কলকাতার শীত

Friends, Nostalgia, আদতে আনাড়ি, বাংলা

বাঙালি শীতচাতক। অর্থাৎ শীতকাল কবে আসবে সে জিজ্ঞাসা তার কথা, কলম আর কীবোর্ডে সতত বিদ্যতে। পুজো সেপ্টেম্বরেই হোক না কেন, কোজাগরী থেকে বাঙালির ‘ঠান্ডা’বোধ হতে থাকে। ভোরের কুয়াশাঘেরা চায়ের দোকানে অথবা অফিসফেরত পাড়ার মোড়ের টুপটাপ হিমপড়া আড্ডায়, একজন থাকবেই যে বলে উঠবে, “এবার কিন্তু বেশ ঠান্ডা পড়বে, দেখে নিস!” বাঙালির এই শীতপ্রীতি কিংবা অবসেশন হেমন্তকে বাজার থেকে ভ্যানিশ করে দিয়েছে। দুর্গাপুজো বাদ দিলে শরৎ এরও প্রয়োজন নেই বিশেষ। তবে কদাচিৎ কোন কোন বছর শীত সত্যিই পড়ে বৈকি। এই ঘটনাটা সেরম একটা, একদশকের বেশি পুরোন মরশুমের। পুজো ছিল অক্টোবরের শেষাশেষি, কোজাগরী খাস নভেম্বর। কলেজে তখন পুজোর ছুটি থাকত ভাইফোঁটা অব্দি। কিন্তু একটা আর্জেন্ট নোটিস আসায়, অনেকটা হটাৎ করেই সেবার ক্লাস শুরু হয়ে গেল। কলকাতা ঢুকতেই শঙ্খ র ফোন। “তুই কি বাড়ি থেকে এসে গেছিস?” আমি ‘হ্যাঁ’ বলতে ফোনটা হাতবদল হয়ে গেল। ওপাশ থেকে কাকিমা বললেন, “বিকেলে চলে এসো। আর রাত্রে খেয়ে যাবে।” আমি স্বভাবতই, “না না কাকিমা, আজ কেন! আমি তো যেতেই থাকি।”, বলে টলে ভদ্রতা রক্ষার চেষ্টা করছি। কাকিমা এবার বেশি কথার মধ্যে গেলেন না, “আজ লক্ষীপুজো, অবশ্যই আসবে।” বলে ফোন শঙ্খকে দিয়ে দিলেন। শঙ্খ মুখের কাছে রিসিভারটা চেপে ধরে বলল, “শোন, সপ্তক আর তন্ময়কে নিয়ে চলে আয়, ওদেরও বলেছি। আর হ্যাঁ এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক।”
#সপ্তর্ষি_বোস

গাঙ্গুলিবাগান স্টেট ব্যাংকের পাশ দিয়ে শ’খানেক মিটার ভেতরে একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের উল্টো ফুটে ছিল শঙ্খদের বাড়িটা। স্কুল, বাড়ি দুই’ই পুরোনো। বাড়ির নিচেটা দোকান আর গোডাউন। ওর দাদুর করে যাওয়া হার্ডওয়্যার বিজনেস। এখনও এলাকায় একনম্বর। দোতলায় থাকে শঙ্খ, ওর বাবা-মা। তিনতলাটা আমাদের। অর্থাৎ আমরা, শঙ্খর বন্ধুরা দখল করে থাকি প্রায়শই। কারনে অকারনে, নেশাতে তর্কে, ফুটবল ক্রিকেট, সঅঅব।
সপ্তক আসবে উল্টোদিক থেকে। আমি আর তন্ময় যখন সুলেখা মোড় থেকে অটো ধরলাম তখন বাতাসে হেমন্ত বিলি কাটছে। সুকান্ত সেতুর নীচ দিয়ে শেয়ালদা ছেড়ে আসা গাঢ় সবুজ ট্রেনটা গতি বাড়াচ্ছে দ্রুত আর অল্প অল্প করে মিশে যাচ্ছে জমাট একটা ধোঁয়া আর আবছা কুয়াশার ভেতর। তিনতলায় আজ পুজো তাই ছাদে উঠলাম সবাই মিলে। আর সেখানেই সারাদিনে প্রথম টের পেলাম খাস কলকাতার এই বাসবহুল পাড়াতেও, হাওয়াটা কেমন বদলে গেছে ক’দিনেই। আজন্ম শহরে লালিত তন্ময় উচ্চারিল অমোঘ বাণী, “শীতটা এবার ভালোই নাববে” ! জিন্দেগীতে কোনদিন কারো কথা মুখবুজে মেনে নেবে, শঙ্খ সে বান্দা নয়। তাই যথারীতি বলল, “তোর মাথা! দিস ইস দি ওয়ারমেস্ট ইয়ার অফ দ্য ডিকেড সেটা জানা আছে? তাছাড়া এখানে ঠান্ডা আর কোথায়, খানিকটা ওই তোদের বাড়ির ওদিকে।” শেষ কথাটা আমার দিকে চেয়ে। আমি কিছু বলবার আগেই সপ্তক বলে উঠল, “তাহলে আমার ওখানে কি বলবি ?” কিছু বলার নেই সত্যিই। আমার রাঢ়বাংলায় ঠান্ডা যথেষ্টই কিন্তু সপ্তকের বাড়ি নর্থবেঙ্গল। শিলিগুড়িতে ওর বাড়ি এবং মা-বাবার উচ্চস্তরের সরকারি পোস্টিং।
– “তা বটে।”, একবাক্যে স্বীকার করলাম আমি। একটু থেমে সপ্তক বলল, “গত বছর তো আমি নিউ ইয়ারে গিয়ে দেখি মা জলের বটলগুলো মাইক্রোওয়েভে দিয়েছে।”

আমরা কী ঠিক শুনলাম!

– “বোতলের ভেতর সব জল জমে বরফ কিনা।”, একগাল হেসে বলল সপ্তক।

তন্ময় শুনলাম বিড়বিড় করছে, “বোতলের জল জমে বরফ! নরওয়ে টরওয়ে তে …”। আর শঙ্খ, নিভন্ত সিগ্রেটটা সজোরে ছুঁড়ে ফেলে, ততধিক জলন্ত দৃষ্টিতে সপ্তকের দিকে চেয়ে বলল, “শিলিগুড়ির বদলে শিমলা পৌঁছে যাসনি তো ভাই?”
পুজো, ভোগ আর পুজো স্পেশাল ডিনার করে যখন বেরোলাম ঘড়ি বলছে রাত দশটা। শঙ্খও আমাদের সাথে অটো স্ট্যান্ড অব্দি। সোজা রাস্তায় দূরত্ব কম, তাই আড্ডাটা দীর্ঘায়ু করতে ঘুরপথ নিলাম। মাঝে মধ্যে একটা দুটো বাইক বাদ দিলে রাস্তা খালিই বলা চলে। এদিকটা ফাঁকা একটু, একটা মাঠের পাশ দিয়ে। হাওয়ার মিঠে হিমেল আমেজ টি শার্টের নীচে বেশ টের পাচ্ছি। সামনে তন্ময় আর শঙ্খ হেঁটে যাচ্ছে আর পিছনে সপ্তকের সাথে আমি। তন্ময়ের আগ্রহ ভেহিকল্স নিয়ে। অত্যাধুনিক সব মেশিনারি, বিশেষত যানবাহন ওর পছন্দের তালিকায়। আজও কিসব সাইক্ল, লকহেড বকবক করছে। আমি সপ্তককে বলছিলাম সামনেই শাহরুখের দিওয়ালি রিলিজ নিয়ে। হঠাৎ সপ্তক এগিয়ে গেল খানিকটা, তন্ময়ের কাঁধে হাতটা বেশ আয়েশ করে রেখে বলল, “লকহেড এর সাইকেল নিয়ে কি বলছিলিস?” শঙ্খ খিঁচিয়ে উঠলো, “লাইফ এ দেখেছিস কোনদিন?”

-“চালিয়েছি।” সংক্ষেপিত জবাব।

তন্ময় কি একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল কারন শঙ্খ আবার জিজ্ঞেস করেছে, “ক’টা গিয়ার থাকে জানা আছে, চালিয়াতি মারছিস?”

-“বিশ্বাস করলি না?”

তন্ময় পিছনে চলে এল এবার, দুটো হাত পাশাপাশি রেখে ঘুড়ির লাটাই ঘোরানোর ভঙ্গি করল দেখলুম। অর্থাৎ সপ্তক গল্পের সুতো ছাড়ছে আর ও সেটা গোটাচ্ছে। তখন নন-স্মার্টফোন এর যুগ। হাতের মোবাইলে গুগল খোলা তো দূর, আমাদের মধ্যে সবার ডেস্কটপেও ইন্টারনেট ছিল না। আর তাই রাস্তাঘাটে বন্ধুদের মধ্যে বহতা বিভিন্ন কথা, দাবিদাওয়া শুধু তর্ক করে খন্ডন করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য আর তা না করতে পারলে তখনকার মত, পাংশুমুখে মেনে নেওয়া একমাত্র বিধেয়।

-“কী রে, ক’টা গিয়ার বললিনা যে।”, আবার বললো শঙ্খ।

-“শোন, বাইসাইকলে ক’টা গিয়ার বলে কিছু হয়না, গিয়ার রেশিও হয়। দ্যাট ডিপেন্ডস অন চেনরিংস। আমারটার চেনরিংস ছিল চারটে আর গিয়ার রেশিও বত্রিশখানা।”

যা তা ব্যাপার। নট ইউসুয়াল উইথ সপ্তক। শঙ্খ অবিশ্বাসী মুখে তাকিয়ে আছে কিন্তু ওর চোখেও সংশয়। স্বভাবলাজুক তন্ময় ফিক করে হেসে ফেলল। সপ্তক পাত্তা দিল না। মৃদুভাষী তন্ময় তবু বলল, “কোত্থেকে কেনা? শিলিগুড়িতে পাওয়া যায়!”

-“না। ইমপোর্টেড।” সুখটান দিতে দিতে বলল সপ্তক।

-তোদের বাড়িতে হ্যাঙার আছে?

-মানে?

-মানে, প্লেন রাখার জায়গা আছে?

“আমাদের কি আলুর চপ পেয়েছিস?”, আসরে নামল শঙ্খ, “শিলিগুড়িতে জল যেদিন জমে বরফ হবে লকহিড সেদিন সাইক্ল বানাবে! কারন ওরা ফাইটার প্লেন বানাবার কোম্পানি, ইউ এস আর্মির কন্ট্রাক্টেড। যত্তসব গাঁজাখুরি গল্প।”
তন্ময় হাসতে হাসতে আমার কাঁধটা ধরে ফেলল বাঁহাত দিয়ে, বলল, “আমরা কথা বলছিলাম লকহিডের একটা টারবাইনের সাইক্ল স্পিড নিয়ে, তাই বলে তুই ওদের বাইসাইকল কিনে ফেলবি!”

উফফ, বোতলের জল খাবার জন্যে মাইক্রোওয়েভ! ছেলেটা কী যাচ্ছেতাই গল্প বানায় মাইরি! আমি তন্ময় আর শঙ্খ হাসছি, রীতিমত পাড়া কাঁপিয়ে।

সপ্তক উদাসীন, নিবিষ্টমনে চিন্তা করে চলেছে কিছু। রাস্তার ওপারে গিয়ে সবার জন্য মিন্ট কিনে আনল। তারপর বলল, “লকহিড নামের জন্য কনফিউশনটা হল। ডেনমার্কের লগারহেড ছিল আমার সাইকলটা। দেড় লাখ দাম, কোম্পানি উপহার পাঠায়। ওদের মালিক বাবার ছোটবেলার বন্ধু কিনা।”!!!

~~♠~~

লেখক ~ সপ্তর্ষি বোস
#স্মৃতির_বারান্দা