পাঠকের চোখে – দেবর্ষি সারগীর উপন্যাসিকা “অন্ধকার দেওয়াল”

Book Review, Reviews, পাঠকের চোখে

♦অন্ধকার দেওয়াল
♦দেবর্ষি সারগী
♦শারদীয় প্রতিদিন(১৪২৬)

যদিও গরম এখনও যায়নি, তবুও হাওয়ায় এখন রুখু টান। বেলা তিনটেয় যানবাহনের আওয়াজ কিছুটা কমে মফস্বলে। দুপুর রোদ তেরছা হয়, বিকেলটা বিষণ্ণ। শেষ দুপুরে পড়তে শুরু করেছিলাম দেবর্ষি সারোগীর ” অন্ধকার দেওয়াল”। বিষণ্ণ বিকেলে এসে শেষ হল পড়া। সমস্ত মন জুড়ে এক নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল ভোরের কুয়াশার মত।
জীবন কেমন ? যে জীবন শৈশবের,কৈশোরের, যৌবনের বাঁধা ভাঙা উচ্ছ্বাসের ; সে জীবন বার্ধক্যে কেমন ? যৌবনে যে জীবন স্বয়ংসিদ্ধ সে জীবন অন্তিমে মানুষের জন্য কী নিয়ে আসে ? ক্রমশ আয়ু ফুরিয়ে আসা অসহায় বার্ধক্য তখন কি বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় দিন গোনে নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটুকরো জমি বাছে যেখানে এবার তার ঠিকানা শুরু হওয়ার কথা ? উপন্যাসিকা শেষে প্রশ্নেরা -ভাবনারা ঘাই মারতে থাকে পুকুরের মাছের মত।

কাহিনিটা এইরকম কিছুটা—

সাতাশি বছরের বৃদ্ধ হরিমোহন গুপ্ত গত চারমাস তেরোদিন ধরে শয্যাশায়ী কোমরে চোট পেয়ে। নব্বই বছর অবধি বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় জীবন এখন থমকে গেছে। আয়ানির্ভর বেঁচে থাকা দিনগুলি রোজ মুখোমুখি হয় ব্যবসায়ী ছেলের উৎকন্ঠার সঙ্গে। বাবা যদি এখনও তিন বছর বাঁচে তাহলে কী হবে- কী হবে তাঁর ব্যবসার — এই ভেবে ছেলে বিরক্ত ও চিন্তিত। সেই চিন্তা ও বিরক্তি ছেলে শ্রীকুমার রোজই বাবাকে জানাতে ভোলেনা। বউমা শান্তা এনজিওয় মানবসেবা ধর্মে নিযুক্ত। ব্যস্ততায় মোড়া দিন। শ্বশুরের ঘরে ঢোকার সময় হয়না বলেই এতদিনেও তিনি শ্বশুরকে একবারও দেখতে আসতে পারেন নি , খোঁজ নিয়ে থাকেন ছেলে ও স্বামীর কাছ থেকে। বৃদ্ধের একমাত্র নাতি সুমিত্র বাংলায় অনার্স পড়ে, কবিতা লেখে, পত্রপত্রিকায় ছাপার জন্য সম্পাদকের বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে, ভালো ছেলে বলে কলেজে ক্লাস করেনা। সুমিত্র এখনও ঠিক করতে পারেনি জীবনে সে কী করবে। বাবার ব্যবসা নাকি চাকরি— কোন দিকে এগোবে সে। তাই কিছুটা ভেসে চলছে তার দিন। সুমিত্রর বাবা মা সারাদিনই বাড়ির বাইরে, নীচতলায় পঙ্গু বিপত্নীক দাদু আর আয়া এবং দোতলায় সুমিত্র ও তার প্রেমিকা প্রেরণা প্রতিদিন দুপুরে ব্যস্ত ক্লান্তিহীন যৌনতায়।
সুমিত্র দাদুকে ভালোবাসে। দাদুর জন্য তার বুকের ভিতরে এখনও মোচড় দেয়। বেশিক্ষণ বাইরেও থাকতে চায়না যদি বাড়ি এসে দেখে দাদু মারা গেছে — এই ভাবনায়।

শ্রীকুমার বৃদ্ধের জন্মদিনে মনে করিয়ে দেয় এখনও নব্বই হতে তিন তিনটে বছর বাকি। গজগজ করে প্রতিদিনই জানায় এত ব্যস্ততায় বাবার জন্য টেনশনে থাকা তার মোটে পোষাচ্ছেনা। একটা হোম বা নার্সিংহোমে বাবাকে রেখে আসার কথা জানায়। বারবার বৃদ্ধ বুঝতে পারেন নব্বই বছর অবধি বাঁচার ইচ্ছা মনে মনে পোষা ও তাদের বলে ফেলাটা বড় ভুল হয়ে গেছে।

মানবসেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বস্তিতে ভাষণ সেরে, কম্বল ও কমলালেবু বিতরণ করে বউমা শান্তা একদিন ঢুকে পড়ে শ্বশুরের ঘরে। খুব আকস্মিক। অবাক বৃদ্ধ স্মিত হেসে বউমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে শুনে নেন—
” কেন যাচ্ছেন না হোমে?…এভাবে আর কতকাল পড়ে থাকবেন এখানে? বলুন? কী চাইছেন আপনি? পরিবারের অন্য সবাইয়ের চেয়ে নিজের জীবনটা বড় হয়ে গেল? এত মায়া প্রাণের উপর?”
পাথর হয়ে গিয়েছিলেন বলেই বৃদ্ধ বুঝতে পারেননি ঘর থেকে বউমা চলে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর মায়ের কথা। সাতাশি বছরের বৃদ্ধ ভাবছেন তাঁর মায়ের কথা। শিশুর অসহায়তা ভিতরে তখন। একাকীত্বের চেয়েও বড় অসহায়ত্ব। লেখক দেখালেন সেই অন্তর্জগত। সে জগতে হরিমোহন অসহায় হয়ে কেবল নারীদের খোঁজেন। নারী — তাঁর মা,স্ত্রী, প্রেমিকা এবং বউমাও — নারী তার বিভিন্ন রূপে ও ভাবে।

হরিমোহন তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে সাধনা করতে থাকেন সমগ্র কাহিনিতে। যে জীবনে ছিল তাঁর নব্বই বছর অবধি বাঁচার আশা, সে জীবনে সাতাশিতে তিনি ভাবতে থাকেন,— “যদি বেঁচে থাকতে বাধ্য হতেই হয়— তিনি কী করতে পারেন? জীবন যে একটা মাঝিহীন দাঁড়হীন নৌকা…ওটা আপনিই গড়িয়ে চলে…একটু খেলে, একটু ঘুমলে, জীবন আপনিই এগিয়ে যায়। তাহলে তাঁর দোষ কোথায় ? তিনি তো জোর করে টেনে টেনে নিজের জীবনটাকে এত লম্বা করেননি ! “
একসময় তিনি অসহায় বোধ করেন। আসতে আস্তে খাঁচায় বন্দী শরীর যে নিজেকেই পিষে ফেলতে পারে এ বোধ শুরু হয় তাঁর। মৃত্যুকে চাইতে শুরু করেন। অথচ পঙ্গু মানুষটা অক্ষম নিজের হাতেও নিজের অসহায় অপমানিত প্রাণটা বের করে দিতে। বারবার পাশে রাখা মোবাইল তুলে সময় দেখেন সময় বইছে কিনা জানার জন্য। ” সময় না বইলে তাঁকেও তো অনন্তকালের জন্য এভাবে শুয়ে থাকতে হবে, জালে আটকে পড়া আধমরা পোকার মত, অথচ মুক্তি দেওয়ার জন্য মাকড়সাটা জালে নেই।”

হরিমোহনের ক্রাইসিস সমগ্র কাহিনি জুড়েই। অমৃতের সন্তান হরিমোহন শেষ বয়সে অথর্ব জীবন কাটাচ্ছেন পুত্রের সংসারের হলাহল কন্ঠে নিয়ে। নিশ্চল বৃদ্ধ স্পঞ্জের মত শুষে নিচ্ছেন পুত্র- পুত্রবধূর সমস্ত ক্ষোভ। তাদের ব্যস্ত জীবনের একমাত্র ঝামেলা এই অচল সিকিপয়সাটি।

নাতি সুমিত্র দাদুর সবিশেষ খেয়াল রাখে। আয়া কাজ ছেড়ে দিলে সুমিত্রই দাদুর সব খেয়াল রাখে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে। বারবার তার মনে হয় যদি দাদু মারা যায়। একদিন সুমিত্র দাদুকে ঘরে না দেখে রাস্তায় নামে। দেখে পৌষের বৃষ্টিতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বৃদ্ধ। দাদুকে বাড়ি এনে সুমিত্র জিজ্ঞাসা করে “হঠাৎ হাঁটার শক্তি কী করে পেলে?”
দাদু জানান,— ” চিতার দিকে যাওয়ার জন্য সব মানুষই হাঁটার শক্তি পেয়ে যায়”।
এরপরই দাদুর হুহু জ্বর আসে। একা সুমিত্র দাদুকে ওষুধ দেয়। তারপর? তারপর কী হয় হরিমোহনের? কী করে সুমিত্র? কাহিনির শেষে উত্তর পেয়ে যায় পাঠক। বুঝে যায় আসলে কেউ কারোর নয়। মানুষ ততক্ষণই অন্যের জন্য ভাবে যতক্ষণ সে নিজে চায়। অন্তত কিছু মানুষতো বটেই। এই উপন্যাসিকা তাই সেই সব মানুষের ক্লিন্ন মানবসত্তার পূতিগন্ধের আখ্যান।

দেবর্ষি সারোগী কাহিনি উপস্থাপনে আউটস্ট্যান্ডিং। ঘটনার বিস্তার,শব্দ নির্মাণ, ঘাত প্রতিঘাত তৈরি— সবেতেই তিনি ভীষণ ভাবে সফল। প্রায় তিরিশ বছর ধরে লেখার কাজে নিমগ্ন থাকলেও পাঠক সীমিত। বাণিজ্যিক ভাবে কতটা সফল তিনি তার হিসাব আমার কাছে নেই। কিন্তু লেখক হিসাবে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আছে পরিশীলিত পাঠকের কাছে। অপূর্ব, অ-ভাবিত তাঁর লেখার জার্নি। পাঠ শেষে স্তব্ধ পাঠক হারিয়ে যাবে দূরাগত এক ভবিষ্যৎ ভাবনায়। চোখে ভাসবে একাকী শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধের ছবি যে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুনছে অজস্র পল-অণুপল। মৃত্যুর।

শেষ করব উপন্যাসিকার কয়েকটি কথা দিয়ে যেখানে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন বৃদ্ধ বয়সের অসহায়তার করুণ রূপ। কোথাও হয়ত নিহিত আছে সেখানে আমাদেরই ভবিষ্যত ছবি,—
“বার্ধক্য অন্তর্জগতে প্রবেশের সময়। যে বার্ধক্য পুরোপুরি নিশ্চল ও শয্যাশায়ী সেটা তো তখন বাস করে শুধুমাত্র নিজের মস্তিষ্কের কোটরের ভিতরে। গোটা জীবন ও জগৎ তখন কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে নিজের এই ক্ষুদ্র আয়তনটুকুর মধ্যেই। আর নতুন কোনো দৃশ্য জন্মাবে না, নতুন কোনো ঘটনা ঘটবে না, আর কারও সঙ্গে আলাপ হবে না। নৌকা এখন শুধু উল্টোমুখে ভেসে যাবে। এলোমেলো ভাবে। টাল খেতে খেতে। যখন- তখন ডুবে যেতে যেতে।”

© তানিয়া সিংহ রায়