পাঠকের চোখে ~ প্রিন্স দ্বারকানাথ

Anirban & Arijit, Book Review, Reviews, পাঠকের চোখে, বাংলা

এই লেখাটা বই-রিভিউ, নাকি পাঠ প্রতিক্রিয়া, সেই নিয়ে আমার নিজেরই দ্বিমত আছে। কোনও একটা বই পড়া শেষ করে এরকম অনুভূতি আমার আগে হয়নি, তাই মনে হল সকলের সাথে এই অভিজ্ঞতা শেয়ার না করলে কয়েকটা মানুষের প্রতি অবিচার করা হবে।

|| কেন কিনলাম এই বই? ||

বর্তমান লেখকদের মধ্যে রাজা ভট্টাচার্য দার নাম জানে না এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া শক্ত। আমরা যারা এখন কিঞ্চিৎ লেখালেখি করার চেষ্টা করি, তাদের এই পথ দেখিয়েছেন রাজা দা আর তারপরে অভীক সরকার দা। বেশ কিছুটা সময় বিদেশে থাকার দরুণ নতুন নতুন বাংলা বইগুলোর লোভনীয় বিবরণ আর কভার দেখেই নিজেকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ফেবু তে “ভারতবর্ষ”-র অংশবিশেষ পড়ে বিদেশে থাকাকালীনই সেটা পড়বার ইচ্ছে সত্ত্বেও কিছু কারণে তা হয়ে ওঠেনি। তাই মনস্থ করলাম দেশে ফিরেই আগে রাজা ভট্টাচার্যের লেখা “প্রিন্স দ্বারকানাথ” আর “চলাচল” পড়ব, তারপর “ভারতবর্ষ” সিরিজ। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। বইচই.কম থেকে অর্ডার করার একদিনের মধ্যেই সুন্দর প্যাকেজে চলে এল বই দুখানা। এই সূত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রথম অর্ডারেই প্রেমে পড়ে গেলাম এই অনলাইন বইয়ের দোকানের, এবার ফ্লিপকার্টের ন্যায় একটা সুদীর্ঘ শপিং হিস্ট্রি তৈরি করার প্ল্যান রইল এই সাইটেও।

|| প্রথম দেখা আর স্পর্শ ||

পার্সোনালি বই এর সুন্দর গেট আপ আর কভার আমাকে বরাবর হাতছানি দেয়। অনলাইনে অবশ্য স্পর্শ বা পাতা উলটে দেখার সুযোগ না পাওয়া গেলেও এই বইয়ের ক্ষেত্রে ঠকলাম না। পেপারব্যাক বইয়ের এত মজবুত বাঁধাই আর মোটা কভার আমি কোনও বাংলা বইতে কমই দেখেছি। কভারের নতুন সাইড ফোল্ডিং ট্রেন্ড টা আমার খুব পছন্দের, এতে কোণগুলো মুড়ে যায় না, বা মলাট দিয়েও পড়তে হয় না। সুব্রত রায়ের ডিজাইনে কভারের ছবি বেশ ছিমছাম, দ্বারকানাথের আউটলাইন স্কেচ দেখে সম্ভ্রম জাগে মনে। সাধারণত বইয়ের দোকানে হাতে বই নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেই আমরা মাঝের একটা পাতা খুলি। সুন্দর পরিস্কার ফন্ট আর ঝকঝকে পাতা, এই দুটো জিনিস পড়ার ইচ্ছেটাকেও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। খোয়াবনামার এই বই প্রথমবার হাতে নিয়েই কিন্তু ঠিক এমনই একটা ফিলগুড এল। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই Raja Podder দার। এই প্রকাশনীর আরও বই পড়ার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল।

|| শুরুতেই আকর্ষণ ||

“খুব যত্ন করে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বহুবর্ণ জীবনকে মুছে দিয়েছিলেন তাঁর উত্তরপুরুষেরা।”

এই লাইন পড়ার পর বইটা হাত থেকে নামাবার আগে আপনি দুবার ভাববেন। এর থেকে যথারীতি “কেন” প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, আর এই বইও আপনাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবে নিজের সাথে যতক্ষণ না আপনি শেষ করে উঠছেন। প্রথমেই রাজা দার লেখা ভূমিকা আপনার এই অভিযানে কিক স্টার্ট দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

“যেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস শুরু হয় বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব কে দিয়েই। বহু যত্নে রচনা করা হয়েছে এক মায়াজাল। বাধ্য হয়েই আমাদের ভুলে যেতে হয় সেই মানুষটিকে – যাঁর স্পর্শ রয়ে গেছে ১৮১৫ থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে চলা সমস্ত মহান কর্মে।”

লেখক চেয়েছেন এই বিস্মৃত রাজপুত্র “দ্বারকানাথ” মানুষটাকে স্পর্শ করতে। আর তাঁকে কেন্দ্র করে সাবলীল ভাবে এঁকেছেন সেই সময়ের কলকাতার পটচিত্র আর সাথে যোগসূত্র তৈরি করেছেন আর এক মহাপুরুষের সঙ্গেও।

“ওই যে, কলকাতার ঘুটঘুটে অন্ধকার বড় রাস্তা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দে ছুটে আসছে দ্বারকানাথের গাড়ি। ঘোড়ার পায়ের শব্দে গরাণের ঝোপে লুকোচ্ছে শেয়াল আর বাঘরোল, সরে দাঁড়াচ্ছে হাড়গিলে। চলুন, তাঁর পিছু নেওয়া যাক।”

এভাবেই শুরু হয়েছে প্রিন্স দ্বারকানাথের জীবনের পিছু নেওয়া অনুসন্ধিৎসু এক লেখকের অপূর্ব লেখনীর কাজ।

|| এ শুধু জীবনী নয় ||

এই বইকে শুধু জীবনী বললে খুবই বড় ভুল হবে। সাধারণত জীবনী বা বায়োগ্রাফি বললেই মনে পড়ে রসহীন প্রবন্ধের আকারে লেখা কোনও মহাপুরুষের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবনের বর্ণনা। অনেকসময় তাতে উদ্ধৃত থাকে সমকালীন আরও কিছু মনিষীর সেই মহাপুরুষকে নিয়ে লেখা গুণগান বা সমালোচনা।

এই বই উপরোক্ত কোনও ক্যাটেগরিতেই পড়ে না। বরং এখানে আপনি ছোট্ট দ্বারকার সাথে প্রথমেই ঢুকে পড়বেন ওর নিজের ঘরে যেখানে ও রাতে বিছানায় শুয়ে দাসীর মুখে রাজপুত্র-রাজকন্যা-সোনার কাঠি-রূপার কাঠির গল্প শুনতে শুনতেও ঘুমায় না। কারণ সে বিশ্বাস করে “গল্প ভালো লাগলে তো বরং বালকদের জেগে থাকা উচিৎ, যাতে গল্পের শেষে কি ঘটবে তা জানা যায়।”

এই দ্বারকা কলকাতা দেখতে চায়, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির কঠোর নিয়মের মধ্যে বাধা পড়েও কিভাবে সেই পথ খুঁজে নেওয়ার আকুল চেষ্টা করতে থাকে, তা আমরা বুঝতে পারি যখন পাঠশালায় তার পাশে গিয়ে আমরা বসি, বা বাবার হাত ধরে যখন সে শিক্ষকের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, তখন তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে। এখানেই এই বইয়ের সার্থকতা, পড়তে পড়তে কখন যে সেই পুরনো কলকাতায় চলে যেতে হয় বোঝাই যায় না। পড়বার পরেও সেই রেশ রয়ে যায়।

তবে ঘটনার মোড় ঘোরে যখন দ্বারকা বড় হতে শুরু করে। তার বিচক্ষণতা ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় মেলে যখন তাকে শুনতে হয়, “ইউ আর নেভার গোইং টু শেয়ার দিজ উইথ এনিবডি এলস্ – আরন’ট ইউ! অর আই’ল কিল ইউ!” এইসময়ে এক নতুন দ্বারকা কে আমরা পাই, যাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে, যার কথা আরও জানতে ইচ্ছে করে।

এই বই আপনি একটানা পড়তে চাইলে আনুমানিক ৪ ঘন্টায় শেষ করে ফেলতে পারেন। আমি একটু রসিয়ে রসিয়ে পড়ি, সেই অনুপাতে আপনার সময় হিসেব করে নেবেন। আমি চেয়েছিলাম একদিনেই শেষ করতে, কারণ একবার শুরু করলে আর রাখতে মন চাইবে না, এই গ্যারান্টি দিলাম।

|| কিছু সাজেশন ||

বইটার সম্বন্ধে সব ভালো ভালো কথা লিখলে পাঠকের বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। তাই এবার সেইদিক গুলোর উল্লেখ করছি যাতে আর একটু দৃষ্টি দেওয়া যেত বলে আমার মনে হয়।

বইয়ের বেশ কিছু জায়গায় প্রিন্টিং মিসটেক চোখে পড়ল। এতে বানান ভুল, শব্দ মিস, বা শব্দ রিপিট সবই পেলাম। যদিও সেগুলো সহজেই উপেক্ষা করা যায় এমন দুর্দান্ত কন্টেন্টের জন্য, তবুও আরও নিখুঁত কাজ হবে ভবিষ্যতে এই আশা ও বিশ্বাস রইল।

বইটা পড়ার পর দ্বারকানাথ নিয়ে আরও জানতে মন চায়। যদিও এটা প্রথম পর্ব, এবং আরও দুই পর্ব প্রকাশিত হবে, তবুও তথ্যসূত্র দেওয়া থাকলে আগ্রহী পাঠকরা আরও উপকৃত হতেন বলে মনে হল।

|| বইয়ের ডিটেলস ||

নাম ~ প্রিন্স দ্বারকানাথ – পরাধীন দেশের এক রাজপুত্র
লেখক ~ রাজা ভট্টাচার্য
প্রকাশক ~ রাজা পোদ্দার (খোয়াবনামা)
মূল্য ~ ২২৫/- টাকা (প্রিন্টেড)
প্রকাশ ~ কলকাতা বইমেলা, ২০১৮

সবশেষে আমার ধন্যবাদ ও প্রণাম জানাই দুই রাজা দা কেই। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইলাম “রাজায় রাজায় সন্ধি” তে আরও নতুন নতুন বই প্রকাশের। 🙂

~~~♣~~~

© অরিজিৎ গাঙ্গুলি