প্রবাসী বাঙালির রোজনামচা

Durgapuja, Friends, Humor, Listicles, Nostalgia, Satire, বাংলা

ইয়াত্রিয়া কৃপায়া ধ্যান দে, পুনে সে কলকাতা জানেওয়ালি গো-এয়ার কি ফ্লাইট ৪৫ মিনিটস দের মে রাওয়ানা হোঙ্গি

এন্ড আই ওয়াস লাইক “হোয়াট দা…..,আমার সাথেই কেন এমন হয়!!”

পুনে এসেছি এক বছর পেরোলো, আপ্স এন্ড ডাউন্স সব জায়গাতেই আছে, থাকে এবং থাকবেও…কিন্তু এই জায়গাটার সব ভালো থাকা সত্ত্বেও, এই মিসম্যানেজমেন্টটা আর নিতে পারছি না…

অগত্যা ল্যাপটপ খুলে লাউঞ্জে বসলাম, লাউঞ্জ বলা ভুল…এটা মালেশিয়া বা ব্যাঙ্গালোরের এয়ারপোর্ট নয় যে এইচএসবিসি র কার্ড খ্যাচাত করে টেনে গ্যান্ডেপিণ্ডে গিলে পেট আর মন এর সুখ করে “ব্যাউউপ” করে একটা ঢেকুর সমেত নোয়াপাতিটায় হাত বোলাতে বোলাতে বোর্ডিং লাইনে গিয়ে দাঁড়াবো..

লোকজনকে গালি দেওয়া হেব্বি সহজ জানেন তো দাদা, খালি নিজের ওপরে যে যখন পড়ে, তখনই ফেটে চৌচির হয় আর কি….তো এরকমই ফাটা চৌচির দিল কে টুকরো সে নিকলা চান্দ্ আলফাজ –

“Bengali Probasi and their lifestyle”

১. বিদেশ হোক বা স্বদেশ, ফার্স্ট যেটা একটা বঙ্গপুঙ্গব করে বাইরে এসে সেটা হলো খোঁজ করা যে সেখানে বাঙালি খাবার কোথায় পাওয়া যাবে? কলকাতায় থাকতে হয়তো জীবনে লোইট্টা মাছের ঝুরি বা লাউচিংড়ি বা ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর-শাক মুখেও তুলতো না, এখন এখানে এসে এইসব খাবার চাই ই চাই, সে তার দাম সাড়ে তিনশ টাকা প্লেট হলেও চলবে, আরে নাহলে #মিসিং-কলকাতা-সিনড্রোম ওয়ালা ইনস্টাগ্রামে ছবি আসবে কি করে?

২. নতুন জায়গা, নতুন অফিস, নতুন ডেস্ক…আর সেই ডেস্কে যদি আসে পাশে কোনো একটা বাঙ্গালি পেয়ে যায়, ব্যাস…মানে ধরুন চোখে পড়লো একটা ডেস্ক যাতে লেখা “পৌলমি ঘোষ” – এবং সে তখন ডেস্কে নেই ধরুন, শুরু হয়ে গেলো “রোমিং ফ্রি” ….ফাইনালি তিনি এলেন এবং সাথে সাথে “এই তুমি বাঙালি”?? অ্যাজ ইফ জাস্ট বাঙালি বলে তুমি তার সাথে এই ভিনদেশে শোওয়ার পারমিশন চাইছো…..(তবে একেবারে এটা হয় না তা নয়, সেম জায়গা থেকে এসে, সেম অফিস, কমন ইন্টারেস্ট, শুক্রবার ১:১ পেগ 100 পাইপার্স..অনেক সময় ক্লিক করেও যায়!)

৩. সব জায়গায় গিয়ে আইদার কলকাতার নামে উচ্ছসিত প্রশংসা(পেটে দু পাত্তর পড়লে) অর, কলকাতার মা মাসি উদ্ধার করা (ঐটা না পড়লে)….বুইলেন কিনা!! ও বুঝলেন না?? দাঁড়ান….
সকালে ব্রেকফাস্ট সারার সময় যখন সিঙ্গারা /ওয়ারা পাও/ মিশেল পাও/ রাওয়া দোসা থাকে এস অপসন্স, তখন “ওয়ারা, বালের জায়গা, কতদিন কচুরি জিলিপি খাইনা ভাই, চল পাতা ফেলে কলকাতা যাই, এক্সেনচারে গুচ্ছ লোক নিচ্ছে”
আর তার ঠিক পরেই ফোন টা বেজে ওঠে “ভাই, সিভি টা তোর জিমেলে পাঠালাম, একটু দেখ ভাই….১০ বছরে ৮.৫ প্যাকেজে আর চলে বল?? ছেলে টাও বড় হচ্ছে….”
হ্যাঁ-হুঁ করে ফোন রেখে, সিগারেট টা ফেলে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে স্বগতক্তি – “ভালো আছি বাঁড়া, অ্যাট লিস্ট কলকাতার এইচ আর দের “টেকেন ফর গ্রান্টেড” এর ছেনালি র হোয়ারলপুলে তো ঘুরছি না”

৪. চলে এলেন সেভেন্থ ফ্লোরে অফিসের ডেস্ক এ, এক কলিগ এসে বললো “ইয়ার আজ মেরে বেটে কা বার্থডে হ্যায়, সাম কো আজানা” -আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে বউকে ফোনে বলা হয়ে গেল আজ ডিনার বাইরে, তোমরা খেয়ে নিও. ঠিক সময়ে পৌছে, কেক-ফেক কাটা হলো, একটা থার্মোকল এর বাটিতে খানিক টা সেও(পাতি গাটি চানাচুর) আর একটা করে লাড্ডু দিয়ে গেল সেই কলিগ..ওই মুখমিষ্টি ভেবে টপাস করে খেয়ে নিলেন, আর তার আধ ঘন্টার মধ্যেই ধপাস করে স্বপ্নভঙ্গ….না না চেয়ার থেকে নয়, সেই বউ কে বলা “বাইরে ডিনার” এর এক্সপেক্টাসন থেকে যখন দেখলেন , সবাই গুড নাইট, “কালজী ঘ্যা” (টেক কেয়ার এর মারাঠি ভার্সন) বলে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন আপনি বুঝলেন এখানে অনুষ্ঠান বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়ানোর কনসেপ্টই নেই…
লজ্জায় বাড়ি ফিরে জল খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়া ছাড়া গতি আছে তখন? খালি পেটে বউ এর চাটন টা হজম হতো না আর।

৫. সব চেয়ে মারাত্নক হলো DPD – না না বাঙালির দীঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, এটা হলো “দুর্গা-পূজা-ডিসঅর্ডার”- ইউএস বা ইউকে যে থাকলে তো ছেড়েই দিন, কারণ ওখানে যেটা হয় সেটা পুজো নয়, কোনো তিথি-নক্ষত্রের বালাই নেই, কোনো একটা ঠাকুর মশাই কে ধরে কোন একটা “উইকেন্ড” এ জাস্ট নমো নমো করে যা হোক একটা করে আল্টিমেটলি সিঙ্গেলমল্ট নিয়ে হালকা করে বসে যাওয়া।আর কলকাতার বাইরে হলে, মানে ধরুন ব্যাঙ্গালোরে বা হায়দ্রাবাদ বা পুনে এইসব জায়গায় আবার অন্য সিন্। দুটো বাঙালির দেখা হলো কি না হলো ” চলো একটা দুর্গাপুজো নামাই ” – যেন একটা ফ্লিপকার্ট সেলে ফোন কেনা আর কি, বললাম আর নেমে গেলো। ….
আরো আছে , এখানে সব যারা বহু বছর ধরে কলকাতার বাইরে তারা মোটামুটি একটা “উত্তরায়ণ বঙ্গীয় সমিতি” গোছের কোনো একটা “বং কেলাবের ” সেক্রেটারি – প্রত্যেকেই “দাদা” এবং কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না – দুর্গা পুজোর মিটিংয়ে মোটামুটি খণ্ডযুদ্ধ লেগে যায় তবে শেষমেশ একটা পুজোর ফিল পাওয়া যায় বটে – কিন্তু আদতে তো বাঙালি নিন্দা করার স্বভাব যাবে কোথায় ? দুপুরবেলা দুশো টাকার কুপনে খিচুড়ি বাঁধাকপি চাটনি পেঁদিয়ে “নাঃ ঠিক জমলো না, চাটনি টায় মিষ্টি বেশি ছিল, বাঁধাকপির বাঁধন টা ঠিক হয়নি, পরের বার সিওর কলকাতায় যাবো পুজোয় ”

৬. মেদিনীপুরের “টুম্পা” (আশা করি টুম্পার ফুল ফর্ম টা আপনারা জানেন – তাও একবার বলে দি – টিপিকাল আনকালচার্ড মেদিনিপুরিয়ান পিপলস এসোসিয়েসন), সবে দু বছর হলো নিউ ইয়র্কে গেছে -নিজেকে প্রবাসী বাঙালি বলা চাই অথচ কলকাতায় ফিরে এসে –
– পুজো মণ্ডপে ভোগের লাইনে দাঁড়িয়ে সীতাভোগ চিনতে পারে না, বিস্ময় বালক হয়ে প্রশ্ন করে “হোয়াট ইস দিস হোয়াইট হোয়াইট ? ”
– প্যাকেজড মিনারেল ওয়াটার ছাড়া চলে না
– বিস্কুট আর লজেন্স? – ওঃ ইউ মিন কুকিস এন্ড ক্যান্ডিস রাইট ?
– ইন্ডিয়ার সব খারাপ ইউএসের সব ভালো – কি করে মানুষ এই পলিউশনে বেঁচে আছে
– মালবোরো লাইটস পৃথিবীর একমাত্র সিগারেট (অথচ ইউ এস যাওয়ার আগে ধার দেনা করে উইলস ফ্লেক পেলে বর্তে যেত)

সর্বোপরি যেকোনো আলোচনা শুরু করার আগে এটা বলবেই ” হোয়েন আই ওয়াস ইন ইউএস…..”

৭. কলকাতা/ পশ্চিমবঙ্গে থাকার সময়ে দুর্গাপুজোর ভাসানে নাচ তো দূরের কথা, দশমীর দিন প্যান্ডেল থেকে শ হাত দূরে থাকত যাতে পাড়ার স্লিভলেস ব্লাউস পড়া মোটা মোটা কাকিমা জেঠিমা রা এসে এথিক্স আর বাঙালি সভ্যতা সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা হয়ে মাকে না লাগাতে পারে “তোমার ছেলে তো মদ খেয়ে নাচছিল”, সেই ছেলের আমূল পরিবর্তন হয় প্রবাসী হলে – এরকম ও দেখা গেছে চেন্নাই এর পোঙ্গাল বা মহারাষ্ট্রের গণপতি তে ফুল টুল্লু হয়ে জামার কলারের কোনা দাঁতে কামড়ে উত্তাল নাচছে – নিজেকে “সেকুলার” দেখানোর হিডেন এট্ট্রিবিউট কিনা সেটা অবশ্য জানা যায়নি

৮. নিজের ছেলে মেয়েকে ভর্তি করেছে শহরের “অন্যতম” বিজনেস স্কুলে ক্লাস ওয়ান এ (বিজনেস স্কুল মানে আবার এম-বি-এ ভাববেন না যেন )- স্কুলের নাম ধরুন “গার্ডেন হাইট্স ” – আর ট্যাগ লাইন হলো “এখানে যত্ন সহকারে আপনার সেভিংস এবং আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের পেছন মারা হয়” – সেখানে বেশিরভাগ বাচ্চা ই অবাঙালি ফর অবভিয়াস রিসন, সেখানে কোনো বাঙালি কালচার ও নেই, কেউ বাংলায় কথাও বলে না, সোজা কথায় বাংলার নামগন্ধ ও নেই দূর দূর পর্যন্ত – এই অব্দি ঠিক আছে কিন্তু আপনি “প্রবাসী বাঙালি” – ছেলে বাংলা পড়তে বলতে বুঝতে পারুক বা না পারুক , এপার্টমেন্ট এর বাঙালি এসোসিয়েশন এর কালচারাল ইভেন্টে সন্তান কে “রুট” সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করার জন্য আপনি ইংরেজি ফন্টে প্রিন্ট করা বাংলা গান ধরিয়ে দিলেন – ভাবলেন ছেলেকে আমার হেবি বাঙালি বানালাম – এটা বুঝলেন না যে আপনার সন্তান কিন্তু ওটাকেও একটা জাস্ট “সাবজেক্ট ” হিসেবেই দেখলো – সংস্কৃতি হিসেবে নয়। .. এবার আপনি বলবেন কলকাতার বাইরে বাঙালি স্কুল কোথায় পাবো ? সঠিক কথা – তাহলে বেকার ওই বছর মাসে একদিন “মুক্তির মন্দির” না করিয়ে বাড়িতে বাংলায় কথা বলা, বাংলা লেখা পড়তে শেখা, কেউ বাংলায় কথা বললে বাংলায় উত্তর দেওয়া এগুলো ও শেখান।.

পি এস : যারা ব্যতিক্রমী তারা আবার এটা পড়ে “হারেরেরে ” করে ছুটে আসবেন না যেন, এরকম ঘটনা প্রচুর আছে সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন লেখক

৯. কিছু বাঙালি আছে যারা থাকে হয়তো ভুবনেশ্বরে যেটা কিনা কলকাতা থেকে ৬-৭ ঘন্টার রাস্তা, অথচ নিজেকে ভাবে “এন -আর -আই” – এদের কাছে হাওড়া স্টেশন হলো মাছের বাজার আর শিয়ালদা হলো ব্যাকটেরিয়ার আড়ত তাই এরা ফ্লাইটে ট্র্যাভেল করে – বিভিন্ন অছিলায় সারা বছর টাকা উড়িয়ে পুজোতেও কলকাতা আসে না আর দোহাই দেয় “ফ্লাইটের যা ভাড়া কি করে যাবো ?” আর সারা পুজোয় নানা রকম সেন্টি ভরা পোস্টে ফেসবুক ভরিয়ে দেয় -শুরু হয় মহালয়ার ইউটিউব দিয়ে ,তারপর “আজ ষষ্ঠী তাও তোর অফিস” ঘুরে দশমীতে দুগ্গাঠাকুরের সিঁদুর মাখা মুখ এর একটা হাই কোয়ালিটি ছবি গুগল থেকে ঝেড়ে ক্যাপশন দেয় “এবারো যাওয়া হলোনা, এবারেও ঘরে ফেরা হলো না ” আর সেই ছবি তে সবার সমবেদনা কুড়িয়ে অনাবিল আনন্দ পায়

১০. ওই দেখো , আসল কথা টাই তো বললাম না – প্রত্যেক বাঙালি কে কখনো না কখনো এইটা শুনতেই হয় হয় কলকাতার বাইরে এলে –
“এ তুম লোগ জল ভি ‘খাতে’ হো , রাইস ভি ‘খাতে’ হো , ওল্ড মনক ভি ‘খাতে’ হো …… তুম লোগ পিতে কুছ নেহি কেয়া” তারপর একটা অট্টহাসি – এদের জন্য সব প্রবাসী বাঙালি দের বলি , ইগ্নোর করুন – যারা চাপাটি দিয়ে শুকনো গুঁড়ো কে চাটনি হিসেবে খায় আর বছরের পর বছর কারিপাতা আর নারকেল তেল দিয়ে ইডলি-সাম্বার-বড়া খেয়ে জীবন কাটায় তাদের অওকাদ নেই আমাদের খাওয়া পড়া নিয়ে হাসাহাসি করার – বুক ঠুকে জল মদ বিরিয়ানি সব “খেয়ে” যান

জয় বাংলা !! জয় বাঙালি !! জয় প্রবাসী বাঙালি !!

~~~♥~~~

© ছন্দক চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ – ইন্টারনেট