শীতের সকাল

Anirban & Arijit, Humor, Nostalgia, আদতে আনাড়ি, বাংলা

ভূমিকা ~

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। হেমন্তের অবসানে ঋতুরঙ্গের নিয়মে এসে পড়ে শীতের ধূসর বার্ধক্য। শীতের সকালে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনে উৎসবের….

ওহ্ “শীত”! বুল “শীত”!

মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি আর কচি খোকা নই। ভূমিকা উপসংহারের বেড়াজালে শীতের সকাল, গ্রীষ্মের দুপুর বা বর্ষনমুখর রাত্রিকে আর বেঁধে রাখতে পারি না। বারো নম্বরের রচনায় শূণ্য পেলেও খুশি, কিন্তু শীতকালকে নতুন ভাবে চিনেছি অনেক বছর ধরে, তাই আজ একটা ট্রাই নিচ্ছি ছোটবেলার সেই রচনাটাকে একটু “আনাড়ি” স্টাইলে লিখতে। লেপ জড়িয়ে বসলাম।

||

আমাদের কলকাতায় শীতের একটা সংজ্ঞা আছে। ঠান্ডা যেমনই থাকুক, হাওয়া যেভাবেই দিক, আবহাওয়া সমাচারে তাপমাত্রা কুড়ির নিচে নামলেই মাঙ্কি ক্যাপ আর মাফলার জড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ো। এটা সিম্পলি আসন্ন শীতকালকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, “বস, আর কেউ বুঝতে পারুক না পারুক, আমি ধরে ফেলেছি যে তুমি লুকিয়ে আছ আশেপাশেই, চলে এস কুইক, নয়তো সবাইকে জানিয়ে দেব যে আজ সূচক উনিশ পয়েন্ট তিন, এল শীতের রুক্ষ শুষ্ক দিন।”

ছোটবেলায় কালীপুজো শেষ হলেই হালকা একটা রোমান্টিক ঠান্ডা হাওয়া চলা শুরু হত। পাড়ার মোড়ে টিং টিং বেল বাজিয়ে চলে আসত কাশ্মীরি শালওয়ালা। সাইকেলের ক্যারিয়ারে থাকত একটা জাম্বো সাইজের পুঁটলি বিছানার চাদর দিয়ে বাঁধা। বাড়ির বেল বাজিয়ে বলত, “জম্মু সে বড়িয়া বড়িয়া শল লায়া হুঁ মাইজি, দেখে লিন, কিনতে হবে না।” ব্যস, আমার দয়ালু ঠাম্মা ওমনি “অনেক দূর থেকে এসেছে রে ছেলেটা, ডাক ভেতরে, একটু জলবাতাসা খেয়ে যাক” বলে ফাঁদে পা দিত, আর কাশ্মীরি বেচুবাবু এক ঘন্টার সেলস স্পিচে আমার হাতে একটা আখরোট ধরিয়ে তিনটে শাল আর একটা লোমশ জ্যাকেট বেচে দিয়ে ধাঁ হয়ে যেত৷ আমি তারপর সারাদিন ধরে দরজার গোড়ায় আখরোট ভাঙার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। লাস্টে ছাদের পাঁচিলে রেখে হাতুড়ির বারি মারতেই গোটা আখরোটটাই সুড়ুত করে ফসকে গিয়ে পাশের ছাদে ল্যান্ড করত।

মনের দুঃখে আমি ছাদের রোদে বিছিয়ে রাখা লেপ কম্বলের ওপর কমলালেবু আর টেস্ট পেপার নিয়ে বসে পড়তাম। টেস্ট পেপারের সাথে শীতকালের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রোদে পিঠ রেখে এক ঘন্টার মধ্যে “কমলা গার্লস স্কুল” সল্ভ করার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল কিন্তু। তার মধ্যেই আমার আবার পার্সোনাল একটা অপ্সরা কেস ছিল, যিনি নিজে থেকে আমার ধ্যানভঙ্গ করার চেষ্টা না করলেও আমার দুষ্টু ধ্যান মাঝে মাঝেই চলে যেত পাশের বাড়ির ছাদে। মিষ্টি হাসির দুষ্টুমিতে, ভালোই লাগত সাড়া দিতে!

আমাদের পাড়ায় খুব ফেমাস দোকান নন্দদার। ক্রিস্টমাস আর নিউ ইয়ার এলেই দোকানে আর নন্দদাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরো দোকানটাই ঢেকে যায় গ্রিটিংস কার্ডে। বিভিন্ন কার্ডের ফাঁকে লুকিয়ে থাকে নন্দদা, আর সারাদিন ধরে আবদার মেটায় নব্য প্রেমিক প্রেমিকাদের। আমাদের ছোটবেলাতেও কিন্তু এই প্রথাটা একইরকম ছিল। ফেসবুক অর্কুটের বালাই ছিল না। তাই আট আনা বা এক টাকার একটা পুঁচকে কার্ডেই মেসেজ আদান প্রদান করা যেত৷ তারপর বেরলো মিউজিকাল কার্ড। খুলতেই জিঙ্গল বেল বাজতে শুরু করত টুঁই টুঁই করে। এরপর সেই জুরাসিক পার্কের ছোট্ট একটা ডাইনো রেগে গিয়ে পাখনা মেলে দেওয়ার মতো কার্ড বাজারে ছেয়ে গেল। কোনোটা খুললেই তাজমহল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, কোনোটা খুলতেই শাহরুখ করিনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ছে, আবার বন্ধ করলেই দুজনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ছে। আমার জন্মদিনে একটা কাকু এইরকম একটা কার্ড দিয়েছিল। দেখতে মালটা ছোট ছিল, কিন্তু খুলতে গেলেই বাপি সবাইকে সাবধান করে বলে দিত সরে বসতে, কারণ খুললেই ছাতার মতো আকার নিত সেটা।

কার্ড দেওয়া নেওয়া নিয়েও তখন কোচিংগুলোতে বেশ ভালো রগড় চলত। কোনও উঠতি কপোতী হয়তো বায়োলজির ব্যাচে তার থেকে সাত আটজন দূরে বসা কপোতকে দেওয়ার জন্য পাস করেছে কার্ডটা। সেই পাসিং রুটে যাওয়াকালীন আমরাও সবাই কার্ডটা খুলে “ফ্রম” এর জায়গায় সাইন করে দিতাম। ফাইনালি কপোতের হাতে সেটা পৌঁছলে তাকে প্রশ্ন করা হত, “বল দেখি তোকে এটা কে দিয়েছে?” সে ক্ষেপে গিয়ে উত্তর দিত, “ভাগ্যশ্রীর ভাগ্য ভালো ছিল যে তোরা ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া-তে কবুতর ছিলিস না!”

আর্চিসের কার্ডের দাম দেখলেই মনে হত এক টাকার সাদা কার্ড কিনে চুমকি মেরে দিলেই শালা ল্যাঠা চুকে যায়। প্রেমিকা “আর্চিস” থেকে আর প্রেমিক “যুগছন্দম স্টেশনারিস” থেকে কার্ড কিনে দিলেই আমরা বুঝে যেতাম যে এ প্রেম হয় মেলোড্রামাটিক সেন্টু মার্কা হবে, নয়তো খুব শিগগিরি মাঝে একটা ত্রিকোণ তৈরি হবে৷ কাউকে অসম্মান না করেই বলছি, হতোও ঠিক তাই! এগুলো অনুমান নয়, নির্ভেজাল অভিজ্ঞতা ছিল।

বাকি পাঁচ ঋতুতে বাপুজি আর ফেরিনি কেক চিবিয়ে বেরানো বাঙালিকে ক্রিস্টমাসের লোভ দেখিয়ে দিল অভিজাত ফ্লুরিস, নাহুমস আর ক্যাথলিন। তবে আমার নাগাল ছিল “জলযোগ” অবধি। বাপুজিও পিছু ছাড়ল না। এই মোচ্ছবে একখানা পেল্লাই সবুজ গোল কৌটোতে নিয়ে এল ওদের ক্রিস্টমাস কেক। বড়দিনের পর সেই কৌটোতে ঠাম্মা মশলা রাখত। তবে আমার সবচেয়ে ফেভারিট ছিল বাপির অফিসের ক্যান্টিন থেকে আনা একটা ইঁটের আকারের কেক। ওহ্, সে কী স্বাদ, প্রত্যেক কামড়ের ৭০% জুড়ে থাকত একটা ইয়াব্বড় মিঠাই,,বাকিটা থাকত কাজু কিসমিস অ্যামন্ড। আমি যত বড় হতে লাগলাম, কেকটার সাইজ তত ছোট হতে লাগল, কিন্তু দামে কোনও পরিবর্তন হয়নি আজ পর্যন্ত! ওই কেকটা পেটে না পড়লে আমার বড়দিন শুরুই হত না। আজও এই লন্ডনে বসেও খুব মিস করি ওই ফ্রুটকেকটা!

আজকাল “মিও আ মরণের” রিচ প্লাম কেক, পুওর ডান্ডি কেক, এগলেস হৃদয়লেস কেকের হাতছানি দেখলে মনে হয় বাপুজিই ঠিক বলেছিলেন,

“নিজেকে পালটাও, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।”

যতই কেক থাকুক, খোসাওয়ালা নতুন আলুর তরকারি দিয়ে কড়াইশুঁটির কচুরি না খেলে শীতের সকাল রচনা লেখাই যায় না। কচুরির তরকারিতে আলুর খোসা কেটে বাদ দেওয়া, আর জয়নগরের মোয়ার মাথা থেকে কাজু কিসমিস তুলে নেওয়া – দুটোই সমান অপরাধ! এর একটাই শাস্তি। তিলের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মার! ডোজ বেশি পড়ে গেলে ক্ষতস্থানে খেজুড় গুড়ের হালকা প্রলেপ, ব্যস।

খেয়ে মজা আছে কিন্তু শীতকালে। সবাই বলত ঠান্ডায় নাকি চেহারা বাড়ে। আমার বাড়েনি কস্মিনকালেও। স্নানে অনীহার একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ ছিল। আমার দিদা বেশ ঘাঁটাঘাটি করত মেটেরিয়া মেডিকা নিয়ে, উনিই দিয়েছিলেন আমাকে খেতে। ছোটবেলায় চানে ফাঁকি দেওয়ার হরেক উপায় ছিল আমার কাছে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার চালিয়ে রেখে দিতাম সাউন্ড এফেক্টের জন্য। তারপর মাথায় জলের হাত বুলিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে এলেই মা ভাবত ছেলেটার চান সারা। মা বারবার বলত যে একবার সাহস করে চান করে নিলে ঠান্ডা নাকি কম লাগে। তখন শুনিনি, তবে আজ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাপমাত্রা মাইনাসে নেমে গেলেও চান ছাড়া এখন আর থাকতে পারি না। আসলে রক্ত বেশ গরম এখন। তাই লীন তাপকে বিলীন করতে চানই একমাত্র উপায়। তবে শীত এলে ছোটবেলা ভেতরে একটা সাদা গেঞ্জি পরে নিতাম যেটা গলা দিয়ে উঁকি মারত। আর সোয়েটার জ্যাকেট পরে নিয়ে আমার প্যাংলা বডিটাকেই কেত মারার জন্য মোটামুটি অ্যাডজাস্ট করিয়ে নিতাম। কেউ পটেনি। না না সত্যি, কেউ না! তবে বয়েই গেল। জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে স্কুলের বন্ধুদের সাথে ঠিক করতাম বড়দিনে চিড়িয়াখানা ঘুরে ভিক্টোরিয়া হয়ে চার্চে যাব। চিড়িয়াখানা গিয়ে লাইনের শেষ খুঁজতে খুঁজতে একবালপুর ক্রস করে বেহালার কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। রণে ভঙ্গ দিয়ে বাস ধরে ভিক্টোরিয়া চলে আসতাম ওখান থেকে। সেখানে নেমে দেখি ভিড়ের ঠেলায় ভিক্টোরিয়ার মাথার পরীটা জাস্ট হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে মাঠের দিকে। চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, লেকের ধারে কে? ঝোপ নড়ছে, গাছ নড়ছে, কী দিন এল বে!

চার্চে যে যাব ওখান থেকে, ভেতরে চিন্তা শুরু হয়ে গেছে যে বাড়ি ফিরব কীভাবে! বাস লরি টেম্পো ভর্তি করে লোক আসছে তখনও। জাস্ট ভিক্টোরিয়ার সামনে এনে উপুড় করে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার পরের লট আনতে। বাঙালিকে দুর্গাপুজা, ঈদ, বড়দিন যাহোক কিছু একটা দিয়ে দাও, ঠিক রাস্তায় নেমে মাতিয়ে দেবে। এদিকে ভিক্টোরিয়ার নিজের দেশে এসে দেখি পুরো উলটো কেস। ক্রিস্টমাসের দিন সব দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় একটাও লোক নেই। সবাই নাকি বাড়িতে বসে ফ্যামিলির সাথে এই দিন উদযাপন করে। বোঝো কাণ্ড! তবে মিল একটা আছে। এরা টার্কির দোকানে লাইন দেয়, আমরা মুরগীর দোকানে।

যীশুদিবসের পরেই নববর্ষের হাতছানি। সারাবছরের সারাংশ নিয়ে খবরের কাগজ বেরতো একটা তার আগে। সাথে ফাউ হিসেবে থাকত “আসুন দেখে নি কেমন যাবে আপনার সামনের বছর”। নিজের ভাগ্যরাশি জানতাম না। তাই মায়ের তুলারাশিই ফলো করতাম। কারণ, মায়ের রাশিফল দেখলেই কিছুটা আন্দাজ করে নিতে পারতাম নিজেরটা। যেমন, “বছরের শুরুতে বিদেশ ভ্রমণ” লেখা থাকলে বুঝে যেতাম দীঘা বা পুরীর প্ল্যান চলছে। “বছরের শেষভাগে সন্তানের কৃতকর্মে গ্লানিবোধ” – এটা দেখলেই মনে হত নির্ঘাত আমার প্রেমকাহিনী নিয়ে কেস খেতে চলেছি, সব জানাজানি হয়ে যাবে এবার।

ছোটবেলায় একত্রিশের রাত্রিগুলো বরাদ্দ থাকত টিভির জন্য। দূরদর্শনে জাভেদ জাফরির পাগলামো শুরু হত রাত দশটা থেকে। যশপাল ভাট্টির ফ্লপ শো দিয়ে ঠিক বারোটার আগে কাউন্টডাউন শুরু হত। বারোটা বাজলেই আমরা সাহারা কাপের সময় বেঁচে যাওয়া চকোলেট বোমগুলো দিতাম ফাটিয়ে। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার, হাপ্পি নিউ ইয়ার বলে পরেরদিন গলা শুকিয়ে ফেলার পালা। প্রথম সাতদিন তারিখ লিখতে ভুল হওয়ার মধ্যেই নতুন বছরকে আপন করে নিতাম।

ফার্স্ট জানুয়ারিতে একবারই শুধু পার্ক স্ট্রীট গেছিলাম। তখন সদ্য কলেজে ঢুকেছি। হালকা ডানা গজিয়েছে। দুতিনটে বন্ধু মিলে ঢুকলাম ট্রিঙ্কাসে। হালকা নীলাভ আলোর মাদকতায় একটা কোণের টেবিলে জমিয়ে বসলাম তিনজনে মিলে। দুজন বন্ধুর মধ্যে একজন আমার সেকশনেরই। অন্যজন আলাদা ডিপার্টমেন্টের। প্রথম আলাপ সেইদিনই হল। আর বন্ধুটি পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বার করে দেখালো। হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম। না না গাঁজার প্যাকেট ছিল না। সিগারেটেরও নয়। আমি গোবেচারা মানুষ। প্যাকেটের বস্তুটা কী ছিল সেটা ধরতে পারলেও কনফার্ম হতে আমার আরও এক ঘন্টা লাগল, যখন ট্রিঙ্কাস থেকে বাইরে বেরিয়ে সেই বন্ধুটা একজন হঠাৎ এসে মিট করা বান্ধবীর কাঁধে হাত রেখে আমাদের ফেলে রেখে তার সঙ্গেই চলে গেল। যাওয়ার আগে আমার কানে কানে বলে গেল, “হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল যাচ্ছি ভাই, রুম আগেই বুক করা আছে। তৈরি থাকতে শেখ এইভাবে।”
আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, আর আমার পাশের বন্ধুটা একবার হাঁক দিয়ে তার চলে যাওয়া বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, “তনিমা ফোন করে তোর খোঁজ নিলে কী বলব শালা?” রাস্তার ওপার থেকে উত্তর এল, “ফোন ধরিস না, সিম্পল। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার…..”

~~~♦~~~

© অরিজিৎ গাঙ্গুলি