝে ও ঘুমিয়েপড়লে অমিয় চলে আসে ঘর খানায়। টর্চ-এর আলোয় অ্যালবামের পাতা গুলো উলটে দেখে।পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা দুঃখ গুলো ওকে বলে, দ্যাখ বোকা,দ্যাখ কতো ভাল আছিস তুই।

এত অব্দি পড়ে যদি ভাবেন অমিয়র দুঃখ দিয়েই গল্পটা শেষ করব তাহলে আপনি একদম ভুলভেবেছেন, একটা হ্যাপী এন্ডিং আছে কিন্তু।

মিনোল্টাটা বাড়িতে পড়ে আছে, একটা হিল্লে করতে হবে ওটার। এই ভেবে একদিন অমিয় এসেপড়ল ধর্মতলার মোড়ে। মেট্রো সিনেমার পাশেই সরু গলি, আর তাতে দুপাশে সারি সারি ক্যামেরার দোকান। পুরনো এস এল আর কেউই আর কিনতে চায়না। অনেক খুঁজে একটা দোকান পাওয়াগেল, মালিকের নাম লেটুবাবু, টাক মাথা, কোঁচকানো চামড়া দেখলে মনে হয় হ্যাঁ এই লোকইঅ্যান্টিক জিনিস কেনাবেচা করতে পারে বটে। তবে মডেলটা মাত্র বছর ৩০ এর পুরনো, তাইদামও ৩০০০ টাকার বেশি উঠল না, দড়াদড়ি চলতে চলতেই লেটুবাবু বলে বসলেন-
– মশাই, এটা বেচে যা পাবেন আজকের বাজারে তাতে দু সপ্তাহও চলবে না, প্রানের জিনিস, রেখেদিন নিজের কাছেই, ভাল কিছু ছবি থাকলে বলুন কিনতে পারি।”
অযাচিত উপদেশে অমিয় একটু বিরক্তই হয়েছিল, তাও বলল-
– কেমন ছবি খুঁজছেন বলুন তো, আমি অনুষ্ঠান বাড়ির ছবি তুলতাম, তা আছে গোটা কতক।
– আরে ধুর মশাই, ওসব ছবির কোন কদর নেই, রেয়ার কিছু চাই, ভাল ভাল ক্লায়েন্ট আছে আমারকাছে।
– রেয়ার বলতে?
– রেয়ার মানে আবার কি? যেটা বাজারে সহজে মিলবে না, যেমন ধরুন কোনারকে সুর্যাস্তের ছবি,আরোরা অস্ট্রালিসের ছবি, কোন বলিউডি হিরোর ছোটবেলাকার ছবি।
– ধুর মশাই, এই কোলকাতায় থেকে কি ওইসব ছবি তোলা যায় নাকি?
– যায় মশাই,যায়। তবে সে অন্যরকম ছবি হতে হবে, যেমন ধাপার বস্তি।
– সেই ছবি বিক্রি হবে?
– আলবাত হবে! আমার একজন দুঃখবিলাসী ক্লায়েন্ট আছে বুঝলেন, কালেকশন দেখার মতো,সোনাগাছির বাচ্ছা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের খরা, কাঁড়িকাঁড়ি টাকা খরচ করে কেনে ছবিগুলো, বলে টাচ অফ লাইফ, কি পায় কে জানে।

অমিয়র মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটল এবারে,
– ওকে কালকে আসছি আবার।

পরেরদিন আবার গেল সেই দোকানটায়, পকেট থেকে একটা ছবি বার করে দেখাল লেটুবাবুকে। ছবিটা নিয়ে লেটুবাবু পাক্কা দুমিনিট চুপ করে রইলেন, তারপরে মুখে বাক্য ফুটল,

– কোথায় পেলেন ভাই এই ছবি?
– আমি তুলেছি, ছেলের স্কুলের স্পোর্টস কম্পিটিশন ছিল। হান্ড্রেড মিটারের হাফ রাস্তাতেই এইছেলেটা হোঁচট খেয়ে পড়ল, কাঁদদে কাঁদদে ফিরে আসছিল, দাঁড় করিয়ে একটা ছবি তুলে নিলাম।
– আপনি মানুষ না অন্য.. যাকগে, বাদ দিন, আরো কিছু আছে এরকম আপনার কাছে?
– জানতাম চাইবেন, তাই এইটা নিয়ে এসেছি, আপনার ক্লায়েন্টকে দেখাবেন, আমি আসছি দুদিনপরে।

এই বলে ব্যাগ থেকে অ্যালবামটা বার করে বোকার মতো বসে থাকা লেটুবাবুর হাতে দিয়েরাস্তা ক্রস করতে থাকে আমাদের অমিয়।

দুদিন পরের কথা, লেটুবাবু অমিয়র হাতে অ্যালবামটা দিয়ে বললেন,

– মশাই আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন ! আমার ক্লায়েন্ট বলছে এরকম কিছু কোনদিন দেখেনি!একটা ছবি খুব পছন্দ হয়েছে, ভাল টাকা পাবেন কিন্তু।
– কোন টা?
– এই যে এইটা। পাতা উলটে ছবিটা দেখালেন লেটুবাবু
অমিয়র চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল,
– এই ছবিটা বিক্রি নেই।
– এরকম বলবেন না দাদা, আমাকে বারবার করে বলে দিয়ছে, ৬০০০০ ক্যাশও দিয়ে দিয়েছে সাথে।

অফারটা আর ফেলে দেওয়া গেল না।৬০০০০ টাকা গুনতেই ১০ মিনিট লাগল।

ছবিটা অমিয় তুলেছিল বছর চারেক আগে। ১০ই আগস্ট, শ্রাবন মাসের একটা শনিবার ছিলসেইদিন, সেইদিনই বাবাই চলে গেল। এতো পরিশ্রম, এতো রাত জাগা সব শেষ হয়ে গেল ১০মিনিটের খিঁচুনীতে। শ্মশান থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে দেখেছিল সঞ্চারী ওর খেলনা গুলো জড়িয়েশুয়ে আছে, শোকের একটা নিজস্ব ওজন আছে, সেই ভারে ভারী হয়েছিল ঘরের বাতাসটা।চৌকাঠের কাছে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল অমিয়, হটাৎ ভিতর থেকে কে যেন একটাফিসফিসিয়ে বলেছিল – “জানি মন খারাপ, কিন্তু এই মুহুর্তটা কি আর পাওয়া যাবে? ক্যামেরাটা কই?”

মাস চারেক পরের কথা,

কাঁধে ডি এস এল আর এর ব্যাগটা ঝুলিয়ে অমিয় বঁনগা লোকালে চড়ে বসল, হ্যাঁ অবশেষে ক্যামেরাটা কিনতে পেরেছে, পল্টুর কাছ থেকে শিখেও নিয়েছে ভালভাবে, তবে আজকে ও বিয়েবাড়ির ছবি তুলতে যাচ্ছে না, সকালেই কাগজে বেড়িয়েছে – হাবড়াতে বিষ মদে মৃত্যু ৬জনের, লেটুবাবুর ফোন এসেছিল, ক্লায়েন্ট বলেছে ভাল ছবি আনতে পারলেই ১ লাখ, আজ্ঞে হ্যাঁ, ১লাখ!

বলেছিলাম না একটা হ্যাপী এন্ডিং আছে!

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদচিত্র ~ vignette1.wikia.nocookie.net

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

3 comments

  • এরকম কিছু লিখতে পারলে খুশি হবো। খুব ভালো লাগলো।

Comments are closed.