মা

Friends, আদতে আনাড়ি, বাংলা

লেখক ~ দেবপ্রিয় মুখার্জি

নিমাইয়ের দোকান থেকে ৫০ টাকার রসগোল্লা কিনে, সড়াখানা কেঁড়ে আঙুলে ঝুলিয়ে ফিরছিল বঙ্কা। একেই গোটা দশেক বড় রসগোল্লা মানে মহাভোজ, তায় নিমাই আবার বঙ্কাকে ফাউ দেয়।

আজ বঙ্কার পোয়াবারো। ম্যাচে জোড়া গোল দিয়ে “ম্যান অফ দা ম্যাচ” হয়েছে বঙ্কা। কপালখানা সাথ দিয়েছে। নইলে বিহারিপাড়ার গ্যোঁৎকা ছেলেগুলোকে সব সমেত চারটে গোল ভরা কি চাট্টিখানি কথা? জেতার প্রাইজ বাবদ বঙ্কাকে অাধকেজি কচি পাঁঠার মাংস আর এক সেরী দেশী কাতলা কিনে দিয়েছে কোচ বরেণ মাস্টার।

বাড়ি ফিরেই বাবাকে ঢিপ্ করে প্রণাম ঠুকলো বঙ্কা। ছুটির দিনে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার রাজেন আজ বাড়িতেই।

– বাবা,এই নাও। ধর গো।

– গোল করেছিস নাকি?

– হুম্। বরেণ স্যার পাঠিয়েছে। আজ জমিয়ে রাঁধো দেখি। এমন গন্ধ বের করবে যেন ননার মা এসেও তোমায় প্রণাম ঠোকে। বড্ড কথা শোনায় ননাটা।

ননা আর বঙ্কার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বঙ্কার বাবার অজানা নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা ছেলের পরিসর ছেড়ে বাবার মধ্যেও ঠাঁই পেয়েছে। সেই সূত্রে বঙ্কার বাবা আর ননার মাও রান্নায় প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। ননার বাবা জলসেনায় কাজ করে, ছয় মাসে একবার আসে। ওদের অবস্হাও বেশ স্বচ্ছল।

– তা আজ কটা গোল পুরলি রে?

– দুটো বাবা। একটা ফ্রিকিকে, আরেকটা কাটিয়ে। তিনজনকে কাটিয়েছি বাবা।

-বাঃ। বরেণদাও গেল হপ্তায় তোর প্রশংসা করছিল। তাহলে দুটো গোল করেছিস যেকালে,  আজ তাহলে পাঁঠার ঝোল আর কালিয়া, দুটোই হোক্। কী বলিস ?

– হ্যাঁ বাবা। বরেণ স্যার আসবে রাত্রে। রেখে দিতে বলেছে। তুমি এবার ননার মাকে দুগোল দাও দেখি।

– বরেণদা আসবে। বাঃ। ভালোই হবে। তাহলে এবেলা কাতলাটা করি, ওবেলা পাঁঠাটা হোক্। কী বলিস্?

– না বাবা! দুটোই কর। রেখে দেব না হয়।

রাজেন সম্মতি জানাল।

– বরেণদা যা খেলত না রে। আমাদের ইস্কুল টিমের ক্যাপ্টেন ছিল জানিস?

– তাই বাবা?

বাইরে ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের ঘন্টিটা বাজলো। হাত পা ধুতে না ধুতেই বঙ্কার ছোটমামা এসে হাজির। সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত ছোটমামার মাথা জোড়া টাক। ছোটবেলায় মামার টাকটা খুব মজার লাগত বঙ্কার। এখন ভাবলে লজ্জা করে। কারণ, মামা আসলেই দারুণ আনন্দ হয়।

কড়কড়ে একটা পঞ্চাশ টাকা বঙ্কাকে ধরিয়ে দিয়ে মামা বললেন – “বঙ্কা, এই নে। দই নিয়ে আয়। যা টাকা বাঁচবে ফেরত দিবি কিন্তু…”

বঙ্কা জানে মামা সেটা নেবে না। বঙ্কার লক্ষ্মীভাঁড় ভেঙে যা টাকা হয়, সেটাকে পুরোপুরি করে দেয় মামা। যদি ৮৫ টাকা হয়,মামা বাকিটা দিয়ে সেটা ১০০ করে দেয়। যদি ১৬০ টাকা হয়,মামা সেটায় ৪০ দিয়ে ২০০ করে দেয়। আজকের আয়োজনে দইটার একটু অভাব বোধ হচ্ছিল, সেটাও মিটল।

কেবল একটা অভাবই সংসারে মেটাতে পারলেন না মামা। সে ক্ষমতা মামার হাতের বাইরে।

 একছুটে বেরিয়ে গেল বঙ্কা। আবার ফিরে এসে বলল – “ও মামা,তোমার সাইকেলটা নিয়ে যাব?”

রান্নাঘর থেকে বাবা চেঁচালেন – “না সুধীর, ওরে সাইকেল দিস না। হাত পা কেটে আসবে।”

– ও মামা! দাও না কিস্যু হবে না। আমি শিখেছি ননার সাইকেলে। হাফ প্যাটেল, ফুল প্যাটেল সব পারি।

বাবা চেঁচাতে চেঁচাতেই বঙ্কা সাইকেল নিয়ে দেছুট।

এই ছোট মামা আর বঙ্কার বাবার এক সময় কত মতবিরোধই ছিল!

– রাজেন, আজ তো অনেক আইটেমরে। চল রান্নাটা শুরু করি।

ছোটমামা প্রস্তাবটা দিল বঙ্কার বাবাকে।

– আরে তুই বস তো। এদ্দুর আসলি। একটু জিরিয়ে নে।

– আমার আবার জিরোনো। দাঁড়া হাতপাটা ধুয়ে আসছি।

– আচ্ছা। তুই কী করে বুঝিস বল তো, যে আজ তোর দরকার পড়তে পারে?

– গতকাল স্বপ্নে কল্যাণীকে দেখলাম রে, বলছিল “ছোড়দা, একবার আসিস বাড়িতে।”

রাজেন বলল – “আর…”

 রাজেনের চোখের জলটা পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে বেরোয়নি।

– আচ্ছা রাজেন, তোদের পুরনো বাড়িটার একটা খদ্দের পেয়েছি, বেচবি? কী করবি ও জায়গাটা রেখে?

– হ্যাঁ ভাল দাম দিলে বেচেই দেব। যার হাতে গড়া ও বাড়ি, সেই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল, ও সাপ খোপের আড্ডা রেখে আর কী হবে?

***

দুপুর গড়িয়ে এল। সাইকেল আর দইয়ের হাড়ি নিয়ে বঙ্কা ততক্ষণে গোটা গাঁ চক্কর মেরে ফেলেছে। নয়ানজুলির পাকা পোল খানা পেরিয়ে অশ্বথ্ব গাছটাকে ডাইনে রেখে বাঁক নিয়েই বঙ্কা দাঁড়াল।

রাস্তা থেকে হাত বিশেক নেমে ওদের পুরনো বাড়িটার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকল –

– মা। ও মা। এসেছি গো।

দরজাটা ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে নিজে থেকেই খুলে গেল।

-এলি? ভেতরে আয়।

স্যাঁতসেতে অন্ধকার ঘরটার বোঁটকা গন্ধ। পোড়া পোড়া। বাদুর আর চামচিকের গুয়ে মেঝে ভরা। ঝুল ভরা ঘরের উপরে রাখা চৌকিটার ধুলো ঝেড়ে বসল বঙ্কা। কাঁধটা ডানদিকে হেলিয়ে হেলান দিয়ে অনুভব করল একটা হিমশীতল হাত ওর পিঠে হাত বুলাতে শুরু করল।

– ছোটমামার সাইকেল টা নিয়ে কেন বেরোলি বঙ্কা, পড়ে যাস যদি?

– না মা পড়ব না আমি। এখন দারুণ চালাই গো।

গালে একটা স্পর্শ অনুভব করল বঙ্কা।

– আজ দুটো গোল দিয়েছিস তো?

– হ্যাঁ মা দুটো। বরেণ স্যার কত প্রাইজ দিয়েছে জানো?

-জানি বাবা। বাবা পারছে রান্না করতে?

– তোমার মত রাঁধতে পারে না মা।

খুক্ খুক্ করে একটা হাসির আওয়াজ হল ঘর জুড়ে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল বঙ্কা।

– নে বাবু। এবার আয়। এত বেলায় কেউ খায়? ভাল আরেকটা কথা, ইস্কুলে ফার্স্ট বেঞ্চিতে বসবি। পিছনে বাজে ছেলেরা বসে।

– আমি তো বাজেই মা। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে সবাই আমায় আজেবাজে বলে, বলে আমি নাকি গোল্লায় যাবো।

-ওসব কান দিবি না। ভাল থাকিস বাবা। এবারে আয়। বাবা আর মামা বসে অাছে।

– আচ্ছা চললাম্। আবার আসব।

– আমি যে এখানে আছি কাউকে বলিস না যেন।

বঙ্কা বেরিয়ে যেতেই ঘরের দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।

****

– এত সময় লাগল? কোথায় গেছিলি রে? খাবার রেডী করে কখন থেকে বসে আছি আমি আর মামা। একি ঝুলকালি মেখে কী অবস্হা তোর? যা ঝটপট স্নান করে আয়।

বঙ্কা তাড়াতাড়ি গিয়ে স্নান করে আসল।

– বঙ্কা ছবির মালাটা একটু পাল্টে দে। মামা মালা এনেছে। আজ তোর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।

বঙ্কা মালাটা পাল্টে দিয়ে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।

– হাসছিস কেন রে বঙ্কা? কী হয়েছে রে?

– কই কিছু না তো।

খাবার খেতে খেতে ছোটমামা কথাটা পাড়ল।

– বুঝলি বঙ্কা, তোদের পুরনো বাড়িটার একটা হিল্লে করে ফেলেছি। যার বাড়ি, তাকেই ঐ বাড়ি খেয়ে ফেলল, ঐ অভিশপ্ত জায়গা রেখে আর কী হবে? একটা খদ্দের পেয়েছি। ভেঙে একটা ছোট মার্কেট মত হয়ে যাবে।

চোখ ছলছল করে উঠল বঙ্কার।

-নাআআআআ। ঐ বাড়ি কাউকে দেবেনা। নাআআআআ।

বঙ্কা চেঁচিয়ে উঠল একপ্রকার।

বঙ্কাকে এভাবে ব্যবহার করতে কেউ দেখেনি আগে। হকচকিয়ে গেল মামা আর বাবা।

– কেন রে? আচ্ছা খেয়ে নে।

কোন মতে খেয়ে দেয়ে বাড়ি থেকে তীরবেগে বেরিয়ে গেল বঙ্কা।

বাবা চেঁচালেন – “কোথায় চল্লি?”

সূর্য ডুবে গেছে প্রায়। পাখিরা ঘরে ফিরছে। এমন সময় ছেলেটা দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

– চল সুধীর, দেখি বঙ্কাটা কোথায় গেল? এরকম করে না রে, এই আজই দেখছি এমন করছে,আসলে ওর মা কে মনে পড়ছে হয়ত বল।

চার শেলের বড় টর্চ টা নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে দুজন গেল বঙ্কাকে খুঁজতে। এদিকে বরেণ মাস্টারের আসবার ও সময় হয়েছে। পথে আসতে আসতেই বরেণের সাথে দেখা হল সুধীন আর রাজেনের।

– বরেণদা, বঙ্কাকে দেখেছ? মাঠের দিকে গেল কি?

– না না, আমি তো মাঠেই ছিলাম।

– আর বল না। দেখো না খেয়ে উঠে রেগে মেগে বেরিয়ে গেল।

– কেন রে, কী বলেছিলিস?

রাজেন ঘটনাটা বলায় বরেণের চোখ বড়বড় হয়ে গেল।

বরেণ বলল – “রাজেন, যেটা বলব বলে তোর কাছে আসছিলাম আজ। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। চল যেতে যেতে বলছি।”

– টুর্নামেন্টে আমার টিম হল নিঃসন্দেহে দারুণ। কিন্তু পাওয়ারে বিহারীপাড়াকে হারায়, এ ঘটনা আমার ভাবনাতীত। ওদের দুর্দান্ত পাওয়ার এবং টানা খেলে যাওয়ার ক্ষমতা ভাবতে পারবি না। কারণ, টিমটাকে কোচিং করায় কলকাতার বিশু। তা বিশুর টিমকে চারগোলে হারানো কেউ ভাবতেও পারে না। আজ তোর ছেলে যে ভাবে খেলেছে কোন এগারো বছরের ছেলে ওভাবে খেলতে পারে না। ওরকম অমানুষিক দৌড় আর শক্তি একটা পূর্ণবয়স্ক লোকেরও নেই। ম্যান মার্কিং, কড়া ট্যাকেল যাই করুক না কেন, ওকে ধরতে পারছিল না কেউ। খেলার পরে আমি ঠিক করি আমি তোর কাছে আসব ব্যাপারটা জানাতে, কারণ ব্যাপারটা আমার স্বাভাবিক মনে হয় নি রে।”

– কবে থেকে দেখছ ব্যাপারটা বরেণদা?

রাজেন আর সুধীরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। পথে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, বঙ্কা পাকাপোলের দিকে গেছে।

সাঁকো পেরিয়ে পুরনো বাড়ির সামনে আসতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অশ্বথ্বের ডাল ভেঙে নিল সুধীর আর রাজেন। বরেণদাও নিল। এই পোড়ো বাড়িতে কী করছে বঙ্কা? টর্চের আলোয় রাজেন দেখল সদর দরজাটা খোলা।

ঘরে ঢুকল তারা। খাটের উপর হাটু দুটো ভাঁজ করে হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে আগলে বসে আছে বঙ্কা। মাথাটা নীচু করে হাটুতে রাখা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

– বঙ্কা বাড়ি চল। তোকে নিতে এসেছি।

– না বঙ্কা যাবে না, তোমরা যাও। ও আমার কাছে থাকবে।

একটা খ্যানখ্যানে মেয়েলি কন্ঠের আওয়াজ বেরিয়ে এল বঙ্কার গলা দিয়ে। বঙ্কা মুখ তুলল। চোখ রক্তের মত লাল।

– কল্যাণী? চেঁচিয়ে উঠল রাজেন।

– হ্যাঁ আমি। বঙ্কা যাবে না। তোমরা চলে যাও। এ বাড়ি আমি বেচতে দেব না। এ বাড়ি আমার সাজানো।

– না বেচব না। তুই বঙ্কাকে ছাড়। ওর ক্ষতি করিস না।

চেঁচাল সুধীর।

খানিকক্ষণ পরে পড়ে গেল বঙ্কা। রাজেন গিয়ে ওকে জাপ্টে ধরল।

ততক্ষণে সকলে ব্যাপারটা বুঝতে গেছে। নয়ানজুলির জলে ডুবে কল্যাণীর আত্মা শান্তি পায়নি। ফিরে এসেছে নিজের পুরনো আস্তানায়। খেলতে যাওয়ার পথে বঙ্কাকে কব্জা করেছে। শিশু মন ভোলানো সহজ।

কোনও মতে বঙ্কাকে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল তিনজনে। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে হতবাক হয়ে গেল। বাড়িতে এসে দেখল রান্নাঘরে আসন পাতা। থালায় খাবার সাজানো।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কমলা দেবী, ননার মা।

রাজেনকে বললেন – ওগো! বরেণদাকে একটু হাত পা ধোবার জল দাও।

কিন্তু এ গলা তো ননার মায়ের নয়। এতো কল্যাণীর গলা।

বঙ্কা গিয়ে ননার মাকে জাপ্টে ধরে বলল – “বাবা! মা ফিরে এসেছে।  আমার মা ফিরে এসেছে!”

সন্ধ্যাবেলায় এলোচুলে জল আনতে যাওয়া ঠিক হয়নি কমলাদেবীর।

~ সমাপ্ত ~

লেখক ~ দেবপ্রিয় মুখার্জি