পাঠকের চোখে – শ্রীজাতর উপন্যাস “বৃক্ষ অনুবাদক”

Book Review, Reviews, পাঠকের চোখে

উপন্যাস ~ বৃক্ষ অনুবাদক

লেখক ~ শ্রীজাত

প্রকাশ ~ শারদীয় দেশ ১৪২৬

রিভিউ লিখলেন তানিয়া সিংহ রায়

এমন কিছু লেখা থাকে যা পড়লে মনে হয় ভাগ্যিস জন্মেছিলাম, ভাগ্যিস সাহিত্য পড়তে শিখেছিলাম, তাই তো এমন মানবজীবন ধন্য হলো। যা পড়লে মনে হয় আর কিচ্ছু না পড়লেও খুব ক্ষতি হয়ে যায় না। যা পড়ার পর মনে হয় আবার কবে এমন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হবে এবং যা পড়ার পর মনে হবে এমন লেখার যথার্থ মূল্যায়ন করার জন্য নিজের কাছে শব্দ বড়ই সীমিত। শারদীয় দেশ (১৪২৬) পত্রিকায় বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাকার শ্রীজাত রচিত “বৃক্ষ অনুবাদক” উপন্যাসটি সেই লেখা যা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলি এক অমোঘ সত্য — ” ইউ ক্যান নট ট্রান্সলেট এভরিথিং “। আমরা কোনোকিছুকেই তার প্রকৃত স্বরূপে অন্যের সামনে তুলে ধরতে পারি না। সাহিত্য, শিল্প, কী মানুষের ভাবনা — কোনো কিছুই তার প্রকৃত সত্তা বা বিস্তার নিয়ে সম্পূর্ণভাবে অন্যের কাছে চেনা হয়ে উঠতে পারে না। তাদের বুঝে নিতে গিয়ে আসলে আমরা তাদের অনুবাদই করে ফেলি। এই উপন্যাসেরও পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা আসলে একধরনের অক্ষম অনুবাদ যা পাঠকের পাঠ ভাবনাকে এবং লেখকের সাহিত্যভাবনাটিকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারবে না।

উপন্যাসের একুশটি অধ্যায়ে রয়েছে দুটি সমান্তরাল আখ্যান। বিশিষ্ট অনুবাদক প্রফেসর ব্রাইট যিনি অ্যালাঝাইমার্স রুগী হিসেবে নিজের আরেকটি পরিচয় তৈরি করেন। সমগ্র উপন্যাসে প্রফেসর ব্রাইটের অনন্য এক ভাবনা পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে যার মাধ্যমে শ্রীজাত আমাদের সামনে খুলে দিচ্ছেন অন্য রকম এক ভাবনার জগতের সিংহ দরজা।
উপন্যাসের আরেকটি আখ্যান নির্মিত হয়েছে কোলকাতার ছেলে সম্যক ও কেমব্রিজের শিক্ষিকা ক্যারলের হে ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ এবং সেই সুযোগে তাদের নিজেদের পারস্পরিক ভাবনার আদানপ্রদান যা একসময় তাদের আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলবে।

প্রফেসর ব্রাইটের মাধ্যমে শ্রীজাত তাঁর অনবদ্য আত্মভাবনাটি উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের যে অনুবাদ হয়ে আসছে তা আসলে ব্যর্থ অনুবাদ। লেখকের ভাষায়,—

“অনুবাদ বলে আসলে কিচ্ছু হয় না কারণ সব কিছুই অনুবাদ”।

” কেবল সাহিত্য, ভাষার চিরকালের ক্রীতদাস, সে টেনে নিয়ে এসেছে এই ভাঁওতাকে। অনুবাদ। ভাষান্তর।”

“মিকেলাঞ্জেলোর ডেভিড।দেখেছ সামনে থেকে?…আশ্চর্য কাজ। কিন্তু সে কি সম্পূর্ণ মৌলিক? যাকে আমরা মিকেলাঞ্জেলোর মৌলিক কাজ বলে ভাবছি তা আসলে ওঁর করা অনুবাদ। পাথরের ভাষায়”।
” মৌলিক বলে কিছু নেই। থাকতে পারেনা…।সমস্তটা অনুবাদ…আমরা আসলে এক বিরাট অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে বেঁচে আছি,যার নাম পৃথিবী”।

এভাবেই এক আশ্চর্য ভাবনার জগতে টেনে নিয়ে যান শ্রীজাত আমাদের,নতুন করে ভাবতে শেখান। তাঁর ভাবানো ভাবনায় আমাদেরও মনে হয় সত্যিই “মৌলিক আসলে বহমান,অস্থায়ী। অনুবাদই স্থির,চিরকালীন।” নতুন এক বোধের জন্ম হয় পাঠকের অন্তরে।

উপন্যাসের আরেক দিকে আমরা মিশে যেতে দেখি পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই কবিকে— জীবনানন্দ ও সিলভিয়া প্লাথ। সম্যক প্লাথের অনুবাদ করে যোগ দেয় হে ফেস্টিভ্যালে যেখানে তার সঙ্গে বলার জন্য রাখা হয়েছে ক্যারলে যিনি করেছেন জীবনানন্দের অনুবাদ। সম্যক ক্যরলকে জিজ্ঞাসা করে — ” তুমি জীবনানন্দকে আবিষ্কার করলে কীভাবে?” এর উত্তর আমরা সহসা পাইনা। লেখক অপূর্ব এক মুন্সীয়ানায় এই অংশটিকে রচনা করেছেন। সম্যকের দ্বারা সাতবার জিজ্ঞাসিত হয়েছে এটি। প্রতি প্রশ্নের পরই লেখক উপন্যাসকে বয়ে যেতে দিয়েছেন পারিপার্শ্বিক বর্ণনায়। ক্যারলের উত্তর পাওয়ার আগে পাঠককেও অপেক্ষা করতে হবে। এ অপেক্ষা জীবনানন্দকে আবিষ্কারের অপেক্ষা। জীবনানন্দ এক বিস্ময়। তাঁকে খুঁজে পাওয়া এক আবিষ্কারই। আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে এক নিরালায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায় কবিতাপ্রেমীদের কাছে। ক্যারলও তাই উত্তর দেয়,— ” যেভাবে অনেক দূরের রাস্তা পার করে মোটেলে রাত কাটাতে আসা মানুষ হঠাৎ বিছানা আবিষ্কার করে।”

এগিয়ে চলে উপন্যাস। প্রফেসর ব্রাইট আমাদের ভাবতে শেখায় আমরা কীভাবে নিজের মত করে অনুবাদ করে ভুল করে ফেলি। চারপাশের সমস্ত কিছুকে নিজের মত ভেবে ফেলে আসলে আমরা তার অনুবাদই করে ফেলি যা কিনা এক মস্ত ভুল। তাই কোনো সাহিত্য, শিল্পেরই অনুবাদ হয় না।

ওদিকে ক্যারল সম্যকের সামনে এক জরুরী আলো ফেলে। যে আলোয় শ্রীজাত বর্তমানের এক অদ্ভুত আঁধার কাটাতে চেয়েছেন। মানুষ শিল্পীকে তাঁর জীবনের সাথে এক করে দেখে ফেলে। শিল্পীর যদি অকালমৃত্যু হয় তবে তাঁর সেই আশ্চর্য জীবন মহত্বের মাপকাঠি হয় পাঠকের কাছে। ক্যারলকে দিয়ে শ্রীজাত বলাচ্ছেন,— মিথ হয়ে উঠতে গেলে কি শিল্পসৃষ্টিই যথেষ্ট নয়? কিন্তু খেয়াল করে দেখবে, কখনও এঁদের মৃত্যুর থেকে শিল্পকে আলাদা করে দেখা হয় না।… পারলে সেটা থেকে বেরিয়ে এসে এঁদের লেখার দিকে,এঁদের আঁকার দিকে একবার সোজা চোখে তাকিও সম্যক, দে ডিজার্ভ এন আনবায়াসড লুক।”

শ্রীজাতর উপন্যাসটির ভাষা আঙ্গিকে একে কাব্যোপন্যাস বলা যেতে পারে। আসলে আদ্যন্ত একজন কবি যখন গদ্যের লেখনী তুলে নেন তখন তাঁর সেই গদ্যে কাব্যের সুললিত ছন্দটি যে থাকবেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। গদ্য থেকে কবিতা এবং কোথায় কবিতা থেকে গদ্য এ উপন্যাস — তার সীমারেখা খুব অস্পষ্ট। সম্যক ও তাঁর স্পিচ চলে যাওয়া বাবার কথোপকথনের অংশ তুলে দিয়ে বিষয়টি দেখানো যেতে পারে,—

“সম্যক ফোন কানে ধরল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর চুপ করে থাকল।

তারপর ফোন কেটে দিল।”
এই কথোপকথনের বিন্যাস ও লেখার সজ্জায় বুঝে যাই ফাঁকা অংশগুলি আসলে তার বাবার প্রত্যুত্তর। পড়তে পড়তে পাঠক আবিষ্ট হবে,পাতা বন্ধ করে চোখ বুজে ভাববে আর ভাববে।
উপন্যাসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে দুজনের আলাপচারিতা আছে যেখানে চরিত্রের নাম না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয়না সমস্ত উপন্যাসে মাত্র একবার আসা সেই চরিত্রদ্বয় কারা এবং তাঁদেরই একজনের মাধ্যমে শ্রীজাত বুঝিয়ে দেন তাঁর কাছে নেই উপন্যাস আর কবিতার ফারাক–” কোনটার মধ্যে আছি, ঠিক ঠাহর করতে পারি না।”

সমগ্র উপন্যাসটিই আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবিয়ে যেতেই থাকে। নামকরণটি নিয়েও ভাবনার পরিসর আছে। “বৃক্ষ অনুবাদক” শিরোনামে রয়েছে এক শব্দাতীত ব্যঞ্জনা। চারপাশের জগতকে নিজের মত করে ভেবে নেওয়া আসলে এক অনুবাদই। আবার সাহিত্যের অনুবাদ করাও আসলে অনুবাদের অনুবাদ করা হয়। প্রফেসর ব্রাইট একজন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং প্রখ্যাত অনুবাদক যাঁর অনুবাদক হিসাবে জগৎব্যাপী সুখ্যাতি এবং যিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনুভব করেন তাঁর কৃত সমস্ত অনুবাদই আসলে মস্ত ভুল। শিক্ষিত সভ্য সমাজকে এভাবে তিনি ভাঁওতা দিয়েছেন কারণ তিনি মনে করেন অনুবাদ আসলে কিছুই না। আবার উপন্যাসের শেষে জীবনানন্দ আর সিলভিয়াকে কাছে টেনে নিয়েছে অনুবাদ — ক্যারল ও সম্যক কীভাবে এসে মিলিত হয় প্রফেসর ব্রাইটের কাছে। অনুবাদক থেকেই যায় সেই প্রাচীন কাল থেকেই। সাহিত্য -শিল্পের ক্যানোপির মধ্যে বয়ে চলে অনুবাদক নামক অগভীর নদীটি যার চলার গতি কোনোদিনই থামবে না। তাই আবহমানকাল হয়ে আসা অনুবাদ যিনি করছেন সেই অনুবাদক বৃক্ষের মতই প্রাচীন যাঁর বল্কলে লেগে আছে সময়রেখার ছাপ।

এক উপন্যাসযাপন করার পর তার রেশ থেকে বেরিয়ে বাস্তব প্রেক্ষিতে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন হয়। উপন্যাস পড়ার রেশটি আচ্ছন্ন করে রাখে,বিমোহিত করে রাখে পাঠককে। তারপর সম্বিত ফিরে যদি মনে হয় এই অসামান্য লেখার একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া দেওয়া যাক, ব্যর্থ হতে হয়; কারণ ততক্ষণে অক্ষম পাঠকও বুঝতে শুরু করে দিয়েছে প্রতিক্রিয়া দেওয়া আসলে এক মস্ত ভুল।ঔপন্যাসিকের ভাবনার অনুবাদ করা কি সম্ভব! ” ইউ ক্যান নট ট্রান্সলেট এভরিথিং”।

এই স্বল্প পরিসরে অব্যক্ত রয়ে গেল অনেক আশ্চর্য হীরকদীপ্ত লাইন যা তুলে ধরতে পারিনি, চাইনিও। সাহিত্যপাঠ একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তাই সে অভিজ্ঞতায় অনেকটাই মেলেনা অন্যের অভিজ্ঞতা। সকল পাঠক এসে একবার দাঁড়াক “বৃক্ষ অনুবাদক” এর সামনে। প্রশান্তি লাভ করুক তার ছায়ায়।

© তানিয়া সিংহ রায়