হিস্ট্রির_মিস্ট্রি- ৮ / যে মানুষের হাতদুটো ছিল ভগবানের- ১

Anirban & Arijit, History, বাংলা, হিস্ট্রির মিস্ট্রি

২২শে জুলাই, ১৯৭২

রোম

“ মাস দুয়েক আগে যে দুর্ঘটনাটা ঘটে ছিল আমি তার সাক্ষী ছিলাম। সেই ডামাডোলের মধ্যে আমার লোভ আমাকে গ্রাস করে। তাই এই পাথরের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি এখন রাতে আর ঘুমোতে পারি না। এই পাপ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি জানি এর কোন ক্ষমা নেই। নিজের হীনমন্যতায় কুঁকড়ে রয়েছি। যা চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম ফিরিয়ে দিলাম আজকে। জানিনা মায়ের আশীর্বাদ আর পাব কি না।”

ছোট্ট চিঠিটা পড়ে একবার উলটে পালটে দেখল পেদ্রো। ভ্যাটিকানে দিনে প্রায় কয়েক হাজার চিঠি আসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেই সব চিঠি এক জায়গাতে জড়ো হয়। একান্তই খুব উঁচুতলার না হয়ে থাকলে সেই চিঠিগুলো খুলে পড়া হয় আগে। তারপরে সেগুলো জমা হয় আর্কাইভে। অধিকাংশই চিঠিই থাকে পোপের বা পরমপিতার উদ্দেশে, কেউ লেখেন তার আশীর্বাদ চেয়ে, কেউ লেখেন নিজের পাপের কথা। তাই অনেক চিঠিরই প্রেরকের নাম থাকে না। যেমন আজকের চিঠিটা। এসেছে সুদূর আমেরিকা থেকে। কিন্তু এই চিঠিটার বয়ান অন্য গুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা, তাই তো!

পেদ্রো এবারে ছোট কার্ডবোর্ডের বাক্সটার দিকে তাকাল। ওটা এসেছে চিঠিটার সাথেই। ওতেই তাহলে আছে চুরি করা জিনিসটা?

বাক্স-টা খুব সাধারণ দেখতে হলেও যেভাবে সেটাকে বন্ধ করা ছিল তাতে অনেক যত্নের ছাপ। চারদিক পুরু টেপ দিয়ে মোড়ানো। ছুরি দিয়ে বাক্সটার একদিক কেটে খুলে ফেলল পেদ্রো। ভেতরে বাবল র‍্যাপের মধ্যে রাখা আছে কিছু একটা। খুব সাবধানে এবারে খোলা হল বাবল র‍্যাপের পরত। আর সেটা খুলতেই দৃশ্যমান হল এত আদর দিয়ে রাখা বস্তুটা। একটা ছোট্ট মার্বেল পাথরের টুকরো।

পেদ্রো চমকে উঠল! এ কি দেখছে সে! এই পাথরটা চিনতে তো তার ভুল হওয়ার কথা নয়। শেষ দুমাস ধরে তন্নতন্ন করে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আনাচে কানাচে খোঁজ চলছে এর। মনে মনে পরম পিতাকে স্মরণ করে খুব সাবধানে টুকরোটাকে নিজের চোখের সামনে ধরল।

সেটা একটা ভাঙা নাকের ডগার অংশ। আর যার শরীর থেকে এটা ভেঙে পরেছিল তিনি আর কেউ নন।

কুমারী মেরী।

যীশুর মা।

 

||

 

জানুয়ারি,১৪৯২

ফ্লোরেন্স

“ ঘুসিটা এমন জোরে মেরেছি যে মনে হল ওর নাকের হাড়-টা আমার মুঠির নিচে আমারোত্তি বিস্কুটের মতো গুঁড়িয়ে গেল। হা হা হা, ব্যাটাকে গোটা জীবন এবারে আমার দেওয়া এই চিহ্নটা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।”

দাঁত কিড়মিড় করে হাসতে হাসতে পাশে দাঁড়ান এক সতীর্থকে বলল পিয়েত্রো টোরিজিয়ানো। এতো দিনে মনে একটু সুখ হল। খুব বার বেড়েছিল ছেলেটা। এখন দেখ কেমন মাটিতে পরে কাতড়াচ্ছে।

একটা ছেলে সত্যি রক্তে মাখামাখি হয়ে পরে আছে। মাঝারি গড়নের চেহারা। ভেঙে যাওয়া নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে ওর জামা। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই।

ইউরোপ জুড়ে যে রেনেসাঁর ঝড় এখন উঠেছে ফ্লোরেন্স তার আঁতুড়ঘর। একটা ছোট্ট শহর শিল্পে, কাব্যে, স্থাপত্যে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে সবার। আর তার জন্য অনেকটাই দায়ী মেদিচিরা। নিজেদের ব্যাঙ্কিংয়ের ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি করায় এরা এখন ধনকুবের। কিন্তু একই সাথে প্রচন্ড শিল্পমনস্কও বটে। এখনকার মেদিচি লোরেঞ্জো মন দিয়েছেন দেশের তরুন সমাজ থেকে মণি মুক্তো গুলোকে তুলে আনতে। এদেরকে একই সাথে রাখা হয়েছে মেদিচির প্রাসাদের গায়েই একটা বাড়িতে, নাম অ্যাকাদেমি। এরা এখানে থাকে, এক সাথে কাজ শেখে। মেদিচির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাতে এদের অবারিত দ্বার। রোমান যুগের স্থাপত্য আর চিত্রকলার ছড়াছড়ি সেখানে। তাই দেখেই এই ছাত্ররা ছবি আঁকে। মূর্তি বানায়।

বাকি সবার মধ্যে থাকলেও আমাদের এই ছেলেটা কিন্তু একদম অন্যরকম। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই নাক ফাটা ছেলেটার কথাই বলছি। বয়স মাত্র ১৭ কিন্তু এর মধ্যেই ওর বানানো ম্যাডোনা অবাক করে দিয়েছে সবাইকে! মার্বেলের ওপরে খোদাই করা ম্যাডোনা, বসে আছেন সিঁড়ির ধাপে। কিন্তু এমন কাজ তো আগে কেউ দেখেনি। এতদিন অবধি যে সব পাথরের কাজ সবাই দেখে এসেছে তার থেকে এটা একদম আলাদা! সবার মনে একটাই প্রশ্ন, এই এক রত্তি ছেলে কোন জাদুবলে এমনটা বানিয়ে ফেলল?

যেটা আনকোরা চোখে জাদু সেটা আসলে জাদুকরের অনেক অনেক ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফসল। এই ছেলেটার ক্ষেত্রেও একই হয়েছিল। মাত্র ছ বছর বয়সে মাকে হারায়। বাবাও তখন সদ্য চাকরি খুইয়েছে। ন’মাসে ছ’মাসে এদিক ওদিক সরকারী চাকরি যা জোটে তাই করেন। ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? তাই সে বড় হয়ে উঠেছে তার ধাইমার বাড়িতে। ফ্লোরেন্সের উত্তর পূর্বের একটা ছোট্ট পাহাড় ঘেরা গ্রামে, নাম সেত্তিগনানো। গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকাই ছিল পাহাড় থেকে মার্বেল কেটে নিয়ে এসে খোদাই করা। তাই এই ছেলেও বড় হয়েছে হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি নিয়ে। পড়াশোনা করতে ওর ভাল লাগে না। তাই বছর তেরো বয়সে বাবা তাকে ফ্লোরেন্সে পড়তে পাঠালেও কয়েক মাসের মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে ঢুকে পরে বিখ্যাত ভাস্কর ঘিরল্যান্দিওর ওয়ার্ক শপে। সেখান থেকেই তাকে বেছে নেন লোরেঞ্জো দি মেদিচি।

এহেন প্রতিভা অ্যাকাদেমির বাকি সবার গায়ে জ্বালা ধরাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঈশ্বর-দত্ত ক্ষমতার ছেলেটা বেশ নাক উঁচু, নিজের কাজ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। আর ঠোঁটকাটা। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে তাকে এক পলও ভাবতে হয় না। তাই তার ব্যক্তিত্ব বাকিদের মনে ঊষ্মা জাগায় বইকি। তারই ফলশ্রুতি আজকের এই মারটা। যদিও ওর কিছু যায় আসে না তাতে। ওই চোখের দীপ্তির কাছেই বাকি সব ম্লান হয়ে যায়।

ছেলেটার নাম মিকেল,

মিকেল অ্যাঞ্জেলো।

এ ছেলের এলেম আছে, সেটা প্রথম দিক কার কাজ গুলো দেখেই বুঝেছিলেন লোরেঞ্জো। তাই তার যত্ন আলাদা করে নিতে থাকলেন। তার জন্যই নিয়ে আসা হল ইতালির সেরা খনির মার্বেল। আর সেই সব পাথরের টুকরো গুলো প্রান পেতে থাকল মিকেলের স্পর্শে।

 

||

 

অক্টোবর,১৪৯৫

ফ্লোরেন্স।

কয়েক মাস ধরে মন দিয়ে একটাই কাজ করে চলেছে মিকেল। এমন কাজ ওকে আগে করতে হয়নি।

শেষ তিন বছরে কিন্তু আর্নো নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। এই তো দুবছর আগেই লোরেঞ্জো মারা গেলেন। মেদিচিদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে ফ্লোরেন্সের গদিতে বসলেন সাভানোরোলা নামের এক কার্ডিনাল। শিল্প, সাহিত্যে বিন্দুমাত্র আকর্ষন নেই না সাভানোরোলার। তাই অর্থের অপচয়ের কথা ভেবে বন্ধ করে দিলেন অ্যাকাডেমি। অতএব বাকি ছাত্রদের সাথে মিকেলকেও ফ্লোরেন্স ছাড়তে হল। পরের দুটো বছর তার কাটল বোলোনা আর ভেনিসে। ১৪৯৪ সালের শেষের দিকে তার কাছে একটা চিঠি এল।

ফ্লোরেন্সে ফিরে আসার আমন্ত্রণ।

মেদিচি ডাক পাঠিয়েছেন।

সাভানোরোলা তখনও ক্ষমতায় থাকলেও মেদিচিরা ধীরে ধীরে আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠছিলেন। লোরেঞ্জোর বংশধর ফ্র‍্যাঞ্চেস্কোই এখন আবার মিকেলের পৃষ্ঠপোষক। মাস কয়েক আগেই মিকেল তাকে একটা সন্ত জনের মূর্তি তৈরি করে দিয়েছিল। সেই মূর্তিটা দেখতে দেখতেই ফ্র‍্যাঞ্চেস্কোর মাথায় অদ্ভুত খেয়ালটা এসেছিল,

– তোমার কাজের সত্যি জবাব নেই মিকেল, বাকি সবার থেকে তুমি আলাদা।

– ধন্যবাদ।

মিকেল এমন কথা আগেও বহুবার শুনেছে, ওর কাছে নতুন কিছু নয় এটা।

– কিন্তু একটা কাজ তুমি হয়ত পারবে না।

কথাটা মিকেলের শুনতে ভাল লাগল না, চোয়াল শক্ত হল ওর।

– পারব না? কি রকম?

– এই যদি তোমাকে বলি একদম আদ্দিকালের রোমান কায়দায় একটা মূর্তি বানিয়ে দাও, পারবে?

– আচ্ছা, দু-মাস সময় দিন।

হ্যাঁ, এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েই মিকেল খুব ব্যস্ত এখন, এমন কাজ সত্যি ওকে আগে কখনও করতে হয়নি।

কাজটা শেষ হতে দু-মাস না, আড়াই মাস লাগল। তারপরে মিকেল একদিন ফ্র‍্যাঞ্চেস্কোকে নিয়ে এলেন অ্যাকাদেমিতে।

পাথরের মূর্তিটার সামনে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন ফ্র‍্যাঞ্চেস্কো। ডান হাতের ওপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে একটা ছোট্ট কিউপিড। তার নিমীলিত চোখ, পেলব গাল, পিঠে ছোট পাখনা। এক নজর দেখলে যে কেউ বলবে রোমের অ্যাক্রোপলিস থেকেই কেউ তুলে এনেছে একে। কিন্তু অবাক হওয়ার সাথে সাথে মেদিচির মনে একই সাথে খেলে গেল দুষ্ট বুদ্ধি।

– না, আমারই ভুল। চারিদিকে সবাই যে বলছে তোমার হাত দুটো ভগবানের তৈরি সেটা হয়ত ঠিকই।

মিকেল উদাসীন ভাবে বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের মনের মধ্যে তখন চাপা উল্লাস।

– একটা কাজ করতে পারবে মিকেল? এই মূর্তিটাকে একটু পুরোনো বানিয়ে দিতে পারবে? এই যেমন ধর এদিকে ওদিকে একটু চিড় ধরেছে, এই ডানার কোণটা একটু ভাঙা, হাতের ভাঁজ গুলো ধরো একটু ময়লা মতন…

– কেন? এতে লাভ কি হবে?

– লাভ! লাভ অনেক! তোমার নিজের ওয়ার্কশপ বানানোর ইচ্ছা না? এই মূর্তি আমি রোমের কার্ডিনালের কাছে বেচে দেব অনেক দামে, ভেবে দেখ, তোমার স্বপ্নটার অনেকটা কাছাকাছি চলে আসবে তুমি।

২১ বছরের মিকেলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল সাথে সাথে, মুহূর্তের পদস্খলনে ভেবে বসল মেদিচির বুদ্ধিটা বেশ পদের। ব্যাস, কিউপিডকে কয়েক দিনের মধ্যেই বেচে দেওয়া হল রোমের কার্ডিনাল রাফেলো রিয়ারিওর কাছে। মিকেল কিন্তু খুব বেশি কিছু পেল না এর পরেও। যে দালালটা মেদিচির সাথে রিয়ারিওর যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল সেই ব্যাটাই লাভের একটা মোটা অংশ হাতিয়ে দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।

কিউপিড বিক্রি হওয়ার মাস চারেকের মধ্যেই মিকেল একটা কানাঘুষো শুনতে পেল ফ্লোরেন্সের রাস্তায়।

রিয়ারিও জেনে গেছেন যে এটা নকল। হাজার বছরের পুরোনো রোমান রেলিক নয়। ধুর, এ কথা নির্ঘাত গুজব! মিকেলের শত্রুর তো অভাব নেই, তাদেরই কেউ এসব ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে।

তবে গুজব টা যে সত্যি সেটা মিকেল বুঝতে পারল কার্ডিনালের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে। চিঠির বয়ান বেশ নির্মম,

মিকেলকে এখনি রোমে যেতে হবে।

 

||

 

২৫শে জুন, ১৪৯৬

রোম

-আপনি জানেন কেন আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে?

মিকেল জানে কারণটা। ক্ষনিকের প্রগলভতায় সে ঠকিয়েছে ক্যাথোলিক চার্চের শীর্ষে যে মানুষগুলো বসে আছেন তাদের একজনকে। গোটা ইতালি এখন খবরটা জেনে গেছে। ওর মুখে তাই ভাষা নেই। কার্ডিনালের চোখের দিকে তাকাতেই পারছে না মিকেল।

– আপনি আমাকে নকল মূর্তি বেচেছেন। যে অপকর্ম করার দুঃসাহস ভ্যাটিকানের ইতিহাসে কেউ কখনও করেনি। আজীবনের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হতে পারে আপনাকে, সেটা জানেন নিশ্চয়?

মিকেলের হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য কি স্তব্ধ হয়ে গেল? নির্বাসন! মানে বাকি জীবন আর কোন কাজ করতে পারবে না ও? যে পাথর ওর জীবন সেই পাথর আর ছুঁতেই পারবে না?!

– আপনার বানানো কিউপিডটা দেখে আমি সত্যি বুঝিনি এটা নকল। কিন্তু অন্যায় কখনো চাপা থাকে না। আপনার অ্যাকাদেমি থেকেই আসল খবরটা আমার কাছে পৌঁছয়। রাগ তো খুব হয়েছিল, অপমানিতও হয়েছিলাম। কিন্তু তার সাথে একটা বিস্ময়বোধও হয়েছিল। একজনের হাতের কাজ এত নিপুণ কি ভাবে হতে পারে! আজ থেকে হাজার বছরের পুরোনো একটা শিল্পের হুবহু নকল কোন মন্ত্রবলে হল! আপনি সম্ভাবনাময়, তাই আপনাকে আরেকটা সুযোগ দেব।

এবারে মিকেল মাথা তুলে চাইল, আরেকটা সু্যোগ! এতো আবার প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো!

কার্ডিনাল রিয়ারিও এবারে তার বাক্যটা শেষ করলেন,

– ভ্যাটিকানেই আপনি থাকবেন। এখানে থেকেই এবার থেকে কাজ করবেন, আমাদের জন্য।

এতো বন্দীদশা! ভ্যাটিকানে থাকা মানে কার্ডিনালদের ফরমায়েশি কাজ করা। তাদের পছন্দ মতো মূর্তি গড়া! নিজের ভিতরের শিল্পী স্বত্তাকে বিসর্জন দিতে হবে তাহলে!

মিকেলের সেইদিন মনে হয়েছিল এই হল তার খারাপ দিনের শুরু। কিন্তু এই ঘটনাই ওর জীবনটা যে আমূল বদলে দেবে সেই ধারণা ওর ছিল না।

সেপ্টেম্বর, ১৪৯৭, রোম

-আমার জন্য একটা মূর্তি তৈরি করে দিতে হবে আপনাকে।

কার্ডিনাল বিলহেরেস এই কয়েক মাস হল ফ্রান্স থেকে ভ্যাটিকানে এসেছেন। এখানেই এবারে পাকাপাকি থাকবেন বাকীটা জীবন।

-কিরকম?

মিকেলের মনে কোন উৎসাহ নেই। এই বুড়োদের জন্য এটা সেটা বানানোই এখন ওর কাজ।

-আমার নিজেরই সৌধের জন্য।

-আচ্ছা।

– আপনি পিয়েতার নাম শুনেছেন?

– হ্যাঁ শুনেছি তো।

মিকেলের চোখ দুটো এবারে চকচক করে উঠল।

– একটা পিয়েতা বানিয়ে দিন।

জেরুজালেমের বাইরেই যে উঁচু ঢিপিটা আছে ওর নাম গোলগথা। ওখানেই যীশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়। ক্রুশ থেকে নামাবার পরে মৃত সন্তানকে কোলে নেন শোকাহত মা মেরী। মায়ের এই শোকের নামই পিয়েতা। মিকেলের অনেকদিনের চাপা স্বপ্ন ছিল একটা পিয়েতা বানানোর। নিজের মতো করে। এবারে সেটা সত্যি হবে তাহলে!

ভিতরের উচ্ছাসটা বাইরে না এনে গম্ভীর মুখে মিকেল এবারে বলল,

– বানিয়ে দেব,কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

– কিরকম?

– এর জন্য যে মার্বেল পাথর লাগবে তা আমি নিজে থেকে পছন্দ করব। তা আনাতে হবে কারারা অঞ্চলের খনি থেকে।

– কারারা? মানে যেখান থেকে ফ্লোরেন্সের গিল্ড ওই বিশাল পাথরটা তুলে এনেছিল? ডেভিড বানাবে বলে?

– হ্যাঁ, সেই রকমই তো শুনে ছিলাম।

– কিন্তু সেই পাথর তো খুব দামী। ওরা ওটাকে আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ফেলে রেখেছে, কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। আপনিও সেরকম অপচয় করবেন না তো?

– নাহ, দু-বছর সময় দেবেন আমাকে।

পাথর এলো কারারা থেকে। তারপরে ২২ বছরের মিকেল নিজের ধ্যানে ডুবে গেলেন। পাথরে প্রাণ আসতে লাগল একটু একটু করে।

 

||

 

জুন, ১৪৯৯, রোম

আজ প্রায় দু সপ্তাহ হলে মিকেলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। সান্তা পেত্রোনেলার চ্যাপেলে মূর্তিটা বসানো হয়েছে। এখন রোমের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে এর নাম। এমন সৃষ্টি নাকি আগে কেউ কখনও দেখেনি। এদিকে যার জন্য বানানো সেই কার্ডিনালই এতোদিন ভ্যাটিকানের বাইরে ছিলেন। তাই ফিরে এসেই মিকেলকে সাথে নিয়েই দেখতে চলে এলেন মিকেলের পিয়েতাকে।

প্রায় মিনিট দশেক মূর্তিটার সামনে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বিলহেরেস। সত্যিই মিকেল যেটা বানিয়েছেন তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রায় দেড় মিটার উঁচু আর দুমিটার চওড়া একটাই মার্বেল পাথর থেকে উঠে এসেছে মা মেরী আর তার কোলের সদ্যমৃত সন্তান। মেরীর পরণের কাপড়ের প্রতিটি ভাঁজ ফুটে উঠেছে মার্বেলেই। শোকে কাতর তার মুখ। যীশুর মুখে কিন্তু শান্তির ছায়া। মায়ের কোলে বলেই কি? ঘাড় তার এলিয়ে পড়েছে পিছনের দিকে। ডানহাতটাও ঝুলে আছে। মনে হচ্ছে পাথরের মূর্তি না। তার সামনে রক্তমাংসের মানুষ দুজনই রয়েছেন! এখনি যেন মেরীর চোখের এক ফোঁটা জল পরবে মাটিতে।

কিন্তু একি? একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে যে শিল্পী। যাক, একটা খুঁত ধরা যাবে তাহলে।

– মিকেল আপনি হয়ত সত্যি মানব সভ্যতার ইতিহাসের সেরা স্থাপত্যটি তৈরি করেছেন। কিন্তু একটা খুব মারাত্মক ত্রুটি যে রয়ে গেল আপনার এই কাজে!

– তাই নাকি! আমার তো কিছু নজরে পরছে না।

মিকেলের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ওর কন্ঠে স্পষ্ট এবারে।

– সে কি, ভাল করে দেখুন, এখনও বুঝতে পারছেন না?

– কার্ডিনাল, এই মূর্তি আমি শেষ দেড় বছর ধরে দেখছি। আপনি বলুন কি ভুল।

– আচ্ছা। শুনুন তবে। মেরীর মুখটা লক্ষ্য করুন তো। কত বছরের লাগছে? নিজেই তো বানিয়েছেন।

– ওই বছর কুড়ি ধরুন।

– যীশু মারা গিয়েছিলেন ৩২-৩৩ বছর বয়সে। আর তার মায়ের বয়স তখন কুড়ি! এই সহজ গণনাটাও মাথায় ছিল না আপনার!

এবারে মিকেল একটু হেসে ফেলল। সেই হাসিতে একটু তাচ্ছিল্যও মিশে আছে।

– কার্ডিনাল আপনি দান্তের বিখ্যাত ডিভাইন কমেডি পড়েছেন নিশ্চয়।

– আলবাত পড়েছি! তার প্রায় প্রতিটি ছত্র আমার কন্ঠস্থ।

– বাহ, তাহলে তো খুব ভাল। একবার মনে করে বলুন তো এবারে, ওই কাব্যের প্যারাডিসো অংশে সন্ত বার্নার্ড মেরীর কি ভাবে আরাধনা করেন?

– ওই তো, “ ভার্জিন মাদ্রে, ফিগিলা দেল তুও ফিগিলো।” মানে হে কুমারী মাতা, তুমি তোমার সন্তানের সন্তান। মানে…

-মানে কি?

– মানে পবিত্র যে ট্রিনিটি, তার মধ্যে একজন যীশু। আর বাকিরা তার সন্তান।

– আর মেরী?

– মেরীও তো সেরকমই একজন মানুষ, তাহলে…

– তাহলে?

– তাহলে মেরীও প্রকারান্তরে যীশুর সন্তানই হলেন! ঠিক ঠিক… আমি এভাবে কেন ভাবিনি আগে!

– সেই জন্যই আমার পিয়েতাতে মেরী যৌবনবতী। আর বাকিদের মতো বছর পঞ্চান্নর বয়স্ক মেরী আমি তৈরি করতে গেলে আমার আত্মায় আঘাত লাগত।

কার্ডিনাল মুখটা একটু শুকিয়ে গেল এবারে। মিকেলের অকাট্য যুক্তির প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার নেই। নাহ, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আরেকবার অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু হটাৎ করে একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেল।

– আচ্ছা মেরীর বুকের ওপরে ওটা কিসের খোদাইয়ের দাগ?

মিকেল এবারে নিঃস্পৃহ গলায় বললেন,

– আমার নাম খোদাই করে দিয়েছি।

– মানে!

– মানে আবার কি? মূর্তিটা এখানে বসানোর পরে একদিন শুনলাম যে আমি না, কোন এক সোলারি নামের শিল্পী নাকি এটা বানিয়েছেন। আমি জানি আমার এই কাজ আগে কেউ কখনও করতে পারেনি। এরপরে আমার এই সৃষ্টির কৃতিত্ব অন্য কেউ চুরি করে নেবে? আমি তাই কালকেই একটা মই নিয়ে উঠে বুকের কাছটায় নিজের নাম খোদাই করে দিলাম।

ভ্যাটিকানের বুকে দাঁড়িয়ে পবিত্র মূর্তির বুকে নিজের নাম খোদাই করার সাহস একমাত্র মিকেলেরই ছিল। তার আগে বা পরে এমন ঔধ্যত্ব আর কেউ দেখায়নি।

 

||

 

 

২১শে মে, ১৯৭২, রোম

আজকে পেন্তেকোস্ট সানডে। ইস্টারের পরে পনেরোতম দিন। খ্রিশ্চানদের কাছে খুব পবিত্র দিন এটা। তাই আজকে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকাতে অন্য দিনগুলোর তুলনায় খুব বেশি ভীড়। সেই ভীড়ের অনেকটা অংশই জড়ো হয়েছে ব্যাসিলিকাতে ঢুকেই ডানদিকের মূর্তিটার কাছে। মিকেল অ্যাঞ্জেলোর পিয়েতা। বানানোর বছর দশেক পরেই সেন্ট পেত্রোনেল্লার চ্যাপেল থেকে একে এখানে সরিয়ে আনা হয়।

সবাই মূর্তিটার একটা ঝলক দেখতে ব্যস্ত। লাইকা, ফুজির ক্যামেরাতে কেউ ব্যস্ত মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে। নিরাপত্তা রক্ষীরা ভীড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে।

এমন সময় হটাৎ করে দড়ির বেড়া টপকে একজন চলে গেল পিয়েতার একদম কাছটাতে। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক তার। গালে দিন দশেকের না কামানো দাড়ি। আর হাতে একটা হাতুড়ি!

“ আমিই যীশু, আমার নবজন্ম হয়েছে!” বলেই লোকটা এলোপাথাড়ি হাতুড়ির বাড়ি মারতে লাগল মূর্তিটার ওপরে। যেন ওর ওপরে কোন অশরীরী ভর করেছে! নিমেষের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল মেরীর কনুই থেকে বাঁহাত, মুখ, নাক আর বাঁ চোখের কিছুটা অংশ। যতক্ষণে নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে বাগে আনে ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। পরে জানা গেছিল লোকটার নাম লাজলো টথ, একজন চাকরি খোয়ানো জিওলজিস্ট। তাকে পাঠানো হয় পাগলখানাতে। বছর তিনেক পরে ছাড়া পেয়ে সে চলে যায় অস্ট্রেলিয়াতে। তারপরে আর কেউ তাকে দেখেনি।

 

 

 

 

পিয়েতার শরীর থেকে সেদিন প্রায় ১০০টা টুকরো খসে পরেছিল। পরের দশ মাস সময় নিয়ে একটু একটু করে খুব যত্ন নিয়ে সেগুলো মেরীর শরীরের সাথে জোড়া হয়। একটা হারিয়ে যাওয়া টুকরো কোন অনুতপ্ত আমেরিকান পাঠান ডাকে, নিজের নাম গোপন রেখে। এখন পিয়েতা পুরু ফাইবার গ্লাসে মোড়ানো। হাত দেওয়া তো দুরের কথা। তাকে দেখতে হয় মিটার দশেক দূর থেকে।

——————————————————–
শেষের কথা-

১. মা মেরীর ভাঙা নাক জোড়া লেগে গেছিল। এখন সেই জোড়া লাগার সুক্ষ্মতম দাগটাও নেই আর। কিন্ত মিকেলের ভাঙা নাকটা কোনদিন জোড়া লাগেনি। তার যে কোন একটা পোর্ট্রের্ট দেখলেই সেটা সহজে বোঝা যায়।

২. কিউপিডের মূর্তিটা মিকেল সত্যি বানিয়েছিলেন। তার বর্ণনা আছে তার আত্মজীবনীতে। মিকেল একজনই একমাত্র রেনেসাঁর শিল্পী যার জীবদ্দশাতেই তার আত্মজীবনী বেরোয়। তাও আবার একটা না, দুটো। কিউপিডের মূর্তিটা এখন কোথায় কেউ জানে না।

২. কারারার মার্বেলে খনির সেই বড় পাথরের চাঁইটার কথা বলেছিলাম মনে আছে? যেটা প্রায় ৪০ বছর পরেছিল ফ্লোরেন্সেই। মিকেল অ্যাঞ্জেলোর স্পর্শ পায় সেই পাথরও। তার ফলশ্রুতি ডেভিড। ডেভিডের গল্প থাকবে পরের পর্বে। তাতেও কম রোমাঞ্চ নেই কিন্তু!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ