বিগত বসন্তের চিঠিরা

Childhood, Friends, Love Story, Nostalgia, Short Story, Story, উড়ো চিঠির লেটারবক্স, বাংলা

একসময় প্রায়ই বিকেলে দরজার তলার চিলতে ফাঁক দিয়ে গলে চলে আসত চিঠিপত্র। যাঁরা সে চিঠি দিয়ে যেতেন তাঁদের সাথে আলাপ হয়নি কোনদিন। কবি সুকান্তর কবিতা আর হেমন্ত মুখার্জীর গান শুনে শুনে ধারণা হয়েছিল বেশ লালচে ফতুয়া, খাটো ধুতিকোমরে দড়িতে ঘন্টা, বাদামী বিশাল ঝোলা নিয়ে এক প্রৌঢ় আরাত্রিদিন ছুটে ছুটে এই সব চিঠি বয়ে নিয়ে এসেছেন (আমার কল্পনায় তার মুখ খানা কেন জানি বাংলা সিনেমার অনিল চ্যাটার্জীর মত !)। রানার রানার ছুটেছে রানার.. ভাবলেই কেমন রোমাঞ্চ হত। চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখতাম .. না জানি কত গল্প লেগে আছে আনাচে কানাচে। হলদেটে পোস্ট কার্ড, কালো স্ট্যাম্প মারা বাঘ বা সিংহের মুখ।শ্রীচরণেষু , আমরা সকলে কুশলে আছি‘ –র গৎ খানা সে সময় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কেন জানি চিঠি সবাই সাধুভাষাতে ই লিখত। খুব গোপনীয় কথা হলে আসত হালকা নীল ইনল্যান্ড লেটার। বহুদিন পর্যন্ত সেটা ইংল্যান্ড লেটার বলেই জানতাম। বয়ঃকনিষ্ঠ পিসতুতো বোনকে বিজ্ঞের মত বুঝিয়েও ছিলাম, ‘ওমা জানিস না ওগুলো ইংল্যান্ড থেকে আসে‘! সে বেচারী আমাকে বেশ সমীহ করেই চলত। হাজার হোক আমি দিন রাত্তির বই পড়তুম কিনা! স্বল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী র সে আর কি জানে!

একটু বড় হতেই চিঠির প্রতি টান টের পেলাম। চিরকালের মুখচোরা কিনা, দুঃখ পেলে হাসি, ভীষণ রাগে চোখে জল আর আনন্দে শুধু বুকের মধ্যে প্রজাপতি। কে বুঝবে! কার দায়! চিঠি সহজ। যা প্রাণ চায় লিখে দাও, তক্ষুনি মোকাবিলার প্রয়োজন ও নেই। যখন প্রয়োজন পড়বে আরো কিছু সুন্দর শব্দের ধোঁয়াশায় লিখে ফেল কঠিন প্রশ্নের কঠিনতর উত্তর। চিঠির দায় নেই দায়িত্ব আছে।

আমাদের স্কুলবেলায় এ বেঞ্চি ও বেঞ্চি চিঠি চালাচালি বিরল ছিল না। ক্লাস চলাকালীন কত অবিরল কল্পনা, কত জরুরি বৈঠক, কত হাসিচাপা হাস্যরস আদান প্রদান হয়ে যেত তার মর্ম ছাত্র মাত্রেই জানে। এখনকার sms এর পূর্বসুরী তারা। রাফখাতার ফাঁকে ফাঁকে আবেগসিক্ত হিজিবিজি সেইসব এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে।

তারপর এলো প্রেম পত্রের কৈশোর। টইটুম্বুর আবেগ। হৃদয় হাতের মুঠোয় নিয়ে চলা। এলোমেলো বানানে ততোধিক এলোমেলো অনুভুতি। সামঞ্জষ্যের দায় নেই।আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা গড়িব না ধরণীতে‘-র সম্পাদ্য। সেইসব ভুলে ভরা নীলচে কাগজ সুগন্ধি হাস্নুহানার মত রাত বিরেতে হানা দিত। মনে হত আমি ঈশ্বর জাতীয়। দু এক আঁচড়ে লিখতে পারি ইতিহাস। চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখা যায় সেই কদম ফুলের মেঘ্দূত। তোলা আছে তারা আমার চন্দন কাঠের বাক্সে। আর আমার চিঠিরা! আছে কোথাও কারো অবচেতনের ঈর্ষা বা অহংকার হয়ে।

আমার চিঠির পাট চুকে গেছে সেই কলেজ জীবনেই। গোলাপী আর্চিস এর কাগজ আর সুগন্ধি কলম কেনার টিউশানি টা পাবার বেশ কিছুদিন পর, আনাড়ি কাব্য লেখার বয়সে। সেসব সময়ে সবাই বোধায় একটু আধটু কবি হয়। হতে হয়। নইলে আকাশী শার্ট আচমকা লম্বা তামাটে রং স্বপ্ন স্বপ্ন চোখ ছেলেটার দিকে সোজা চোখে তাকানো যায় না। তাকালে বুকের ভিতর ভোমরার হুলে বিষ চারিয়ে যায় শিরায় উপশিরায়। তখন কবিতা জন্মায়। কি নেশা যেবিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে..’। রোজ সারাদিন বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় উদগ্রীব চোখাচোখির পর বাড়ি ফিরে লিখতে বসা। আলগোছে খাতা বিনিময়। তারপর সেই প্রেম গঙ্গার ধারে বা রবীন্দ্র সদনের সিঁড়িতে পৌঁছে দিতে পারলেই চিঠির দায়িত্ব শেষ। তখনকার কানে কানে গুঞ্জরণ চিঠির অতীত। তদুপরি সেটা সবে মিসড কলের যুগ। ১৪০ অক্ষরে মনের কথা ধরিয়ে ফেলার যুগের সেই শুরু। তারপর চিঠিরা বুড়ো হয়ে গেল চোখের সামনে। কুঁজো হয়ে গেল। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। পোস্ট কার্ড ইনল্যান্ড লেটার থেকে আর্চিস পেপার রোজসবাই এক মুহূর্তে অবান্তর হয়ে গেল। রেকর্ড প্লেয়ারের মত, সাদা কালো টিভির এন্টেনার মত, ক্রস কানেকশনের মত, ছোটকালের অনাবিল সারল্যের মত চিঠিরাও..নেই। অথচ যখন ছিল তখন তার চেয়ে মহার্ঘ্য আর কিছু ছিল না। রাতবিরেতের দোলাচল, তীব্র প্রেম, আকাঙ্খা, নিকোটিন একাকারে ছিল। ভাগ্যিস ছিল। তাই এখনো ছুঁয়ে দেখতে পারি আমার বাসন্তিক অভিসার। থাক আমার পুরনো খাতার ফাঁকে সেই আশ্চর্য প্রদীপ। সেই থরথর আকাঙ্খার শব্দরূপ।হাজারো খোয়াহিশে এয়সি কি হর খোয়াইশ পে দম নিকলে.. বহত নিকলে মেরে আরমান ফিরভি কম নিকলে।

 

~~~^^^~~~

~সুজনা কবিরাজ