পাঠকের চোখে ~ নীলাঞ্জন মুখার্জির থ্রিলার উপন্যাস “১৪ই ফেব্রুয়ারী”

Book Review, Humor, Reviews, পাঠকের চোখে

বই ~ ♦#১৪ই ফেব্রুয়ারী♦
লেখক ~ #নীলাঞ্জন_মুখার্জ্জী
প্রকাশক ~ বেঙ্গল ট্রয়কা পাবলিকেশন
মুদ্রিত মূল্য- ১৮০ টাকা

রিভিউ লিখলেন #পিয়া_সরকার

কোনো অপরিচিত লেখকের বই কেনার আগে অনেকের মতই আমার কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ করার দরকার পড়ে, যেমন তাঁর পূর্বপ্রকাশিত কোনো লেখা বা অন্য কোনো বই বা নিদেনপক্ষে কোনো ব্লগে প্রকাশিত লেখকের কলমের কিঞ্চিৎ পরিচয়। বন্ধু ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী সাজেস্ট করামাত্রই নীলাঞ্জন মুখার্জ্জীর প্রোফাইল সার্চ করে তাঁর ব্লগ এবং-১৮ এর খোঁজ পেলাম, পড়ে ফেল্লাম টুকটাক কটি লেখা, এবং সেই টুকটাক অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই বইটি কেনা।

প্রচ্ছদশিল্পী কুশল ভট্টাচার্যের কাজের সঙ্গে আগে পরিচিত ছিলাম না, প্রচ্ছদ যথোপযুক্ত মনে হয়েছে আমার। হরফসজ্জা সুন্দর এবং বানান নির্ভুল। তবে বইয়ের নামকরণের বিষয়টা নিয়ে স্বয়ং লেখক যে যুক্তি দিয়েছেন সেটা খুব একটা মনঃপূত হয়নি আমার। হয়ত পরবর্তী খণ্ড আসবার যে আভাস লেখক দিয়ে রেখেছেন, সেগুলি পড়ার পর আমার দ্বিধা কেটে যেতে পারে।

এবার আসি মূল বক্তব্যে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী একটি থ্রিলার, কোন বিশেষ ধরণের থ্রিলার জনরাতে বইটিকে ফেলা যায় তা এই পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার আগে একটু ভেবেছি আমি। পাঠক হিসাবে যখন বইটির রসাস্বাদন করছিলাম তখন সেই দায় আমার ছিল না, গল্পের মৌতাতেই মজে ছিলাম। ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে একটি অকাল্ট থ্রিলার বলা যেতে পারে, এ আমার ব্যক্তিগত মতামত। গুণীজন এবং প্রশিক্ষিত পাঠকেরা হয়ত বইটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে অন্য মতেও পৌঁছাতে পারেন। তবে, যে জনরারই হোক না কেন, অকাল্ট প্র্যাকটিসের সঙ্গে শার্প সাইকোলজ্যিকাল রিফ্লেকশনের জন্য আর অবশ্যই লেখকের মুচমুচে, স্মার্ট লেখনীর জন্য বইটি শুরু করার পর শেষ না করে থামতে পারিনি। এবং অনেকদিন পর একটি গল্প শেষ করতে না করতেই পরবর্তী গল্পটি কতক্ষণে শুরু করতে পারব সেটার জন্য মনে মনে উত্তেজনা হচ্ছিল।

বইটিতে গল্পের সংখ্যা দুই। অনাহিতা আহরিমান এবং জারদিম দে সাতানাস। নাম দুটি পড়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না করে মূল গল্পে ঢোকার পর, আমার সাধারণতঃ দু-ধরণের অভিজ্ঞতা হয়।

১. অজানা গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে লেখকের রাশভারী কলম বা অত্যধিক আলঙ্কারিক ভাষায় পড়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলা।

২. ‘ আমি অনেক জানি কিন্তু তোমায় আমার জ্ঞান দেখিয়ে ঢোক গিলতে বাধ্য করব না টাইপ’ মাই ডিয়ার ভাষায় লেখা ঝরঝরে গদ্য। লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই যে সম্পূর্ণ অপরিচিত জেন্দ আবেস্তার কানাগলিতে পাঠককে অযথা ঘুরপাক না খাওয়ানোর জন্য। লেখকের ক্রিস্প লেখার মূল রহস্য বোধ হয় পরিমিতি বোধ। আর তাই ঐতিহাসিক এবং মাইথোলজ্যিকাল কোনো ন্যারেটিভই বোরিং লাগে না।

লেখক ন্যারেটিভ স্টাইল নিয়ে বেশ কটা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন- কখনও প্রথম পুরুষে আততায়ীর মুখে, কখনও তৃতীয় পুরুষে আই.পি.এস অফিসার মোহন সর্দারের কথায়, কখনও গল্পের মধ্যে গল্প বুনে লেখক নিজেই গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। গল্প এগিয়েছে তরতর করে। অপ্রয়োজনীয় ডায়লগ নেই, প্রোটাগনিস্ট তদন্তকারীর নিজেকে স্মার্ট প্রমাণের অযথা চেষ্টা নেই, এবং অকুস্থলে হাজির না থেকেও বিশ্লেষণ দিয়ে, যুক্তি সাজিয়ে মোহন সর্দার নিজেকে বিচক্ষণ প্রমাণ করেছেন বারবার।

অনাহিতা আহরিমান গল্পের নামকরণের মধ্যে গল্পের মূল একটি চরিত্রকে ধরা হয়েছে। স্পয়লার দিতে চাই না, কিন্তু তবুও বলব মোহন সর্দারকে লেখা নাহিদার চিঠিতে তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ সম্পর্কে সে যা খুঁজে বার করতে বলেছে, সেই কারণ কিন্তু চিঠিটা পড়ার সাথে সাথেই অনুমান করা যাচ্ছে। আমি জানি না, লেখক আদৌ ওখানে চমক রাখতে চেয়েছিলেন কি না! কারণ গল্পটি হু ডান ইট গোত্রের মনে হয়নি আমার, বরং হাউ ডান ইট ধরণের এই লেখাটায় খুনের আসল কারণ খোঁজাটাই পাঠকের কাছে আসল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়।
নীলাঞ্জন বাবুকে বলব,জরাথ্রুস্টীয়ান মিথোলজি ঘেঁটে হত্যার কারণ সম্পর্কে মোহন সর্দারের অ্যানালিসিসটা একটু আরোপিত লাগল। কায়য়োজের সঙ্গে মোহন সর্দারের মানসিক দ্বন্দ্বর ব্যাপারটা দুর্দান্ত যদিও। পাঠক হিসাবে মনে হচ্ছিল, যদি মোহন সর্দার ক্লাইম্যাক্সে ঐ দ্বন্দ্ব চলাকালীন কোথাও একটু স্বীকার করে নিতেন যে অনুমানের উপর ভিত্তি করেই তিনিও যুক্তি সাজিয়েছেন, তবে ব্যাপারটা আরও বাস্তবানুগ হত। আফটার অল, আপনি মোহন সর্দারের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ গড়তে চাননি, তাই না?

আর একটি বিষয় হলো, মোহন সর্দার কমিশনারকে বলছেন, -“আমরা এই কেস থেকে নতুন একটি বিষয় পাব স্যার। বিদেশ তা অনেক দিন ধরেই হচ্ছে।” এই নতুন বিষয়টি সম্পর্কে কিন্তু আমি গল্পের শেষ পর্যন্ত কোনো ক্লু পাইনি।

দ্বিতীয় গল্প জারদিম দে সাতানাস বহু পরিচিত গোয়ান ইনক্যুইজিশন নিয়ে। খ্যাতনামা সাহিত্যিকের খ্যাতনামা বইতে কিছুদিন আগেই বেশ জম্পেশ একটি গল্প পড়েছি এই একই টপিকে। কিন্তু নীলাঞ্জন বাবুর গল্প বলার কৌশলে মুগ্ধ হয়ে গেছি। সাব প্লট থেকে কী করে মূল প্লট বিল্ডাপ করা যায়, কী করে গোর, প্যাথোস এবং চরম উইটকে মিশিয়ে একটি সুখাদ্য রান্না করা যায়, তা জনাব কোই আপসে শিখে!

তবু বলব, কোথাও কোথাও বীভৎস রস একটু বেশি পড়ে গেছে, কোথাও একটু রিপিটেশন হয়েছে।

শেষ কথাতে এটুকুই বলে যেতে চাই, রিভিউ লেখার মামলায় আমি অতি ল্যাদখোর, যেটুকু বই পড়ি তার থেকে সেরাটা নিয়ে মনে জমিয়ে রাখি। নীলাঞ্জনবাবুর বইটি বাধ্য করল বহুদিন পর স্বতঃস্ফূর্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে। অনেক শুভেচ্ছা রইল লেখকের জন্য, এবং বেঙ্গল ট্রয়কার জন্য।

© পিয়া সরকার