“পাতা” ঝরার মরশুমে – IT Special

Freedom, Friends, Humor, Protest, Series, Short Story, Technology, আই টি ভাইটি, বাংলা

আপনারা যারা এই IT ব্যাপার টা নিয়ে অতটা সড়গড় নন, তাদের জন্য শুরু তেই একটু বলে নিই। আর পাঁচটা Engineering এর মতো এটাও একটা প্রকারভেদ যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ ছেলেপুলে Joint Entrance দিয়ে ঢুকে “Another brick in the wall” হয়ে বের হয় চার বছর পর। “Another Brick” শব্দ টা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম, কারনটাও ভিষন ক্লিশেড্ – উপযুক্ত পরিকাঠামো, সঠিক knowledgeable Faculty এরকম সব কিছুর ই বড্ড অভাব। কলকাতা-র বাইরে জানিনা, কিন্তু কলকাতার মধ্যে অবস্থা সত্যি শোচনীয়।

এত দূর পড়ে যদি আপনি ভেবে থাকেন যে এই self-proclaimed wannabe writer টা প্রচণ্ড দুখু-বিলাসি, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন, আর আপনার সেই ভুলটাই পরবর্তী কয়েক “para” তে ভাঙার করার চেষ্টা করব।

মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার এর ছেলেমেয়ে দের অনেক স্বপ্ন থাকে যার অধিকাংশই বি এস এন এল এর নেটওয়ার্কের মতো – আধা সময় Not reachable থাকে। তবু তার মধ্যেই দেবজিত এর বাড়ি তে অনুঘটক এর কাজ করেছিল এই IT।Courtesy?? সেই “শর্মাজি কা বেটা” যে কোন রকমে সেকেন্ড ডিভিশানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই NRI quota (অথবা বাবার কালো টাকার কোটা) এ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে এখন লাস ভেগাসে বসে ডলার ছাপছে।

দেবজিত (দেবু) এর বাবা ভেবে বসল “দেবু টা কে এই লাইনে যদি একবার ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না” – একবারের জন্য ভাবল না যে ছেলেটার HS এ এই  computer science additional নিয়ে কি ভোগান্তি হয়েছিল – “For loop” কোনদিন ঘোরেনি দেবুর লেখা code এ, vbscript এ “dim A” আজও ডিম পেড়ে উঠতে পারলনা..

কথায় বলে Depression এর বাংলা নাকি নিম্নচাপ; ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওই বছরগুলো কিভাবে কাটিয়েছে দেবু সেটা ওর থেকে ভাল কেউ জানে না। তবু কপাল এর জোরে কিভাবে যেন একটা চাকরি হয়েও গেল দেবুর ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে। কিন্তু হলে কি হবে, ছেলের মন বসে না কাজে, আর বসবেই বা কি করে? ছোটবেলা থেকেই দেবু খুব আবেগপ্রবণ –  মানে সেই category র মানুষ যারা “দিল সে চলতে হ্যায়, দিমাগ সে নেহি”। ভিষন সহজ সরল কাটিং, কেউ ভুলভাল কিছু বললেও তার সঠিক উত্তর দিতে পারতনা। খুব অস্থির মাথা দেবুর, কিছুতেই একটা সিদ্ধান্ত ঠিক ভাবে নিতে পারত না আর সেটার কারনও ছিল দেবুর বাবা। ভদ্রলোক নিজে খুব কষ্টে মানুষ হয়েছিলেন, তাই ছেলে কে আগলে আগলে রাখতে গিয়ে ছেলের মেরুদণ্ড টাই তৈরি করতে পারেননি। দেবু যখন ১২ এ পড়ে, উনি তখনো ছেলের স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে দিতেন, একটা জ্যামিতি র এক্সট্রা বা ফিসিক্স এর একটা হার্ডার  আটকে গেলে সাথে সাথে সেটা করে দিতেন। দেবুর ঠাকুমা ছিলেন ঢাকার বাঙাল, এসব দেখে প্রায়ই বলতেন দেবুর বাবাকে, “বুড়ো, ওরে নিজেরে করতে ক, বড় হলে মুখ থুবড়ায়ে পড়ব” – দেবু র বাবা সে কথা শোনেনি, ফল যে কে সেই হল..”3 Idiots” এর ভাষায় যাকে বলে “রাট্টা মারকে কলেজ কা চার সাল তো তু নিকাল দেগা, পার জিন্দেগি ভর তেরে সাথ বলাৎকার পে বলাৎকার হোতা রাহেগা”।

Image source: connect.talemetry.com

অফিস জয়েন করল দেবু, ঝাঁ-চকচকে মাল্টিন্যাশনাল, সুইচ টিপলে জরজিয়ার কফি, সাউথ কলকাতার ট্যাঁস মামনিদের ফিটফাট ড্রেস থেকে আসা গুচির মন উদাস করা গন্ধ, করপোরেট পার্টি, ঢালাও মদ মাংস, মাস গেলে বাইশ হাজার টাকা মাইনে – আর কি চাই কাকা জীবনে!! স্বাধীনতার স্বাদে বড় নেশা – আর দেবু ছিল বরাবর ই স্বল্পে সন্তুষ্ট টাইপ, আশেপাশে সবাই যখন H1B র জন্য ম্যানেজার কে ত্যালাছে বা শনি রবিবার এ অন্য কম্পানির ওয়াক-ইন এর জন্য গাতন্ দিচ্ছে, দেবু তখন হয় নিজের ব্যান্ড এর রিহার্সাল নয়ত গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এস্পল্যানেড এর কোনো একটা বার এ বসে ৭ পেগ এর পরে আর একটা ব্লেন্ডারস প্রাইড নিয়ে ঝগড়া করছে।

দেখতে দেখতে ৮-৯ বছর কেটে গেল। বিয়েথা করে দেবু এখন এক ছেলের বাবা, অনেক কিছুই  পালটেছে শুধু চাকরি টা ছাড়া। দেবুর ব্যাচ এর ছেলেরা বেশিরভাগ US এ গুছিয়ে নিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, নয়ত অফিসে বেশ একটা ভারিক্কি ম্যানেজার হয়ে সারাদিন PPT আর Excel নিয়ে বসে বাকিদের মাথা খাচ্ছে। কিন্তু তাও দেবু সুখেই ছিল, হয়ত দশ বছর পরেও এই চুয়ান্ন হাজারেই চালিয়ে নিত যেভাবেই হোক, শুধু বাধ সাধল ২-৩ বছরের জুনিয়ার ছেলেরা যখন ছড়ি ঘোরানো শুরু করল – মেরুদন্ড খুব শক্ত না হলেও self-respect টাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি দেবু, বিশ্বাস রেখেছিল নিজের আর ছায়া প্রকাশনীর ওপর।

In this revolutionary world, nothing is permanent apart from “Change”. নিজের ভালো পাগলেও জানে এবং দেবু খুব ভাল ভাবেই বুঝে গেছিল যে এই এক কম্পানি তে এত বছর ধরে মাথা মেরে কোন লাভ নেই. কিন্তু ওই অঞ্জন দত্ত stereotype – “আমার কলকাতা, আমার কসবার নীল দেওয়াল এর ঘর, রবীন্দ্র সদন এর পাসে মোমো, ময়দান এ বাদাম ভাজা, ওপিয়াম এর মেটে চচ্চরির সাথে কার্লসবার্গ, গোলবাড়ির কষা মাংস, আরসালান এর স্পেশাল বিরিয়ানি…” এগুলো থেকে বেরোনোর কথা ভাবলেই দেবু কেমন একটা হয়ে যেত – আর সর্বোপরি “ল্যাধ” তো ছেড়েই দিলাম….

ফসিলস এর একটা গান ছিল – “সততার বিলাসিতা আর নয়, এটা যুদ্ধ জিতবার সময়, দেওয়াল এ যদি পিঠ ঠেকে যায় তবে ঘুরে দাড়াতে হয়!!”

একদিন অফিসের বাইরে বসে সিগারেট খেতে খেতে হঠাত ফোন এর ইমেল নটিফিকেসন টা বেজে উঠল, চেক করে দেবু মিলিয়ে নিল নতুন কম্পানির অফার লেটার – ফোন টা পকেটে রাখতে না রাখতেই শুনতে পেল “সিংহাম” এর টাইটল থিম, তবে সেটা ফোন থেকে আসছিল না!!
এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ – “Submit Resignation” – আর পিছন ফিরে তাকানো নয়, আর কোনো দোটানা নয়, অনেক সহ্য করেছে দেবু…তাও আবার কি ভেবে মেশিন টা লক করে নিচে এল, আর একটা সিগারেট ই পরে আছে, ঝিরঝির বৃষ্টিতে দু টান মেরে ওপরে উঠতে উঠতে আবার “সিংহাম” থিম…মুচকি হেসে ওই স্পাইন-চিলিং, গলা শোকানো, ঢোঁক গেলা “Feel” টা নিতে নিতে ক্লিক টা করে দিল দেবু!! বাংলায় আমরা যাকে বলি “পাতা ফেলা”..

এসব খবর ছরাতে দেরি হয়না, দেবু উপলব্ধি করতে শুরু করল যে ওকে ছাড়া এই অফিস কেন, পুরো IT industry টাই অচল। নানাবিধ মিথ্যা মাখানো প্রতিশ্রুতি ঝরে পরতে লাগল – দেবুর নাকি প্রমোশন এবার সিওর, অক্টোবরে নাকি দেবুর পাসপোর্ট টাও ভার্জিনিটি হারাতো ইত্যাদি ইত্যাদি। দেবু শিখে গেল যে নোটিস পিরিওড ই হচ্ছে সেই সময়, যখন, কম্পানি তার এমপ্লয়ি কে নোটিস করা শুরু করে।
ফাইনালি দেবুর কারেন্ট কম্পানির শেষ দিনটাও এসে গেল, “বিড্ আদেউ” ইমেইল এর “সেন্ড্” বাটন্ এ ক্লিক করে আইডি কার্ড টা জমা করে পারকিং থেকে শেষবার এর মত গাড়িটায় স্টার্ট দিল দেবু…হাল্কা সন্ধে হয়ে এসেছে, মিউজিক প্লেয়ার এ বেজে উঠল “… In the end, it doesn’t even matter” – কি অদ্ভুত কাকতালীয়!!
অবশেষে দেবুর ও কম্পানি চেঞ্জ হল, সাথে চেঞ্জ হল শহর আর বাবা মায়ের ছত্রছায়া, যেটা কিছুতেই দেবু কে বড় হতে দিচ্ছিল না।

||

এই ঘটনার ৫ বছর হয়ে গেছে, দেবু এখন বেশ ভালভাবে একটা সিনিয়র রোল সামলাচ্ছে, Honda Jazz এর টপ মডেলটা নামিয়েছে, ছেলে ভাল স্কুল এ যাচ্ছে, বউদিকেও এখন আর সেই ধনতেরাস এর আশায় বসে থাকতে হয়না একটা কানের দুল এর জন্য।

 

পুনশ্চ: ওপরের ওই শেষ তিন লাইন কিন্তু নিছক ই Happy Ending এর একটা রাফ কপি, তবু যারা এটা পড়লে এবং IT তে বিশেষত কলকাতায় বেশ অনেক বছর কাটিয়ে ফেলে সেভাবে কোনো উন্নতি দেখোনি – তাদের বলি, “হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং CV ছাড়ো জোরে”!!

 

লেখক ~ ছন্দক চক্রবর্তী

এই লেখকের আরও একটি বিতর্কিত প্রবন্ধ ~> ওরে আমার ভাইটি, দিন ফুরলো IT-র

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ primerosetravel.com

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

 

4 comments

Comments are closed.