ফেরা

Anirban & Arijit, আদতে আনাড়ি, বাংলা

নৈহাটি  স্টেশনে নেমে একটা বড় হাই তুললেন বছর ষাটের চিত্তবাবু, একদম ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ট্রেনে। ভাগ্যিস পাশে বসা ছোকরাটা বিকট শব্দে হাঁচল, আর উনি চোখ খুলেই দেখলেন কাঁকিনাড়ার প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গাড়ি বেরোচ্ছে। নড়ে চড়ে বসে বাঙ্ক থেকে ছোট সু্টকেসটা নামিয়ে জানলার হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলটা ঠিক করতে করতেই নৈহাটি এসে গেল। চল্লিশ বছর পরে আবার নিজের বাড়ি ফিরছেন চিত্ত। স্টেশনটা অনেকটা বদলেছে, আবার বদলায়ওনি বটে। এখন একটার জায়গায় দুটো ওভারব্রীজ, অনেক বেশি মানুষ, এই মনে হয় কারো পায়ে পা পড়ে গেল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে গান্ধী মুর্তিটা এখনো আছে, আর আছে স্টেশনের বাইরে পা ফেলতেই কালিকার কচুরি ভাজার গন্ধটা, স্টেশনের গায়ের লম্বা রিকশ স্ট্যান্ডটা। -মিত্রপাড়া যাবে? -মিত্রপাড়ার কোথায় যাবেন? -জোড়া শিব মন্দির চেন? -চিনি। -ওর গায়েই মালতী নিলয়। -সে বাড়ি তো সবাই চেনে, পনেরো টাকা লাগবে। -দেব। বয়স বাড়ে, পরিবেশ বদলায়, কিন্তু ছোটবেলার বাড়ি গলি গুলো মানুষকে কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে থাকে, আর মাঝে মাঝে টান মারে। বলে আয় একবার, একটু সময় আমাদের কাছে বসে যা। নিজের বাড়ির নাম বলতে গিয়ে গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল একটা কষ্ট। তাতে মিশে আছে ক্ষোভ, অভিমান আর অনেক অনেক লজ্জা। আচ্ছা বাবা বেঁচে আছেন এখনও? নিশ্চয় নেই। চিত্ত যখন বাড়ি ছাড়েন তখনই বাবার বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। তবে দাদাকে গেলেই পাওয়া যাবে। এখনও কি রেগে আছে দাদা ওর ওপরে?  কোলকাতায় চলে আসার পরে দাদা একদিন লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল চিত্তর সাথে, ওর সিটি কলেজের মেস বাড়িতে, সেটাও বাবাকে না জানিয়ে। কিন্তু দাদার অনেক অনুরোধেও ঘরের দরজা খোলেনি চিত্ত। হাতের মুঠো শক্ত করে বসেছিল খাটিয়ার ওপর। সিঁড়ি দিয়ে দাদার নেমে যাওয়ার শব্দ পেতে দরজা খুলেছিল চিত্ত। লম্বা গলির মোড়ে দাদার শরীরটা ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল। দাদা তো কোন দোষ করেনি, কিন্তু নাহ, ওকে ডাকা যাবে না। নিজেকে এভাবে দুর্বল করা যাবে না, ফিরবে ও একদিন, আর ফিরেই একটা মোটা টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে মারবে ওই বুড়োটার… এখনো চোয়াল শক্ত হয়ে আছে চিত্তবাবুর, রিকশর হাতলে হাতের মুঠো চেপে বসেছে। এখন রাতে আর ঘুম আসে না। ওই বাড়িটা, ওই বুড়ো রাশভারী লোকটা, ওই ঘুড়ি ওড়ানোর দাদাটা ওকে ঘুমোতে দেয় না। আজকে ক্ষমা চেয়ে নেবে ও। আজকে একবার ওর নিজের পুবের ঘরটাতে গিয়ে বসবে।  জানলাটা খুলে দিলেই দেখবে সবুজ পুকুরটা। পানকৌড়ি খেলছে, ছোট ছোট মাছগুলো ঘাই মারছে এদিক ওদিক। না,  পুকুরটা আর নেই, প্রথমে রিকশা থেকে নেমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল চিত্ত। জোড়ামন্দিরটা আছে, সামনের মাঠটা আছে। কিন্তু পুকুরটা একদম গায়েব হয়ে গেছে। তার জায়গায় এখন বড়ো পাঁচিল, রিকশাওয়ালা বলল পুকুর বছর দশেক হল বুজে গেছে, কিন্তু শরিকদের ঝামেলাতে তাতে আর বসতবাড়ি তৈরি হয়নি। নিজের বাড়িটাও দোতলা হয়েছে, বাড়ির রঙ বদলে গেছে, শুধু এক রয়ে গেছে দরজার পাশের মার্বেলের প্লেটটা। কালো রঙের লেখাটা আবছা হয়ে এলেও পাথরের খোদাইটা পড়া যায়। ‘মালতী নিলয়’। একদিন দুম করে স্টোভ থেকে আগুন লেগে মালতীদেবী যখন মারা যান তখন চিত্তরঞ্জন দশ, আর অমিত্ররঞ্জন আঠেরো। সেদিনও দাদা আগলে রেখেছিল চিত্তকে। শ্মশানে যেতে দেয়নি ওকে। বলেছিল, তুই ও বাড়ির বল্টুর সাথে খেল, আমরা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসব। মার্বেলটার ওপরে একবার হাত বোলালেন চিত্তবাবু, তারপরে বুক ভরা শ্বাস নিয়ে হাত রাখলেন কলিংবেলের ওপরে।

||

– নমস্কার, আমি অর্ণব রায়। – আরে আসুন আসুন, আমিই সুদীপ মিত্র, আমিই কল করেছিলাম আপনাকে, বাড়িটা চিনতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো? একরকম মাথা নিচু করেই মালতী নিলয়ে ঢুকল অর্ণব, ড্রয়িং রুমটা বেশ ছিমছাম, মাঝে একটা গ্লাস টপ টেবিল, তার দুদিকে রট আয়রনের সোফা, ছোট ছোট কুশন তাতে।  বাঁদিকের সোফাটায় বসতে বসতেই অর্ণব বলল, -আই অ্যাম ভেরি সরি মিস্টার মিত্র, এরকম এমব্যারাসড আমি কখনও হইনি আগে। – প্লিজ সরি টরি বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমার জায়গাতে আপনি হলেও একই কাজ করতেন। কী নেবেন বলুন, চা না কফি? -এই গরমে চা কফি কিছু খাব না আর, আপনি বরং একটু ঠান্ডা জল খাওয়াতে পারলে… – শিওর শিওর। জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অর্ণব  বলল, – আপনি যখন ফোনটা করলেন তখন আমি থানাতে মিসিং ডায়রিটা করে বেরোচ্ছি, সকাল থেকেই দৌড়াদৌড়ি চলছে, চারদিকে ফোন করছিলাম, বাবা যে হটাৎ করে এভাবে… – আরে আমিও একদম কিছু বুঝতে পারছিলাম না। রবিবারটাতে আমরা একটু দেরি করেই লাঞ্চ করি। সবে চান করে বেরিয়েছি আর কলিং বেলটা বাজল, খুলে দেখি ষাট বাষট্টি  বছরের একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার বাবা বাড়ি আছেন কিনা জানতে চাইলেন। দু’বছর হল বাবা মারা গেছেন, ভাবলাম হয়তো পুরনো কোন বন্ধু, খবরটা পাননি হয়তো। বাইরে কাঠা ফাটা রোদ, তাই এই ড্রয়িং রুমে এনে বসালাম। তারপরে বাবার খবরটা দিলাম,  আমারই হয়তো ওভাবে দুম করে খবরটা দেওয়া উচিত হয়নি। কথাটা শুনেই ওঁর মুখটা শুকিয়ে গেল, অতো বড়ো মানুষটা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আমার স্ত্রী রুমি পাশেই ছিল, ওই সামলালো। এক গ্লাস জল এনে দিল ওনাকে। তখনই খেয়াল হল আরে ওঁর নামটাই তো জানা হয়নি, আসলে সব কিছুই এমন পর পর হয়ে গেল যে এটা মাথাতেই আসেনি। তারপর? সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসে বলল অর্ণব । – নিজের মাথা নিচু করে নাম বললেন চিত্তরঞ্জন মিত্র,  আমার কাকা। যিনি অনেক বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ভদ্রলোকের কোথাও একটা কনফিউশন হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই সৌম্যকান্তি চেহারা দেখে একবারও আমার ওনাকে হোস্টাইল মনে হয়নি। অবাক হয়ে গেলাম এটা দেখে যে এ বাড়ির আনাচ কানাচ ওঁর চেনা। নিজেই শিশুর মতো এঘর ওঘর ঘুরে দেখতে লাগলেন। এক তলার ঠাকুর ঘরটাকে সরিয়ে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে একটু মনক্ষুন্নও হলেন মনে হয়। আমাদের তখনও লাঞ্চ হয়নি, ওনাকে আমাদের সাথে খেতে বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। রুমির হাতের রান্নার তারিফ করতে করতে খুব তৃপ্তি করে খেলেন। তারপরে নিজেই বললেন পূর্বদিকের ঘরটাতে কিছু সময় কাটাতে চান। ওটা আমার কাকার ঘর ছিল। এতো বছরেও বাবা আমাদের কাউকে ওই ঘর ব্যবহার করতে দেননি। আমিও না বলতে পারলাম না ওনাকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই শুনি ওঁর নাক ডাকার আওয়াজ। – ওকে। তার মানে তখনই… – হ্যাঁ তখনই আমি ওঁর মানিব্যাগটা চেক করি আর একটা ছোট চিরকুট পাই, এই যে এটা। সুদীপ অর্ণবের হাতে একটা ছোট কাগজের টুকরো দিল। তাতে লেখা- আমার নাম অঞ্জন রায়। আমার ছেলের নাম অর্ণব রায়। ফোন নাম্বার… – হুম, আমিই এটা বাবার মানিব্যাগে রেখেছিলাম। কাগজের টুকরোটা ভাঁজ করতে করতে বলল অর্ণব। – ওহ ওকে ওকে। এই কাগজটা পেতেই আমি আপনাকে কল করি, জানি খুব ইন্ট্রুসিভ কাজ হয়ে গেছে এটা, কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে ওঁর কোথাও একটা… সুদীপের কথার মাঝপথেই অর্ণব ওর হাত দুটো ধরে ফেলল, – প্লিজ এভাবে বলবেন না, আপনি ওই কাজটা না করলে আমরা জানতেও পারতাম না বাবা বাড়ি থেকে এতো দূরে চলে এসেছেন। হ্যাঁ আমার বাবার নাম আসলে অঞ্জনই, তবে চিত্তরঞ্জন নামটা কী করে মাথায় এল তার একটা এক্সপ্ল্যানেশন আছে আমার কাছে। -সেটা কীরকম? অর্ণব বলল, কয়েক মাস আগেও মানুষটা ভাল ছিল জানেন, তারপরে হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড জ্বর আর হেডেক, মেনিনজাইটিস ধরা পড়ল, টানা পনেরো দিন কোমাতে ছিল বাবা, ডাক্তাররাও প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভেন্টিলেটর থেকে বেরিয়ে এল বাবা, আরো দিন দশেক পরে বাড়িতে আনলাম। কিন্তু বাড়ি এল যেন একজন অন্য মানুষ। আসতে আসতে দেখলাম কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই আমাকে চিনতে পারছিলেন না, এমন লোকেদের নাম নিচ্ছিলেন যাদের কথা আগে শুনিনি। একদিন বাজার করতে বেরিয়ে হঠাৎ বাড়ি ফেরার রাস্তা ভুলে গেছিলেন, পাড়ার ছেলেরা বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তারপরেই একজন নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম, উনি সব দেখে শুনে বললেন আর্লি অ্যালজাইমার্স। সেটাই এই স্মৃতিভ্রংশের কারন। আর এই জন্যই বাবার ছোটবেলায় শোনা নাম গুলো হয়ত এখন ফিরে আসছে। উনিই বাবার মানিব্যাগে ওই চিরকুটটা রেখে দিতে বলে ছিলেন, ইন কেস যদি কখনও রাস্তায় মেমরি ল্যাপ্স করে আবার। -ওহ! নাও ইট অল মেক সেন্স,এবারে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সুদীপ। অর্ণব  জাগ থেকে আরেক গ্লাস জল ঢেলে এক চুমুক দিয়ে বলল, – নট অল অফ ইট সুদীপ বাবু। আমি কিন্তু এই শেষ কয়েক দিনে বাবাকে অমিত্ররঞ্জন, পরেশরঞ্জনের নাম বিড়বিড় করে বলতে শুনেছি, আর বারবার বলতেন খুব ভুল হয়ে গেছে। বাড়ি যাব একবার। কিন্তু বাবার. জন্ম বিহারে,  সেখানেই স্কুল, কলেজ। মায় চাকরি জীবনের প্রথমটাও সেখানেই। – সেকী, আমি তো ভেবেছিলাম ছোটবেলাটা হয়ত উনি নৈহাটিতেই কাটিয়েছেন, তখন হয়ত কাকার বন্ধু ছিলেন, আমাদের বাড়িতেও হয়ত তখনই এসেছিলেন। সেই স্মৃতি জট পাকিয়েই আজকে আমাদের বাড়িতে এসে পড়েছেন। অমিত্ররঞ্জন আমার বাবার নাম, আর পরেশরঞ্জন ঠাকুর্দা। – না না সুদীপ বাবু, বাবা পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কোলকাতা আসেন, ১৯৮৪ সালে। তারপরেই হয়ত চিত্তরঞ্জনের সাথে আলাপ… – সেটা অসম্ভব মিস্টার রায়। বাবার মুখে শুনেছি ১৯৭৯ তে কাকা ঠাকুর্দার সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। বাবার সাথেও নাকি দেখা করতে চাননি আর। সেই ঘটনার মাস ছয়েক পরে একটা আপ নৈহাটি লোকাল ডিরেইল্ড হয়ে প্রায় দেড়শো লোক মারা যায়, তার মধ্যে ছিল চিত্তরঞ্জনের দেহ, হয়ত নিজের বাড়িতেই ফিরতে চেয়েছিলেন আবার। সেই শোকেই ঠাকুর্দাও মাস কয়েক পরে মারা যান। কিন্তু আপনার কথা মতো আপনার বাবা মানে অঞ্জনবাবু তখন বিহারেই। তার মানে দুজনের কোন সময় দেখাই হয়নি! ড্রয়িংরুমে  দুই যুবক হতভম্ব হয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুবের দিকের ঘরটাতে তখন অঞ্জন রায়ের শরীরটা আরাম করে ঘুমিয়ে আছে কোলবালিশ জড়িয়ে। আর ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা হাওয়াটা ফিসফিস করে কাউকে বলছে- দেখেছ বাবা, আমাদের চিত্ত ফিরে এসেছে, এবারে তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও।

~ সমাপ্ত ~

 

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ