আনাড়ি টকিজ : পর্ব ৪ : সাউন্ড ডিজাইনিং

বাংলা

আলো কোন বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে আমরা সেই বস্তুকে দেখতে পাই। এই দেখতে পাওয়ার সাথে মিশে থাকে সেই বস্তুটির গায়ের রঙের বোধ। রঙের তিনটে প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হল যথাক্রমে-

১. এর চরিত্র, যেমন লাল, হলুদন নীল ইত্যাদি। ইংরাজীতে আমরা একে হিউ(hue) বলি।

২. তীব্রতা, যা এর শক্তি এবং বর্ণবিশিষ্টতাকে বোঝায়। ইংরাজীতে আমরা একে বলি ব্রাইটনেস। অর্থাৎ সাদা বা কালোর সাথে তুলনা করলে কোন রঙ কতটা হালকা বা জোরালো।

৩. মান। আমরা একে বলি স্যাচ্যুরেশন।

এই হিউ,স্যাচ্যুরেশন আর ব্রাইটনেস নিয়েই রঙ এর খেলা। যারা কখনও একবারও ছবি এডিট করার চেষ্টা করেছেন তারা জানবেন যে খুব বেসিক অ্যাপেও এই তিনটি প্রপার্টি থাকে। কোন সিনেমাকে এই তিনটে বৈশিষ্ট্য নিয়ে খেলা করেই একেবারে একট আআলাদা সিনেমা বানিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্যই সাদা কালো সিনেমার যুগে এই সুযোগ ছিল না। কিন্তু টেকনিকালার আসার পরেই পুরো ব্যকরণটা পালতে যায়। হলিউড শুরু করে খুব গাঢ় রঙের ব্যবহার। সেই সময়ে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের ফিল্ম মেকাররা বলা শুরু করেন যে সিনেমার রঙ যত কমিয়ে দেওয়া হবে ততই দর্শক সিনেমার চরিত্র, তাদের ইমোশন, ভাবনা চিন্তার ব্যাপারে বেশি সচেতন হবেন। একে বলা হয় ডিস্যাচ্যুরেশন থিওরি। ঋতুপর্ণ ঘোষ দোসর তৈরি করার সময়ে সেই কারণে সাদা কালোতে ফিরে গেছিলেন। ওঁর মনে হয়েছিল এই সিনেমার মূল সম্বল এর ইমোশন, তার জন্য সাদা কালো রঙের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই লেখার প্রথম কমেন্টে একটা কালার হুইলের ছবি দিলাম, নিশ্চয়ই সবাই এটা আগে দেখেইছেন। এই কালার হুইলে একে ওপরের বিপরীতে থাকা রঙ গুলো নিজেদেরকে কমপ্লিমেন্ট করে। যে কারণে লাল সবুজ বা নীল হলুদ দেখতে এত ভাল লাগে।

আমরা এক একটি রঙকে এক একটি মনের ভাবের সাথে মেলাই। যেমন ধরুন ভালবাসার রঙ লাল, অজস্র সিনেমায় লাল গোলাপের সাথে প্রেমের রেফারেন্স পাবেন। কিন্তু সেই লালই আবার রঙের রঙ, যা ভায়োলেন্স ক্রাইম বা অ্যাকশনের কথা মনে করায়। অথবা ধরুন নীলের সাথে সমুদ্র, আকাশ বা স্নিগ্ধতা,শান্তি জড়িয়ে আছে, কিন্তু সেই একই নীল তোন দিয়ে একটা সিনেমাতে ভালবাসার অভাব অথবা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বোঝানো যায়। এবারে কোন রগের সাথে কেমন ঘটনা বা ইমোশনকে জোড়া হবে তা ভীষণই সাবজেক্টিভ। একেক ডিরেক্টর একেক ভাবে সেটা দেখেন। কোন কোন ডিরেকটর এই কালার হুইলের বিপরীত মুখী রঙগুলিকে ব্যবহার করে সিনেমা তোইরি করেন যেমন ওয়েস অ্যান্ডারসন, আবার কোন ডিরেকটর একটি রঙের হিউ, স্যাচ্যুরেশন,ব্রাইটনেসকে ব্যবহার করে পুরো ছবিটা তৈরি করেন। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

ওয়াচস্কি ব্রাদারদের( এখন যদিও ওদের বলে দি ওয়াচস্কি’স) বানানো ম্যাট্রিক্স সিনেমাটির কথা ভাবুন। ছেলেরা মারপিট আর মেয়েরা কিয়ানু রিভসের চার্মকে বাদ দিয়ে সিনেমার যে কোন একটি দৃশ্যকে মনে করলেই দেখবেন গোটা সিনেমাটা জুড়ে একটা সবুজের আভা আছে। সেটা পোস্ট প্রোডাকশনে গ্রীনের হিউ বাড়িয়ে, অন্য রঙের স্যাচ্যুরেশন কমিয়ে এবং আরো অনেক কালার গ্রেডিং করে বানানো। কেন? কারণ সবুজ রঙটা কম্প্যুটারের কোডিং এর সাথে জড়িত। আর যেহেতু গোটা সিনেমাটাই একটা ম্যাট্রিক্সের মধ্যে দেখানো হচ্ছে তাই এখানে এতটা সবুজের আধিক্য। তা ছাড়া যেহেতু দৈনন্দিন জীবনে আমরা এরকম সবুজের বিভিন্ন শেড দেখতে অভ্যস্ত নই তাই এই কালার থিম টা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীটা আমাদের রোজ দেখা মাছের ঝোলভাতের পৃথিবীর থেকে অনেকটাই আলাদা।

কালার গ্রেডিং এর কথা বলছিই যখন তখন একটা ছোট তথ্য দিয়ে রাখি। কালার কারেকশন এবং কালার গ্রেডিং কিন্তু এক জিনিস নয়। কালার কারেকশনটা শ্যুটিং এর সময়েই করতে হয়, ক্যামেরা রঙকে বিভিন্ন রকমের আলোতে বিভিন্ন ভাবে ক্যাপচার করে, সূর্যের আলোয় একরকম আর টিউবলাইটের আলোয় একরকম। তাই শ্যুটিং এর সময় আলো পালটে গেলে ভিডিওর রঙ পালটে যায়। সেই কারণে প্রতিবার আলো পাল্টালে হোয়াইট ব্যালান্সিং করে নিতে হয়, এই কাজটা পোস্ট প্রোডাকশনে করাটা খুব কঠিন। কালার গ্রেডিং হল পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ ,তবে অনেক সময়ে আলাদা লেন্স ব্যবহার করে অথবা ফিল্টার এর মাধ্যমে শ্যুটিং করেও অন্য রঙের হিউ আনা যায়। এটা একটা ক্রিয়েটিভ ডিসিশন, এটা করা হয় গল্পের স্বার্থে, এর সাথে টেকনিকালি ঠিক বা ভুল সিনেমা বানানোর বিশেষ সম্পর্ক নেই।

©এলজা রয়