নাম

Childhood, Friends, Humor, Journey, Short Story, Technology, বাংলা

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, সদ্য সময়যান-ঘড়ির আবিষ্কর্তা বাপনবাবুু কিছুতেই এতদিন ভেবে পেতেন না, তাঁর পিতৃদেব কী খেয়ে তাঁর ভালো নাম আমিয়াসি রেখেছিলেন। নিকষ্যি বাঙালি ছেলের নাম আমিয়াসি? বাংলা আমি আসি তো বটেই, সেটা বাদ দিলেও শুনতে কেমন জাপানি জাপানি শোনায়। অথবা অন্য কোনও ভাষা – কে জানে! বাপনবাবু তো জানেন না! অথচ এই নামের চক্করে সেই আধো-আধো প্রাইমারির বয়স থেকেই কী যে খোরাক হতে হয়েছে তার ঠিক নেই! আদ্দেক লোক তো নাম শুনেই গড়ে দেড় মিনিট ধরে হেসে বলে, “আমি আসি? এরকম নাম হয় নাকি?” বাকিরা হয় জিগ্যেস করে, “কী বললেন?” নয় পাগল ভেবে পিছিয়ে যায়।

একটু জ্ঞানগম্যি হওয়ার পর থেকেই এইসমস্ত ধরণী দ্বিধা হওয়ার পরিস্থিতি এড়াতে তিনি তাই সুকৌশলে পাড়ার এবং ইস্কুলের বন্ধুদের মধ্যে, এমনকি প্রতিবেশী ও স্যারেদের মধ্যেও নিজের ডাকনাম ‘বাপন’টি তীব্রভাবে প্রচার করে দিয়েছিলেন। ওই নামে না ডেকে কেউ আমিয়াসি বলে ডাকলে শুনতে না পাওয়ার ভান করতেন। কিন্তু মুশকিল হতো অফিশিয়াল কাজকম্মের বেলায়। একবার তো রেশন কার্ডের অ্যাপ্লিকেশন বাতিল হয়ে গিয়েছিল, কারণ ভারপ্রাপ্ত ক্লার্ক চটে উঠে মুখে গ্যাঁজলা তুলে চিৎকার করছিলেন, “নামের জায়গায় এসব কী? খিল্লি হচ্ছে মশাই?” আরেকবার, খুবই দুঃখের সঙ্গে বাপনবাবু এখনও স্মৃতিচারণ করেন, কোনো এক পরীক্ষার মৌখিক অংশে, টেবিলের ওদিকে থাকা বিরক্ত-মুখের পরীক্ষক “নাম কী” বলে হেঁকে উঠতেই বাপনবাবু “আমিয়াসি, স্যার” বলায় পরীক্ষক চরম নির্লিপ্ততার সঙ্গে একটা “এসো” বলে, বাপনবাবুর চোখের সামনে ট্যাবুলেশন শিটে শূন্য বসিয়ে দিয়েছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বাপনবাবু সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেন, এ নাম তিনি রাখবেন না।

মুশকিল হচ্ছে আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতোই, বাপনবাবুর বাবাভাগ্যও বড্ড ইয়ে। কাজেই সেবার বাপনবাবু বাড়ি ফিরে কম্বুকণ্ঠে সবার সামনে “আমি নাম বদলে ফেলব” বলার পরই একটা ক্রাকাতোয়া গোছের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল এবং তার জ্বলন্ত প্রমাণ সর্বাঙ্গে নিয়ে বাপনবাবু হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে পিতরি প্রীতিমাপন্নে না হলে নাম বদলানোর জন্য এফিডেভিটের টাকাটাও জুটবে না। অগত্যা শেক্ষপিয়র স্মরণ করে “নামে কী আসে যায়”-মার্কা চরম ঔদাসীন্যে বাপনবাবু নিজেকে সমর্পিত করে ফেলতে যাকে বলে বাধ্য হলেন আর কী!

খেলায় জিততে না পারলে মানুষ যেমন পার্টিসিপেশনেই সান্ত্বনা খোঁজে, তেমনি নামবিপ্লব ক্ষণজীবি হওয়ার পর বাপনবাবু অন্য অ্যাঙ্গল থেকে সান্ত্বনা আদায় করার চেষ্টা চালালেন কিছুদিন। এমনও তো হতে পারে, তাঁর নামের মানে এমনই সুন্দর, মহৎ, তেজী একটা কিছু, যা তিনি জানেন না! মনে হতেই বাপনবাবু কোমর বেঁধে লাগলেন। পিতৃদেবকে জিগ্যেস করে কোনো ফল হয় নি, সেই ছোটোবেলা থেকেই। একটি মৃদু ধমকসম্বলিত “তাতে তোমার কী? এসব নিয়ে না ভেবে পড়াশুনোয় মন দাও” শুনলেই বাপনবাবুর জলতেষ্টা পেয়ে যেত, অতএব ওদিকে ফার্দার ইনভেস্টিগেশন অসম্ভব। অগত্যা বাপনবাবু পণ্ডিতদের ধরলেন – নিজের বন্ধুদের দাঁতভাঙা সব নাম শুনেটুনে তদ্দিনে তিনি ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছিলেন যে বাঙালি বাপ-মা-রা নিজেদের ছেলেমেয়ের এমন সব তৎসম খটোমটো নাম রাখতে পছন্দ করে যা শুনলে ঢোক গেলা ছাড়া উপায় থাকে না। অতএব প্রথমেই তিনি এক সংস্কৃত পণ্ডিতের কাছে ধর্ণা দিলেন। তিনি প্রত্যয়-ধাতু-বিভক্তি পেঁচিয়ে কীসব জোড়াতাড়া খাড়া করার চেষ্টা করলেন বটে, তবে ধোপে টিকল না। একে একে খুঁজেপেতে চিনা-জাপানি-কোরিয়ান-ইন্দোনেশিয়ান-বর্মিজ-আফগান-তুর্কি-আজেরবাইজানি হয়ে এশিয়া পেরিয়ে আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকান, এসপেরান্তো, মায় বুশম্যান বা এস্কিমোভাষাবিশেষজ্ঞকেও ধরা হলো, কিন্তু হা হতোস্মি!

হোমফ্রন্টে অবশ্য একটু এগোনো গিয়েছিল। বাপনবাবুর ক্রমাগত খোঁচাখুঁচির সামনে আত্মসমর্পণ করে তাঁর মা একটু তথ্য দিয়েছিলেন, তবে সামান্যই।
“তোর নামের মানে কী, জানি না বাবা। তবে তোর জন্মের মুহূর্তেই নাকি কী এক বিশাল গণ্ডগোল হয়েছিল, সে থেকে তোকে কে-একজন নাকি বাঁচিয়েছিল। তাঁরই ওই নাম। তোর বাবা তাঁকে মনে রাখতেই ওঁর নামে তোর নাম রেখেছিল। আমি তো তখন হাসপাতালে, বাকি কিচ্ছু জানি না। তোর বাবাকে তো জানিস, কিচ্ছু বলে না।”

এ-কথা জানার পর থেকে অবশ্য নাম বদল করার চিন্তাটা কমে গিয়েছিল বাপনবাবুর। যিনি উপকার করেন, তাঁর নামে নাম রাখাই যায়। কিন্তু কৌতূহলটার নিষ্পত্তি তো হয়ই নি, উল্টে ক্রমাগত খচখচ করতেই থাকত। কে এই ভদ্রলোক? কোথাকার? এমন অদ্ভুত নাম কেন? কী করেছিলেন তিনি, যে একেবারে নাম রাখার মতো সম্মান পেয়েছেন? আর-কেউ না জানুক, বাপনবাবু জানেন, এই তীব্র কৌতূহলই তাঁর সময়যান নিয়ে গবেষণা বেছে নেওয়ার একটা বড় কারণ। মনে মনে চাইতেন, যে-কোনওভাবে গবেষণায় সফল হতেই হবে। সময়যান বানিয়ে, অতীতে ফিরে গিয়ে দেখতেই হবে সেই ঘটনা। চিনে নিতে হবে সেই রহস্যময় নামের অধিকারী ভদ্রলোককে। বাপনবাবুর বাবা বাপনবাবুর ছাত্রাবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন, ফলে বড় হয়ে যাওয়ার পর, ভয় কাটার পর যে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে, সে পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে হাতে রয়ে গিয়েছিল শুধু পেন্সিল… থুড়ি, সময়ঘড়ি।

আজ, সময়ঘড়িটা কবজিতে বাঁধতে বাঁধতে তাই আপন মনে হাসছিলেন বাপনবাবু। এতদিনে তাঁর কৌতূহলের নিষ্পত্তি হতে চলেছে। গত কয়েকদিন টুকরো-টুকরো এদিক ওদিক করে দেখে নিয়েছেন, দিব্যি কাজ করছে তাঁর যন্ত্র। তিরাশির ক্রিকেট বিশ্বকাপের খবর রেডিওতে শুনেছেন, আবার দুহাজার তেত্রিশের বেহালা মেট্রোর সমাপ্তিও দেখে এসেছেন। এখন শুধু একটাই কাজ বাকি – চলো হাসপাতাল! ইতিমধ্যে বার্থ সার্টিফিকেট ইত্যাদি দেখে এবং মাতৃদেবীর সহায়তায় কোন হাসপাতালে কখন তিনি তাঁর ক্ষণজন্মা মগজ সহ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, তার হিসেব করে ফেলেছেন। সুতরাং সেই জায়গায় পৌঁছে, নিরিবিলি একটা কোণ দেখে দাঁড়িয়ে, সব ঠিকঠাক অ্যাডজাস্ট করে যন্ত্রের বোতাম টিপতে কোনো সমস্যাই হলো না। পাক্কা আধঘন্টা কাজ করে এই যন্ত্র – জন্মমুহূর্তকে মাঝখানে রেখে তাই এদিকে পনেরো ওদিকে পনেরো মিনিট সময় সেট করে নিয়েছেন তিনি। নিশ্চিন্ত।

কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঝিরঝিরে ডিসটর্শনের পরে যন্ত্রের কাঁটা স্থির হলো। চারদিকে তাকিয়ে বাপনবাবু দেখলেন, হাসপাতাল চত্বরে অনেক বেশি গাছ আর কম ভিড়, তিন-চারটের বদলে একটাই বিল্ডিং, দেওয়ালে অন্য রঙ, ল্যাম্পপোস্টে অন্য দলের পতাকা! স্বস্তিবোধ করে দ্রুত পা চালালেন। লেবার রুমটা তখনও একই ছিল কী? দেখে নিতে হবে।
সময়ের আগেই দোতলার লম্বা করিডরের মাঝামাঝি লেবার রুমটা পেয়ে গেলেন তিনি। একটু আড়ালে থেকে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন সবকিছু। লেবার রুমের সামনেই কাঠের লম্বা বেঞ্চিতে বসে রয়েছেন মাত্র একজন – বাপনবাবুর বাবা। মুখেচোখে টেনশন। অনেকদিন পর বাবাকে দেখে চোখ চিকচিক করে উঠল বাপনবাবুর একটু। যতই রাগী হোন, বড় ভালোবাসতেন।

একটু পরেই লেবার রুম থেকে বেরিয়ে এলো নার্স। খবর দিল, ছেলে হয়েছে। বাপনবাবুর বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলে প্রায় নাচতে নাচতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন কোথায়। মনটা বেশ খুশি-খুশি হয়ে উঠলেও বাপনবাবুর চিন্তাও যে হচ্ছিল না, এমন না। আর মিনিটদশেক বাকি।
ভাবতে না ভাবতেই উল্টোদিক থেকে একটা চাদরমোড়া ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখলেন বাপনবাবু। সারা গায়ে, এমনকি মুখেও চাদর জড়ানো ভালো করে, শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। তবুও দূর থেকে বাপনবাবু বুঝতে পারলেন, না, চিনা-জাপানি নন, বাঙালি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সন্তর্পণে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে আসছে লোকটা। বাপনবাবুও আড়ালে আড়ালে থেকেই আর একটু এগিয়ে গেলেন। এইবার কিছু একটা হবে।

আর-একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে লেবার-রুমের দরজায় আলতো টোকা দিল লোকটা। বেরিয়ে এল সেই নার্স। ফিসফিস করে বলল, লোকটা চলে গিয়েছে? দেখেছ?
চাদরমোড়া লোকটা বলল, হ্যাঁ, মিষ্টি কিনতে দৌড়েছে দেখলাম। পাঁচ মিনিটের আগে আসবে না।

তারপর… বাপনবাবু বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেই নার্স ভেতর থেকে যে-কাপড়মোড়া জিনিসটা লোকটার হাতে চালান করল, সেটা একটা সদ্যোজাত শিশু! বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল লোকটা!

আতঙ্কিত বাপনবাবু স্থানকালপাত্র ভুলে দৌড়ে গেলেন। লোকটাকে এক হ্যাঁচকা টানে ঘুরে দাঁড় করিয়েই বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিলেন, আর তার সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার। লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই রইল, তারপর উল্টোদিকে দৌড় দিতে যেতেই বুদ্ধি করে বাপনবাবু ওই অবস্থাতেই ল্যাঙ মারলেন একটা। দেখার মতো একটা বৃত্তচাপ এঁকে আছড়ে পড়ল লোকটা।

ইতিমধ্যে চেঁচামেচি শুনে কিছু লোক ওপরে উঠে আসছে করিডরের দুদিক থেকেই। তারাই ধরে ফেলল লোকটাকে। তাদের কথাবার্তা থেকেই বোঝা গেল, এই হাসপাতালে ছেলেচুরি হচ্ছিল ইদানীং। এতদিনে ধরা গেল ব্যাটাকে।
গোলমাল, গণধোলাই আর নার্সকে খিস্তি, হুমকির মধ্যেই ফিরে এলেন বাপনবাবুর বাবা। সব শুনে আর-একবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বাপনবাবু এতকিছুর মধ্যে প্রায় ভেবলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু চোখের সামনেটা ঝিরঝির করে কেঁপে উঠতেই বুঝলেন, গোলমালের মধ্যেই কখন যেন সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। ফিরতে হবে।

বাপনবাবুর বাবা তখন হাত ধরে রেখেছেন চেপে। আর বলছেন, আপনার কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম… কিভাবে এ ঋণ শোধ করব বলুন…! আপনি কে দাদা… দেবদূত? বলুন…?
বাপনবাবু কোনোমতে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রবল ডিস্টর্শনের মধ্যে শুধু বলতে পারলেন… আমি… আমি আসি…

★ ★ ★ ★ ★

ফিরে আসার পর সবচেয়ে বড় সমস্যাটার সমাধান হলেও একটা খচখচে কাঁটা তবুও রয়েই গেল। ছোট্ট, তবু কাঁটাই।

পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে নিজেই নিজেকে কোলে নেওয়ার দুর্লভ অভিজ্ঞতার পরও সেসব না ভেবে বাপনবাবু অন্য একটা কথা ভেবে যাচ্ছিলেন। ভেবেই যাচ্ছিলেন।

বাবাকে সেদিন কী বলেছিলেন তিনি? আমি আসি, না নিজের নামটা? আমিয়াসি?
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিছুতেই না।

~~~♣~~~

লেখক ~ সুশ্রুত চক্রবর্তী