রাজায় রাজায় যুদ্ধ – ১ – মৃত্যুর একদিন আগে

Anirban & Arijit, Facts, History, Series, Short Story, Story, বাংলা, রাজায় রাজায় যুদ্ধ

এর আগেও বহু চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছে সেকেন্ড লিউটেন্যান্ট স্যান্ডি কে, কিন্তু আজকের দিনের কাছে সেগুলো সবই ফিকে। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে, যেকোন সময় সে আপন করে নিতে পারে। ওজন সম্পর্কে যা আন্দাজ করেছিল স্যান্ডি, সেটাই মিলল, আনুমানিক ২৫০ কেজির মতন।…

||

(চার দিন আগে)

গতকাল রাতের ভয়াবহ অ্যাটাকের পর শহর এখন একটু শান্ত হলেও চারিদিকের ধ্বংসস্তূপ যেন চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে। জার্মানদের মূল লক্ষ্য ধীরে ধীরে সফল হওয়ার পথে। ওদের প্রধান টার্গেট দেশের শিল্পের ভিত্তি কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। আর সেই বাছাই করা কিছু শহরের মধ্যে কভেন্ট্রি-র স্থান বেশ ওপরের দিকে। ইতিমধ্যে ফাইটার প্লেন থেকে এরিয়াল বম্বিং-এ শহরের বেশিরভাগ কল কারখানা ধূলিসাৎ। সমস্ত জলের সাপ্লাই বিপর্যস্ত, তাই কোথাও আগুন লাগলেও তা নেভানোর মতো জল নেই। স্যান্ডির কপালের ভাঁজেই সেই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

দু তিনবারের চেষ্টায় লাইটার দিয়ে চুরুট টা ধরালো স্যান্ডি। আজ মেঘলা না হলেও আকাশে নীলের বদলে এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা রঙ। হয়তো চারিদিকের আগুন আর ধোঁয়াই এর জন্য দায়ী। মাইকেল একমনে রেডিও কানে ধরে ভোরের সংবাদ শুনতে ব্যস্ত। খুব বাঁচোয়া যে রেডিও স্টেশন টা এখনও অক্ষত, অন্তত আগাম কিছু খবর পাওয়া গেলেও যেতে পারে। হেড কোয়ার্টার থেকে এখনও কোনও টেলিগ্রাম আসেনি, তাই দিনের শুরু তেই অল্প একটু সময় পাওয়া গেছে বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার।

জন্মসূত্রে স্কটিশ হলেও স্যান্ডি, ওরফে আলেকজান্ডার ফ্রেজার ক্যাম্পবেল এর বর্তমান পোস্টিং ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরে। এই ৪২ বছর বয়সেও তার মনোবল ও নিষ্ঠার প্রতি ভরসা রেখেই ব্রিটিশ আর্মি তাঁকে সেকেন্ড লিউটেনান্টের পদমর্যাদা দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহ পরিবেশে স্যান্ডির দায়িত্ব “রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ারস বম্ব ডিস্পোজাল” স্কোয়াডের কভেন্ট্রি শাখা কে নেতৃত্ব দেওয়া। এই কাজে যে কি পরিমাণ প্রাণহানির আশঙ্কা লুকিয়ে আছে, তা বেশ ভালোমতই জানে স্যান্ডি আর তার অধীনে থাকা সার্জেন্ট মাইকেল গিবসন। এদের বিবেচনার ওপর ভিত্তি করেই জান লড়িয়ে দেয় ৫ জন স্যাপার-এর দল। স্যাপার দের কাজ সাধারণত বিল্ডিং বা রাস্তার মেরামতি, ক্ষণস্থায়ী ব্রিজ বানানো, মাইন পাতা বা খুঁজে বের করা ইত্যাদি, কিন্তু এখানে তাদের কাজ নির্ভর করে স্যান্ডির নির্দেশের ওপর।

মাথায় আর্মি হ্যাট টা চাপিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল স্যান্ডি।

– কি বুঝছ মাইকেল, আজ দিন কেমন যাবে?

– ভালো নয় স্যার, বার্মিংহাম পুরো বিপর্যস্ত, এবার ওদের লক্ষ্য এই কভেন্ট্রি। কাল কাছাকাছি অনেক জায়গায় বোমাবর্ষণ হয়েছে। তার মধ্যে ক্যানলি-র চ্যাপেল স্ট্রীটে “ট্রায়াম্ফ ইঞ্জিনিয়ারিং” এর মোটরসাইকেল ফ্যাক্টরির সামনে লোকজন নাকি খুব আতঙ্কিত, কিন্তু কারণ জানা যাচ্ছে না।

– কোয়ার্টার থেকে কোনও খবর পেলে?

– এখনো না, ওর অপেক্ষা তেই আছি। নির্দিষ্ট খবর না পেয়ে রাউন্ডে যাওয়া ঠিক হবে না।

– না না, দরকার নেই। লোকাল লোকেদের থেকে দেখো কিছু জানতে পারো কিনা। আমাদের টীমের কি খবর?

– গিবসন, গিলক্রিস্ট, প্লাম্ব, স্কেলটন তো কাল রাত থেকেই ছিল, আজ ড্রাইভার টেলর ও জয়েন করেছে।

– বাহ্, ওদের বলো তৈরি থাকতে। অর্ডার এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

||

ঠিক এক ঘন্টা পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে মাইকেল, হাতে একটা চিরকুট নিয়ে।

– স্যার, খবর এসে গেছে ক্যানলি থেকে, শীঘ্র যেতে হবে আমাদের ওখানে। নিন, পড়ে দেখুন।

স্যান্ডি চিরকুট টা মেলে ধরে টেবিলের ওপর।


ক্যানলির ট্রায়াম্ফ ফ্যাক্টরি তে একটা বিশালাকৃতির বম্ব পড়েছে, যেটা এখনও ফাটেনি! অবিলম্বে আসুন।
১৪ই অক্টোবর, ১৯৪০

চিরকুট টা পকেটে পুরে নিয়েই দ্রুত গতিতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে পরে স্যান্ডি, চেঁচিয়ে বলে, “টীম, লেটস গো, ফাস্ট! গাড়ি বার করতে বলো টেলর কে।”

||

ট্রায়াম্ফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুনাম ইদানিং বেশ ভালোই ছড়িয়েছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও কাজ থেমে থাকেনি এদের, একের পর এক মোটরসাইকেলের যোগান দিয়ে গেছে এরা। কভেন্ট্রি তেই এদের প্রথম কারখানা গড়ে ওঠে। “বাইসাইকেলের পীঠস্থান” বলে খ্যাত এই কভেন্ট্রি শহর। তবে ১৯০২ সাল থেকে বাইসাইকেলের পাশাপাশি নামীদামী সব মোটরসাইকেল তৈরি হতে শুরু করে এই ফ্যাক্টরি থেকে। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সমস্ত কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে।

বম্ব ডিস্পোজাল স্কোয়াডের গাড়ি এসে থামল ফ্যাক্টরির মেনগেটের কাছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো স্যান্ডি, মুখে চিন্তার ছাপ। দ্রুতগতিতে শ্রমিকদের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কারখানার কর্ণধার করমর্দন করতে এগিয়ে এলেন।

– স্যার, প্লিজ বাঁচান আমাদের, পেছনের গেটের সামনে বম্ব টা পড়েছে, কিন্তু বাইরে থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

– নিয়ে চলুন আমাকে সেখানে। তবে তার আগে সমস্ত শ্রমিককে নির্দেশ দিয়ে দিন ফ্যাক্টরি খালি করে দূরে কোথাও চলে যেতে।

মাইকেলও স্যান্ডিকে ফলো করে এসে পৌঁছায় সাইটে। একটা প্রকান্ড মাপের গর্ত তৈরি হয়েছে গেটের ভেতরের ফাঁকা জায়গায়। ঝোপঝাড়ে ঢাকা বলে বোঝাও যাচ্ছে না বম্ব টা মাটির কতটা ভেতরে ঢুকে গেছে। স্যান্ডি গিয়ে গর্তের ধারে বসে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।

– মাইকেল, খুব তাড়াতাড়ি এইখান থেকে ২ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে যারা আছেন, তাদের সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এক মুহূর্তও অপেক্ষা করা যাবে না। হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠিয়ে দাও। আর স্যাপারদের বলো আমার সাথে এক্ষুনি দেখা করতে।

– ওকে স্যার, আমি ব্যবস্থা করছি।

মাইকেল ছুটে বেরিয়ে যায়। স্যান্ডি মাটি তে শুয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কিছু। পেছনে এসে দাঁড়ায় স্যাপার দের দল।

– স্যার, আমরা এসে গেছি, নির্দেশ দিন।

– গুড, শোনো সবাই ভালো করে। আমি নিশ্চিত এই গর্তে একটা বিশাল সাইজের বম্ব আছে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ওটার ওজন আনুমানিক ২০০ থেকে ২৫০ কেজি মতো হবে। কিন্তু ওটা কেন ফাটেনি বা কতক্ষণ বাদে ফাটবে সেসব জানতে হলে আমাদের বম্ব টা কে আনকভার করতে হবে সমস্ত কিছু থেকে। আমি জানি এতে প্রাণের ভয় আছে আর সময়ও লাগবে। কিন্তু আর কোনও উপায় নেই বন্ধুগণ। তাই, চলো লেগে পড়ি কাজে।

– ঠিক আছে স্যার।

মাথা নিচু করে উত্তর দিল প্লাম্ব, বুক দুরু দুরু করে কাঁপতে শুরু করলেও লিউটেনেন্টের অর্ডার, অগ্রাহ্য করা মানেই শাস্তি।

জোরকদমে কাজ শুরু হল। গর্তের মধ্যে নেমে পড়ল স্যাপারদের সবাই। দৈত্যাকৃতি এই বম্ব কে তোলা তো দূরের কথা, নাড়ানোই বেশ কঠিন কাজ। সারারাত কাজ চলতে লাগল। স্যান্ডি আর মাইকেল-এর কাজ মাঝে মাঝেই নেমে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া আর খাতায় নোটস নিয়ে রাখা।

চার দিন কেটে গেল এইভাবে। আজ ১৭ই অক্টোবর। এলাকা এখন পুরো ফাঁকা। নাওয়া খাওয়া ভুলে এখন একটাই লক্ষ্য, বম্ব টার একটা ব্যবস্থা করা।

মাইকেল এগিয়ে এল চেয়ারে বসে থাকা স্যান্ডির কাছে।

– স্যার, কাজ শেষ, বম্ব টা কে দেখা যাচ্ছে, ওপরেও তোলা গেছে।

– চলো আসছি।

এই আয়তনের একটা বিস্ফোরক চোখের সামনে দেখলেই যেকোন লোকের হার্টফেল করতে বাধ্য। কিন্তু স্যান্ডি সোজা এগিয়ে গেল বম্বটার কাছে। কান পাতলো ওটার গায়ে ১ মিনিট মতন। তারপর ঘুরে ঘুরে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালো স্যান্ডি। বেশ অবাক হয়েছে মনে হল। স্যাপার দের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তাড়াতাড়ি একটা লোহার শিক মতো কিছু দাও।

– এই নিন স্যার।

কিছু একটা ইলেকট্রনিক সার্কিটের মতো লাগানো আছে বম্ব টার গায়ে, কিন্তু মাটিতে পড়ার আঘাতে সেটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্যান্ডি খুব ভালো করে ৫ মিনিট ধরে পরীক্ষা করে টীমের সামনে এসে দাঁড়ালো।

– টীম, আমরা একটা অজানা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি, তোমাদের সাহায্য লাগবে।

– বলুন স্যার, আমরা প্রস্তুত।

– বম্ব টার গায়ে একখানা ফিউজ মেকানিজম আছে যেটা ওকে দেরিতে ফাটতে সাহায্য করে। কিন্তু সেটা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে আমরা যদি ওই ফিউজ কে খোলার চেষ্টা করি, তাহলে এখনই সেটা ফেটে যেতে পারে।

– তাহলে উপায় স্যার?

– আমি ঐ ফিউজের অবশিষ্ট ইলেকট্রিক চার্জ কে কিছুটা হলেও খরচ করে দিতে পেরেছি, যাতে আশঙ্কা একটু কম হয়, কিন্তু তাও আমরা জানি না কতক্ষণ বাদে ওটা অ্যাক্টিভেট হয়ে যাবে। আর এছাড়া ভেতরে আর কোনও টাইমার লাগানো আছে কিনা সেটাও আমাদের অজানা। তাই এখন একটাই রাস্তা খোলা আমাদের সামনে।

মাইকেলের চোখে মুখে টেনশান, কোনরকমে জিজ্ঞাসা করে, “বলুন স্যার, আপনার ওপর বিশ্বাস আছে।”

– আমাদের এই বম্ব টা এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে একটা নিরাপদ জায়গায়, সেখানে গিয়ে রিমোটলি ডিটোনেটর দিয়ে ফাটাতে হবে। মাইকেল, তুমি বলো এরকম কোনও জায়গা জানো কিনা।

– উইটলি কমন এখান থেকে চার মাইল মতো দূর, ফাঁকা জায়গা। কিন্তু নিয়ে যাওয়া যাবে কিভাবে?

– লরি তে। টেলর কে বলো একটা বড়ো লরি যোগাড় করতে, এক্ষুনি। সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।

মাইকেলের তৎপরতায় এসে গেল বেশ বড়ো সাইজের লরি। স্যাপার আর পুরো দল মিলে ওই বিশাল বম্ব কে বেশ সতর্কতার সাথে লরি তে তুলে ফেলল। রাস্তা ৪ মাইল হলেও এই বিপদজনক জিনিস নিয়ে জোরে চালানোও যাবে না, খুব সামলে চালাতে হবে। স্যান্ডি কিছু চিন্তা করছিল গালে হাত দিয়ে, তারপর মাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলল।

– মাইকেল, আজ এই লরি তুমি চালাবে।

মাইকেলের ভেতর টা এক মুহূর্তের জন্য হলেও কেঁপে উঠল।

– হ্যাঁ তুমিই চালাবে। তবে ভয় পেও না, পেছনে বম্ব-এর পাশেই শুয়ে থাকব আমি।

– কিন্তু!

– শোনো মন দিয়ে। আমি খেয়াল রাখব যাত্রাপথে বম্ব টার ভেতরে কোনও টাইমার এর টিক টিক আওয়াজ শুরু হচ্ছে কিনা। হলেই তোমাকে অ্যালার্ট করব আর আমরা লরি ছেড়ে দূরে পালাবো। তাই তুমি নিশ্চিন্তে ড্রাইভ করো, বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

– কিন্তু স্যার, আপনাকে অনুরোধ করব এতটা প্রাণের ঝুঁকি না নিতে।

– চলো কুইক, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। স্টার্ট দাও লরি তে। আর বাকি রা গাড়ি তে করে সাইটে পৌঁছে যেও, ওখানেই দেখা হবে।

মাইকেল ড্রাইভারের সিটে বসে চাবি ঘোরালো। স্যান্ডি লরির পিছনে বম্ব-এর ঠিক পাশেই শরীর টা এলিয়ে দিল। চলতে শুরু করল লরি, শুরু হল রুদ্ধশ্বাস এক অভিযান!

||

এর আগেও বহু চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছে স্যান্ডি কে, কিন্তু আজকের দিনের কাছে সেগুলো সবই ফিকে। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে, যেকোন সময় সে আপন করে নিতে পারে। এমন একটা শক্তিশালী বোমায় গোটা শহর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ওজন সম্পর্কে যা আন্দাজ করেছিল স্যান্ডি, সেটাই মিলল, আনুমানিক ২৫০ কেজির মতন।

কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে ব্লেচলি পার্কে অ্যালান টুরিং আবিষ্কৃত ডিকোডিং মেশিনের সাহায্যে জার্মানদের এনিগমা মেসেজ বিশ্লেষণ করে জানতে পারা গেছে যে কভেন্ট্রি তে এবার ভয়াবহ আক্রমণ হতে চলেছে। জার্মানদের আগামী অপারেশান “মুনলাইট সোনাটা”-র টার্গেটই হচ্ছে কভেন্ট্রি শহর কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু মহামান্য চার্চিল নাকি চান না এই আক্রমনের মোকাবিলা করা হোক, কারণ উনি জার্মানদের জানাতে চান না যে তাদের কোডেড মেসেজ পড়ে ফেলেছে ব্রিটিশ রা। তাই সামনের দিনগুলোতে আরও কি কি বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে ঈশ্বরই জানেন।

চুরুটও ধরানো যাচ্ছে না এখানে। আগুনের সামান্য ফুলকিও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমনিতে আধঘন্টার রাস্তা আজ বেশি সময় লাগছে, কারণ মাইকেল খুব সন্তর্পণে চালাচ্ছে, যাতে ঝাঁকুনি বেশি না হয়। কিন্তু এই মারণফাঁদের পাশে বসে স্যান্ডির এক একটা মিনিটও যেন এক এক ঘন্টা মনে হচ্ছে। তবে মৃত্যুর পরোয়া করে না স্যান্ডি, একদিন তো মরতে হবেই, তাই সেটা বীরের মতই হোক না।

মনে হল যেন ভেতর থেকে কিছু আওয়াজ এল! ভালো করে কান পাতলো স্যান্ডি বম্ব-এর গায়ে। পাশে রাস্তার আওয়াজে মন দিয়ে শোনা বেশ শক্ত। উঠে গিয়ে অন্যপাশে গিয়ে আবার কান পাতলো। নাহ্, মনের ভুল হয়তো। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল স্যান্ডি, “মাইকেল, সব ঠিক আছে তো? এদিকে অল ফাইন।”

– একদম স্যার, আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন।

– আর কতদূর?

– এখনও দু মাইল মতো বাকি।

– আচ্ছা, ধীরে চালাও। প্লাম্ব কি ডিটোনেটর নিয়ে আসবে ওখানে?

– হ্যাঁ, ওরা মজুত রেখেছে।

স্যান্ডি এসে শুয়ে পড়ল আবার দৈত্যের পাশে। ফিউজ থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অদ্ভুত এক অনুভূতি আসছে মনে। যতই মন শক্ত থাকুক না কেন, খালি মনে হচ্ছে একটু বাদেই প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠবে চারিদিক, দুজনের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে, কালকের সকাল আর দেখা হবে না। কিন্তু চমক ভাঙলেই আবার ফিরে আসতে হচ্ছে বাস্তবে, যে বাস্তব আরও কঠিন! আজ বারবার অ্যাগনেসের মুখটা খুব মনে পড়ছে। আবার দেখতে পাবে তো ভালোবাসার মানুষকে!

মাইকেলের বাবা খনির শ্রমিক ছিলেন, তাই বাবার খুব গর্ব ছেলে কে নিয়ে। মাইকেলের ভয় হচ্ছে যে এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা বাবাকে বললে হয়তো খুব রাগারাগি করবে, কিন্তু মনে মনে হয়তো খুশিও হবে। আর মাত্র এক মাইল মতো বাকি। ভগবানের দয়ায় উইটলি তে পৌঁছে ভালোয় ভালোয় বম্ব টা লরি থেকে নামাতে পারলে হয়। এই চাকরিতে পদে পদে বিপদ আছে বলেই না কাজ করতে এতো ভালো লাগে মাইকেলের!

জনবসতিপূর্ণ লোকালয় এড়িয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হচ্ছে আজ, যদিও এদিকটা বেশ ফাঁকাই আজ। আর ১০-১৫ মিনিট মতো লাগবে। আশা করা যায় স্যাপাররা অন্য রাস্তা দিয়ে অলরেডি পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। বম্ব গাড়ি থেকে নামানোর স্পট টা যদি ওরা আগে থেকে দেখে রাখে, তাহলে কাজে সুবিধা হবে।

ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে স্যাপার দের গাড়ি। স্যান্ডির চোখের কোণে হালকা হাসি খেলে উঠল। অবশেষে এই যাত্রা শেষ হতে চলেছে। আর কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা। সব ভালো যার শেষ ভালো। মনে উচ্ছাস এলেও দমিয়ে রাখছে স্যান্ডি। এখনও অনেক কাজ বাকি। লরি থেকে এই বিশাল জিনিস টা কে নামানোও বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ।

অবশেষে লরি এসে থামল একটা ফাঁকা জায়গায়। মাইকেলের গলায় বেশ স্বস্তির আওয়াজ শোনা গেল, “স্যার, আমরা এসে গেছি, অবশেষে!”

নামবার আগে আর একবার কান পাতলো স্যান্ডি বোমার গায়ে, সব ঠিকঠাক। স্যাপার রাও এসে দাঁড়িয়েছে লরির পাশে।

– বন্ধুরা, একে নামানোর কাজ শুরু হোক।

সবাই মিলে লেগে পড়ল দড়ি আর কাঠের পাটাতনের সাহায্যে বম্ব টা কে লরি থেকে নামাতে।

– খুব সাবধানে স্কেলটন, ফিউজের জায়গায় চাপ দিও না একদম।

প্রায় ১৫ মিনিট লাগল বম্ব টা কে নামিয়ে মাটি তে একটা বিশাল গর্তের মধ্যে রাখতে। এবার শুরু হল ওর গায়ে ডিটোনেটর লাগানো, ৫ খানা লাগানো হল চারিদিকে। গিলক্রিস্ট গিয়ে স্যান্ডির হাতে তুলে দিল রিমোট।

– চলো গাড়ি তে উঠে পড়ো সবাই। এখানে থেকে দূরে যাওয়া যাক।

নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্যান্ডি ও মাইকেল ভালো করে চেয়ে দেখে নিল চারিদিক। রিমোটের বাটন প্রেস করল স্যান্ডি।

কেঁপে উঠল মাটি!

||

আজ ২৫শে অক্টোবর ১৯৪০, ট্রায়াম্ফ কারখানার সেই না ফাটা বম্ব এর হাত থেকে শহরবাসীকে বাঁচানোর ৮ দিন পর। সকাল থেকেই ভিড় কভেন্ট্রি ক্যাথিড্রালের সামনে। চার্চের দরজা খুলে গেল সকাল ১০ টা নাগাদ। কিছুক্ষণ বাদেই পরপর লাইন দিয়ে বেরিয়ে এলো স্যান্ডি, মাইকেল, গিবসন, গিলক্রিস্ট, প্লাম্ব, স্কেলটন ও টেলর। এই বীরদের জন্যই এখানকার কত মানুষের জীবন বেঁচে গেছে এক সপ্তাহ আগেই। কিন্তু তবুও এদের দেখে সবাই এতো চুপ কেন! মুখে কোনও আওয়াজ নেই, নেই কোনও করতালি! ওরা বেরোবার সাথে সাথেই জনসমুদ্র এগিয়ে চলল ওদের সাথেই, গন্তব্য কভেন্ট্রির “লন্ডন রোড কবরস্থান”। ওখানেই যে পাশাপাশি শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই ৭ জনের।

অ্যাগনেসের চলবার শক্তি হারিয়ে গেছে আজ। দুজন পাশ থেকে শক্ত করে ধরে নিয়ে চলেছে শবদেহবাহী গাড়ির পাশ দিয়ে দিয়ে, যার মধ্যে শুয়ে আছে স্যান্ডি, একদম চিন্তামুক্ত হয়ে। আজ আর কোনও টাস্ক নেই, নেই সকাল থেকে টেলিগ্রামের অপেক্ষা। এবার শুধুই বিশ্রাম, চিরবিশ্রাম!

||

২২শে জানুয়ারি, ১৯৪১:

অ্যাগনেসের হাতে ইউনাইটেড কিংডমের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান “জর্জ ক্রশ” এর মেডেল। স্যান্ডি ও মাইকেল কে এই মরণোত্তর সম্মান আজ দেওয়া হয়েছে চরম বিপদের মুখে বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রদর্শনের জন্য। সকালের “লন্ডন গেজেটের” পাতায় আজ এই লেখা বেরিয়েছে।

সেকেন্ড লিউটেনান্ট স্যান্ডি ক্যাম্পবেল কে তাঁর অকুতোভয়তা ও সাহসিকতার নিদর্শনের জন্য এই সম্মান প্রদান করা হল। কভেন্ট্রি তে ট্রায়াম্ফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফ্যাক্টরি তে পড়া একটি না ফাটা বম্ব-এর ব্যবস্থা নিতে স্যান্ডি কে ডেকে পাঠানো হয়। এই বম্ব এর জন্য কারখানার উৎপাদন স্থগিত হয়ে যায়ে এবং শ্রমিক সহ ১০০০ জনকে সেই স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। স্যান্ডি ও তাঁর দল প্রবল দক্ষতার সহিত একটি লরিতে এই বম্ব স্থানান্তরিত করেন এবং এই যাত্রাপথে স্যান্ডি বম্ব-এর পাশেই শুয়ে থাকেন যাতে তিনি সঙ্গী চালক মাইকেল কে অ্যালার্ট করতে পারেন বিপদের মুহূর্তে। সফলভাবে এই বম্ব তারা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাটাতে সক্ষম হন ১৭ই অক্টোবর ১৯৪০ তারিখে। ঠিক পরেরদিন অর্থাৎ ১৮ই অক্টোবর ১৯৪০, হুবহু একইরকমের আর একটি বম্ব কে স্থানান্তরিত করে নিরাপদ স্থানে তাঁরা নিয়ে যান, কিন্তু লরি থেকে বম্ব টি নামানোর সময় তা প্রবল বিস্ফোরণের সাথে ফেটে যায় এবং স্যান্ডি ও তাঁর ৬ জন সঙ্গী মৃত্যুবরণ করেন।

~~~♦সমাপ্ত ♦~~~

“যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা।”

নির্মলেন্দু গুন-এর দুই লাইনেই যেন ধরা দেয় ইতিহাসের অনেকখানি অধ্যায়। ক্ষমতা ও অস্ত্রের দাপটের প্রতি মোড়কে লুকিয়ে থাকা রোমহর্ষক কিছু সত্যি গল্প খুঁজে বের করতেই শুরু করলাম এই নতুন সিরিজ – #রাজায়_রাজায়_যুদ্ধ । আশা করি পাশে থাকবেন। মন খুলে মতামত দেবেন। 🙂

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি